নদীর ধারে ইজমালি খেজুর গাছটা কি করে যে সামন্তদের হয়ে গেল তা আজও ইতিহাস। তবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে এই গাছটা সত্যিই ইজমালি হয়ে গেল আমাদের কয়েকজন বন্ধুর কাছে। হেমন্তের শেষ শীতের শুরুতে রাতে কনকনে ঠান্ডায় বাড়ির বারান্দায় শোওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল গাছে চড়ে খেজুর রস চুরি করে খাওয়া। চৌর্যবৃত্তিতে সিদ্ধহস্ত আমাদের ধরা খুবই মুস্কিল ছিল কিন্তু সামন্ত খুড়োর সকালে গাছ থেকে খেজুর রসের হাঁড়ি পাড়ার পর দুমুড়ো গালাগাল আমাদের কাছে গায়ত্রী মন্ত্র ছিল। এমনকি সামন্ত খুড়ো রাসের হাঁড়ি পেড়ে নিয়ে যাওয়ার পরও স্কুল যাওয়ার পথে গাছে উঠে চুঁইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রস হাঁ করে খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। এখনো সেই দিনগুলোর কথা মনে পরলে বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরে।
শীত যত ঘনো হবে। খেজুর রসও তত মিষ্টি হবে। তার স্বাদও যাবে বেড়ে। কুয়াশা-ঢাকা শীতের সকালে টাটকা এক গ্লাস খেজুরের রসের তুলনা হয় না। এই মধুবৃক্ষ থেকে আহৃত রস কাঁচা ও জ্বাল দিয়ে খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ রস দিয়ে তৈরি গুড় ও পাটালিরও তুলনা নেই। শীতের পিঠা-পায়েসের একটি উপাদেয় উপাদান খেজুরের রস। এই রসে তৈরি দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। সাধারণত বছরে ৪ মাস খেজুরগাছ থেকে মিষ্টি রস সংগ্রহ করা হয়, যা দিয়ে গুড় তৈরি হয়। এ রস অত্যন্ত সুস্বাদু ও মানবদেহের উপকারিতার কারণে যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে। এখনও শীতে শহর থেকে অনেক মানুষ ছুটে যান গ্রামে, খেজুর রস খেতে।
বাংলা আশ্বিন মাস থেকে সাধারণত রস সংগ্রহ শুরু হয়। তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়, কারণ এই দুই মাসে শীতের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া যত ঠান্ডা থাকে রসও তত বেশি পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে আর রসও কমতে থাকে।
‘খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন’—ভবা পাগলার এই বিখ্যাত গানের জনপ্রিয়তা স্তিমিত হয়ে গেলেও শীত এলেই খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধা এখনো চলে বাংলার প্রতিটা জেলায়। বিশেষ করে উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলির কিছুটা আর জঙ্গলমহলের শাল-পিয়াল-মহুয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা খেজুর গাছ গুলোতে। রস সংগ্রহ করে প্রস্তুত করা হয় নলেন গুড়। রস খেজুর গাছের, কিন্তু গুড়ের নাম নলেন কেন? এই শব্দের সাথে দ্রাবিড় সাভাতার যোগ থাকার কারণ সুস্পষ্ট। কারণ, দ্রাবিড় অভিধানভুক্ত ‘ণরকু’ শব্দের অর্থ কাটা বা ছেদন করা। জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষজনদের মিতান নাপিতের কাছে নরুন দিয়ে নক কাটানোর প্রচলন খুবই প্রচলিত। খেজুর রস সংগ্রহ করার জন্য শিউলিরা প্রথমে দা দিয়ে খেজুর গাছের কিছুটা চেঁছে দেয়, তারপর নরুন দিয়ে ফুটো করে সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া রস একটা বাঁশের ছিল বা নল লাগিয়ে খেজুর গাছের গায়ে ঝোলানো হাঁড়িতে বা ভাঁড়ে সংগ্রহ করে। নল দিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করা থেকে নলেন নামের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস মেলে। ভোরের রসকে জিরেন এবং বিকালের রসকে ওলা বলে। প্রত্যেক দিন রস সংগ্রহ করার পর প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে আগুনে ফোটাতে হয় নলেন গুড় তৈরী করার জন্য। পৌষ মাসে পুরোদমে রস মেলার পর মাঘ থেকে রস কমতে শুরু করে। কারণ ঠান্ডা কম হওয়ার সাথে সাথে রসের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। তবে খেজুর গাছ কাটার পর প্রথম দিকের রসের যে গুড় হয় তার গুনগত মান ভাল হয়। গাছের সামনে দাঁড়ালে মনোমুগ্ধকর গন্ধও মেলে সেসময়। তাই শীতের প্রাক্কালেই গুড় তৈরির কারিগররা গ্রামে ঘুরে ঘুরে খেজুর গাছের মালিকের কাছ থেকে গাছ ইজারা নিতে শুরু করে দেয়।
বিশেষ স্বাদ ও গন্ধের কারণে বাঁকুড়ায় নলেন-গুড়ের অনেক চাহিদা রয়েছে। শীতের মরসুমে এরকম প্রায় আশি হাজার শিউলি পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরের গ্রামের খেজুর রস থেকে উৎপন্ন নলেন গুড়ের পসরা সাজিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। ইন্দপুর-তালডাংরা ব্লকের সীমান্তে শিবডাঙ্গা-যুগীবাইদ এলাকায় বা মানবাজার থেকে মুকুটমণিপুর পিকনিক করতে যাওয়ার রাস্তায় অনেকের চোখেই নিশ্চয় ধরা পড়েছে খেজুর গাছে টাঙানো হাঁড়ি । বাঁকুড়ার হাউসিবাদ, সারেঙ্গা, রাইপুর, তালডাংরা, কোতুলপুর, জয়পুর সহ একাধিক গ্রামে, জয়পুর, কোতুলপুর, সোনামুখি, মেজ়িয়া ও বড়জোড়া সহ বিভিন্ন ব্লক এলাকার হাজার হাজার মানুষ এই পেশায় যুক্ত। ওরা শিউলি, স্বাদে গন্ধে ভরপুর বিখ্যাত নলেনগুড় তৈরির অখ্যাত জাদুকর। জয়নগরের মোয়ার সুখ্যাতির পেছনেও রয়েছে জঙ্গলমহলের নলেন গুড়ের বিশেষ অবদান৷
আদ্রা-কাশীপুর রাস্তার ধারে লাগারবাঁধ মোড়ে গুড়ের ভিয়েন বসিয়েছেন নদিয়ার দেবগ্রামের আসগর আলি দফাদার। তিনি জানান, এই এলাকার গুড় স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় হলেও বাজার ভাল নয়। একই অভিজ্ঞতা জামাল দফাদার, সমীর দফাদার কিংবা তেহট্টের আমির আলি দফাদরেরও। আমির আলির অভিজ্ঞতা, পৌষ পার্বণ ছাড়া বছরের অন্য সময় পুরুলিয়ার বাজারে নলেন গুড়ের তেমন চাহিদা নেই। সমীর দফাদার জানান, তাঁরা কয়েকজন মিলে প্রতিদিন প্রায় দেড় কুইন্টাল গুড় তৈরি করছেন। কিন্তু পুরুলিয়ায় ভাল বাজার পাচ্ছেন না বলে গাড়িতে গুড় নিয়ে তাঁদের বাঁকুড়া আসানসোলের বাজারে যেতে হচ্ছে। আবার পূর্ব বর্ধমানের উত্তর রাঢ়দেশ তথা কেতুগ্রাম ও গঙ্গাটিকুরি অঞ্চলে নলেন গুড়ের ইতিহাসের জড়িয়ে আছে এক বিচিত্র পরিযায়ী জীবন। যেমন উত্তরের শীতের দেশগুলি থেকে পরিযায়ী পাখিরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উড়ে আসে আর গোটা শীতকাল তারা এখানে কাটিয়ে আবার ফিরে যায় তাদের শীতের দেশে, ঠিক এক রকমভাবে নদিয়ার দেবগ্রাম, কালীগঞ্জ, ধুবুলিয়া, তেহট্ট থেকে গুড় প্রস্তুতকারী বিভিন্ন মানুষ শীত পড়তেই প্রতিবার ঘাঁটি গাড়েন কেতুগ্রাম ও গঙ্গাটিকুরির আশেপাশে বন্দর, গোমাই, শিবলুন, গঙ্গাটিকুরি, বালুটিয়া প্রভৃতি গ্রামগুলিতে। আফসার শেখ, কাদের মোল্লা, গফুর আলি-রা নভেম্বর মাসের মাঝের দিকে বিভিন্ন গ্রামে আসেন আর মার্চের শুরুতে আবার ফিরে যান। নভেম্বর মাসে এসে প্রথমেই খেজুরগাছ সমৃদ্ধ কোনও ডাঙা জায়গাকে তাঁরা বেছে নেন, বিশেষত পুকুরপারের পাশে কোনও ডাঙাকে। তারপর নিদিষ্ট জমির উপর খেজুর গাছের মালিকানা অনুযায়ী, সেই সব খেজুর গাছের মালিকদের কাছ থেকে আফসার, গোফুররা ইজারা নেন এবং ইজারা অনুযায়ী নিদিষ্ট অনুপাতে গুড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
কীভাবে তৈরি হয় খেজুর গুড়? সন্ধ্যার ঠিক আগ দিয়ে গাছে ‘ছে’ দিয়ে ভাঁড় বেঁধে দেওয়া হয় এবং ভোরবেলা গাছ থেকে ভাঁড় নামিয়ে এনে গুড় জ্বাল দেওয়া হয়। কয়েক ঘন্টা ওই রস জ্বাল না দিয়ে ফেলে রাখলে খেজুরের রস গেঁজে যেতে থাকে। তৈরি হয়ে যায় নেশার রস ‘তাড়ি’। দিনের বেলা খেজুর গাছের থেকে যে রস বেরোয়, তাকে বলে ‘ঝারা-রস’। এই রস থেকে তৈরি গুড় আদৌ সুগন্ধি হয় না।
সুগন্ধি-পাতলা নলেন গুড় প্রস্তুতকারীদের মধ্যে ইতিহাসের পাতায় নাম রেখে গেছেন দক্ষিণ বারাসাত জনপদের দক্ষিণ কালিকাপুরের ঐতিহ্য সম্পন্ন শিউলি পরিবারের সন্তান কৃত্তিবাস সরদার। কৃত্তিবাস খেজুর গাছে ‘ছে’ দিয়ে আসার পর রাতে প্রায়ই ঘুমোতেন না। আকাশে মেঘ করলে বা কুয়াশা হলে সেই রাতেই গুড় তৈরি করতেন। গুড়ের গন্ধ অটুট থাকত, কারণ রসের সাথে বৃষ্টির জল বা কুয়াশা মিশে গেলে রসের প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। কৃত্তিবাসের বংশধর অনাথ সরদার এখন এই অঞ্চলের নামকরা শিউলি। খেজুর কাছ প্রত্যেকদিন কাটলে গুড়ের মান বজায় থাকে না। তাই সপ্তাহে তিনদিন মাত্র রস নির্গত করা হয় এবং তিনদিন গাছকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। তিনদিন বিশ্রামের পর প্রথম দিনের রসকে বলে ‘জিরেন গুড়’। এই জিরেন গুড় মোয়া তৈরির জন্য সবচেয়ে ভালো। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে ‘দো-কাট’ আর তৃতীয় দিনের রস হল ‘তে-কাট’।
বিষ্ণুপুরের কাছে কুলুপুকুর গ্রামের গুড়চাচা একটু অন্যরকমের। বিষ্ণুপুর সাবড়াকোন রাস্তায় চাঁদাবিলায় গুড়চাচার গুড়মহল। বেশ কয়েকবছর ধরে শীতের শুরুতেই শীতের সকালে ভাটির আগুনে জাল দিতে দিতে চাচা বলতে থাকে সারাবছরের কত গল্প, কথা। মাঝে মাঝে আসে খরিদ্দার, হয় সওদা। আশেপাশের খুদে খরিদ্দারদের জন্যে অবশ্য গুড় একদম বিনামূল্যে। কিন্তু কেন? গুড়চাচার অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা—‘বাবু পয়সা তো জীবনে আসবে যাবে, ওরা পয়সা কোথায় পাবে? আগে যখন মাটির হাঁড়ি খেজুরগাছে ঝোলানো হতো তখন আমরাও ছোটবেলায় গুলতি ছুঁড়ে অন্যের হাঁড়ি ফাটিয়ে খেজুররস খেয়ে চম্পট দিতাম। এখন তো বাবু যুগ বদলেছে, মাটির হাঁড়ি হয়েছে প্লাস্টিকের, তা বলে এই খুদেগুলোর জীভ শুকনো থাকলে যে উপরওয়ালাও ক্ষমা করবে নি বাবু; তাই ওদের ফেরাতে পারিনা’।
Khub valo laglo
খুব সুন্দর লেখা।
স্যার আপনার লেখা ❝কাজলদিঘী❞ উপন্যাসের অনির সাথে ভোর রাতে মিত্রা,দেবা,অদিতি,মিলি,নিরমাল্য,টিনা,নিপার পেঁপের ডাটা দিয়ে খেজুরের রস খাওয়ার কথা মনে পরে গেলো।