শরীর-মন ভালো রাখতে একসময় হাওয়া বদলের পরামর্শ দিতেন বদ্যিরা। এখন কোভিড সময়ে ডাক্তাররা দিচ্ছেন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নিদান। মানে, সামাজিক পরিসরে যোগাযোগের সময় বেশি কাছে না আসা। গোল বাঁধিয়েছে ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ বাক্যবন্ধটি। তা মোটেই আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া নয়। কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে বুঝতে গিয়েই এই বিভ্রাট। যাকগে যা বলছিলাম, রোগশোকের মোকাবিলা করতে হলে হাওয়া বদল করতে হবে। মানে, মনের গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য কাছেপিঠে বেড়াতে যেতে হবে। আর মনে মনে থাকতে হবে প্রিয়জন তো বটেই, মানুষের কাছাকাছি।
কিন্তু এসব হবে কী করে? কোভিড তো শুধু আমাদের স্বাস্থ্যতে ধ্বস নামায়নি, ধ্বস নামিয়েছে অর্থনীতিতেও। এর মধ্যে আবার বেড়ানো! তা মানেই তো একগাদা খরচ। চেনা ছকে ভাবলে তাই, কিন্তু অন্যভাবে ভাবলে সমস্যাটার সমাধান করে ফেলা যায়। এই পরিস্থিতিতে মোটেই খুব বেশি দূরে বেড়াতে যেতে পারবেন না অনেকেই। তাই বেড়ানোর জায়গাটা খুঁজতে হবে কাছেই কিন্তু তা মোটেই কোন চেনা জায়গা নয়। এমন জায়গা যেখানে গিয়ে আপনি নতুন করে কোন একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবেন না।
হাতের কাছেই আছে এমন সব চেনা জায়গা। আপনি সেখানে শুনবেন, নিজের জীবনের শিকড় ছোঁয়া গান, দেখবেন অবাক করা নাচ, হাত ছোঁয়াবেন চোখ জোরানো হস্তশিল্পের ওপর। হ্যাঁ, এমন সব জায়গা আছে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেই। যার কোনটার কথা আপনি শুনেছেন অথচ যাননি। আবার কোনটায় আপনার যাওয়ার কথা মনেও হয়নি। ঘরের কাছে এই আশ্চর্য ভ্রমণের হদিশ দিচ্ছে পর্যটন মন্ত্রকের ‘দেখো আপনা দেশ’ মানচিত্র। বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে এক পরিচিত ব্র্যান্ড ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র মাধ্যমে রূপ পাচ্ছে এই উদ্যোগ।
এই নতুন পর্যটনের ক্ষেত্রটি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রস্তুত ছিল। এবার তা একটা চমৎকার প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত হল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ছৌ, পট, মুখোশ, ডোকরা, কাঠের পুতুল ইত্যাদি শিল্পীদের গ্রামগুলিতে তৈরি হয়েছে রুরাল ক্র্যাফট অ্যান্ড কালচারাল হাব। এই গ্রামগুলিতে তৈরি হয়েছে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প ও সংস্কৃতির মিউজিয়াম। এখানে থাকার জায়গাও আছে।
গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই যারা জিজ্ঞেস করেন, যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু থাকবো কোথায়? সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, বাংলার লোকশিল্পীদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলা বাংলা নাটক ডটকম এর কর্ণধার অমিতাভ ভট্টাচার্য। তিনি জানিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব ৩১টি থাকার জায়গায় ৫০০-র ওপর রুম আছে। সেগুলিতে নিয়মিত মানুষজন থাকেন। বেসরকারি হোটেল, ইকো ট্যুরিজম, হোম স্টে মিলিয়ে আরও ১৫হাজারের মত রুম। তাই বাংলার লোকশিল্প ও সংস্কৃতি এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে গ্রামে গেলে আপনি মোটেই জলে পড়ে যাবেননা। আসলে ভ্রমণ সম্পর্কে আমাদের চেনা দৃষ্টিভঙ্গিটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা”।
কোভিড পরবর্তী সময় অনেক খারাপের মধ্যেও বাংলার পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কাছেপিঠে বেড়াতে যাওয়ার তাগিদে বাড়ির কাছে ‘অবহেলিত’ জায়গাগুলির দিকে মুখ ফেরাচ্ছেন মানুষ। আবার ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র চমৎকার ব্র্যান্ডিং এবং পরিকল্পনায় বাংলার লোকশিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী গ্রামগুলির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন দেশের পর্যটকরা। মনে রাখতে হবে, এই সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলেই এগিয়েছে গোয়া, রাজস্থান, কেরালা, তামিলনাডুর মত রাজ্যগুলির পর্যটন।
কোভিড আর মৃত্যুর খবরে ক্লান্ত মানুষ ঘরের কাছে পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে একটু হাঁফ ছাড়তে চাইছেন। এতে এগোবে পর্যটন, এগোনোর রসদ পাবেন অবহেলিত লোকশিল্পীরা। ভ্রমণে এটাই নতুন স্বাভাবিকতা। আতঙ্কিত মনের ব্যাটারিটা রিচার্জ করে নেওয়ার নিউ নর্মাল ট্যুরিজম কিন্তু বাংলায় ভ্রমণের চেনা ছবিটা বদলে দিতে পারে।