২২০ নং কিস্তি
পেয়ারা ডাল ভেঙে চিবতে চিবতে যখন নদীর ধারে গেলাম, দেখলাম সিং-এর ঘরের নৌকাটা ঘাটে বাঁধা। হুড়মুড় করে সব স্মৃতিগুলো আমার চোখের সামনে এসে হাজির।
আমি ভানু এই নদীতে সিং-এর ঘরের নৌক নিয়ে কতো দাপাদাপি করেছি।
ফিরে এসে নিত্য দিন কাকার কাছে মার খেয়েছি। তবু নেশা।
ওই যে তোকে বললাম মগজে খোদাই করা স্মৃতিগুলো এখনো পলি পরে নি।
ওরা দুজনে মুচকি মুচকি হেসে আমার বুকে ঠোঁট ছোঁয়াল।
বৌদি। সুরো নীচ থেকে চেঁচাল।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
তোকে দুজনে মিলে একটু একা পাব তার জো নেই।
আগে তুমি বারান্দায় যাও, না হলে এখুনি সুরো ওপরে উঠে আসবে। তনু বললো।
তনুদি। সুরো আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
কি হয়েছে ?
মিত্রা বলতে বলতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
তনু ওদের ব্যাগ থেকে আমার একটা পাজামা পাঞ্জাবী বার করলো।
মুচকি মুচকি হাসছে।
বল। বারান্দা থেকে মিত্রার গলা শুনতে পেলাম।
রাঘবন স্যার অনিদাকে ডাকছে। এখুনি চলে যাবে।
হঠাৎ!
জানি না।
আবার কি হলো ?
সুকান্ত এসেছে। দুপুরের ফ্লাইট। বিকেলের মধ্যে দিল্লী পৌঁছতে হবে।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কিগো আবার কোন গন্ডগোল ?
না।
তাহলে!
ফাইলে সই হয়েছে। দায়িত্ব নিতে হবে। এখানে বসে থাকলে চলবে।
মিত্রা ঘরে ঢুকলো।
কিরে রাঘবন চলে যাবে বলছে!
তনু মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
তোকে বলেছে।
তনু মাথা দোলাল। ছুঁয়েছে।
ওকে নিয়ে বড্ড ভয়। এখুনি ঠিক আছে, এখুনি বিগরে গেল।
আমি খাটে বসে পাজামাটা গলাতে শুরু করলাম।
প্লিজ তুই আর জালাস না। মিত্রা ছুটে এলো।
আবার কি হলো!
মিত্রা, তনুর দিকে তাকাল।
তোকেও বলি তনু। হাতের কাছে সব গুছিয়ে দিতে পারিস না।
কি বলবে তো ?
তখন জল থেকে ওঠার সময় দৃশ্যটা দেখেছিলি। লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
সরি সরি বিশ্বাস করো একবারে খেয়াল করি নি।
ওর তো কিছু না পরলেই ভালো। চস্বর কোথাকার। মিত্রা দাঁতে দাঁত চিপলো।
কোথায় রেখেছো।
হোলডোলটায় দেখ।
আমারটায় নেই।
তাহলে আমারটার নিচের দিকে আছে। দেখিস আবার তোরটা দিয়ে দিস না। ওর তো কোন বাদ বিচার নেই।
তনু শরীরে ঢেউ তুলে হাসতে হাসতে খাটে শুয়ে পরলো।
তুই আর হাসিস না। ওই টুকু নিজেদের আছে সেটাও হয়তো কাউকে দান করে দেবে।
ধ্যুস।
তনু উঠে বসে একটা ড্রয়ার আর গেঞ্জি বার করে দিল।
গেঞ্জি পরে কি করবো ?
গা কুট কুট করবে ? মিত্রা খিঁচিয়ে উঠলো।
আমি হাসছি।
তোর মান সম্মান না থাকতে পারে, আমাদের আছে।
ধুয়ে জল খা।
খাচ্ছি তো।
আমি টাওয়েলটা তনুর হাতে দিয়ে পাজামায় গিঁট মারলাম। গেঞ্জিটা গায়ে চড়ালাম।
এতো ঝকঝকে জামা কাপর সব সময় পড়তে ভাল লাগে।
গামছা পরে থাক।
জানিস তো গ্রামের ঘরে একটা প্রবাদ আছে।
কি।
যস্মিন দেশে যদাচার, কাঁচা খুলিয়া নদী পার হও।
তনু আবার হাসতে হাসতে খাটে বসে পরলো। মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।
তোর ওপর প্রবাদটা প্রয়োগ করেছিল? মিত্রা তনুর দিকে তাকাল।
তনু হাসতে হাসতে মাথা দোলাচ্ছে।
এখুনি তুমি সম্মানের কথা বলছিলে না।
মিত্রা তনুর দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে হ্যাঁ বললো।
সত্যি ওর সঙ্গে বেরলে সম্মানটা বাড়ির শিকেয় যত্ন করে রেখে যেতে হবে।
কই এতদিন বলিস নি।
তোমায় কতো বলবো, মনেও থাকে নাকি ছাই।
চল এখন শুনে কাজ নেই। পরে শুনবো, এখুনি আবার সমন এসে হাজির হবে।
ঘরের দরজা ভেজিয়ে তিনজনে নিচে নেমে এলাম।
চারদিক শুনসান যে যার ইচ্ছে মতো ঘুরছে।
আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। চড়চড়ে রোদ উঠেছে।
খামারে দেখলাম কয়েকজন খাঁকি জামা-প্যান্ট পরা পুলিস দাঁড়িয়ে। মাম্পি, মিকি, বাবান তাদের সঙ্গে কিচির মিচির করছে। আরও সব বাচ্চাগুলো রয়েছে।
এ বাড়ির বারান্দায় পা রাখতেই আমাদের দেখে সকলে জোরে হেসে উঠলো।
বেঞ্চে বড়োমারা সারিবদ্ধ ভাবে বসে। অনেক চেয়ারের আমদানি হয়েছে। যে যার চেয়ারে বসে। রাঘবন, বিধানদা, অনিমেষদা, আফতাবভাই পাশা পাশি বসে।
ঠিক অপর্জিটে দাদা, ডাক্তারদাদা। মল্লিকদাকে ধারে কাছে দেখতে পেলাম না।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে রূপায়ণদা, অনুপদা, ইকবালভাই, ইসলামভাই।
আমি কাছে এসে মাসিমনি আর আন্টির মাঝখানে নিজেকে গুঁজে দিলাম।
অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে তখনো হেসে যাচ্ছে।
হাসতে হাসতেই অনিমেষদা বৌদির দিকে তাকাল।
কি সুতপা ছেলের মুখ দেখে কিছু ঠাহর করতে পারছো।
বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
তুই শেষ পর্যন্ত বনিকে আর নাজমা ম্যাডামকেও চুরি বিদ্যেটা শেখালি।
রাঘবনের কথায় আবার হাসির ঢেউ চারিদিকে আছাড় খেয়ে পরলো।
ছোটোমা, দামিনমাসি, নয়নাকে ধারে কাছে দেখতে পাচ্ছি না।
নেপলারাও হয়তো উড়ে উড়ে বেরাচ্ছে।
তবে যাই বলো অনিমেষ জামরুল এবং আঁখ দুটোই বেশ মিষ্টি। ডাক্তারদা বললো।
কেন টিপ্পনি না কাটলে চলছে না। বড়োমা খেঁকিয়ে উঠলো।
দাদা দেখলাম ডাক্তারদার হাতটা ধরে টিপে দিল।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
ভেতর থেকে একটা হুটো পুটির শব্দ ভেসে এলো। মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম নম্রতা, অনিকা, অনিসা সামনে এসে দাঁড়াল। প্রত্যেকের হাতে টুকরো টুকরো আঁখ।
আবার সবাই একবার হেসে উঠলো।
এটা কি হলো মশাই। নম্রতা বলে উঠলো।
আমি তিনজনের দিকে তাকিয়ে হসছি।
আমরা তোমার স্কুল দেখতে গেলাম এই ফাঁকে….।
আমাদের কখন চরাবে। অনিকা বললো।
অনিসা আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।
তুই কিছু বল।
ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে কথাই বলবো না।
আগে বলো আমাদের কখন চরাবে। অনিকা হাত ধরলো।
নদীর ঘাটে নৌক বাঁধা আছে চলে যা।
উঠেছিলাম যেই দুলে উঠেছে নেমে পালিয়ে এসেছি। নম্রতা বললো।
আমি হাসছি।
বীরপুরুষ সব। বড়োমা বলে উঠলো।
একবারে কথা বলবে না। অনিসা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
কেন বলবো নারে।
তোমাকে সকালে কে ডাকতে বলেছিল।
বড়োমা হেসে ফেললো।
তুমি না ডাকলে বাবা মাদের নিয়ে যেত না। আমাদের নিয়ে যেত।
ওরা কোথায়?
আমি মেয়ের দিকে তাকালাম।
নদীর ঘাটে।
কি করছে।
এখনো ট্রাই করছে। বসিরভাই দুবার জলে ধপাস।
কি করে?
সুন্দরদা এমন ভাবে নৌকোয় উঠেছে নৌকো কাত বসিরভাই জলে। শুভ কিছুতেই বাঁশটা দিয়ে নৌকটাকে ম্যানেজ করতে পারল না।
আন্টি, মাসিমনিরা হেসেই চলেছে।
চেষ্টা কর, দেখবি ঠিক হয়ে যাবে। না হলে স্নান করার সময় নৌকোয় চেপে স্নান করবো। কাল যেখানে মাছ ধরেছিলাম, সেখানে এখন এক মানুষ জল।
তুই আবার উঠবি….। বড়োমা বলে উঠলো।
তোমার কি? অনিসা আবার চেঁচিয়ে উঠলো।
ঠিক আছে ঠিক আছে এখন যা, ওই তো বলেছে স্নানের সময় চরিয়ে দেবে। অনিমেষদা বললো।
বুঝতে পারছি অনিমেষদা ওদের বিদায় করতে পারলে বাঁচে।
মনে হলো আমার মোবাইলটা যেন বাজছে। পকেটে হাত দিলাম। না পকেটে নেই। মিত্রা ভেতর থেক ছুটতে ছুটতে সামনে এসে দাঁড়াল বুবুন অনুজবাবু ফোন করেছেন।
ভয়েজটা অন করে ওর হাতে দে। অনিমেষদা বলে উঠলো।
মিত্রা হেসে ফেললো।
হাসিস না।
মুহূর্তের মধ্যে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রূপায়ণদা, অনুপদা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে।
মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে।
হ্যালো।
অনি।
বলছি।
কোথায় তুমি।
নদীর ঘাটে বসে আছি।
একটু কথা বলা যাবে।
বলুন।
অনিমেষদারা কোথায়?
বাড়িতে।
মিঃ রাঘবন বেরিয়ে পড়েছেন।
কোথায়?
কেন, তুমি কিছু শোনো নি!
না।
ওনার দিল্লী যাবার কথা।
এখানকার কাজ শেষ না করে দিল্লী যাবে! আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না?
সত্যি তুমি কিছু জান না?
একচ্যুয়েলি কাল এখানে বেশ জোর কালবৈশাখী হয়েছে। রাস্তাঘাট বেশ কাদা। ওরাও এসেছে বেশ রাত করে। রাস্তায় আটকে পরেছিল। সকাল থেকে আর কারোর সাথে কথা বলা হয়ে ওঠে নি।
একটা খবর কানে এলো। তাই কনফার্মেসনের জন্য তোমাকে ফোন করছি।
আপনি মন্ত্রী একটু চেষ্টা করলে নিজেই সঠিক খবরটা পেয়ে যেতেন।
না ঠিক তা নয়….।
আমাকে আবার….।
তুমি রাগ করছো।
না না রাগ করতে যাব কেন।
শুনলাম উনি প্রাইমিনিস্টারের সচিব হয়েছেন।
তাই নাকি! তাহলে এখুনি একবার গিয়ে কথা বলতে হয়। এতো বড়ো খবরটা আমার কাছে চেপে গেছে।
আমি জানতাম তুমি জান।
সত্যি আমি জানি না। যদি আপনার কথাটা সত্যি হয়, তাহলে আমাদের অনেক সুবিধা। কিছু একস্ট্রা কাজ বাগিয়ে নেওয়া যাবে।
সেই জন্য তোমাকে প্রথম ফোন করছি। আমার কাছে কনফার্ম নিউজ আছে।
আপনার কিছু আছে নাকি। তাহলে কানে তুলে রাখি।
খুব ভাল হয়।
কি আছে বলুন।
যে জমিগুলো পারচেজ হয়ে পরে রয়েছে, ওখানে কিছু একটা করার ইচ্ছে রয়েছে।
এর মধ্যে অনাদি, সাগর ইনভলভ নাকি ?
ওরা তোমার সঙ্গে একটা আন্ডার স্ট্যান্ডিং-এ বসতে চায়।
পার্টিগত ব্যাপার।
আমি সামলাব। কথা দিচ্ছি।
দেখলাম ইকবালভাই, ইসলামভাই, রূপায়ণদা, অনুপদা খামারের দিকে চলে গেল।
আমার খরচ ওরা সামলাতে পারবে না।
ওদের ভাল ফাইনেন্সার আছে। টাকার কোনও অভাব হবে না।
আমার ইনভলভমেন্ট।
তুমি যে ভাবে চাইবে। ওরা রাজি আছে।
তারপর গাছে উঠিয়ে মই কেরে নেবেন।
আমি গ্যারেন্টার।
ঠিক আছে কলকাতায় ফিরি। ওদের একবার বসতে বলুন।
তুমি কবে ফিরছো?
পরিবার নিয়ে এসেছি। দু-চারদিন এখানে থাকার ইচ্ছে আছে।
অনিমেষদারা কি আজ চলে আসবেন?
বললাম না, আমার সঙ্গে কোনও কথা হয় নি। ওরা ওঁদের মতো আছেন, আমি আমার মতো।
আমাকে দু-একজন ভাল আইপিএস জোগাড় করে দাও না।
আমি কোথা থেকে পাব?
সুকান্তকে বললে….।
আপনি তো আচ্ছাই লোক মশাই। সুকান্ত আপনার সরকারের কর্মচারী, আমার থেকে আপনার কথা সে বেশি শুনবে।
ঠিক আছে তুমি ফিরে এসো। সব কথা ফোনে আলোচনা করা যায় না। তোমার সঙ্গে বসে কথা বলবো।
আচ্ছা।
ফোনটা কাটতেই অনিসা হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল।
একটু টেপা টিপি করেই আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাল।
তিনজনেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
অনিমেষদারা এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে।
তোমার নতুন খেলা।
নম্রতার চোখ চকচক করে উঠলো। গলার স্বরে পরিবর্তন। নম্রতার এই গলার স্বর সবার কাছে অপরিচিত ঠেকল।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
বাইরের বারান্দায় একবার আয়।
অনিকার গলার শব্দে ওর দিকে তাকালাম, দেখলাম কান থেকে ফোনটা নামাচ্ছে।
তুমি এটা ভাল করে জান, ওই সম্পত্তিতে আমার মায়ের চোখের অনেক জল রয়েছে।
কেন বৃথা রাগ করছিস।
ওটা আমার চাই। অনিমেষদাদাইরাও আমাকে আটকাতে পারবে না।
দেখলাম ভেতর থেকে শুভ, বসির, সুন্দর, অনন্য, ঘণ্টা, পক্কে সব বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
আবহাওয়া দেখে বুঝে গেল সামথিংস রং।
শুভ অনিকার মুখের দিকে তাকাল।
অনুজ সেন মামাকে ফোন করেছিল।
শুভ হাসলো।
তুই কিছু জানিস।
তার মানে খবরটা যেটা ভাসান হয়েছিল সেটা ক্যাচ করেছে।
অনিমেষদা মাথা দুলিয়ে হাসছে।
শুভ আমার দিকে তাকাল। তোমার অভ্যেসটা এখনো বদলাল না।
আমি শুভর দিকে তাকিয়ে হাসছি।
এই ছাইতে কোন মনি মানিক্য নেই। আমার খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে। তবু তুমি যখন বাজালে আর একবার খোঁজ খবর নেব।
তোমায় জানিয়ে রাখি ওখানে ফার্স্ট প্রেফারেন্স নম্রতাদি দেন আন্টি তারপর…. যাক….
আর একটা কথা, অনাদি আঙ্কেল তোমার বন্ধু। আমার সঙ্গে তার কোনও রিলেসন নেই। তুমি ভালোবেসে তাকে ছারলেও আমি ছেরে দেব না। তোমার জীবনের অনেকটা সময় সে ডাকাতি করেছে। চুরি করলে তাকে পানিসমেন্ট দিতাম না। ডাকাতি করেছে, তাকে শাস্তি পেতে হবে।
শুভ, সুন্দরের দিকে তাকাল।
সুন্দরদা সকাল থেকে নেটে বসেছিলি।
সময় পেলাম কোথায়?
একবার তোর মোবাইলে নেটটা খুলে চেক করে নে। মনে হচ্ছে কিছু আপডেট পাবি।
শুভর মোবাইলটা ঢং ঢং করলো। অনিসার দিকে তাকালাম।
রেকর্ডিংটা শুভর মোবাইলে ট্রান্সফার করে দিলাম।
অনিমেষদারা মুচকি মুচকি হাসছে।
শুভ, নম্রতার দিকে তাকাল।
আঙ্কেলের সঙ্গে কি কথা হলো শুনেছিস।
ওই জায়গাটার ব্যাপারে।
শুভ আমার দিকে তাকাল।
জায়গাটা আমি কিনে নেব। তুমি মিটিং করে ব্যবস্থা করো।
আমি জোরে হেসে উঠলাম।
আফু আঙ্কেল যা ফাইনান্স করবে তার থেকে বেশি ফাইনান্স করবো। নিশ্চই ভালোদাদাইরা সেটা লুফে নেব।
অনিমেষদারা হাসছে। রাঘবন মাথা দোলাচ্ছে।
প্রজেক্ট রেডি আছে। আমি এখুনি রঘুআঙ্কেলের হাতে প্রজেক্ট রিপোর্ট তুলে দিতে পারি।
মাছের তেলে মাছ ভাজবি।
তোমার কাছে শিখেছি।
কি রে ব্যাটা বসির।
শুভ সাচ বাত বোলা। আবু আঙ্কেল সে মেরা পাশ জাদা ফাইনান্স হ্যায়। সাচমুচ আচ্ছা প্রজেক্ট মিল গায়া তো লাগা দুংগা।
আমি নীচু হয়ে দিদির দিকে তাকালাম।
দিদি চোখ নাচিয়ে হাসছে।
হাসির চোটে আফতাবভাই-এরও শরীর দুলছে।
অনিমেষদার দিকে তাকালাম।
তোমার এখন কেন্দ্রে বৃহস্পতি। তোমায় আর ফাইনান্স আনার জন্য চারদিকে ছোটাছুটি করতে হবে না।
অনিমেষদা, বিধনদা দুজনেই হেসে ঢলাঢলি করছে।
তুমি যতই কথার ভাঁজে ট্র্যাক ঘোরাবার চেষ্টা করো। আমি কিছুতেই এই প্রজেক্ট করতে দেব না। শুভ আমার দিকে তাকিয়ে।
অনিকা একটু চা আন।
আগে তুমি শুভর কথার সঠিক উত্তর দাও।
আমি কি পাবো।
তুমি দাদাই, দিদাই, মামীমাদের নিয়ে ঘরে চুপটি করে বসে থাকবে। সারাজীবন অনেক লড়াই করেছ, আর নয়, এবার রিটায়ার লাইফ।
আই সাপোর্ট ইট। হক কথার এক কথা। ডাক্তারদাদা বলে উঠলো।
বসিরমিঞা লাইন বাট্টা ভালই করেছ তাহলে বলো।
একবারে বসির ভাইকে বসিরমিঞা বলবে না। অনিসা খ্যাঁক করে উঠলো।
আমি হাসছি।
বড়োমা বাঁকা চোখে অনিসার দিকে তাকাল। মুচকি মুচকি হাসছে। বসির আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। কিছু বোঝার চেষ্টা।
ছোটোমা, দামিনীমাসি, নয়না চা নিয়ে এসেছে।
মিলি, টিনারা এগিয়ে এসেছ ছোটোমাদের সাহায্য করার জন্য।
আমি আগে হাত বারালাম।
নেশা মাথায় উঠে যাচ্ছে। ছোটোমা ধমকে উঠলো।
সকাল থেকে বেলা দশটা বাজল। এখনো চা পেটে পরলো না।
আঁখ খা।
হুঁ আঁখ, সবাই কোঁচরে ভরেছে যার যার কত্তার জন্য।
মিলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
তনু একটা জামরুল দেবে বলেছিল।
এই একবারে মিথ্যে কথা বলবে না। তোমায় দিয়েছিলাম, তুমি পরে খাবে বলেছিলে।
তোমরা খেলে, আমার খাওয়া হয়ে গেল।
নিতে কে বারন করেছিল।
সবার হাতে হাতে চায়ের কাপ উঠে গেছে।
হাসাহাসি চলছে।
ওরা কিন্তু আমার চোখ থেকে চোখ সরায় নি।
তোরা এখানে সং-এর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন। ছোটোমা অনিসাদের দিকে তাকাল।
দরকার আছে।
অনিসার কথা বলার ধরণটা ছোটোমার ঠিক ভাল শোনাল না। কেমন খটকা লাগলো। একবার আমার মুখের দিকে, একবার অনিসার মুখের দিকে তাকাল।
ছোটোমা চোখে চোখে ইসারা করলো। অনিসা মাথা দোলাল।
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি।
সবাই কম বেশি হাসছে।
ওদের দিকে তাকিয়ে হেসেই বললাম।
তোরা এখন সকলে এ্যাডাল্ট, প্রাপ্তবয়স্ক। প্রত্যেকেই নিজের নিজের জায়গায় যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে কাজ করছিস। এখানে যারা বসে আছে তারা সকলেই তোদের কাজে খুশি। সবার সামনে তোদের সঙ্গে একটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প শেয়ার করছি।
আমার এক বৃদ্ধ বন্ধু বলেছিলো, ছেলে-মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তারা পিতা-মাতার বন্ধু হয়। আমিও তোদের সঙ্গে সেই ভাবে মেশার চেষ্টা করি।
ছোটোমা আমার দিকে তাকাল। চোখে মুখের অভিব্যক্তি বলছে, তোর কি মাথা খারাপ ?
আমি ব্যাপারটার কোন গুরুত্বই দিলাম না।
এখানে যারা বসে আছে সবাই তোদের গুরুজন। সম্মানীয় ব্যক্তি। তবু কেন জানিনা এই মুহূর্তে লোভ সামলাতে পারছি না।
সকলের চোখের ভাষা বদলে গেল। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
সাংবাদিক হিসেবে তখন আমি শিশু।
ভাল কলেজে পড়াশুন করার সুবাদে কিছু বড় বড় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। যেমন আমার মাস্টার মশাই ডক্টর রায়।
আলাদা করে নিশ্চই ওনার পরিচয় তোদের দিতে হবে না।
তোরা নিশ্চই তাঁর বিস্তারিত পরিচয় এরিমধ্যে পেয়েছিস।
নিঃসন্তান স্যারের কাছ আমি পুত্রবৎ সাহায্য পেয়েছি।
মাঝে মাঝে তোদের কারুর মা কারুর মামীমার মুখে হয়তো শুনে থাকবি কলেজের ছাত্ররা আড়ালে আবডালে আমাকে তাঁর পোষ্যপুত্র বলতো।
স্যারের হাত ধরেই সাংবাদিকতার জগতে আমার অনুপ্রবেশ।
স্যার শুভঙ্করবাবুকে আমার মনের ইচ্ছেটা বললেন, শুভঙ্করবাবু দাদাকে।
বড়োমা ডক্টর রায়ের ছাত্রী সেই সূত্র ধরেই দাদার সঙ্গে স্যারের একটা ক্ষীণ পরিচয়ও ছিল। অনেক পরে সেটা জেনেছি।
সুরোকে পড়াতে গেছি স্যারের সূত্র ধরে।
বৌদি আমাদের কলেজের ছাত্রী। স্যারের কাছে পড়েছিলেন। আমার টাকার দরকার। সুরোর একটা ভাল গৃহ-শিক্ষক দরকার।
আমাকে সুরোর গৃহ-শিক্ষক নিযুক্ত করা হল।
কেউ কখনো বুক বাজিয়ে বলতে পারবে না। অনির কারিগর একজন। যে যখন সুযোগ পেয়েছে সেইই ঘষে-মেজে অনিকে চকচকে করে দিয়েছে।
তাই অনির অনেক দায়। অনেক দায়িত্ব। মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত অনি তাদের কোন ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না।
জীবনের শুরুতে আমি স্বাধীন সাংবাদিক।
পিরিচিতির সূত্র ধরে যাওয়ায় সম্পাদকের স্নেহের পাত্র। পড়াশুনর ব্যাকগ্রাউন্ড খারাপ নয়। তাই কেউ ঘেউ ঘেউ করতো না। নিজের কাজটা খুব মন দিয়ে করতাম।
অচিরেই সম্পাদকের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলাম।
অফিসের গন্ডী পেরিয়ে সম্পাদকের বেডরুমে পৌঁছে গেলাম।
জীবনে প্রথম মা বলে দু-জনকে সম্বধন করলাম। যাঁদের আজ তোরা দিদান, দিদুন বলছিস।
কেন মা বলে সম্বধোন করলাম সেটা একটা আলাদা অধ্যায়।
সময় সুযোগ পেলে বলবো।
সম্পাদকের কাছের মানুষ হওয়ায় অনেকের সঙ্গেই আমার খুব হৃদ্যতা-পূর্ণ সম্পর্ক। এঁদের মধ্যে অনেক কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্পীও ছিলেন।
তা আমি একবার একজন বিখ্যাত কবি আর শিল্পীর সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গেছিলাম। তোদের তারই গল্প বলছি। ধরে নে কবি হচ্ছেন কবিদা, শিল্পী হচ্ছেন শিল্পীদা।
সবাই নরেচরে বসলো। অনিসার চোখের ভাষা বদলে গেল।
একদিন অফিসে বসে লিখছিলাম। হঠাৎ ফোন।
অনি তুই কোথায় রে ? কবিদার গলা।
অফিসে।
এখুনি একবার হাওড়া স্টেশনে চলে আয়।
আমার তখন ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। বললাম।
কেন! আপনার কিছু হয়েছে ?
না। আমি শিল্পী আছি। তুই এখুনি চলে আয়।
বুঝলাম কবি মহাশয় কোথাও যাবেন, আমি চ্যালা।
জলটা এনে দে, পেঁয়াজ এনে দে, লঙ্কা এনে দে। শঁসাটা একটু কুঁচিয়ে দে। একটু টক দই আন।
তোদের ইসলামদাদাই-এর একসময় এরকম ফাই-ফর্মাস খাটতাম। তখন তিনি কলকাতার ডন। বিশ-পঞ্চাশ টাকা টিপসও পেতাম। একার সংসার বেশ চলে যেত। পরে অবশ্য ভজু এসে জুটেছিল।
দেখলাম ইসলামভাই মুখ ঘুরিয়ে হাসছে। মেয়েরা আমার মুখের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না। সকলের চোখেই জিজ্ঞাসা।
কবি মহাশয়কে বললাম। আমার পকেটে একটিও পয়সা নেই।
আমারও নেই, তাতে কি হয়েছে।
একবার চারদিকে চোখ মেলে দেখলাম, গল্প শোনার ভিড়টা খুব খারাপ হয় নি।
সবাই উজাড় করে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে তনুর দিকে এগিয়ে দিলাম।
রাঘবন আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
আমি তখন সবে মাত্র গ্র্যাজুয়েসন কমপ্লিট করেছি। পয়সা দিতে না পারার জন্য কলেজ হোস্টেল থেকে বিতারিত হয়ে কোন প্রকারে তোদের দামিনীদিদার মহল্লায় একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় পেয়েছি।
কাঁচা মনে হাবিরজাবির অনেক রং।
এদের সান্নিধ্যে এসে জীবনের এক একটা নতুন অধ্যায় আবিষ্কার করছি। মনের ভেতর সব কেমন যেন ওলটপালট। আমার অবস্থা অনেকটা অপুর মতো।
ভয়ও হচ্ছে, লোভও হচ্ছে।
তা হাওড়া গেলাম।
স্টেশনের বড়ো ঘরির তলায় শিল্পীদা, কবিদা দাঁড়িয়ে। আমায় দেখে শিল্পীদা হেসে বললেন, আমি ভাবলাম, তুই আসবি না।
দাদা ডাকলেন।
ওঃ শিল্পী বেশি বকিস না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অনি তুই আয়।
আমি কবিদার পেছন পেছন গেলাম, সামনের একটা সিগারেটের দোকানে গিয়ে বললেন, ভাই একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট দাও তো। ভদ্রলোক কবিদাকে কেমন বাঁকা চোখে দেখলেন, তারপর কি মনে হল, একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট দিলেন।
একটা পেন হবে।
না।
পেন্সিল।
আছে।
দাও।
উনি কট কট করে কবিদার দিকে তাকিয়ে পেন্সিলটা দিলেন। কবিদা খশখশ করে প্যাকেটটা ছিঁড়ে সাদা অংশটায় লিখলেন।
সোমনাথ, অনিকে পাঠালাম, ওর হাতে দুশোটা টাকা দাও, শান্তিনিকেতন যাব। পকেটে একটা পয়সাও নেই। টিকিট কাটব না। তোমার লোকজনকে একটু বলে দিও। কবিদা।
আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বললেন, ছুটে চলে যা দোতলার ওই কোনের ঘরটায়। হাতে সময় বেশি নেই।
আমি মার টেনে ছুট।
সেমনাথদা তখন রেলের খুব উঁচু পোস্টে আছেন। ঘরের সামনে আসতেই সিকুরিটি আটকাল, সব বললাম, ভেতরে ফোন গেল। প্রবেশাধিকার পেলাম। সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম। সোমনাথদা লেখাটা পরে, ঠোঁটের তলা দিয়ে মুচকি হাসলেন।
তুইও দাদার পাল্লায় পরেছিস, লিখিস টিকিস নাকি ?
হ্যাঁ।
তুই একা না আর কেউ আছে।
শিল্পীদা আছেন।
সেমনাথদা বেল বাজালেন, একজন ভেতরে এলেন।
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের তিনটে এসি চেয়ারকারের টিকিট আনুন। দাঁড়ান।
ফিরবি কবে।
জানি না।
সোমনাথদা হাসছে।
শোন কালকের রির্টান টিকট কেটে দিচ্ছি। কিছু পরিবর্তন হলে ওখানকার স্টেশন মাস্টারকে বলবি ঠিক করে দেবে। আমি বলে রাখছি।
আমি মিনিট পাঁচেক বসেছিলাম।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ পর ঘুরে এলো। হাতে টিকিট।
এই নে। মানি পার্টস থেকে একশো টাকার পাঁচটা নোট দিলেন।
জিনিসপত্র কেনা হয়েছে।
না।
যা সময় হয়ে গেছে। দৌড় লাগা।
আবার দৌড়।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে কবিদার সামনে এসে দাঁড়ালাম। টাকাটা দিলাম। টিকিটটা দিলাম। কবিদা হাসলেন। দেখলি, এর নাম পাওয়ার।
আমি মাথা নীচুকরে দাঁড়িয়ে আছি।
মালের ঠেকাটা চিনিস।
চিনি।
যা তিনটে পাঁইট নিয়ে আয়। বাংলা। আর কিছু বলতে হবে।
না। ট্রেন থেকে নেমে কিনলে হতো না।
পাবিনা। পৌঁছতে রাত হবে।
আমি গঙ্গার ধারে চলে এলাম।
দামিনীমাসিদের ওখানে থাকার সুবাদে কলকাতার অনেক অলি গলিতে আমার অনেক পরিচিত মুখ। জিনিস পত্র কিনলাম।
শান্তিনিকেতন যখন পৌঁছলাম তখন আটটা বাজে।
স্টেশনের বাইরে এসে কবিদা রিক্সা ধরলেন।
অনি তুই একা একটা রিক্সায় ওঠ আমি আর শিল্পী একটা রিক্সায়।
কিছু নেবেন না।
ঠিক মনে করেছিস।
আবার পকেট থেকে একশোটাকা বার করে দিলেন। আমি শসা, কলা, পেঁয়াজ, লবু, লঙ্কা, আপেল, আঙুর কিনলাম। খিদে পেয়েছিল। ওই পয়সায় দুটো রুটি কিনে খেলাম।
আমি একটা রিক্সায় জিনিসপত্র নিয়ে, আর শিল্পীদা কবিদা একটা রিক্সায়। পথ প্রদর্শক কবিদা। বেশ কিছুক্ষণ পর আধা শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় চলে এলাম।
একটা মাটির দেওয়াল খড়ের চাল কাঁটা বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ির কাছে এলাম।
চারদিক ঘুট ঘুটে অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। একফালি চাঁদ আকাশে। তাতে সেরকম জোরাল আলো নেই যে চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাবে।
কিরে শিল্পী, দাদা মনে হয় নেই। কবিদা বললো।
কি করে বুঝলি।
দেখছিস চারদিক অন্ধকার।
একবার ডেকে দেখ না।
রিক্সাওয়ালাদের বললো, তোরা বাবা একটু দাঁড়া। যদি দাদা থাকে তোদের বিদায় করবো, না হলে ফিরে যাব।
কবিদা কাঁটা বাঁশের তৈরি গেটটা একটু ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।
চারিদিক নিঝুম অন্ধকার। আকাশের গায়ে যেন চিকেন পক্স হয়েছে এতো তারা। ঝিঁঝিঁ পোকার তারস্বর ডাক কানের পর্দা ফাটিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। জনমানব শূন্য। দূরে কয়েকটা ঘর দেখা যাচ্ছে। সেখানে লম্ফের ক্ষীণ আলোর রেখা টিম টিম করে দেখতে পাচ্ছি।
কিঙ্করদা ও কিঙ্করদা আছো নাকি।
কেউ যেন আমার শরীরে চাবুকের বারি মারল। কিঙ্করদা! মানে রামকিঙ্কর বেইজ!
ভেতর থেকে শব্দ ভেসে এলো।
কে-রে, কে এলি। ফ্যাঁস ফেঁসে গলার আওয়াজ।
আমি কবি।
কবি ?
হ্যাঁ কিঙ্করদা।
দাঁড়া দাঁড়া যাচ্ছি।
চারিদিক অন্ধকার কেন ?
আর বলিস না। মেয়াটা আজ আসে নি। কে আলো জালবে।
দরজা খুললো। কিঙ্করদা!
রামকিঙ্কর বেইজ বেরিয়ে এলেন। মাটির নিকনো উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।
একফালি চাঁদের আলোয় তাঁর উজ্জ্বল মুখশ্রী। আমরা যেন তার কতো আপনজন।
ওরে বাবা তোর সঙ্গে আরও কে কে এসেছে মনে হয়।
হ্যাঁ শিল্পী আছে। আর একে তুমি চিনবে না। আগে দেখো নি।
ওটা আবার কে রে।
অনি।
সেটা আবার কে ?
একটু আধটু লেখা লিখি করে।
পদ্য লেখে না গদ্য লেখে।
ছাই পাঁশ কি লেখে ওইই জানে।
বড়ো খারাপ রোগ। খেতে পাবে না। আয় আয় ভেতরে আয়।
আমরা ভেতরে এলাম। কিঙ্করদা নিজে হাতে ওই অন্ধকার হাতরে একটা হারিকেন আনলেন।
তুমি ছাড় অনিকে দাও ও ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।
না না এটুকু পারবো। কিঙ্করদা নিজেই হারিকেনটা জাললেন।
আমরা একটা মাদুর পেতে বসলাম।
আমার কাছে আজ কিছুই নেই।
আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
বেশ করেছিস।
সবার খোঁজ খবর নিলেন। বুঝলাম কবিদা প্রায়ই কিঙ্করদার কাছে আসেন। শিল্পীদাও আসেন।
অনি যা ওগুলো রেডিকর। কবিদা আমার দিকে তাকাল।
কিঙ্করদা ওকে একটা বঁঠি দাও।
বঁঠি নেই একটা চাকু আছে। বাইরের জানলার ওপর।
যা হ্যারিকেনটা নিয়ে গিয়ে খুঁজে নে। কবিদা বললো।
আমি উঠে গেলাম। চারিদিকে গাদা হয়ে পরে আছে ঝুরি ঝুরি স্কাল্পচার।
কোনোটা ভাঙাচোড়া কোনটা গোটা।
বারান্দায় একটা নগ্ন সাঁওতাল মেয়ের মূর্তি দেখতে পেলাম। অসমাপ্ত। কাঁচা মাটির প্রলেপের দাগ তখনো সেই নগ্ন মূর্তির সারাটা শরীরে।
তারাহুড়ো করে আমার কাজ সারলাম। সব গুছিয়ে নিয়ে এলাম।
দেখেছো কিঙ্করদা, কেমন করিতকর্মা ছেলে। কবিদা বললেন।
কিঙ্করদা হো হো করে হেসে ফেললেন। বুঝলি কবি একটু মাংস হলে ভাল হতো।
কোথায় পাওয়া যায় ওকে বলে দাও, ও ঠিক জোগাড় করে নিয়ে আসবে।
কিঙ্করদা আমার দিকে তাকালেন। একেবারে শিশুসুলভ চাহুনি।
মনে মনে বললাম পৃথিবীর যে প্রান্তেই পাওয়া যাক, আমি ঠিক খুঁজে নিয়ে আসব।
এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁকে স্পর্শ করা যায় না, আর আমি কিনা তাঁর সামনে বসে আছি, উনি একটু মাংস খেতে চাইছেন আমি আনতে পারবো না ?
তুই এই পাশের লাল মোরাম রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যা সামনে শবর পাড়া পরবে। দেখবি ওরা মাংস পোড়াচ্ছে। দুটো পয়সা দিয়ে নিয়ে আয়। আমার কাছে যে সাঁওতাল মেয়েটা থাকে, ও থাকলে তোকে কষ্ট দিতুম না।
আমি বেরিয়ে এলাম। ওই নিঝুম অন্ধকার হাতড়ে শবর পাড়া থেকে খুঁজে খুঁজে শালপাতার ঠোঙায় করে পোরা মাংস নিয়ে এলাম।
আমাকে দেখে কিঙ্করদার মুখে শিশু সুলভ হাঁসি।
দে দে কবি ওকে একটু দে।
ও এসব ধেনো খায়না।
সেকিরে! ধেনো না খেলে ওর হাত থেকে লেখা বেরবে না। যা তো বাবা ওখান থেকে রং-এর আর একটা ভাঁড় নিয়ে আয়।
তাকিয়ে দেখলাম তিনজনে কিঙ্করদার ছবি আঁকার রং-এর ভাঁড়ে বাংলা ঢেলে খাচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে একটা ভাঁড় নিয়ে এলাম। কিঙ্করদা নিজের বোতল থেকে আমাকে একটু ঢেলে দিলেন। চারিদিক গন্ধে ম ম করছে। মাথা ধরে যাবার অবস্থা।
শুরু হলো কবিতা নিয়ে আলোচনা, চললো অনেক রাত পর্যন্ত। শেষ হলো মাটির পুতুল গড়ার কারিকুরিতে এসে। আমার মাথায় কিছু ঢুকলো, কিছু ঢুকলো না, কপালে ধাক্কা খেয়ে মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।
যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো তিনজনের শৈল্পিক স্বত্বার আদান প্রদান হচ্ছে। আমি যেন সঙ্গমে ডুব দিয়েছি। তল খুঁজে পাচ্ছি না। তখন মোবাইলের যুগ নয় যে ক্যামেরা বন্দি করে রাখব। একে একে তিনজনে বেহুঁশ হয়ে ওই ঘরে শুয়ে পরলো।
আমি একা।
অনেকক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে রইলাম।
হ্যারিকেনটা দপ দপ করে নিভে গেল। বুঝলাম তেল নেই। অন্ধকার হাতড়ে লম্ফ জাললাম।
লম্ফের আলো সাপের শরীরে মত লক লক করে কাঁপছে।
কাঁপা কাঁপা আলো ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
এক মায়াবী অন্ধকার আমার শরীর মনকে গ্রাস করলো।
বার বার কানের কাছে তিনজনের কথা ভেসে আসছে।
বাইরের বারান্দায় এসে একটা মাদুর জোগাড় করে শুয়ে পরলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। হঠাৎ মশার কামরে ঘুম ভাঙল। চোখে একটা লম্ফের শিখা এসে পড়েছে। এঁকে বেঁকে থিরি থিরি কাঁপছে। সামনে একজন বসে।
ভয় পেয়ে উঠে বসলাম।
কে ওখানে ? এই গভীর রাতে।
সম্বিত ফিরতে দেখলাম কিঙ্করদা। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সেই নগ্ন সাঁওতাল মেয়েটার অসমাপ্ত শরীরে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন। চোখ স্থির। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য। ধ্যানমগ্ন কোনও মহাপুরুষ।
লম্ফের আলো থিরি থিরি কাঁপছে। আমার চোখের পলক পরে না।
অনেকক্ষণ বসে বসে মাটির প্রলেপ দেওয়া দেখলাম।
কি যত্ন নিয়ে স্নেহের পরশে কিঙ্করদা মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন।
নিটোল বুকে মাটির প্রলেপ দেন আর অবাক হয়ে কিছুক্ষণ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বোঝার চেষ্টা করেন মেয়েটা কতটা লজ্জা পেল।
বুক থেকে পেট ধীরে ধীরে শরীরের নিম্নাংশের অবয়ব নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুললেন।
মনে হলো মেয়েটা কিঙ্করদার হাতের পরশে কেঁপে কেঁপে উঠছে। যেন লজ্জা পাচ্ছে।
মেয়েটার নুয়ে পড়া চোখেমুখে অদ্ভূত এক লজ্জার প্রতিচ্ছবি। ওই ঘুট ঘুটে অন্ধকারে লম্ফের ওই লকলকে শিখায় আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
আমি স্থানুর মত কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। লম্ফের শিখা কাঁপছে। সেই কাঁপা কাঁপা আলোর শিখা ছড়িয়ে পরছে নগ্ন সাঁওতাল মেয়েটার সারাটা অবয়বে। ভাললাগা ভালবাসার রং মেশা মিশি হয়ে একাকার।
আমারও কেমন যেন নেশা ধরলো। ধীরে ধীরে উঠে চলে গেলাম খোয়াইয়ের ধারে।
লালা মাটির রুক্ষতার মধ্যে সৌন্দর্যের এক নতুন সংজ্ঞা আবিষ্কার করলাম।
সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
সূর্য উঠলো। চারদিক রাঙা হয়ে। রাঙা সূর্যের সঙ্গে রাঙা মাটি মিলে মিশে একাকার।
একটু বেলা হতে ফিরে এলাম।
দেখলাম বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী এসে হাজির। কিঙ্করদা বসে কবিদা শিল্পীদার সঙ্গে কথা বলছেন।
আমায় দেখে কবিদা বললেন, কোথায় গেছিলে বাপ।
কি বলবো, মুখ নীচু করে হাসলাম।
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন।
সেই সাঁওতাল মেয়েটাকে দেখলাম। সে আজ এসেছে। কিঙ্করদাদের চা করে দিয়েছে।
আমিও একটু ভাগ পেলাম।
আমি দাওয়ায় বসে ওদের কথা শুনছি।
দেখলাম একটা ছাত্র খুব মন দিয়ে কিঙ্করদা কাল রাতে যে নগ্নমূর্তিটায় মাটির প্রলেপ দিচ্ছিলেন। তার শরীরে হাত বুলচ্ছে।
আমি ওদের কথা শুনছি। মাঝে মাঝে সেই ছাত্রটির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে।
অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা কিঙ্করদার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আর সব মূর্তি দেখছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। খাতা খুলে নোট করছে।
হঠাৎ দেখলাম কিঙ্করদা শুর শুর করে উঠে গিয়ে সেই ছেলেটির গালে সপাটে একটা থাপ্পর কষাল। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, বেরোও এখান থেকে, কতো বড়ো সাহস।
হঠাৎ হাসি খুশি পরিবেশটা কেমন থম থমে হয়েগেল। তাল কেটে গেল।
ছাত্র-ছাত্রীরা মুখ কাঁচু মাচু করে যে যার বিদায় নিল।
আড্ডাটা তারপর আর ঠিক জমলো না।
আমরা কলকাতা ফিরে এলাম।
আবার আমার সেই একঘেয়েমি জীবন।
সেই গণিকা পল্লীর চিলেকোঠার আশ্রয়, টুকটাক লেখালেখি, ইউনিভার্সিটি, বন্ধুবান্ধব।
রাতে একা থাকলেই কিঙ্করদার কথা মন পরে যায়। কিছুতেই কিঙ্করদার ওই অস্বাভাবিক আচরণ, ছাত্রটিকে সপাটে থাপ্পর মারার কারণটা খুঁজে পাই না।
মাস খানেক হয়ে গেল।
সে দিনটা দাদা আমাকে চরকির মতো ঘুরিয়েছিল।
একবার বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম, ভাবলেশহীন মুখ।
ভাগ্যিস ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ক্লাসটা করেছিলাম। আর যেতে পারি নি। শেষবেলায় এক বন্ধুর বাড়ি থেকে খাতা চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
এককথায় ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আমার চিলে কোঠার সুইটে এসে পড়াশুন করতে করতে হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম জানি না। একটা সুন্দর আবেশে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।
চোখ মেলে দেখলাম একটা সুন্দর মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সম্বিত ফিরে পেতে দেখলাম, কবিতা আমার দুই পায়ের মাঝখানে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বসে। আমার পাজামার দড়িটা খোলা। কোমর থেকে অনেকটা নীচে নেমে গেছে।
মাথাটা কেমন বারুদের মত দপ করে জলে উঠলো।
উঠে বসে কবিতার গালে সজোরে একটা থাপ্পর কষালাম।
চেঁচিয়ে উঠলাম, বেরোও এখান থেকে, কতো বড়ো সাহস।
(আবার আগামীকাল)