২১৩ নং কিস্তি
কেন মিলির ভিঁজে কাপর পরে নামবি। আমি বললাম।
তুই আমার মনের কথাটা বলে ফেলেছিস। নীরু চেঁচিয়ে উঠে দূরে ছিটকে গেল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওই বাড়ির পথে পা বারালাম।
তনুরা হাসছে।
তুই ওই বাড়ি যাচ্ছিস? মিত্রা বললো।
হ্যাঁ।
এখনও ব্যাগ খোলা হয়নি।
ঠিক আছে।
বারান্দায় পা রেখেই বুঝলাম গত দশদিনে এই বাড়ির চেহারায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। চারদিক ঝক ঝক করছে। দেওয়ালে নতুন করে গোবরমাটির প্রলেপ পড়েছে। যেন মনে হচ্ছে রং করা হয়েছে। বারান্দার এবরো খেবরো মাটি উঠে যাওয়া অবস্থা আর নেই। সমান করে যেন নিট সিমেন্ট করা হয়েছে। গ্রামের ছেলে হয়েও মাটির যে এত বাহারি রং হয় জানতাম না।
এই মুহূর্তে এই মাটির বাড়ির সঙ্গে মৌসুমীমাসিদের ভালপাহাড়ের মাটির বাড়ির অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছি।
ধীর পায়ে শিঁড়ি ভেঙে আমার ঘরে এলাম। সেকল খুলে ঘরে পা দিতেই অবাক হলাম।
মিটসেফটা জায়গা বদল করেছে। একটা নতুন সোফা এসেছে। আলমাড়িটা খাটের আরও কাছে সরিয়ে দিয়ে ওখানে আর একটা ছোটো সোফা পাতা হয়েছে। যেটা ছিল সেটাতো আছেই।
ঘরের একটা কোনে ছোট্ট সেন্টার টেবিল। দুটো বড়ো বড়ো টেবিল ফ্যান।
মা-বাবার ছবিটা নতুন করে পরিষ্কার করে হয়েছে। ফটোতে ঝুলছে দুটো মোটা মোটা রজনীগন্ধার মালা।
সামনে এসে দাঁড়ালাম। ফটোতে মায়ের চোখে চোখ রেখে মন মনে বললাম। মা মাসীমনি এসেছে তোমাকে দেখতে। তোমার সঙ্গে মাসীমনির কবে শেষ দেখা হয়েছে জানিনা। মাসীমনিকে জিজ্ঞাসাও করিনি।
বুকের ভেতরটা কেমন চিন চিন করে উঠলো।
বেশিক্ষণ আর দাঁড়ালাম না। জামা-প্যান্টটা ছেড়ে আলনা থেকে একটা টাওয়েল নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
খেয়েদেয়ে পুকুর ঘাটে যখন মুখ ধুতে এলাম তখন দেখলাম পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের আস্তরণ। হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা বাতাস বইছে।
ঝড়ের পূর্বাভাস।
ভেতরে তখনও চেঁচামিচি হই হুল্লোড় চলছে। বুঝতে পারলাম একটু পড়েই ঝড় উঠবে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন আনচান করে উঠলো। চারদিকটা দেখে নিলাম। আশেপাশে কেউ নেই। হাওয়ার দোলায় বাঁশগাছের শুকনো পাতা উড়ে এসে পুকুরের জলে পরছে। পায়ে পায়ে বাঁশবাগানের পেছন দিয়ে গাঙ্গুলী বাড়ির পেছনে চলে এলাম।
চারদিক নিস্তব্ধ।
একসময় এই গাঙ্গুলী বাড়ি কত রম-রমা ছিল। মনাকাকা পরেশদাদুকে মামা মামা বলতো। ঠাকুমার কেমন দূর সম্পর্কের ভাই হতো এই পরেশদাদু। এখন ওদের ভিটেতে ঘু ঘু চড়ছে। মাটির বাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবাই এ গ্রাম ছেড়ে চলেগেছে স্টেশন চত্ত্বরে। যে টুকু জমি-জমা আছে ভাটপাড়ার কয়েকজন দেখা শোনা করে।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে চলে এলাম।
নদীর ওপারটায় সামন্তদের ঘর। ওদের পরিবারের অনেকে এখন কলকাতায় বাসা বেঁধেছে। কয়েকজন শরিক এখনও রয়ে গেছে। নদীর কোল ঘেঁষে ওদের যে জমিটা, সেখানে মাদুর কাঠি আর আঁখের চাষ করেছে।
ধীরে ধীরে উজ্জ্বল আকাশটাকে কালোমেঘ গ্রাস করছে।
আসছে কালবৈশাখী। ভাগ্য ভাল থাকলে আজ দু-চারটে শিল জুটতে পারে।
একটা সময় এই ঝড়ে জামাপ্যান্ট খুলে ন্যাংটো হয়ে বৃষ্টিতে ভিঁজেছি। আমবাগানে আম তুলেছি। আবার কাকার হাতে উত্তম মধ্যম মারও জুটেছে কপালে।
বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। মাঝে মাঝে পথের ধুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। হাওয়ার দমকা ঝাপটায় বাঁশগাছগুলো একবার পথের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে চলে এলাম কাঠপুলের কাছে। কয়েকঘণ্টা আগে এই পথ পার হয়ে গেছি।
চারদিক শুনশান।
ভেতর ভেতর কিসের যেন একটা টান অনুভব করছি। পায়ে পায়ে নদীগর্ভে নেমে এলাম। হাওয়ার দোলা নদীর জলের পাতলা শরীরে। নদী পাড় হয়ে এ পারে চলে এলাম। বেরা ঘরের আমগাছটা থিরি থিরি কাঁপছে। আকাশের পাখিগুলো দল বেঁধে উড়তে উড়তে গাছের ডালে এসে বসছে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের সন্ধানে। ওরা বুঝতে পেরেছে এবার একটা প্রলয় শুরু হবে। বাতাসের সাঁই সাঁই, পাখির কিচির মিচির শব্দ সব মিলে মিশে একাকার।
হাওয়ার দোলায় গাছের কচি ডাল দুলছে। পাখির শরীরও দুলছে। দুটো পায়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে গাছের ডাল।
কি জানি কি মনে হতে ফোনটা পকেট থেকে বার করে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ লিখলাম।
মা, আমি সেই আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছি। ঝড় দেখবি? চুপি চুপি নদী পেরিয়ে চলে আয়।
সেন্ট করে নিজেই হেসেফেললাম।
পশ্চিম আকাশের মেঘটা ধীরে ধীরে সূর্যটাকে গ্রাস করে ফেললো। কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের ছটা সার্চ লাইটের মতো অনেকটা অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভূত এক আলো-ছায়ার খেলা। এই প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ সম্পূর্ণ অপরিচিত। প্রলয়রূপী এই প্রকৃতির মধ্যেও রয়েছে এক অদ্ভূত মাদকতা। স্নিগ্ধতা। আমি কেমন যেন নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলছি। কতদিন পর আমি একা এইভাবে।
এলো মেলো হাওয়ায় সব কেমন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।
এখান থেকে শ্মশানটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাতাসের ফোঁসফোসানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পিচ রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলাম চারদিকে লাল ধূলোর আস্তরণ।
ধূপ করে আওয়াজ হতেই পেছন দিকে তাকালাম। কয়েক হাত দূরে দুটো আম মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কিরে অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন। কতদিন পরে এলি। আমরা তোর জন্য….।
নিজের মনে নিজে হেসে ফেললাম।
এই ঝড়ের সময় আমি চিকনা আম কুড়তে এসে কতবার কাকার হাতে মার খেয়েছি। তবু নেশা যায় নি। আকাশে মেঘ দেখলেই দু-জন চোখের নিমিষে হাওয়া হয়ে চলে যেতাম শবর পাড়া কিংবা হারু জানার কালা। কাকীমা তখন পরিত্রাতা। আজ কাকা নেই আমাকে শাসন করার মত কেউ নেই।
এই দিকটা সচরাচর কেউ আসত না। আমরা দু-জন রাজ করে বেরাতাম। ঘণ্টা খানেক কাক চান করে বাড়ির পেছন পাশের পুকুর পাড় ধরে লুকিয়ে বাড়ি। খিড়কি দিয়ে সোজা নিজের ঘরে। তখন উকুনের ভয়ে বছরের এগারমাস নেড়া মাথা। অতএব চুল ভিঁজে থাকার কোনও ভয় নেই। আদল গায়ে গামছাটা কোনও প্রকারে কোমড়ে জড়িয়ে নিতাম। কখনও কখনও তারও সময় থাকতো না। উদম ন্যাংটো। নিজের মনে নিজে হাসছি।
পায়ে পায়ে নদীর কিনারায় ফাঁকা জায়গাটায় এলাম। এখান থেকে সামনের বিস্তীর্ণ মাঠ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
ওপাশটা রামপুরা। এপাশটা আদাশিমলার বিল। ওই কোনটাকে বলে গঙ্গাকোন। ওইখানে আমাদের এই নদী আর কেলেঘাই এক সাথে মিশেছে। দূরে আবঝা হয়ে দেখা যাচ্ছে আমার খোলার চালের হাই স্কুল।
হঠাৎ আকাশের বুক চিড়ে চারদিক আলো করে উঠলো। কড় কড় শব্দে মুহূর্তের মধ্যে মেঘ গর্জন করে উঠলো। সাঁই সাঁই হাওয়ার আওয়াজ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। হাওয়ার গতিবেগে শরীরের বসন রাখা দায়।
কতদিন এরকম বিদ্যুতের চমক দেখিনি, শুনিনি মেঘের গর্জন। কেউ যেন কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে উঠলো। আমি তোমার দুয়ারে উপস্থিত।
এখন তীরবেগে হাওয়া বইছে। সাঁই সাঁই আওয়াজের সুরের মূর্চ্ছনা চারদিকে ম ম করছে। থেকে থেকে ঝাপটা হাওয়ায় মাঠের মাঝখানের গাছগুলো শরীর বেঁকিয়ে মাটির পানে নুয়ে পড়ছে। দু-একটার ডাল যে ভেঙে উড়ে চলে যাচ্ছে না তা নয়। এখান থেকে অত দূর দৃষ্টি যায় না। চারদিক কেমন ঘোলাটে। অন্ধকারাচ্ছন্ন।
হঠাৎ দেখলাম পিচ রাস্তার ওপর আলোর ঝলকানি দুলে দুলে উঠছে। গোটা পাঁচেক গাড়ি একসঙ্গে লম্বা করে লাইন দিয়ে ঢুকছে। নির্ঘাত অনিমেষদারা ঝড় মাথায় করে এলো। এখান থেকে গাড়িগুলোই খালি দেখতে পেলাম।
প্রথম এই ঝড় অনুভব করেছিলাম মৌসুমি মাসির কোলের মধ্যে ঢুকে। তখন কাকার বিয়ে হয়েছিল? ঠিক মনে করতে পারছি না। মা-বাবা তার বছর কয়েক আগে গত হয়েছেন। মাসি কতো গল্প বলেছিল। ভগবান মেঘের আড়াল থেকে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। অসুররা একে একে….।
বাবা তুমি কোথায় ?
তারস্বর চিৎকারে চমক ভাঙলো। মেয়ের গলা না?
মসাই তুমি কোথায়? নম্রতার গলা পেলাম।
হন্তদন্ত হয়ে নদীর কিনারা থেকে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। দেখলাম সবাই এসেছে। বসির, পিকু পর্যন্ত দলে আছে। ওরা এসে আমাকে ঘিরে ধরলো।
তুমি এখানে একা! মেয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ।
তোমার ভয় করছে না?
কিসের ভয়! কেন ভয় করবে!
শুভরা চারদিক দেখছে আর একবার করে আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ঝাপটা হাওয়ায় পাখিগুলো মাঝে মাঝে কিচির মিচির করে উঠছে। ডানাদুটো মেলে ধরে দুলে ওঠা পা দিয়ে কামড়ে ধরে থাকা ডালের তালে তালে দোল খাচ্ছে।
বসির একবার ওপরের দিকে তাকায় একবার চারদিকটায় চোখ বোলায়। মরু ঝড় দেখার অভিজ্ঞতা ওর আছে।
আমগাছটার তলায় কত আম পড়ে আছে দেখেছিস।
মেয়ে হাসলো।
আয় একটা জিনিষ দেখবি আয়।
ওদের সঙ্গে নিয়ে নদীর সেই উঁচু পাড়টায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ নদী মুখ।
আমাদের যেন হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
ওই যে দূরে লাল ধুলো উড়ছে, ওই রাস্তা দিয়ে একটু আগে আমরা এসেছি। একটু ভাল করে লক্ষ কর ক্যালভার্টটা দেখতে পাবি।
ওই যে দূরে টালির ঘরটা দেখা যাচ্ছে ওটা আমার স্কুল, একটু ভাল করে লক্ষ কর তার ঠিক আগে যে ঝাঁকরা গাছটা দেখা যাচ্ছে ওটা অশ্বত্থ গাছ, পীরসাহেবের থান, আর এই যে কাছের জঙ্গলটা দেখছিস ওটা শ্মশান। তোর দাদু-ঠাকুমাকে ওখানে দাহ করা হয়েছিল।
আমি হাত তুলে আঙুলের নিশানায় ওদের দেখাচ্ছি।
শ্মশানের এই দিকটা খ্যাঁড়েগোড়ার বিল। আমাদের গ্রামের ভাগার বলতে পারিস আবার গোচারণ ভূমিও বলতে পারিস। এই দিকটা আদাশিমলার বিল। ওই যে দূরে মাটির বাঁধটা দেখছিস, ওটা রামপুরার বাঁধ। আমাদের গ্রামের শেষ সীমানা। ওই বাঁধে বাঁধে একটু এগোলেই গঙ্গাকোন। আমাদের এই নদী আর কেলেঘাই নদীর মিলন স্থল। আর ওই যে দূরে একটা বাঁশের ওপর একটা পতাকা উড়ছে দেখতে পাচ্ছিস…।
আমি ওদের দিকে তাকালাম। ওরা আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। একরাশ বিষ্ময় ওদের চোখে মুখে। কেউ কোনও কথা বলছে না।
ওটা বীরকটার শিবমন্দির। ওর পোষাকী নাম ছাতারকল।
ঈশান কোনে আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। সারাটা মাঠ আলোয় আলো হয়ে গেল।
ওয়াও। দিদিভাই দেখলি। অনিসা চেঁচিয়ে উঠলো।
প্রচণ্ড শব্দে মেঘ গর্জন করে উঠলো।
ওরা সবাই এগিয়ে এসে কাছ ঘেঁসে দাঁড়াল।
মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। অনিকা, নম্রতা আমার দুটো হাত শক্ত করে ধরেছে।
কিরে ভয় করছে? সুন্দরের দিকে তাকালাম।
সুন্দর কোনও কথা বললো না।
বসির?
বসির আমার দিকে তাকিয়ে। চোখের পলক পরছে না।
ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সঙ্গে মেঘের তর্জন-গর্জন। কুয়াশার মতো বৃষ্টিতে সবাই মাখা মাখি। ঘাসের ওপর শিশির দানার মতো ওদের চোখ মুখ চুল ভিঁজিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ রামপুরার আবঝা বাঁধটার দিকে চোখ চলে গেল। নিবিড় বনের বুক চিড়ে ঝম ঝম করে বৃষ্টি হাঁটি হাঁটি, পা পা করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটা সন সনানি আওয়াজ চারদিকে ম ম করছে।
ওই দেখ। আঙুল তুললাম।
ওরা চোখ মেলে চাইল।
মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে। বাবা কি দারুন দেখতে লাগছে।
সুন্দর আই এ্যাম সকড্। বসির চেঁচিয়ে উঠলো।
আর কেউ কোনও কথা বললো না। পকেটে থেকে যে যার মোবাইল বার করে পটা পট ছবি তুলতে শুরু করেছে। বৃষ্টিটা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
বেশিক্ষণ দাঁড়ান যাবে না, বৃষ্টিতে ভিঁজে যাব। আমি বললাম।
মশাই আমরা বৃষ্টিতে ভিঁজবো। নম্রতা সুর করে বলে উঠলো।
ঠাণ্ডা লেগে যাবে, নতুন জল তোদের অভ্যাস নেই।
লাগুক।
যার যার মোবাইল ঠিক জায়গায় রাখিস নাহলে জল ঢুকে যাবে।
ওরা তখন ওদের মতো গা ভাসিয়ে দিয়েছে।
দিদিভাই আকাশটা দেখ কেমন উড়ে উড়ে যাচ্ছে।
সবাই এক সঙ্গে আকাশের দিকে মুখ তুললো।
বৃষ্টির ছোঁয়া গায়ে লাগতেই যে যার মোবাইল ঢুকিয়ে নিল। নিমেষের মধ্যে আমরা ভিঁজে চান করে গেলাম। সবাই সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। থুতনি বেয়ে জলের ধারা সারাটা শরীরে গড়িয়ে পরছে। এ এক অদ্ভূত অনুভূতি। তাড়িয়ে তাড়িয়ে সকলে উপভোগ করছে।
বসিরভাই তুমি আগে কখনও এইরকম বৃষ্টিতে ভিঁজেছ? শুভ বললো।
না।
সুন্দরদা তুই?
তোর কথার এখন কোনও উত্তর দেব না। আগে ভাল করে ভিঁজে নিই।
হাত পা ছড়িয়ে যে যার ভিঁজছে।
দিদিভাই মায়ের মতো একটু নেচে নে।
অনিসার কথায় সবাই কল কল করে উঠলো।
ঝেঁপে বৃষ্টি আর তার সঙ্গে ফর ফর আওয়াজ হতেই তাকিয়ে দেখলাম, চারিদিকটা হঠাৎ সাদা হয়ে গেল। মেয়েরা প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিল। তারপর ওদের মধ্যে হুটোপুটি পরে গেল বরফ কুরবার জন্য।
নিজেরাই হাসাহাসি কারাকারি মারামারি করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই কাদা মেখে একসা। আমি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ওদের প্রাণোচ্ছলাতা উপভোগ করছি। হঠাৎ ওদের পায়ের দিকে তাকালাম। সকলের খালি পা।
তোরা জুতো পরে আসিস নি!
সময় পেলাম কোথায়। বৃষ্টিতে ভিঁজবো বলে বেরিয়েছিলাম।
মেয়ের দিকে তাকালাম।
তুমি যখন ম্যাসেজ করলে। তখন আমরা তেঁতুলতলায়।
তোমার ম্যাসেজ পেয়েই সুন্দরদা বললো, ওপাশ দিয়ে যাব না, সবাই দেখে ফেলবে। হাটের ওপর দিয়ে চল। জানো বাবা সুন্দরদার সমস্ত রাস্তা মুখস্থ।
ঘুরে ঘুরে চলে এলাম।
কাদায় হাঁটতে পারবি?
দু-চারটে আছাড় খাব এই তো। শুভ বলে উঠলো।
তুই তো খাতা খুলে ফেলেছিস।
হ্যাঁ।
ওরা সবাই জোড়ে হেসে উঠলো।
অঝোড়ে বৃষ্টি পড়ছে।
পিকু পকেট থেকে রুমাল বার করেছে।
তোর রুমালে বৃষ্টি আটকাবে? আমি বললাম।
পিকু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে সবাই হারুজানার কলায় এলাম।
বাবা আম কুরবো না?
যাওয়ার সময়।
এই জায়গাটাকে কি বলে বাবা?
হারুজানার কালা।
সেই বার!
মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
চিকনাদাদের খেঁজুর গাছ কোনটা?
ওই যে। আঙুল তুললাম।
রস চুরি। অনিকা বললো।
মেয়ে শরীর দুলিয়ে হাসছে।
ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে চলছে তুমুল বৃষ্টি।
তোরা একটু দাঁড়া আমি আসছি।
কোথায় যাবে!
দাঁড়া না।
আমি সামনের ঝোপটায় গিয়ে দুটো বেড়া কলমির ডাল ভেঙে আনলাম।
ওরা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
কি করবে!
মাছ ধরবো।
এই ডাল দিয়ে!
হ্যাঁ।
ওরা আমার দিকে তাকিয়ে!
অবাক হচ্ছিস?
ওদের চোখে বিষ্ময়!
কেউ কথা বলবি না। আমার পেছন পেছন চলে আয়।
মেয়ের মোবাইলটা বেজে উঠলো।
বন্ধ করতো। শুভ চেঁচিয়ে উঠলো।
সরি সরি ভুল হয়ে গেছে, রাগ করছিস কেন।
আমি ছোট্ট পুকুরটার ধার দিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছি। পচ পচ শব্দ হচ্ছে।
ধর ধর ধর ধর। সুন্দর চেঁচিয়ে উঠলো।
পেছন ফিরে তাকালাম। পক্কে পা পিছলে পড়েছে। ওরা হাসা হাসি করছে।
আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ পুকুরের পাড়ে। বৃষ্টির আব জলটা কোন দিক দিয়ে গড়িয়ে পুকুরে নামছে সেটা ভাল করে লক্ষ করলাম। একজায়গায় দাঁড়িয়ে পরলাম। সরু হয়ে বেশ তোড়ে জলটা পুকুরে নেমে যাচ্ছে।
আমি উবু হয়ে বসে পরলাম।
কিগো বসে পরলে?
তোরা আম কুরিয়ে আন।
কোথায়?
ওই তো অতো বড়ো আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছিস না।
শুভ দৌড় মারলো। পেছন পেছন সবাই। মেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
তুই গেলি না?
আমি মাছ ধরা দেখবো।
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। উঠতেও পারে নাও উঠতে পারে।
কি রকম?
এই পুকুরটায় প্রচুর পুরনো কই মাগুর সিঙ্গি মাছ আছে। বর্ষার প্রথম জল পেয়ে ওরা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। নতুন জলে ভিঁজতে হবে না।
মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তুমি কি করে বুঝলে?
এই যে বৃষ্টির আবজলটা স্রোতের মত পুকুরে নেমে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছিস…।
হুঁ।
ওরা ভাববে বন্যা হয়েছে নদীর জল পুকুরে ঢুকছে। স্রোতের বিপরীত মুখে সাঁতার কাটতে কাটতে ওরা ওপরে চলে আসবে ভাববে নদীতে যাচ্ছে। পুকুরটা আবদ্ধ জায়গা নদীটা অনেক খোলামেলা। চেনা জগত ছেড়ে অচেনার উদ্দেশ্যে যাত্রা। কেউ বদ্ধ থাকতে চায় না বুঝলি।
কথা বলতে বলতেই দেখলাম একটা কই মাছ স্রোতের বিপরীতে উঠতে গিয়ে পিছলে আবার পুকুরে চলে গেল।
বাবা! মেয়ে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো।
এটা পালের গোদা বুঝলি। জল থেকে উঠে এসে দেখে গেল লাইন ক্লিয়ার আছে কিনা। এবার দল বেঁধে আসবে। তুই একটাও কথা বলবি না। চুপ চাপ দেখে যাবি।
মেয়ে আমার গালে গাল ছুঁইয়েছে।
অনিসা। শুভ চেঁচাল।
আমি একদৃষ্টে স্রোতটার দিকে তাকিয়ে।
বেশ বুঝতে পারছি শুভর সঙ্গে অনিসা ইশারায় কথা বলছে।
বৃষ্টিটা আরও একটু জোড়ে নামলো।
সমানে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার সঙ্গে প্রবল হাওয়া। চারিদিকে শঙ্খ আর উলুধ্বনি বেজে উঠলো। মেয়ে আলতো করে ঠেলা মারলো।
কি!
শঙ্খ বাজছে কেন?
ওই যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর বাজ পড়ছে।
সেই জন্য শঙ্খ বাজাতে হবে!
তোকে পরে বলবো।
দেখলাম একটা কইমাছ সাঁতার কাটতে কাটতে ওপরের দিকে উঠে আসছে।
আমি নড়ে চড়ে বসলাম।
স্রোতের টানে আবার মাছটা পুকুরে চলে গেল।
তুই এখানে চুপটি করে বস আমি একটু নীচের দিকে নামি।
দেখবো কি করে?
ঠিক দেখতে পাবি।
আমি দু-পা নীচে নেমে এলাম।
মিনিট দশেক পর বৃষ্টিটা সামন্য কমতেই জলের স্রোতটা সামান্য কমে এলো। মুহূর্তের মধ্যে কই মাছগুলো স্রোতের মুখে উঠতে শুরু করলো। লোভ সামলাতে পারলাম না। লাঠি ছেড়ে হাতেই ধরে ধরে ওপরে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলাম। মিনিট তিনেক লাইন দিয়ে ওপরে উঠেছিল তারপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আর উঠলো না।
ওপরে উঠে এলাম। মেয়ে জড়িয়ে ধরেছে।
বাবা কুড়িটা।
এ্যাঁ।
হ্যাঁগো পক্কেদা ধরে ধরে এক জায়গায় রেখেছে।
সামনের দিকে তাকালাম। ওরা গোল হয়ে বসেছে। সামান্য জলে মাছগুলো ছটফট করছে।
মামা দারুণ এক্সপিরিয়েন্স। আগে কখনও বলোনি। ঘণ্টা বললো।
এগুলো নিয়ে যাই কি করে বলতো।
পঞ্জাবীটা খুলে ফেলি।
খোল। বাঁধতে পারবি?
খুব পারবো।
হাল্কা করে বাঁধিস। না হলে মরে যাবে।
অনিকা, নম্রতা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তোদের আম কোথায়?
গাছের তলায় রেখে এসেছি।
বেঁধে নে।
খেঁজুর গাছে কুল হয়েছে পেরে দাও। অনিকা আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
রাতে যদি হাঁচি মেরেছিস নাকের মধ্যে নরুন ঢুকিয়ে দেব।
ডেকেছিলে কেন?
তোকে ডেকেছি।
বোনকে ডাকা মানেই সবাইকে ডাকা।
দেখলাম শুভ গেঞ্জিগায়ে এগিয়ে আসছে।
কিরে জামা খুললি।
পক্কেদার একটা পাঞ্জাবীতে ধরেনি। তাই আমার জামাটা খুলে দিয়ে দিলাম।
বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সুন্দরদার গতরটা দেখেছ। ওর মাথয় চাপিয়ে দেব।
আমি হাসছি।
তুমি তাড়াতাড়ি গাছে ওঠো। মেয়ে বললো।
কেন!
দিদি বললো না খেজুর পাড়তে।
এখনও পাকেনি।
আমরা পাকিয়ে নেব।
অনিকা, নম্রতা দুজনেই ঠেলা ঠেলি শুরু করে দিল।
বসিররা হাসছে।
বাধ্য হয়ে চিকনাদের গাছে উঠে একটা কুলের কাঁদি পারলাম।
তখন বৃষ্টিটা খুব সামান্যই পড়ছে। একবারে থেমে যায়নি।
মাছ, আম নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
সত্যি সত্যি শুভ আর ঘণ্টা মাথায় আম চাপিয়েছে।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছি।
সাবধান, পা হরকালে একবারে আলুর দম। আমি বললাম।
তুমি হাসাবে না। অনিকার দিকে তাকালাম।
পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলো দেখছিস।
দেখেছি কাদা।
এই কাদার সঙ্গে কতো পটি আছে জানিস।
এ মাগো। নম্রতা চেঁচিয়ে উঠলো।
অনিকারা হাসছে।
ড্যাড খারাপ হয়ে যাবে।
হ্যাঁরে এটা পটি বন। অনেকে এখানে পটি করতে আসে।
সকলে হাসা হাসি করছে।
কাদা মাখা মাখি করে সবাই খালের ধারে এলাম।
দিদিভাই দেখ। মেয়ে খালের জলের দিকে আঙুল তুলেছে।
আমি তাকালাম। এরিমধ্যে জলটা বেরে গেছে। স্রোত বইতে শুরু করেছে। নদীর ঢাল পশ্চিম থেকে পূবে। ফলে পশ্চিমের জল নীচে নামতে শুরু করেছে।
মেয়েদের দিকে তাকালাম।
বাবা পার হব কি করে?
আমি হাসছি।
বলো না?
সাঁতার কাটবি।
কতটা জল?
এখন এক কোমড় হবে।
তুমি হাত ধরে পার করে দেবে।
কাঠ পুলের ওপর দিয়ে চলে যাস।
পাগল। যদি উল্টে পরি। যা নড় বড়ে।
কেন?
তখন শুভ উঠেছিল। মাঝ পথে গিয়ে যেই কাঠপুল নড়ে উঠেছে। ও বসে পরলো। আমরা সবাই হসে মরি। তারপর শুভ হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে এসেছে। বেশি সাহসী।
শরীরে দোলা তুলে তিনজনেই হাসছে।
শুভরা কাদা প্যাচ প্যাচে রাস্তায় পচর পচর শব্দ তুলে উপস্থিত হলো।
সুন্দরদা এবার খালের জলে স্নান করতে হবে।
পক্কে মাথা থেকে আমের পোঁটলা নামাল।
অনেকটা পরিশ্রম হয়ে গেল। আমি বললাম।
তোমাকে পুচুর পুচুর করতে বলেছি।
আমি হাসছি।
দিদিভাই এবার সাঁতার কেটে পার হতে হবে। ঘণ্টা বললো।
মামা বলেছে কাঠপুলের ওপর দিয়ে যাবে।
তোরা যা আমরা সাঁতার কাটি।
ওরা নিজেদের মধ্যে হাসা হাসি করছে।
সামনের দিকে একটু এগোলে জলটা মনে হয় একটু কম হবে।
নাসরিন এ ক্যা হ্যায়। বসির বললো।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম।
কাঁহা মিলা! অনিকা এগিয়ে গেল।
ও যো দুবলি পাতলি লম্বাই পের হ্যায় না।
কঁয়েতবেল।
কঁতবল।
সুন্দররা হাসছে।
তোমাকে জানতে হবে না। অনিকা বলে উঠলো।
বসির আমার কাছে এসে হাজির।
মামা।
ওকে বুঝিয়ে দিলাম।
পেছন ফিরে দেখলাম অনিকা হাওয়া, বেল গাছের দিকে ছুটেছে।
আমি চেঁচিয়ে বললাম, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তুই একা থাক।
আমরা নদীর গর্ভে নেমে এলাম।
নদীর ধার বরাবর এগোচ্ছি।
কয়েক দিন আগেও এই নদীর বুকে ছোট ছোট খেত করে ধানের চারা তৈরি করা হচ্ছিল। গ্রামের ঘরে বলে ব্যান তলা। কেউ কেউ আবার জলটা ধরে রাখার জন্য দুপাশের মাটি উঁচু করে ছোট ছোট বাঁধ দিত। গ্রামের ঘরে বলে গাঙার দেওয়া। এখন সেগুলো ডুবে গেছে। মাঝে মাঝে মাটির চুড়ো গুলো ভেসে আছে।
আমি সামনে। নম্রতা মেয়ে আমার দু-পাশে।
পক্কেরা নিজেদের মধ্যে ইয়ার্কি ফাজলামো মারছে।
নদীর দু-পাশে কাঁটা বাঁশের ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে শাল, জাম, আম, কাঁঠাল, সপেদা গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির জল গাছের পাতার শরীর বেয়ে টপ টপ করে নীচে পড়ছে। আমাদের মাথাতেও যে পরছে না তা নয়।
আমি বললাম দাঁড়া তোরা কেউ কথা বলিস না। প্রকৃতির গান শোন।
ওরা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। একটা বিশাল গাছের তলায় এসে সবাই দাঁড়ালাম।
এবার শোন।
মেয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কিছুক্ষণ পর মেয়ে বলে উঠলো। বৃষ্টি পড়ার শব্দ।
এখন বৃষ্টি পড়ছে?
না।
তাহলে?
এবার ওপর দিকে তাকা।
ওরা তাকাল।
মেয়ের চোখে মুখে অচেনার আনন্দ।
গাছের পাতায় যে জল আছে, সেই জল এ পাতা থেকে ও পাতায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।
তার শব্দ!
আমি হাসলাম।
তুমি এই বর্ষার সময় এই সব জায়গায় এসে একা একা এই সব শব্দ শুনতে?
আমি মাথা দোলালাম।
নম্রতারা আমার মুখে দিকে তাকিয়ে। মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
বাবা এটা কি গাছ?
ক্ষিরীশ গাছ।
কি হয়?
এই গাছের কাঠ দিয়ে বেশ ভাল চেয়ার টেবিল তৈরি হয়।
কাদের গাছ?
ইজমালি।
সেটা আবার কি!
হেসেফেললাম। বলা ঠিক হয় নি। স্পনটেনিয়াস মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে।
বলো না?
খাস।
কারুর নয়?
হ্যাঁ।
কেন?
নদীর ধারটা কারুর নয়। এটা গ্রামের সম্পত্তি।
ওদের চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছি আমার কথাটা ওদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
গ্রামের হিতার্থে কোনও কাজ হলে সবাই মিলে বসে মত বিনিময় করে গাছ কাটা হয়। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কাজে লাগিয়ে বাকিট বিক্রী করা হয়। তখন যে কেউ পয়সা দিয়ে কাঠ কিনে নেয়। সেই পয়সাটা গ্রামের উন্নতির কাজে লাগে।
কারা ঠিক করে?
গ্রামের মাতব্বরা।
মীরদাদাই, চিকনাদা?
আরও অনেকে আছে।
মামাগো গেলাম।
পেছন থেকে দুরদার শব্দে ঘণ্টা, পক্কে ছুটে এলো।
প্রথমে আমিই ওদের চেঁচানর শব্দে একটু ভড়কে গেছিলাম ভেবেছিলাম সাপটাপ হবে। সামনে এসে হাঁপাচ্ছে।
কি হলো!
ওই দেখো। পক্কে আঙুল তুলেছে জঙ্গলের দিকে।
তাকিয়ে দেখলাম শেয়াল।
আমি হাসছি।
এখানে এ্যালসেশিয়ান কুত্তা কে পুষেছে?
ছাগল, ওটা এ্যালসেশিয়ান না শেয়াল।
এ তো খোদার খাসি গো!
শেয়ালটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাল। তারপর আবার চলে গেল।
ঘণ্টা দাঁড়া, দিদিভাই আসুক।
তুই দাঁড়া। ওকে কে যেতে বলেছিল। লোভী।
পক্কে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা আবার সামনের দিকে এগোচ্ছি।
শুভ এটলিস্ট তুই দাঁড়া।
আমার মাথার বোঝাটা নিবি।
শেয়ার করতে পারি।
তাহলে দাঁড়িয়ে থাক।
আমি, মেয়ে, নম্রতা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছি।
নদীর দিকে তাকালাম। কয়েকদিন আগেও এই জায়গাটায় ব্যান রোয়া হয়েছিল। তার মাটির বাঁধ দেখা যাচ্ছে। ঘোলা জলের বুকে আগাছা মাথা তুলে। চুনো-চিংড়ির বাসা বাঁধার স্বর্গ রাজ্য। তার ওপর নতুন জল। সবাই গা ভাসিয়েছে।
নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেরই কেমন লোভ হলো। আমার যখন সাত-আট বছর বয়স মৌসুমি মাসির পেছন পেছন ছেনিজাল দিয়ে কত গুঁড়ো চিংড়ি ধরেছি। মাসি একবার করে জলে নেমে জালটা তিনপাক ঘুরিয়ে পারে এসে ঝেড়ে চলে যেত, আমি পানার মধ্যে থেকে নাচতে থাকা চিংড়ি, চুনো মাছ একটা একটা করে ঘটিতে রাখতাম। মাসিই ফিরে এসে ছাড়িয়ে-ছুড়িয়ে পরিষ্কার করে দিত। পান্তা দিয়ে চুনো মাছ ভাজা।
সামন্ত ঘরের আঁখ বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। লম্বা লম্বা আঁখগুলো বর্ষার জল পেয়ে বেশ লক লক করছে। তাদের নধর চেহারা থেকে কিছুতেই চোখ সরিয়ে নিতে পারছি না। সবাই যেন উঠেপরে আমার শৈশব, কৈশোরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
অনি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন। এখন মনামাস্টার বেঁচে নেই, তোকে মারধোর করার মতো কেউ নেই। তুই এখন স্বাধীন। নিজের মনে নিজে হাসলাম।
মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে, বুঝলো বাবা মনে মনে কিছু চিন্তা করছে।
মেয়ের দিকে তাকালাম। মাছ ধরবি?
এখানে!
না, নদীতে।
কি করে ধরবে?
শুভ, সুন্দর আমার কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মাথা থেকে আমের বোঝা নামিয়ে নিচে রাখলো।
নম্রতা তোর ওর্নাটা দিবি।
অফকোর্স। মশাই আমরা কিন্তু তোমার সঙ্গে মাছ ধরতে নামবো।
দাঁড়া আমি আগে নেমে দেখে আসি কি হাল।
নম্রতা বুক থেকে ওর্নাটা খসিয়ে ফেলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
আমি ওড়নাটা পরে এলে ভাল হতো। মেয়ে হাসছে।
সবাই এখানে দাঁড়া।
মেয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।
শুভ আমাকে হেল্প করতে পারবি?
আর কাদাকে ভয় নেই। যা কাদা ঘাঁটালে।
আমি ধীরে ধীরে জলে নেমে গেলাম।
না এখানটায় বেশি জল নেই। এক হাঁটুর একটু ওপরে। জলে বেশ চোরা শ্রোত। দুপাশের গাঙারটা একটু কেটে দিলেই জল ঢুকতে আরম্ভ করবে। আবার বেরিয়েও যাবে, জল বেরবার মুখে যদি ওর্ণাটা পেতে দিই নির্ঘাত মাছ পড়বে। আবজল নিচের দিকে নেমে আসছে।
পাড়ের দিকে তাকালাম। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে।
শুভ, নম্রতার ওর্নাটা নিয়ে নেমে আয়।
ড্যাড আমি যাব? সুন্দর বলে উঠলো।
পারবি?
পারবো।
নেমে আয়। এখানটা একটু বেশি কাদা। সাবধানে নামিস।
মশাই আমি যাব। নম্রতা বললো।
এখন না, একটু পরে।
ওরা দুজন টলতে টলতে আমার কাছে এলো। কাদা মাখামাখি করে একসা।
আমি ওর্নাটা নিয়ে একদিক ধরলাম। শুভকে বললাম, দেখ কি ভাবে ধরছি। সুন্দরকে আর একটা দিক ধরিয়ে বললাম, আস্তে আস্তে জলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখ। আমি এই মাটির বাঁধটা কেটে দিই তাহলেই জলটা নামতে শুরু করবে।
এরকম করে রাখলে মাছ পরবে? শুভ বললো।
এই যে স্রোতটা আসছে দেখতে পাচ্ছিস…।
হ্যাঁ।
ওপাশের গাঙারটা কেটে দিলেই জল ঢুকবে আর এপাশ দিয়ে বেরবে।
গাঙারটা কিগো। সুন্দর বললো।
হেসেফেললাম। এই যে মাটির পাতলা বাঁধ দেখছিস এটাকে গাঙার বলে। জল ধরে রেখে ধানের চারা ছড়ান হয়।
এই যে আগাছা দেখতে পাচ্ছিস এখানে প্রচুর ছোট ছোট গুঁড়ো চিংড়ি চুনোমাছ পাবি। ভাগ্য ভাল থাকলে দু-একটা কই মাগুর লেটাও পেয়ে যেতে পারিস।
ওরা হাসছে।
ড্যাড মিরাকেল এক্সপিরিয়েন্স। সুন্দর বললো।
লিখে ফেলিস।
আজই ঝেড়ে দেব।
দাঁড়া আমি ও পাশের গাঙারটাকে কেটে দিয়ে জলটাকে একটু ভাঙলে দিই।
সেটা কি গো? শুভ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
জলটাকে একটু ঘেঁটে দিই।
উঃ আঙ্কেল তুমি যা এক একটা শব্দ ছাড়ছো না। শুভ বললো।
তাহলে ওপাশের মাছগুলো এপাশে চলে আসবে। সুন্দর বললো।
হাসলাম।
একপাশ দিয়ে জলটা ঢুকবে, আর একপাশ দিয়ে জলটা বেরবে। স্রোতে ভাসতে ভাসতে তোদের পাতা ফাঁদে মাছগুলো ঢুকে পরবে।
শুভ-সুন্দর দুজনেই মিটি মিটি হাসছে।
আমি আমার কাজে লেগে পরলাম। শুভ, সুন্দর আমার দেখান মতো জলের মধ্যে ওর্ণা ধরেছে।
মামা শেয়াল দেখলাম।
পাড়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম বসিররা সবাই চলে এসেছে।
মামা আমি যাব। বসির চেঁচাল।
দাঁড়া ব্যাটা, অভ্যাস নেই কিছু কামড়ালে তোর বাপ আমাকে ঠ্যাঙাবে।
কে কার কথা শোনে তর তর করে জলে নেমে এলো।
ঘণ্টা, পক্কে অনিকার ওর্ণাটা নিয়ে একটু তফাতে একি ভাবে জলে ডুবিয়েছে।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এভাবে মাছ পরবে না।
তাহলে!
শুভ এবার ওর্ণাটা তুলে নিয়ে পাড়ে যা। অনেকক্ষণ জল বেরিয়েছে। তোরা দুজনে এবার ওইভাবে পাত।
ওরা ধীরে ধীরে ওর্ণাটা তুলেছে। জল ঝরে যেতেই দেখলাম ওর্ণার পাতলা কাপর নাচানাচি করছে। আমি হাসছি।
ড্যাড প্রচুর বড়ো একটা মাছ পেয়েছি। সুন্দর চেঁচাল।
যা রেখে আয়। ওরা তিনজন মাছ বাছুক।
মাছ কোথায় রাখবো।
তোর জামাটা খুলে দে।
বসিরভাই তোমার পাঞ্জাবী খোল।
নে।
কথা বলার আগেই দেখলাম বসির গা থেকে পাঞ্জাবী খুলে ফেলেছে। পাকা গমের মতো গায়ের রং। গলায় একটা মোটা সোনার চেন। ছোট ছোট ঘাসের মতো কালো চুল সারাটা বুক জুড়ে। পাঞ্জাবীটা অনিকাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েই ইচ্ছে করে জলে পরে গেল।
তোর বাপ দেখলে সিওর স্যুইসাইড করবে।
তুম মেরা সাথ হ্যায় না, ইসলিয়ে কারেঙ্গে নেহি।
হাসাহাসি চলছেই।
(আবার আগামীকাল)