দল এখনও বৃদ্ধতন্ত্র থেকে বেরতে পারেনি সেকথা আরও একবার উঠে এল ডানকুনিতে সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে। বাংলায় সিপিএম যে তরুণ কর্মী বাড়াতে পারেনি, এমনকি দলে তরুণ প্রজন্মের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা যে ভীষণভাবে পিছিয়ে রয়েছেন সেকথা স্পষ্ট করেই বলেন কেন্দ্রীয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত। সিপিএম দলে তরুণ সদস্য সংখ্যা কমেছে হু হু করে, বিষয়টি বেশ কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা গেলেও খাতায় কলমে এই তথ্য প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিল গত কলকাতা জেলা সম্মেলনে। সেখানে স্পষ্টতই বলা ছিল, ৩১ বছরের কম বয়সীরা সিপিএম দলে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে মোটেও আগ্রহী নন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল, সোশাল মিডিয়ায় তো এখনও বহু তরুণ বামেদের পক্ষেই গলা ফাটান। এর উত্তরে ওই প্রতিবেদনই জানায়, গলা ফাটানোটা স্রেফ প্রচারের আলোয় থাকা, আসলে সংগঠনের কাজ করার মতো সিপিএম দলে তরুণদের অভাব প্রকট। উত্তর, দক্ষিন, পূর্ব বা পশ্চিম কলকাতা যে কোনো প্রান্ত তো বটেই এমনকি ২৩টি জেলার অধিকাংশ অঞ্চলগুলিতে লাল ঝান্ডা ধরার মতো পক্ককেশ গুটিকয় নেতার সন্ধান পাওয়া গেলেও তুলনায় শক্তিশালী ঘাঁটিগুলিতেও এখন তরুণদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এতো গেল একেবারে হালের কথা। বছর সাতেক আগেই জানা গিয়েছিল, বঙ্গ সিপিএম ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধ নেতাদের সরিয়ে ২৩টি জেলাতে ৩০০রও বেশি তরুণ নেতা নিয়োগ করেছে। বঙ্গ সিপিএম নেতৃত্ব তখন জানিয়েছিল, বয়স্ক নেতাদের সরিয়ে যুব নেতৃত্ব সামনে আসায় দল মনে করছে, এই যুব নেতৃত্ব এ রাজ্যে পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বহু গুণ বাড়িয়ে দেবে। প্রসঙ্গত, ওই নতুন নেতারা একদল ছিলেন ৫০-এর নীচে আর এক দল ছিলেন ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। ৫০-এর নীচে যারা তাঁদের অধিকাংশই রাজ্যের রাজনীতিতে অপরিচিত অথবা লাইটওয়েট আর যারা ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে, তাঁরা দু-মাস ধরে সাংগঠনিক নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বে এসেছেন। উল্লেখ্য, জ্যোতি বসু ১৯৫৩ সালে যখন দলের সেক্রেটারি হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ৩৯ বছর। সেই সময়ে দলীয় নেতৃত্বের গড় বয়স ছিল ৪০ বছর।
সিপিএম দলে তুলনায় কম বয়সীদের নেতৃত্বে আনার প্রক্রিয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। তখনও বলা হয়েছিল, দলে আগের তুলনায় তরুণ নেতাদের অভাব দেখা দিয়েছে। সেই সময় দলীয় প্রতিবেদন জানায়, বাংলায় মাত্র ১৩.৫ শতাংশ সদস্যের বয়স ৩১ বছরের কম। দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তখন বলেছিলেন “যুবা ছাড়া কারও ভবিষ্যত থাকে না। সিপিএমেরও ভবিষ্যৎ নেই”। তারও প্রায় পাঁচ বছর পর কম বয়সী নেতৃত্বের মুখ বলতে দেখা গেল শতরূপ, ঐশী ঘোষ, প্রমুখ। প্রতিনিধিত্বমূলক বৃদ্ধ সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা রইলেন, স্টপগ্যাপ নেতা মহম্মদ সেলিমও থাকলেন। শোনা গেল, কয়েক জেএনইউ, জেউ বা টেকনোলজি ইউনি পাসআউট ছেলেমেয়েরাই আগামী দিনে বাংলা কাঁপাবেন, জাতীয় স্তরে আলোড়ন ফেলবেন। মনে করা হয়েছিল, তাঁদের হাতেই সিপিএমের ভবিষ্যত। ব্রিগেডেও তরুণ মুখের ঢল নেমেছিল। যদিও ওই সময় সিপিএম পার্টির দুরবস্থা চলচিল। তবু নতুন কিছু মুখের ঢল নামলো। যদিবা সিপিএম নিঃশব্দেই তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তাতে শুকিয়ে যাওয়া প্রাণধারায় সামান্য হলেও জলসিঞ্চন হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা বিপুল নয় বা তাঁদের অনুসরণ করেননি বাংলার বিশাল যুব সমাজ।
লক্ষ্য করা গেল যে সিপিএম একসময় বাংলায় কম্পিউটার ঢুকতে বাধা দিয়েছিল সেই দল সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করলো কারণ, তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতে হবে। সেই লক্ষ্যে ২০২৪-এর লোকসভায় তরুণ ব্রিগেডকে মাঠে নামানো হল। কিন্তু জামানত জব্দ হওয়া ছাড়া ফলাফলে আর কিছুই মেলেনি বা শূন্য থেকে এক হওয়ায় সম্ভব হল না। উপরন্তু সবকটি উপনির্বাচনেও গোহারা হারতে হল।
এবার দেখা যাক সিপিএমে কি হারে কমবয়সি সদস্য বেরেছে। সিপিএম দল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩১ বছরের নীচে প্রার্থী সদস্যপদ দেওয়া হয় ৪৬ জনকে, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা ছিল ১৪০ এবং ২০২২ সালে ৯৩। তাহলে সিপিএমে তরুণ প্রজন্ম উঠে আসার ক্ষেত্রটি স্রেফ মুখের কথা, আর সেই কারণেই কি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সিপিএম নিয়ে একেবারেই অনাগ্রহী? সিপিএমের ২৬তম কলকাতা জেলা সম্মেলনের রাজনৈতিক–সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন জানায়, ৩১ বছরের নীচে সিপিএমের সদস্য সংখ্যা ৪.৬ শতাংশ। সম্প্রতি ডানকুনিতে ২৭তম রাজ্য সম্মেলন শেষে জানা গেল সেই অঙ্ক ৪.৩ শতাংশ হয়েছে। তাহলে কি বৃদ্ধতন্ত্র থেকে সিপিএম এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি?
২৭তম রাজ্য সম্মেলনে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির কো-অর্ডিনেটরের স্বীকারোক্তি, বাংলায় সিপিএমের নেতৃত্বে আন্দোলনে তারুণ্য থাকলেও দলে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। পার্টি সদস্য হিসাবে ৩১ বছরের কম বয়সীদের যে আরও বেশি চাই, এটা তিনি স্পষ্ট করেই বলেন এবং কেরলের উদাহরণ দিয়ে জানান, কেরলে ২২ শতাংশ পার্টি সদস্যের বয়স ৩১-এর কম। বঙ্গ সিপিএম গত রাজ্য সম্মেলনেও একাধিক তরুণ মুখকে সামনে আনা এনেছিল কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হয়েছে? আবার সিপিএম রাজ্যে সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া মহম্মদ সেলিমের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কথা, সময়ের উপযোগী পার্টি গড়ে তুলতে হলে নতুন প্রজন্মের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাঁর কথা থেকে প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যে সিপিএম ক্ষমতা হারানোর ১৪ বছর পরও কি সময়োপযোগী পার্টি গড়ে তুলতে ব্যার্থ?