নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ, ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের উদ্যোগে ৯ই আগস্ট আয়োজিত হল বিংশতিতম পার্টিশন বক্তৃতা। দেশভাগ নিয়ে বিকল্প এক আখ্যান নির্মাণের উদ্দেশ্যে, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরির পক্ষ থেকে বিগত ১০ বছর ধরে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে এই বক্তৃতামালা। ইতিমধ্যেই, বিখ্যাত সাহিত্যিক দেবেশ রায় থেকে শুরু করে বহু প্রথিতযশা সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও গবেষক এই বক্তৃতমালাতে আমন্ত্রিত হয়েছেন। মানববিদ্যা অনুষদের দ্বারা আয়োজিত এইবারে আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী ড. মইনুল হাসান। পার্টিশন বক্তৃতামালা এবং বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি প্রকল্প সম্বন্ধে প্রথমেই আলোকপাত করেন সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ, ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের কো-অর্ডিনেটর এবং প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মননকুমার মন্ডল। নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমজাদ হোসেন এবং বিশিষ্টজনেরা। এছাড়াও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিক্ষিকা এবং উৎসাহী ছাত্র ছাত্রীরা অংশগ্রহন করেছিল এদিনের বক্তৃতায়।
মূল বক্তৃতায়, ড. মইনুল হাসান দেশভাগ নিয়ে প্রায় অনালোচিত একটি দিক সম্বন্ধে আলোকপাত করেন। ‘পার্টিশন পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গ: মুসলমান মন ও সমাজ’ শীর্ষক এই বক্তৃতায় ড. হাসান দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজ এবং তাঁদের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে একটি রূপরেখা দেন। বেঙ্গল পার্টিশন সংক্রান্ত আলোচনায় মুসলমান সমাজের অনুপস্থিতি এবং তাঁর রাজনৈতিক কারণ সম্বন্ধেও তিনি আলোকপাত করেন। পৃথিবীর সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন প্রায় একইরকম—এই কথাটি বক্তব্যের সূচনাতেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। একাত্তরের আগে পর্যন্ত মুসলমান সমাজের সামনে ‘পূর্ব-পাকিস্তান’ নামটি অপর এক ‘স্থান’ হিসেবে চিন্তায় আসর করে নিত। পূর্ব-পাকিস্তান অনুসারী মন নির্মাণের ক্ষেত্রে খণ্ডিত ভারতে মুসলমানদের অবস্থসন দ্বিধান্বিত ছিল। জমি কেনাবেচার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারির মতো রাষ্ট্রিক পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত তাদের সমসুযোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল (পরবর্তী কালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিধানসভায় এই আইনের বিরোধিতা করেন এবং আইনটি বাতিল করেন)। একাত্তরের পর মুসলমান সমাজের সামনে আর কোনো পরিসর থাকল না, পিঠ পুরোপুরি দেওয়ালে ঠেকে গেল। তারা অনুধাবন করল যে আমৃত্যু তাদের এই মাটিতে থেকেই লড়াই করতে হবে। ফলে একাত্তরের পূর্বের বাঙালি মুসলমানের মন ও পরবর্তী বাঙালি মুসলমানের মন ও তার সমাজের মধ্যে একটা বদল ঘটতে থাকে। বর্তমানে মুসলমান সমাজের যে উন্নতি ও অগ্রসরণ তা মূলত গত পঞ্চাশ বছরের ফসল। পার্টিশনের আঘাতে থমকে যাওয়া মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এই সময়পর্বেই সম্ভবপর হয়েছে। পার্টিশনই মুসলমানদের একাত্ম হবার সমস্যা তৈরি করছে। ওপার থেকে আসা হিন্দুদের বিভিন্ন স্থানে ইতিউতি বসে পড়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়েছে। মুর্শিদাবাদ, মালদায় মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির ইতিহাসের দিকে নজর দিতে গিয়ে তিনি বলেন- ধুবুলিয়ার যে সব মানুষ ওপারে চলে যায় তাঁরা ফিরে এসে সে সব সম্পত্তি আর নিজেদের দখলে টানতে পারে না, তাই কোর্টকেস হয় কিন্তু বিশেষ সুরাহা হয় না। এই সমস্ত মানুষ মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলায় ভিড় করে। ওই সময় মালদায় ৬০% এবং মুর্শিদাবাদে ৪৫% মুসলমান বৃদ্ধি পায়। তার এই বক্তৃতাটি বইসর্বস্ব তথ্যবহুল নয় বরং অনেকবেশি জীবনসর্বস্ব ঘটনাবহুল। তার বক্তৃতায় মহাফেজখানার ধুলোবালি অপেক্ষা গ্রাম-গঞ্জের পার্টিশন-আক্রান্ত ধুলোবালি মাখা মানুষেরা অনেক বেশি সজীব ছিল। বক্তব্যে উঠে এসেছে রহমতপুর ও গিরিধারী পাড়ার গল্প। করিমপুরের গ্রাম রহমতপুর। ওপার (পূর্ব-পাকিস্তান)-এ ছিল গিরিধারী পাড়া। গ্রামের নাম অপরিবর্তিত রাখার শর্তে দুটি গ্রামের জনগোষ্ঠীর মধ্যে জায়বদল ঘটে,তাতে নতুন এক গল্পের জন্ম নিল। গ্রামের নাম রহমতপুর হলেও গ্রামে কোনো মুসলমান নেই কেন?
এছাড়া তিনি স্মৃতি থেকে বলেছেন — ’৬৪-র দাঙ্গায় আচমকা তার প্রতিবেশী গ্রামটি হারিয়ে গেল, মুহূর্তে বদলে গেল। তার মা যখন নানার কাছে জিজ্ঞেস করে এই দাঙ্গার সময় কেন আমরা দেশ ছাড়ছি না? তখন তার নানা বলেন, “মা, ওখানে গেলে আমাদের বিদেশী বলবে”। অনেক পরে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে হারিয়ে ফেলা হিন্দু প্রতিবেশীকে ফিরে পাওয়ার যে গল্প তাতে দীর্ঘ ব্যবধানে হারানো প্রতিবেশীর অন্তরে তখনও জাগরুক ছিল তার ছেড়ে আসা ‘দেশ’। অপরিমেয় আগা-পাশ-তলহীন ধারণা হল ‘দেশ’। এ প্রসঙ্গান্তরে তিনি বলেন লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজ তৈরি হয়েছিল মুসলিম মহিলাদের উন্নতির জন্য। একদিনে লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজের প্রশাসন বদলে যায়, হোস্টেল ফাঁকা হয়ে যায়। হোস্টেল সুপার অবিভাবকদেরকে উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেন মেয়েদের আর হোস্টেলে রাখা যাবে না। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পার্টিশন পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মুসলমানের মন সংখ্যালঘুর মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকে যাওয়ার এটাই নিদর্শন। আমরা জানতে পারি নেহেরুর উদ্যোগে সৈয়দ মুজতবা আলীর পাসপোর্টের ফিরে পাওয়ার গল্প। বি টি রণদিভের নির্দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে সাজ্জাদ জহিরের পাকিস্তানে চলে যাওয়া এবং অড়হর ডালের অপ্রতুলতার কারণে জাহিরের ভারতে ফেরার গল্প। পাকিস্তানে থাকলে জহির অনেক বড়ো পদাধিকারীর সুযোগ হয়ত পেতেন কিন্তু হারিয়ে ফেলতেন আজন্ম লালিত ‘দেশ’-এর ধারণা, যা তার যাপনের আঞ্চলিকতার সঙ্গে যুক্ত। তাতে আলো-মাটি-বাতাস যুক্ত হয়ে আছে। অড়হড় ডালের স্বাদ তাই তার ‘দেশ’-কে প্রতিনিধিত্ব করে। দেশ জিনিসটা কী? কাকে বলে দেশ?— এই মূল প্রশ্নটাই পুনরুত্থাপিত হয়েছে তার গল্পগুলোর মাধ্যমে। এমনই টুকরো টুকরো গল্প ছড়িয়ে ছিল তার সমগ্র বক্তৃতায়। বক্তব্যের সমাপ্তিতে বাংলাদেশের নবোদ্ভূত পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি রেখে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘বন্ধু পালটানো যায় কিন্তু প্রতিবেশী পালটানো যায় না।’ এই অপরিহার্য অপরিবর্ত পড়শি সময়ের অন্তর্ধ্যানে ‘ওরা’ ও ‘আমরা’ থেকে ‘ওরাই আমরা’ নামক সকল সমন্বয়ের গান ; দিনের শেষে এটাই তার বক্তব্যের সার কথা। সমগ্র অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপিকা গীতশ্রী সরকার।
প্রসঙ্গত, পার্টিশন বক্তৃতামালা নামক এই উদ্যোগটি নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের, মানববিদ্যা অনুষদের দ্বারা ২০১৬ সালে গৃহীত বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি নামক জনগবষেণা প্রকল্পের অংশ। নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পিত এই জন-গবেষণা প্রকল্পটি বাংলার পার্টিশন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সমকালীন ব্যক্তিক স্মৃতি সংগ্রহ করেছে। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের পক্ষ থেকে প্রায় ৫০০র অধিক মানুষের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রায়, ৭০ জন আগ্রহী গবেষক ও শিক্ষার্থী এই প্রকল্পের যুক্ত। ইতিমধ্যেই, প্রকল্পের পক্ষ থেকে ‘বাংলার পার্টিশন -কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ’ শীর্ষক বইটির দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। তিন খন্ডে পরিকল্পিত এই বইটির দ্বিতীয় খন্ডে স্থান পেয়েছে উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, বর্ধমান,মালদা, নদিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ, ঢাকা এবং নাটোর থেকে সংগৃহিত সাক্ষাৎকারের প্রতিলিপি। আগ্রহী পাঠকরা বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন দে’জ পাবলিশিং থেকে।