পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘ কবর ‘কবিতা। ‘ বাংলা সাহিত্যে কাহিনী নির্ভর কবর’ কবিতার রচনাকাল চলতি ২০২৫ সালে শতবর্ষে পদার্পণ করেছে।
১৯২৫ সালে ‘কবর’ কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে যাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাদের মধ্যে ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিএ ক্লাসের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সাফল্য। ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়।
‘কবর’ কবিতা কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হলে সেটা পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন ‘অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট’ শিরোনামে একটি আলোচনা লিখেছিলেন ফরওয়ার্ড পত্রিকায়।
জসীম উদ্দীন তাঁর আত্মস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন, দীনেশচন্দ্র সেন একদিন এমএ ক্লাসের সাহিত্যের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘জসীম উদ্দীনের মতো কবির শিক্ষক হতে পারা তাঁর জন্যে বড় গৌরবের বিষয়। শেলি, কিটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- বিশ্বসাহিত্যের এই মহারথীদের কবিতার চেয়েও জসীম উদ্দীনের কবিতা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল’.।
কবিতাটি কবির ‘রাখালী’ কাব্যে স্থান পেয়েছিল। এ ধরনের কবিতাকে ড্রামাটিক মনোলগ বা একাকী কথন বলা হয়। যদিও গ্রামের এক বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীম উদ্দীন ‘কবর’ কবিতায় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। কবিতাটি শোক গাথা হলেও বৃদ্ধের জীবেনর ক্ষণিকের হাসি- আনন্দের অনুভূতি উঠে এসেছে বেদনার মাঝে এ ভাবে —
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এক সময় এই বৃদ্ধের যৌবন ছিল আর তার ঘরে এসেছিল ছোট্ট নববধূ, তার ছিল সোনার মত মুখ।
বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে ‘কবর’ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বেদনা বিধুর অনুষঙ্গ ছাড়াও কবিতাটিতে প্রিয়জনদেরকে ভালবাসার স্মৃতি কাতরতা উঠে এসেছে দুঃখ বেদনায়। গ্রামীণ জীবনের দুঃখ-বেদনা এবং স্নেহ-মমতা আর প্রেম ভালবাসার চিত্র অঙ্কন করেছেন কবি এই কবিতায় গভীর মমতায়। পল্লীজীবনের অসাধারণ ছবি তুলে ধরেছেন স্মৃতিময়তায়।
মানব জীবনের হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনার ক্ষণিক বিচ্ছুরণন আলো আঁধারিতে উঠে এসেছে। অপূর্ণ ভালোবাসার হাহাকার কবিতার শব্দগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে। মৃত্যু আর শূণ্যতাকে মনে হয় আত্মার আর্তনাদ বলে।
কবিতাটির প্রথম স্তবকেই আড্মার আর্তনাদ যেন আমরা শুনতে পাই।
”এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
ভালবাসা প্রগাঢ় ভাবে মৃত্যু আর শূন্যতার মিশ্রনে হারিয়ে গেছে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,”
বেদনার নস্টালজিক অনুষঙ্গ কবি জসিম উদদীন অসাধারণ ভাষায় গভীর মন্ময়তায় চিত্রয়িত করেছেন।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ‘কবর’ কবিতাটিতে কাহিনী বর্ণনাকারী এক গ্রামের বৃদ্ধ দাদু। আর শ্রোতা হলো তাঁর নাতি। নাতিকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধ দাদু তাঁর জীবনের সকল প্রিয়জনকে হারানোর আকুতি ক্রমে ক্রমে ব্যক্ত করেছেন। যে পাঁচজন স্বজন হারানোর ব্যথা বৃদ্ধ দাদু এক এক করে বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : বৃদ্ধের স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনী ও মেয়ে। এরা নাতির দাদী, পিতা, মাতা, বোন ও ছোট ফুপু।
পল্লীকবি জসিম উদদীন বাংলা ভাষায় একক বর্ণনায় যে কাহিনী উপস্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়।
বৃদ্ধ কৃষকের বয়ানে এদের হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনার আর জীবনের সুক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে এ কবিতায়। এগুলো কবিতার পঙ্ক্তিমালা থেকে তুলে ধরলে বেদনার অনুভূতিগুলো সর্বকালের পাঠকের কাছে ধরা দেবে।
‘বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।’
সে সময় দাদুর যৌবন কাল —, যৌবনবতী দিদিমার বাপের বাড়ি যাবার সময়ের চিরায়ত অনুরোধ ব্যক্ত হয়েছে। ‘আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।’ কবি কতটা সচেতন এটা অনুধাবন করা যায়।
আমাদের বৃদ্ধ দাদু তার যৌবনবতী বৌয়ের দেখতে যাওয়ার আগে —
শাপনার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সার করি দেড়ী।
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!’
বাঙালির স্বামী-স্ত্রীর চিরন্তন প্রেমপ্রীতি-ভালবাসার শাশ্বত ছবি ফুটে উঠেছে উপরের লাইনগুলোতে।
এই কবিতার প্রথম অংশে কবির মুখ থেকে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার অনুরনন উপলব্ধি করি এই কয়টি লাইন থেকে, যা বৃদ্ধ দাদু নাতির হাসি থামানোর জন্য বলছে, —
‘হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!’
কবি জসিম উদ্দীন বৃদ্ধ কৃষকের যৌবনবতী বউয়ের সে সময়ের অভিব্যক্তি উঠে এসেছে এ কথায় —
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।’
প্রেম ভালবাসার অসাধারণ অনুরনন আমরা লক্ষ করি উপরের লাইন থেকে। এর মাঝেই ‘কবর’ কবিতার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। বেদনার মাঝেও ভরা যৌবনের নস্টালজিক অনুষঙ্গ যা, আনন্দের উদ্ভাসে সমুজ্জল।
আত্মজনের একটার পর একটা মৃত্যু বৃদ্ধ দাদুর হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে তুলেছে। নাতির মায়ের মৃত্যু দাদুর হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। নাতির মা বা বৃদ্ধের মেয়ে মারা যাবার আগে তার ছেলেকে ডেকে বলল,’
‘বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
আমরা বৃদ্ধ দাদুর আত্মজনের বিয়োগ ব্যথার অশ্রু বির্সজনে বর্ণনা বাড়াতে না চেয়ে কবিতার শেষ স্তবকে তিনি নাতিকে কি বলেছেন আমরা দেখবো।
‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।’
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত ‘কবর’ কবিতাটিতে বিষাদকরুণ ছন্দোময়তার অনুরণন পাঠককে বিষদগ্রস্ত করে।
তিরিশের দশকে যখন ইউরোপীয় আধুনিক কাব্যের আদলে বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয় সে সময়ই জসীম উদ্দীন রচনা করেছিলেন ‘কবর’।
জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। এটি ছিল তাঁর নানার বাড়ি। নিজের বাড়ি ছিল গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবা আনসার উদ্দীন মোল্লা এবং মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। পাঁচ সন্তানের মধ্যে জসীম উদ্দীন ছিলেন চতুর্থ। তাঁদের পরিবারকে কৃষিজীবীই বলা যেতে পারে। যদিও তাঁর পিতা ছিলেন ফরিদপুর হিতৈষী এমই স্কুলের শিক্ষক। কবি যে ঘরে থাকতেন সে বাড়ির সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর ‘কবর’ কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। জসীম উদ্দীনের কবি প্রতিভা বিকশিত হয় শৈশবেই।
কবি ছিলেন লোকসংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী। তাঁর কবিতা ও গানে এই অনুরাগের ছোঁয়া আছে স্পষ্টই। একসময়ে তাঁর গুরু ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের কল্যাণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গীতিকা-সংগ্রাহকের দায়িত্ব পান।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী।
এক শত বছর আগে লেখা পল্লীকবি জসিম উদদীনের ‘কবর’ কবিতা আজকের দিনেও সমান মর্যাদায় আসীন। তাঁর এ কবিতা কোনদিনই পুরনো হবে না। যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যে পল্লীকবি জসিম উদ্দীন ‘কবর’ কবিতা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
মনোজিৎকুমার দাস, কথাসাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।