১৯০ নং কিস্তি
বড়োমা, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
তোরা কি করতে এসেছিস?
বেশ করেছি এসেছি, তোর কি।
তোদের তো ডাকিনি।
বড়োমা ডেকেছে।
তাহলে বড়োমার সঙ্গে যা। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পরলাম।
ঠিক আছে ঠিক আছে কোন ঝামেলা করবো না দেখিস। মিত্রা আমার হাত ধরেছে।
তনু হাসছে।
তুমি হাসছো কেন।
যা বাবা হাসলাম কোথায়, গম্ভীর হয়ে আছি তো, তখন থেকে একটা কথাও বলেছি।
বড়োমার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
তোমরা মাঝখানে বসো; ছোটোমা, বৌদি সামনে বসুক, আমরা পেছনে বসি।
কোথায় যাবি?
বড়োমার দিকে তাকালাম।
কতবার বলেছি বেরবার সময় জিজ্ঞাসা করতে নেই। জানো না।
জ্যেঠিমনি হেসে ফেললো।
কিরে জ্যেঠিমনি যে হাসলো, এবার কিছু বল। মিত্রা বলে উঠলো।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
সকাল থেকে আমার পার্মিসন ছাড়া বহুত ফর ফর করেছিস।
আমাকে বলছিস কেন বৌদিকে, অনিমেষদাকে বলতে পারছিস না।
আবার আমাকে নিয়ে পরলি কেন। বৌদি বললো।
আমি পেছনের দরজা দিয়ে উঠে পরলাম।
তনু উঠে আমার পাশে বসলো। মিত্রা অপরজিট সিটে।
সবাই উঠে বসলো।
রতন গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে জিজ্ঞাসা করলো।
কোথায় যাব অনিদা?
নারায়ণপুরের ভেতর দিয়ে রাজারহাট যাব।
সেদিন যেখানে গেছিলে।
হ্যাঁ।
বড়োমা পেছন ফিরে আমার মুখটা দেখলো।
গেট থেকে গাড়ি বার করেই রতন গড়গড় করে গাড়ি ছোটাতে শুরু করলো। গড়িয়াহাট পেরিয়েই রতন বাইপাস ধরলো। রতন এসি চালিয়ে দিয়েছে। কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া।
মিত্রা-তনু সমানে আমার পায়ে পা ঘষে চলেছে। আমি তাকালেই চোখে মুখে দুষ্টুমি ছড়িয়ে পরছে। মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে।
ছোটোমা।
বল।
আজকে টিভিতে মিত্রার মুখটা দেখতে কেমন লাগছিল?
তোর থেকে ভাল।
সে তো লাগবেই। ফেশিয়াল করে।
আবার ওর পেছনে লাগছিস কেন। বড়োমা ঝাঁজিয়ে উঠল।
তোমরা কথাবার্তায় এতো ভুল করো না। এতো শেখাই পাখি পড়ার মতো….।
জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি মুখ টিপে হাসছে।
তোর কাছে এই বুড়ো বয়সে কথা শিখতে হবে।
দিতো পারছো না। ছোটোমা সামনে থেকে দাঁতে দাঁত চিপল।
আমি বড়োমার কাঁধে আস্তে করে টোকা মারলাম।
বড়োমা আমার দিকে পেছন ঘুরে তাকাল।
একটু জলের বোতলটা দাও। সকাল থেকে জল খাওয়া হয়নি।
একটা মিষ্টি খা। বড়োমা বললো।
দেখলে ছোটোমা। মিত্রা বললো।
কি দেখবে রে। তোরা সকাল থেকে গিলছিস ও এক কাপ চা খেয়েছে। বড়োমা বললো।
খায়নি কেন, মিত্রা মাথার দিব্যি দিয়েছিল।
তোকে না বললেই ভালো হতো।
বড়োমার কথায় তনু, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি জোড়ে হেসে উঠলো।
বড়োমা ব্যাগের থেকে জলের বোতলটা দিল। আমি হাতে নিলাম।
মিষ্টিটা নে। মিত্রা বললো।
তুই নে, তুই খেলে আমার খাওয়া হয়ে যাবে।
কোন মন্দিরে যাবি?
তোকে কানে কানে বলেছি।
রতনকে বলেছিস।
রতনের কাছ থেকে জেনে নে।
মিত্রা আমার দিকে মিচকে পোড়ার মতো তাকিয়ে হাসছে। তনু তখনও পায়ে পা ঘসে চলেছে।
আমি তনুর দিকে তাকাতেই তনু মুখ ঘুরিয়ে নিল।
নিউটাউনের ভেতর দিয়ে তখন গাড়ি হু হু করে ছুটছে।
ছোটোমা।
আবার কি হলো।
মিত্রাকে আজ সকলে চিনেগেল, কি বলো।
তোর কি এলো গেলো।
তা ঠিক, বেল পাকলে কাকের কি।
যততো সব অলুক্ষণে কথা। বড়োমা দাঁত মুখ খেঁচালো।
বুঝছো না একটা কিছু ফন্দি এঁটেছে। ধানাই-পানাই চলছে। মিত্রা বললো।
দামিনীমাসি এবার পেছন ফিরে তাকাল। মুচকি হাসছে।
বড়োমা, কাগজে দিবাকরের ছবিটা দেখলে?
ওকে চিনতেই পারিনি।
ভালো-মন্দ খেয়ে একটু গতরটা বাড়িয়ে ফেলেছে।
তুইও ভালমন্দ খেতে পারিস।
আর বাড়িয়ে দরকার নেই, যথেষ্ট আছে। মিত্রা বললো।
দাদা আমার চেনা রাস্তা ফুরিয়ে গেল। রতন বললো।
সামনের মোড়টায় গিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরবি।
এখানে কোথায় আসতিস রে রতন? বড়োমা বললো।
বলতে পারবো না। দাদা ওই বিএলআরও অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলে যেত। ঘণ্টা খানেক ঘণ্টা দেড়েক পরে ফিরে আসতো।
তোকে নিয়ে যেত না?
তুমি তো জানো বড়োমা। বেশি জানতে চাইলে বিপদ আছে।
তোরা কি সবাই ওকে যমের মতো ভয় পাস?
ঠিক ভয় না। সব জানার মতো বোঝদার এখনও হইনি হয়তো। তাছাড়া দাদা নিজে থেকে যখন সব বলে, তাই বেশি উৎসাহ দেখাই না।
মিত্রাদি চারদিকটা একবার দেখছো। তনু বললো।
এ তো কাজলদীঘিতে চলে এসেছি।
ছোটোমা পেছন ফিরে আমার মুখের দিকে তাকাল। চোখে মুখে বিষ্ময়ের রেখা স্পষ্ট।
রতন সামনে একটা বটগাছ দেখতে পাবি। তারপর আর রাস্তা পাবি না।
রাস্তা নিশ্চই আছে গাড়ি যাবে না।
ওই হলো।
ছোটোমা সামনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। একবার বাঁদিকে দেখে একবার ডানদিকে দেখে।
এখানে এতো জল কিসের রে। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
চিংড়িমাছের চাষ হচ্ছে। গলদা, বাগদা।
এটা কি নদী?
না। জলা জমি। ওইদিকটা ধানের ফলন হয়। এই দিকটা খুব বেশি হয় না। তাই নদীর জল ঢুকিয়ে চিংড়ি মাছের চাষ হয়।
দাদা ওই সামনের বটগাছটা।
হ্যাঁ।
রতন বটগাছটার সামনে এসে গাড়ি থামাল।
পেছনের দরজা খুলে আমি নামলাম। আমার পেছন পেছন মিত্রারা নেমে এলো।
পরিবেশটা আধা গ্রাম আধা শহর। কাঁচা বাড়ির সঙ্গে দুচারটে পাকা বাড়ি আছে। তবে খড়ের চাল ওয়ালা বাড়ি নেই।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। ছোটোমা একবার আমার মুখের দিকে তাকায় আবার চারদিকটা দেখে। চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই ঠাহর করতে পারছে না।
এই জায়গাটার নাম কিরে অনি। বৌদি বললো।
মাছিডাঙা।
এই রাস্তাটা মনে হয় আর তৈরি হয়নি না?
জমি নিয়ে গণ্ডগোল। জমি দিলে রাস্তা হবে, না হলে এখানে দাঁড়ি পরে যাবে।
সামনের এই রাস্তাটা।
ওটা গ্রামের দিকে গেছে।
এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল করে না।
খুব একটা করে না।
চায়ের দোকানও তো দেখছি না।
দুপুরে পাবে না। বিকেলের দিকে আর সকালের দিকে। সাইকেল ভ্যানে করে চায়ের দোকান আসে। সকালের দিকে ঘণ্টা তিনেক থাকে। মাছ ধরা হয়। তারপর সব ভোঁ-ভাঁ।
বিকেলের দিকে মহাজনরা আসে, হিসেব নিকেশ হয় তখন একটু ভিড় থাকে। একটু রাত্রি পর্যন্ত থাকে। তারপর আবার ঘরে ফিরে যায়।
আমরা কোথায় যাব?
একটু অপেক্ষা করো, আসছি।
কোথায় যাবি! বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।
সামনের ওই বাড়িগুলো দেখছো ওখানে যাব।
আমি যাব। মিত্রা বললো।
একটু দাঁড়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবো। আমাকে তোরা দেখতে পাবি।
আমি সামনের মাটির রাস্তায় নমে এলাম।
যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম দেখলাম মিত্রারা উৎসুক চোখে আমার চলার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাড়ির কাছা কাছা আসতেই বিকাশের বউ পুকুরঘাট থেকে আমাকে দেখতে পেল। উঠে এলো।
অনিদা তুমি এই অবেলায়!
চলে এলাম, বিকাশ কই?
ঘরে আছে, এই তো মন্দির থেকে এলো।
ইস দেরি করে ফেলেছি। ওকে একবার ডাকো।
ঘরে চলো।
না বড়োমাদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে এসেছি।
তুমি কি ওই গাড়ি করে এলে?
হ্যাঁ।
আমি তো ভাবলাম আবার সার্ভে করতে এসেছে।
কিসের সার্ভে!
এখন ঘন ঘন সরকারের লোক আসছে। এই রাস্তাটা শেষ করতে হবে না।
রাস্তাটা হলে ভালই হয়। তোমাদেরও যাতায়াতের অনেকে সুবিধা হয়।
সে তো হয়। ও পাশের রাস্তায় কাজ চলে যাচ্ছে তাই কেউ গা করছে না।
পায়ে পায়ে বিকাশের ঘরের সামনে এলাম। বিকাশের বউ চেঁচিয়ে উঠলো।
কই-গো, কোথায় গেলে, অনিদা এসেছে।
কে এসেছে? ভেতর থেকে বিকাশের গলা পেলাম।
অনিদাগো অনিদা।
অনিদা! এই সময়!
দেখলে আমি তোমাকে তখনই বললাম। বিকাশের বউ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বিকাশ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
তুমি এই সময়! বিকাশ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
চলে এলাম। বড়োমাদের সঙ্গে এনেছি। একবার মন্দিরে পূজো দেব।
বড়োমারা এসেছে! তাহলে দুপুরে দুটি খেয়ে যাও।
তুই পাগল হয়েছিস। সাড়ে তিনটের মধ্যে ফিরতে হবে।
তাহলে কি করতে এসেছো। বিকাশের গলায় অভিমানের সুর।
কেন তোর ঘরে আমি খাইনি।
সে কথা বলেছি। বড়োমারা আজ প্রথম এলো।
আসার সময় কি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর একদিন আসবো।
বিকাশ চুপ করে রইলো।
ওই বাড়ির চাবিটা সঙ্গে নিয়ে নে।
টুনি-টকা এই তো খেয়ে দেয়ে ওই বাড়িতে গেল।
মন্দিরের চাবিটা নিয়ে নে।
মন্দিরে আসবে, পেছন পাশ দিয়ে এলে?
সামনের দিক দিয়ে এলে গণ্ডগোল ছিল।
আমাকে একটা ফোন করতে পারতে।
আসার ঠিক ছিল নাকি। হঠাৎ মন চাইলো। তাই চলে এলাম।
তারমানে! মনে হচ্ছে, তুমি একটা গণ্ডগোল করেছো।
তা করেছি।
ইলা তুমি চলো। ফিরে এসে খাওয়া যাবে।
আর একটা রিকোয়েস্ট করবো একটু রাখবি।
বলো।
একটু বেচাকে ফোন কর। বরফে না ডোবালে আমার জন্য গোটা পাঁচ কিলো বড়ো সাইজের গলদা আনতে বলে দে।
তুমি তো বড়ো সরেস, বেচাকে খবর দিলে আর কেউ খবর পাবে না ভেবেছো।
পেলে পাবে, কি করবো।
তাহলে ওকেই বলে দিই মিষ্টি আর ফুল কিনে নিয়ে আসুক।
তাই বলে দে।
বিকাশ-ইলা ভেতরে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার কাছে এলাম। মিত্রারা আমাদের দেখে চোখ কুঁচকেছে।
কাছে আসতেই বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
তুই তো বেশ ছেলে মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে চলে গেলি।
আমি হাসলাম।
বিকাশকে ডাকতে গেছিলাম। ও না হলে পূজো করবে কে।
মিত্রা তাহলে ঠিক বলেছে বল। বৌদি বললো।
মিত্রা, তনু দু-জনেই আমার মুখের দিকে তাকিয় হাসছে।
মন্দিরে যখন এলাম মিষ্টি কিনে নিয়ে আসতে পারতিস। বড়োমা বলে উঠলো।
তোমাকে ভাবতে হবে না। সব জোগাড় হয়ে যাবে।
তোর সবতাতে হেঁপি মারা কথা।
বিকাশ এদিকে আয়।
বিকাশ এগিয়ে এলো।
একে একে সকলের সঙ্গে ওদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলাম।
এবার দেখলি অনিদার দুটো বউ কিনা।
বিকাশ হাসছে।
মনাদার ছেলে কার কাছে আছে।
দূর ব্যাটা ওটা মনার ছেলে নয় আমার ছেলে।
তুমি তো মরে গেছো। এখন আমরা তোমার ভূত দেখছি।
মিত্রারা হাসছে।
বাবাঃ, তুমি তো বেশ কথা বলো। তা বাবা তোমার নাম কি? বড়োমা বললো।
বিকাশ।
পদবী-টদবী কিছু আছে তো?
আজ্ঞে চক্রবর্তী।
তোমরা অনিকে চিনলে কি করে?
সে অনেক কথা। চলুন এখন পূজো দিয়ে নিন আগে। বেলা হয়েছে।
বিকাশ আমার দিকে তাকাল।
গাড়ি এখানে থাকুক। আমরা হেঁটে যাই চলো।
কতোটা যেতে হবে বিকাশ। বড়োমা বললো।
মিনিট পনেরো।
সে তো অনেক পথ।
অনিদা উল্টো পথে এসেছে।
ও কোনওদিন সোজা পথ চেনে।
আপনি একবারে খাঁটি কথা বলেছেন।
রতন গাড়ি লক করে দিয়ে চল। আমি বললাম।
আমি এখানে থাকি।
কিচ্ছু হবে না। আপনি চলে আসুন। এতক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে। আপনি এসে দেখবেন গাড়ি পাহাড়া দেওয়ার লোক বসে আছে। বিকাশ বললো।
আমরা পিচ রাস্তা থেকে একটু এগিয়ে বাঁদিকের পথ ধরলাম।
ইঁট বেছানো পথ। দুদিকে এক দেড়ফুট করে ইঁটভাঁটির ঘেঁস ফেলা আছে।
আমি, বিকাশ সামনে, ইলা বড়োমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে পেছনে আসছে।
পথের ধারে যে দু-চারটে বাড়ি পড়ছে, তারা আমাদের গলার শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখছে।
স্বাভাবিক। চারিদিক নিস্তব্ধ। আমরা এতগুলো প্রাণ কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছি।
কেউ কেউ বিকাশের সঙ্গে কথা বলছে। বিকাশ সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে।
আমাদের ওই পাশের মতো এ পাশে বাঁশ ঝাড়ের বহর নেই।
তবে আম, জাম, জামরুল, পেয়ারা, সপেদা গাছ প্রচুর আছে। আর সার বেঁধে কলা বাগান।
কিছুটা আসতেই পাঁচিল ঘেরা টিনের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সামনে সামান্য একটু বাগান। লোহার গেট বন্ধ। এই রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই বড়ো রাস্তা।
আমি বিকাশ এসে দাঁড়ালাম।
বড়োমারা সকলে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো।
কিগো বিকাশ আর কতোটা যেতে হবে।
আর মাত্র এক মিনিট। আপনারা বরং এই বাড়িতে একটু হাত-পা ধুয়ে নিন।
কেন মন্দিরের সামনে কোনও কল-টল নেই।
সব আছে। আমি বরং একটু দেখে নিই ওরা ফুলটুলগুলো আনল কিনা।
আমাদের কথা বলার ফাঁকেই টুনি-টকা এসে হাজির।
দরজা খুলে আমাকে দেখে হাসছে।
অনিকাকা তুমি!
টুনি এবছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে। টকা বিএ ফাইন্যাল।
সবার চোখেই বিষ্ময়। ছোটোমার চোখের পলক পড়ছে না।
বার বার আমার চোখা-চুখি হলেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।
এতোটা রাস্তা এসেছে আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। শুধু চেয়ে চেয়ে চারদিক দেখেছে। টুনি-টকা এরই মধ্যে সকলকে প্রণাম সেরে নিয়েছে। একমাত্র রতন ওদের প্রণাম না নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। মুখে বলেছে আজ থাক।
এসো।
আমি সকলকে ভেতরে ডাকলাম।
অনি এরা কি বিকাশের ছেলে মেয়ে। বৌদি বললো।
হ্যাঁ।
দু-জনেই ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বাবাঃ বিকাশকে দেখে মনে হয় না, ওর এতো বড়ো বড়ো ছেলে-মেয়ে আছে।
বিকাশ হাসছে।
দাদা আমাকে চিমড়ে মারা বলে ডাকে।
ওর কথা ছাড়ো, ও বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবাইকে একটা করে নাম দিয়ে ওর মতো করে লোক চেনে।
না বৌদি, দাদার জন্য আজ আমি এখানে দুটো করে কম্মে খাচ্ছি।
বিকাশ তুই আর দেরি করিস না। আমি বললাম।
বিকাশ আর দাঁড়ালনা, হন হন করে সামনের দিকে হেঁটে চলেগেল।
টুনি আমার ঘর কে দখল করেছিস?
তোমার ঘর কেউ দখল করেনি। যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটি আছে। সকাল বিকেল পরিষ্কার করে তালা বন্ধ করে রাখা হয়।
টকা।
বলো।
একবার সাইকেলটা নিয়ে বিনয়দার বাড়ি যা। বলবি আমি এসেছি। মন্দিরে পূজো দিয়ে যাব।
ইলা ভেতরে গেছে।
আমরা সকলে ভেতরে এলাম।
বুবুন।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
যাওয়ার সময় জাম, জামরুল, পেয়ারা নিয়ে যাব।
বস্তা নিয়ে এসেছিস?
তুই বললে আনতাম। কোচর ভড়ে যতটা নিয়ে যাওয়া যায় নিয়ে যাব।
রতন হাসছে।
কেন তুমি দাদার পেছনে কিচ কিচ করছো বলো তো?
তনু চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
ছোটোমা গম্ভীর।
পায়ে পায়ে বারান্দায় এলাম। টিনের চালা ঘর।
দেখলেই মনে হয় বেশ পুরনো। ওপর ওপর যেটুকু সংস্কার হয়েছে। কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
বাগানের সামনের অংশের একটু জায়গা নিয়ে পার্টি অফিস তৈরি করা হয়েছে।
বড়োমা একটু চা হবে?
হলে ভালই হয়।
দামিনীমাসি দেখলাম ইলার সঙ্গে কথা বলছে।
টুনিকে বললাম, যা একটু চায়ের বন্দোবস্ত কর।
আগে চলো তোমার ঘরটা বুঝিয়ে দিয়ে আসি। টুনি নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
হ্যাঁরে অনি, এটা কার বাড়ি। বড়োমা আমার দিকে তাকাল।
আমার।
দেখছো সুতাপা ওর কথার ছিড়ি দেখছো।
তোমার ছেলে, তুমি দেখো।
মুহূর্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি, মিত্রা, তনু হাওয়া হয়ে গেছে।
অনিকাকা কাকা জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো।
টকা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে সাইকেলে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
বল ঘণ্টাখানেক পর যাচ্ছি।
চলো তোমার ঘরটা তুমি দেখে নাও। টুনি এগিয়ে গেল।
আমি ওর পেছনে। আমার পেছনে বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি।
টুনি ঘরের দরজা খুলে ভেতরে গেল। আমি ভেতরে এলাম।
মাস পাঁচেক আগে শেষ এসেছিলাম। সাদামাটা একটা টিনের ঘর। টিনের দেওয়াল। একটা সাধারণ খাট কোনও প্রকারে দুজনে শুতে পারে। তাতে একটা মাদুর তার ওপর একটা চাদর টান টান করে পাতা। একটা আদ্দি কালের টেবিল চেয়ার। জানলায় একটা কাপর দু-টুকরো করে পর্দা তৈরি করা হয়েছে। টেবিলের ওপর কয়েকটা বই পুরনো কাগজ। মেঝের সিমেন্ট এবড়ো খেবড়ো হয়ে ভেঙে গেছে। একটা কেরসিনের টেবিল ল্যাম্প। আসবাব বলতে এইটুকু। এই ঘরে নেই কোনও লাইট নেই কোনও ফ্যান। বৌদি তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিক দেখছে। বড়োমার চোখে বিষ্ময়।
দেখো তোমার আর্কাইভ্যাল মেটিরিয়াল সব ঠিক আছে কিনা। টুনি ফর ফর করে উঠলো।
ছোটোমার দিকে তাকাতেই চোখ মুখটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে গেল।
বড়োমা বৌদি দু-জনেই চেঁচিয়ে উঠে এগিয়ে গেলো, এই ছোটো কি হয়েছে!
ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে। চোখ ছল ছল করছে।
কাছে এগিয়ে গেলাম।
ছোটোমা আমাকে জাপ্টে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
আমিও ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরেছি।
তুই নিশ্চই ছোটোকে কিছু বলেছিস। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
টুনি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। চোখের ইশারায় বললাম এখন যা। টুনি বেরিয়ে গেল।
ও কখন বললো, ছোটো এতটা পথ এলো একটা কথাও বলেনি। বৌদি বললো।
বড়োমা ছোটোমার মাথায় হাত রেখেছে।
ছোটো কাঁদিস না। বল কি হয়েছে।
আমি স্থবিরের মতো দু-জনের দিকে একবার তাকাই আবার ঘরের চারদিকটা দেখি।
ছোটোমা আমার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।
বড়োমা দেখ জামরুলের সাইজগুলো….। মিত্রা কল কল করতে করতে ঘরে ঢুকলো।
পেছনে ওরা সকলে।
ঢুকেই আমার আর ছোটোমার দিকে তাকিয়ে কেমন থমকে গেল। যে উৎসাহ নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সেটা কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেল।
জ্যেঠিমনি, দামনীমাসি অবাক হয়ে গেছে।
মিত্রা-তনু দুজনেই আমার চোখে চোখ রেখেছে।
ছোটোমা, অনেকক্ষণ কেঁদেছো। আমি কিন্তু কাউকে কিছু বলিনি।
কেন তুই এখানে এলি। ছোটোমা আমার বুকে মুখ গুঁজেই বললো।
কি জানি। হয়তো আমার পাগলামো।
সবার চোখেই বিষ্ময়।
ছোটোমা আমার বুক থেকে মুখ তুললো।
চোখের পাতায় জলের স্পর্শে জোড়া লেগে গেছে।
ছোটোমা আমার চোখে চোখ রেখেও রাখতে পারছে না। বার বার মুখ-চোখ দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। চোখে জল ভরে আসছে।
অনি অন্যায় করলে শাস্তি দাও। সে অধিকার তোমাদের আছে। কাঁদবে কেন?
ছোটোমা মুখ নামিয়ে নিল।
ঈশ্বরদা বেঁচে আছেন?
না।
ওঁর ছেলে সীতারম?
না। তিনিও গতো হয়েছেন।
এই বাড়ি?
আমি সীতারাম জ্যেঠুর কাছ থেকে কিনে নিয়েছি। বিকাশ সীতারাম জ্যেঠুর শালির ছেলে। ওকেই সীতারাম জ্যেঠু ছেলের মতো লালন-পালন করেছেন।
কেন কিনলি?
তোমাকে মা বলে ডেকেছি। মায়ের প্রতি সন্তানের একটা কর্তব্য আছে। তাই।
ছোটোমা আমার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।
দেখো সকলে আমাকে কালপ্রিট ভাবছে।
ছোটোমা আরও জোড়ে আমাকে জাপ্টে ধরলো।
যাও এবার চোখে-মুখে জল দিয়ে নাও। বিকাশ চলে আসবে, পূজো দিয়ে আর একটা কাজ আছে। সেরে ফিরতে হবে। না হলে ওরা আবার ভাববে।
মন্দির কি এখনও সেরকম আছে।
সবটা নয়, তোমার বয়স হয়েছে, মন্দিরের বয়স হবে না?
আমি আগে মন্দিরে যাব।
ঠিক আছে, একটু চা খেয়ে নাও। যাও মিত্রার সঙ্গে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এসো।
ছোটোমা তবু যেন আমাকে ছাড়তে চায় না।
দেখো মিত্রা গাছ থেকে জামরুল তুলে নিয়ে এসেছে।
ছোটোমা মিত্রার দিকে তাকাল।
মিত্রা চোখ নামিয়ে হাসছে। ছোটোমার জলেভেঁজা চোখে হাঁসির কাজল।
ও জানে?
কেউ জানে না।
বুঁচকি?
জেনেছে। ওখানে যাওয়ার আগে দুই বোনে নেপলাকে নিয়ে একদিন ঘুরে গেছে।
বিকাশরা কেউ জানে না?
না।
মুর্হূ মুর্হূ ছোটোমার চোখ জলে ভরে উঠছে। কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছে।
কাঁদিসনা ছোটো, বলনা কি হয়েছে।
ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরেই বড়োমার করুণ মুখের দিকে তাকাল।
বলবো।
ইলা থালার ওপর চায়ের কাপ সাজিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
কিগো এখনও সবাই দাঁড়িয়ে আছ। যাও তাড়াতাড়ি কাজ সারো। ও ফোন করেছিল।
রেডি।
হ্যাঁ।
যাও আর দেরি করো না। আমি ছোটোমাকে ছারলাম।
মিত্র ছোটোমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেল।
বৌদি তখনও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। একটা কথাও বলছে না।
আমি ইলার ধরে থাকা থালা থেকে একটা কাপ নিয়ে বৌদির হাতে দিলাম।
নাও। চা খাও।
বৌদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তুমি তো আবার ঠাকুর দেবতা বিশ্বাস করো না। নাস্তিক।
বৌদি আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিল। আমি জ্যেঠিমনির মুখের দিকে তাকালাম।
ওদেরও চায়ের কাপ ধরালাম।
এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। একটু খাটে বসে নাও।
কেউ কোনও কথা বললো না।
জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি স্থবিরের মতো খাটে গিয়ে বসে পরলো। আমি ইলার হাত থেকে চায়ের থালাটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলাম। ইলা বেরিয়ে গেল।
তনু, রতন কোথায়?
বাগানে জামরুল, পেয়ারা পারছিল।
হাসলাম।
নাও চা খেয়ে তাড়াতাড়ি চলো।
তনু টেবিলের কাছে চলে গেল। বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখল। তারপর কাগজগুলো টেনে বার করে দেখেই আমার মুখের দিকে তাকাল।
কিরে তনু, ওগুলো কবেকার কাগজ? বৌদি বললো।
সাতাশ বছর আগেকার।
তোদের হাউসের?
হ্যাঁ।
বৌদি আমার মুখের দিকে তাকাল। কিছু পড়ার চেষ্টা করলো।
চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি পেট ফুলে যাচ্ছে। একটু ফাঁকা পেলেই কড়া, খুন্তি নিয়ে ভাজতে বসে যাবে। সব কিছু বুঝেও বুঝে উঠতে পারছে না।
বড়োমা একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখের পলক পড়ছে না।
ছোটোমা, মিত্রা ঘরে ঢুকলো। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তুই এতো শয়তান!
বৌদি, তনু, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
ছোটোমা মাথা নীচু করে বড়োমার পাশে খাটে এসে বসলো। আমি টেবিলের ওপর রাখা থালা থেকে চায়ের কাপটা ছোটোমার হাতে দিলাম।
ও কোন দিন ভালো ছিল বল। বৌদি বললো।
তুমি জানো এটা কার ঘর। মিত্রা বললো।
আভাসে ইঙ্গিতে বুঝতে পারছি, একসময় ছোটোর সঙ্গে এই বাড়ি এই ঘরের কোনও রিলেসন ছিল। বৌদি বললো।
রিলেসন মানে! ছোটোমা এই ঘরে তিন বছর কাটিয়ে গেছে। যে মন্দিরে আমরা এখন যাব সেই মন্দিরে মল্লিকদা ছোটোমাকে বিয়ে করেছিল। ঈশ্বরবাবু ছোটোমাকে সম্প্রদান করেছিল। ঈশ্বরবাবুর ছেলে সীতারামবাবু ছোটোমার বিয়ে দিয়েছিলেন।
বৌদি, দামিনীমাসি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
বড়োমা, ছোটোমার গলা জড়িয়ে ধরেছে।
তুমি দাদা তখন রাজবল্লভ পাড়ায় থাকতে। মাঝে মাঝে মল্লিকদা রাতে ফিরতে পারতো না।
কেন!
তখন এখানে রাস্তা-ঘাটই ছিল না। দেখছো না ঘরটার অবস্থা।
ইলা আবার দু-কাপ চা নিয়ে এসেছে। পেছনে টুনি।
কিরে আবার চা কে খাবে। তুমি, বৌদি।
আমি তো খেলাম।
আর একটু খাও।
একটা লাইট ফ্যান লাগাতে পারিসনি। বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
কতোবার অনিদাকে বলেছি। দাদা টিন ফুটো হয়ে জল পরছে। বলেছে পিচ চট চাপিয়ে নে। আমার কাজ বাকি আছে। আমাদের সব ঘরে লাইট ফ্যান আছে এই ঘরে নেই। যখন সাধু সেজেছিল ওই পচা গরমে এই ঘরে এসে পরে পরে ঘুমতো। গরমও লাগতো না। অখদ্যে মার্কা লোক একটা। ইলা বললো।
সকলে ইলার কথায় হাসছে।
হবে না কেন। ছোটোমা এই ঘরে যখন থাকতো তখন কি লাইট ফ্যান ছিল? ছিল না। ছোটোমা-মল্লিকদা যদি কষ্ট করতে পারে, আমি কেন পারবো না। মিত্রা টিজ করার ভঙ্গিতে বললো।
তনু মুখ টিপে হাসছে।
ছোটোমা একবার আমার মুখের দিকে তাকাল।
ছেলে তো ধোয়া তুলসি পাতা, এবার মুখ থেকে কথা সরছে না, তাই না। মিত্রা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বড়োমার দিকে তাকাল।
ও তো কোনও অন্যায় কাজ করেনি। বড়োমা মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
মিত্রা হাসছে। বলবেই তো।
ও ঠিক-ঠাক ভাবে গুছিয়ে রেখেছিল বলে চোখের দেখা দেখতে পেলাম। আমি যে ঘরে এসে উঠেছিলাম তোর দাদার সঙ্গে, সেটা এখন পাঁচতলা বাড়ি হয়েছে।
জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি হাসছে।
টুনি এই টুনি, বাবা এরা সব গেল কোথায়। চারদিক শুনসান। দরজা হাট করে খোলা।
বেচাকাকা এসেছে। টুনি ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
এই তো। ছিলি কোথায়?
কেন, ওই ঘরে।
অনিদা কোথায়?
এসো, দেখিয়ে দিচ্ছি।
আর কে আছে রে? বিকাশ বলছিল অনিদার ছোটোমা, বড়োমা, ম্যাডাম এসেছেন।
সব্বাই।
কথা বলতে বলতেই টুনি, বেচা ঘরে ঢুকলো।
ঘরে ঢুকেই একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
কাগজ পড়ে টনাকে ফোন করেছিলাম। সব শুনলাম।
শুনে-টুনে একবারে গদো গদো হয়ে গেলি।
তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই বেচা সবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে নিল।
উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
বৌদিকে স্টেজে দেখেছি, এতো কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
বেচা বৌদির দিকে তাকাল।
এই জন্য পাঁচকিলো গলদার কথা বলেছিলাম বিকাশকে, জোগাড় করেছিস।
তনু মিত্রা জোড়ে হেসে উঠলো।
টনা ধরতে গেছে।
টনা ধরতে গেছে মানে!
আমি যে মাছ বেছেছিলাম পছন্দ হয়নি।
টনা এলো কোথা থেকে?
বিকাশ ফোন করার পর টনাকে ফোন করলাম। অনিদা এসেছে। বাইক নিয়ে চলে এলো।
বৌদি হাসছে।
তোমার পার্টির গ্রাম পঞ্চায়েত। এখানকার পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান। গলদা, বাগদার ভেঁড়িগুলোকে একবারে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে দিল, বুঝলে।
না বৌদি, একটু আধটু গণ্ডগোল হয়, আমরা ম্যানেজ করে নিই।
ফুলটুল জোগাড় করেছিস?
সব রেডি। বিকাশ গোছাচ্ছে। তোমরা গেলেই শুরু করে দেবে।
দুটো ভ্যান রিক্স জোগাড় করে দে। বিনয়দার বাড়ি যাব।
সব জোগাড় করে দেব। তোমাদের পূজো দেওয়া হোক আগে।
বেচা একবারে গদো গদো।
চলো আর দেরি করবো না। বেলা হয়ে যাচ্ছে।
আমরা সকলে পায়ে পায়ে মন্দিরে এলাম।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর ছোটোমা আমার হাত ছাড়েনি। শক্ত করে ধরে রেখেছে।
তনু-মিত্রা মুচকি মুচকি হেসেছে।
মাঝে মাঝে ছোটোমা গম্ভীর হয়ে ওদের দিকে তাকিয়েছে।
ওদের চোখে মুখে তখন দুষ্টুমি।
ভাবটা এরকম, কেমন মজা এবার বুঝেছো। শুধু আমাদের বলা না।
মন্দিরের সামনে আসতে দেখলাম, বেচার চেলাগুলোর সঙ্গে রতন বেশ জমিয়ে নিয়েছে।
এতক্ষণে হয়তো ব্যবসার হিসাবও করে নিয়েছে।
সেই আদি অকৃত্তিম বিশাল বট গাছ। ঝুড়ি নেমে চারদিক আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
একটা সময় এই গাছের তলাতেই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তখন মন্দির বলতে একটা চালা ঘর। পিচ রাস্তা হওয়ার পর এই দিকে অনেক বসতি বেড়ে গেছে। আগে এতো লোকজন ছিল না। একসময় এই অঞ্চলটা দিনের বেলাতেই শুনসান থাকতো। প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম তখন যা দেখেছিলাম, সেই তুলনায় খোল-ননচে অনেক বদলে গেছে। মন্দিরের মাহাত্ম্য বারতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক জনের আসা বেড়ে গেছে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে একটা ছোটোখাটো বাজারও তৈরি হয়েছে।
ঈশ্বরদাদু একবার কথায় কথায় বলেছিল, আমার যখন জ্ঞান পরে তখন থেকে আমি এই মন্দির দেখছি আর এই বটগাছ। তখন মন্দির বলতে মাটির ঘর খড়ের চালা। মা মনসা এখানে খুব জাগ্রতা। লোকে বলে মনসার থান। বাৎসরিক উৎসবে এখানে প্রচুর ভিড় হয়। আমার একবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
এছাড়াও আরও অনেকে আছেন। কম বেশি সব পূজোই পালা করে এখানে হয়।
এলাকার বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা মাছ মারা। সামনেই বিদ্যেধরী নদী। এখনও নাকি তাতে জোয়ার-ভাটা হয়। জোয়ারের জল খেতে চালান করেই চিংড়িমাছের চাষ।
টকা কাছে এলো।
বিনয়জ্যেঠু বাড়িতে ছিল না। ওষুধ কিনতে গেছে। আমি ফোন করেছিলাম।
কি বললো?
তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
মন্দিরের সামনে একটা টিউবওয়েল রয়েছে দেখলাম। মনে হয় বেচা এটা পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে বানিয়েছে। মাস পাঁচেক আগে এসেছিলাম এটা ছিল না।
ছোটোমা আমার হাতটা নাড়িয়ে বললো, তুই চল।
আমি এখানেই আছি। তুমি যাও।
না।
আজ তোমার জন্য এখানে এসেছি। আগে জানতে পারলে মল্লিকদাকে ধরে আনতাম।
ছোটোমা আমার দিকে তাকাল। আবার চোখ ছল ছল করে উঠেছে।
এরকম করলে এবার নিজের খুব খারাপ লাগবে।
ছোটোমা আমার হাত ছেড়ে মন্দিরের ভেতরে গেল।
আমি মন্দিরের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
বেচাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। টনা এলো মাছের ব্যাগ হাতে।
ওরও সাগরেদ আছে তিন-চারজন। টনাকে বললাম।
তুই এক কাজ কর।
বলো।
ম্যাডামের শ্যামবাজারের বাড়িতে চলে যা। কেটে কুটে একটু পরিষ্কার করে দে। ভজু আছে।
টনা হাসছে।
কে করবে বল।
ভাইঝি সেখান থেকে মাছের অর্ডার দিয়ে রেখেছে।
আমি হাসলাম।
বেচাকে বলেছিস।
বলেছি।
টাকা না নিলে মাছ নেব না।
তুমি চাওনি, ভাইঝি চেয়েছে। আমি ভাইঝির সঙ্গে বুঝে নেব।
ওদিককার হাওলা কি?
রতনদা সামলে দিয়েছে।
রতনের দিকে তাকালাম।
ইন্টারেস্ট নেব বলেছি। তুমি বলো না, হুট করে অতোটাকা কেউ দেয়।
পেলি কোথা থেকে?
দাদাভাইকে বলে মাছের তেলে মাছ ভেজে নিয়েছি।
বেচা-টনা দুজনেই হাসছে।
কিরে বেচা তোর ভ্যানরিক্স কোথায়?
অনি। মন্দিরের ভেতর থেকে বড়োমা চেঁচাল।
ওদিকে তাকালাম।
দাঁড়া আসছি।
টিউবওয়েলে হাত ধুয়ে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে বসলাম। বিকাশ বেশ যত্ন করে পূজো করেছে। ফল মূল যা কিছু নিজেই কাটা কাটি করেছে।
একটা জামরুলের টুকরো মুখে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
বৌদি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।
যারা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল বড়োমা তাদের সকলকে ফল, মূল যা ছিল বেটে দিল। শুধু মিষ্টির প্যাকেট দুটো সঙ্গে নিল।
বিকাশকে বললাম বড্ড বেলা হয়ে গেল আজ, তুই বাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া কর।
তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
খুব জরুরি?
বিকাশ তাকাল।
কয়েকদিন খুব ব্যস্ত থাকব। এদিকে আর আসা হবে না, তুই এক কাজ কর খেয়ে দেয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়া ফেরার পথে শুনে নেব।
বিকাশ মাথা দোলালো।
টনা, বেচা দুজনেই মিত্রাদের বাড়ির দিকে রওনা হলো।
বেচার আনা দুটো সাইকেল ভ্যানে আমরা সকলে এলাম বিনয়দার বাড়ি।
বড় রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে, তবে বাড়ি পর্যন্ত ইঁটের রাস্তা।
আমাদের ভ্যানের পাশে পাশে সাইকেল চালিয়ে টুনি-টকা এসেছে।
মন্দির থেকে বিনয়দার বাড়ি পৌঁছতে প্রায় মিনিট দশেক লাগলো।
বিনয়দা গেটের মুখেই দাঁড়িয়েছিল।
আমায় দেখে এগিয়ে এলো।
কেমন আছো।
ভালো।
বৌদি স্কুলে গেছে?
হ্যাঁ।
তিতাস কোথায়?
ইউনিভার্সিটি গেছে, প্রফেসারের কাছ থেকে নোট নিতে।
ওরতো এবার ফাইন্যাল ইয়ার।
হ্যাঁ। কাল ফর্ম ফিলাপ।
বেচারার পড়াশুনোর চাপটা বেড়ে গেছে। শুনলাম তুমি ওষুধ আনতে গেছিলে?
একটা ওষুধ শেষ হয়েগেছিল। আজ এসপ্ল্যানেড যেতে পারবো না। পর্শু যাব। তাই দু-দিনের ওষুধ নিয়ে এলাম।
পেলে?
হ্যাঁ। একটু দাম বেশি নিল।
আমি একবার বাড়িটার দিকে তাকালাম। যা দেখে গেছিলাম তার থেকে দৈন্যতা একটু বেড়েছে। পুরনো আমলের বাড়ি। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। পলেস্তারা খসে সেই সময়কার পাতলা পাতলা ইঁট দাঁত বার করে আছে। দো মহলা বাড়ি। সামনের অনেকটা অংশ জুড়ে বাগান। ভীষণ অপরিষ্কার। দেখলেই বোঝা যায় এতো বড়ো বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার লোকের খুব অভাব।
আমাদের দুজনের কথা বলার ফাঁকেই বড়োমারা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি সকলের সঙ্গে বিনয়দার আলাপ করিয়ে দিলাম।
বিনয়দা নীচু হয়ে বড়োমাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।
বিনয়কে তুই পেলি কোথায়? এতদিন ওর কথা শুনিনি।
বড়োমার কথায় বৌদি হাসছে।
বিনয়দারা এই অঞ্চলের খুব বর্ধিষ্ণু পরিবার। বলতে পারো জমিদার পরিবার। একসময় অনেক জমি জিরেত ছিল। এখন সরকার সব নিয়ে নিয়েছে। যে টুকু আছে সেটুকু নাড়া-চড়া করেই চলে যায়।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, বুঝলাম উত্তরটা মনপসন্দ হলো না।
মাসিকে কোন ঘরে রেখেছো? বিনয়দার দিকে তাকালাম।
যে ঘরে ছিল সে ঘরেই আছে।
এখন কেমন আছে?
একই রকম।
খাওয়া-দাওয়া ইমপ্রুভ হয়েছে?
খুব একটা না। তবে আগের থেকে একটু ভালো আছে।
নতুন ওষুধগুলো কাজ করছে।
খুব সামান্য।
কথা বলতে বলতে পেল্লাই দরজা ঠেলে আমরা বাড়ির ভেতরে এলাম। বাগান পেড়িয়ে প্রথম মহল্লা, পেছন দিকটা দোতলা। তবে দোতলাট খুব একটা ব্যবহার হয় না। সবাই নিচের তলায় থাকে। মাঝে বিরাট একটা উঠোন।
তনুরা ঘার ঘুড়িয়ে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
কেউ তো নেই। মার সঙ্গে একটু কথা বল, আমি একটু চা বানাই। বিনয়দা বললো।
তোমাকে আর কষ্ট করে বানাতে হবে না। বড়োমা বলে উঠলো।
দিদা আমি বানাব। টুনি বলে উঠলো।
তুই করবি, কর। বেশি করিস না।
বিনয়দা হাসছে।
আমি মাসীমার ঘরে এলাম। পেল্লাই ঘর। পুরনো আমলের কাঠের আসবাবে ঠাসা। একপোঁচ ময়লা ধরে আছে অসবাবগুলোয়। মাসিমা সেই আদ্দিকালের খাটে চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
(আবার আগামীকাল)