২১৯ নং কিস্তি
আরে, আচ্ছাই পাগল তো। কেউ বেশি দোলাদুলি করবে না। নৌকয় জল ঢুকে সবাই একসঙ্গে সলিল সমাধি।
এই যে বললে একগলা জল। বনি চেঁচাল।
ওই হলো।
আমি নৌকয় উঠে নদীর পাড়ে বাঁশ দিয়ে একটু ঠেলতেই একবারে মাঝ নদীতে চলে এলাম।
ওয়াও। মিলি চিল্লিয়ে উঠলো।
মিত্রাদি একবার চারদিকটা দেখো।
মিত্রা, মিলির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
আমি নদীর বুকে আবার বাঁশ ফেললাম।
তোরা মাঝখানে বসে পর। দাঁড়িয়ে থাকিস না। টাল খেলে সামলাতে পারবি না।
তনু দাঁড়িয়ে থাকলো, মিত্রা দিদি ইসি বসে পড়েছে। অদিতি-টিনা নৌকর সাইডে বসেছে।
কথায় যাবি।
বেশি দূর যাওয়া যাবে না। নদীতে জল নেই।
তুই যে বললি কাঠ পুল।
ওই পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
তনু মোবাইল বার করে ভিডিও করতে শুরু করছে। বনি, অদিতি, টিনা মনের সুখে ছবি তুলে চলেছে। ওদের চোখে মুখে অপার আনন্দের ছোঁয়া।
আমি আর বাঁশ ডোবালাম না। নৌক এমনিই হাওয়ার টানে ভাসছে।
মিত্রা সামনের দিকে তাকা।
কাঠপুল। সুরো চেঁচাল।
বৌদি দেখো কি সুন্দর লাগছে।
তনু ওই দেখ। মিত্রা চেঁচাল।
দেখলাম একটা জলঢোঁরা সাপ এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে। শরীরটা জলে ডুবে রয়েছে। মাথাটা উঁচু করে রেখেছে।
তনু মোবাইলটা ঘুরিয়ে ছবি তুললো।
অনিদা প্লিজ পুলের তলাটায় একটু থামবে। টিনা বললো।
কেন।
এই পথে যাওয়ার সময় গেলাম। এখন কেমন লাগে একটু দেখবো না।
দিদি ধরোতো। তনু নিজের মোবাইলটা মিত্রার হাতে দিল।
কোমরে কাপরটা পেঁচিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
আমি একটু লগি ঠেলি।
মিত্রা, দিদি হেসে উঠলো।
নৌক ডুবে গেলে তুমি বাঁচাবে ?
মিত্রার ফোনটা বেজে উঠলো। নম্বরটা দেখেই বলে উঠলো।
তনু গেছি, তুই কথা বল।
বড়োমা ?
হ্যাঁ।
বলো ছেলের সঙ্গে জলকেলি করছি।
আবার একচোট হাসি।
মুড়ো ঝেঁটা দেখেছিস। সক্কাল সক্কাল ছেলেকে জল দিয়েছিস, সন্দেশ দিস নি।
তাহলে দিদিকে দাও।
দিদি তুমি ধরো। মিত্রা ফোনটা এগিয়ে দিল।
দিদি হাসতে হাসতে ফোনটা ধরে হ্যালো বললো।
হ্যাঁ….অনিকা সাথ বোটমে বৈঠা হ্যায়….
বড়োমা কি বললো শুনতে পেলাম না। দিদি প্রচন্ড শব্দ করে হেসে উঠলো।
মিত্রাদি ছেলের কথা শুনে বড়োমা গলে জল। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।
কাঠপুলের কাছে এলাম।
তনুর হাতে বাঁশটা দিয়ে বললাম, বাঁশটা জলে ডুবিয়ে মাটির স্পর্শ পেলে সামান্য ঠেলে তুলে নেবে। আমি ওই পাশে গিয়ে পুলের বাঁশটা ধরে থামাব।
ঠিক আছে।
আমি পায়ে পায়ে সুরোদের কাছে এগলাম, তখনো পৌঁছই নি।
মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো দিলি তো, এবার গালাগাল খা। শখ মিটে যাবে।
টিনা, অদিতিরা হাসছে।
আমি পেছন ফিরে দেখলাম বাঁশটা বর্ষার ফলার মতো নদীর বুকে কাদায় গেঁথে আছে।
আমি তনুর দিকে তাকিয়েছি।
কি করবো। টেনে তোলার আগেই হাত ফসকে গেল।
জামরুল খাও।
সবাই হাসছে।
নৌক কাঠপুলের কাছে চলে এসেছে। এখন আর চলছে না। বলা যেতে পারে ভাসছে।
আমি নৌকটাকে কাঠপুলের লম্বা বাঁশ ধরে দাঁড় করালাম।
পাজামাটা গুটিয়ে তনুর দিকে তাকালাম।
তনু হাসছে।
তুই জলে নামবি ? মিত্রা বললো।
তাহলে কি করবো।
তা ঠিক।
পাঞ্জাবীটা খুলে মিত্রার হাতে দিলাম।
অনিদা প্লিজ ছাপান্ন ইঞ্চি….। মিলি বললো।
বনি, সুরো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
পাঞ্জাবীটা ভিঁজিয়ে লাভ কি বল।
আমি ঝুপ করে জলে নামলাম।
সত্যি কোমর ছুঁয়ে গেল।
জল ঠেলে নদীর পারে এলাম।
ওরা কন্টিনিউ হেসে যাচ্ছে।
নদীর পার বরাবর হেঁটে আবার জলে নেমে বাঁশ তুলে নিয়ে এলাম।
ফিরে এসে নৌকয় উঠলাম।
মিত্রা ইশারায় দেখাল ভেতরে কিছু পরিস নি সিগগির আগে পাঞ্জাবী পর। তনু, মিত্রার ইশারা দেখে ফেলেছে, মুচকি মুচকি হাসছে।
আমি পাঞ্জাবীটা গলিয়ে নিলাম।
টিনার দিকে তাকালাম। ছবি তুলেছ।
তুলবোনা আবার।
বড়কে জুম করে দেখিও।
বড়কে দেখাবার দরকার নেই, নিজে দেখলেই মন শান্তি।
ওরা হাসাহাসি করছে।
কিরে ইসি, খুব মজমা নিচ্ছিস।
ইসি হাসছে। ও পাশে যাবি না।
জল নেই।
যাওয়ার সময় অতটুকু জল ছিল ?
হ্যাঁ। তিনদিন এরকম টানা বৃষ্টি হলে। বাড়ি ফিরতে হবে না।
কেন ?
ওই রাস্তায় এক মানুষ জল হয়ে যাবে। তখন চারদিক সমুদ্র।
তনুর দিকে তাকালাম।
আবার লগি ঠেলবে নাকি।
তুমি ধরে থাকো আমি ঠেলি।
তনুদি তুমি থামবে। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।
সবাই অট্টহাসির মতো হেসে উঠলো।
বিশ্বাস কর।
আর বিশ্বাস করতে হবে না। অনিদাকে এতদিনে চিনতে পারলে না।
তনু সজোরে আমার পেট চিমটে ধরলো।
শয়তান।
চোরের মন বোঁচকার দিকে। আমি হাসতে হাসতে বললাম।
মিত্রার দিকে তাকালাম। একটা জামরুল দে। কনটিনিউ চিবিয়ে যাচ্ছিস।
যাওয়ার সময় আর কয়েকটা পেড়ে দিস।
সব শেষ ?
শেষের পথে।
তনু কোঁচর থেকে একটা জামরুল বার করে আমার হাতে দিল।
জলে বাঁশ ফেলে আবার ঠেললাম।
বনি।
বলো।
নাগেশ পিট্টি দেবে।
তোমাকে ভাগ দেব।
হাসাহাসি থেমে নেই।
এই গাছগুলো কাদের অনি। দিদি বললো।
মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ইজমালি।
নিজেই হেসে উঠলাম। তারপর দিদিকে আবার বিদেশী ভাষায় ব্যপারটা বোঝালাম।
দিদির চোখ গোল গোল।
ইন্ডিয়ায় এরকম হয় নাকি!
সেই জন্য ইন্ডিয়া।
কালকের সেই মাছ ধরার জায়গাটায় এলাম।
ওরা ঘার ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে।
নৌকটা নদীর পারে ভেড়ালাম। হাত পঁচিশেক দূরেই সামন্ত ঘরের আঁখের খেত।
টিনা আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাচ্ছে।
আমি হেসে ফেললাম। মিত্রা দেখে ফেলেছে।
একবারে যাবি না। চোর। কেউ দেখে ফেললে….। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
আরে চুপ চুপ।
সবাই হাসাহাসি করছে।
দাঁড়া আমি জ্যেঠুকে বলে নিয়ে আসি।
না তুই যাবি না। মিত্রা হাত ধরেছে।
অগত্য আমি ওখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলাম।
খগেন জ্যেঠু ঘরকে আছ।
বার তিনেক চেঁচাবার পর, সারা মিললো।
ক্যারে।
আমি অনি, নদীর ঘাটে একবার আইসো।
কি হইছে।
একবার আইসো না।
মিত্রাদের দিকে তাকালাম।
তুই আবার একটা গন্ডগোল পাকাচ্ছিস।
আজ চুরি করবো না। চেয়ে নেব। আমি চাইলে জ্যেঠু অবশ্যই দেবে।
কিছুক্ষণ পর জ্যেঠুর মুখ দেখলাম। আদল গায় একটা গামছা পরে নদীর পারে চলে এসেছে। কোলে একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা। তারও গায়ে কোন জামা নেই।
ওরা খগেন জ্যেঠুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
বাঁধের ওপর থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো।
বৌমা মনকাকে লিয়ে কাই গেছলু।
একটু নদীতে ঘুরছিলাম।
কা হরে লৌক।
সিং-এর ঘরের।
অখন নদীয়ে জল লাই কাই আটকিইবে।
না না এই এইটুকু জায়গায়া ঘুরছি।
কি কইতিছু।
তৌমার বৌমারা আঁখ খেতে চাইছে।
আর কইস নি। লজর দিতে পারি নি বলে সব বেবাগ চুরি করে লিয়ে পালাইতিছে।
মিত্রারা মুখ ঘুরিয়ে হাসতে শুরু করলো।
কাল বৈকালে ঝড় উঠছিল কে আইসে তিনখন আঁখ ভাঙি লিয়ে চলিইছে। লজর দিতে পারি লাই।
মিত্রারা এবার আর ফিক ফিক করে না হেসে জোড়ে হেসে উঠলো।
আমি একবার কট কট করে ওদের দিকে তাকালাম।
ধরতে পার নি।
চোরকে ধরা যায়। বৌমাদের মনকে লিছে তুই লিয়ে আয়।
পয়সা নিতে হবে।
লাগবে নি। তান্যে শহরে থাকে।
এদের নিয়ে যাব।
লিয়ে আয়।
আমি মিত্রাদের দিকে তাকালাম।
ওরা চোখ নাচিয়ে বলছে চল চল।
প্রথমে নিজে নদীর পারে নেমে এসে নৌকটা ধরলাম, তারপর সকলে একে একে নামলো।
মিত্রা হাতটা ধরে আস্তে করে বললো, কত নাটক করতে পারিস।
তনু সামনে দাঁড়িয়েছিল, ফিক করে হাসলো।
মিত্রাদি। মিলি ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলেছে। খগেন জ্যেঠুর দিকে ইশারা করছে।
গাঢ়ল। এখুনি বুঝতে পারলে বাপ-চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দেবে। আমি বললাম।
সকলে হাত ধরাধরি করে নদী বাঁধে উঠলাম।
সামন্তদের আঁখ বাড়িটা নদীর ধারের অনেকটা জায়গা নিয়ে।
কাকার মুখে একবার ঝগড়ার সময় শুনেছিলাম এই জায়গাটা সামন্তদের নয়। খাস। সামন্তরা নিজেদের দখলে রেখেছে বলে এখন সকলে সামন্তদের জায়গা বলে।
খগেন জ্যেঠুরা এই তল্লাটের বর্ধিষ্ণু চাষীদের মধ্যে একজন। একসময় মনাকাকার সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক ছিল। পুকুর ধারে আমাদের বাঁশ ঝাড় থেকে প্রায়ই বাঁশ কেটে নিয়ে পালিয়ে যেত। কাকা কিছু বললেই বলতো এটা অনির ঘরের বাঁশ তোমার ঘরের নয়।
মনে পরলে এখন হাঁসি পায়।
সারা বছর কাঁচা সব্জী এদের কিনতে হয় না। সংসার খরচের তেলটা নিজেরাই নিজেদের ঘানিতে তৈরি করে নেয়।
খেত থেক সরষে উঠলে তেল তৈরি করে। উদ্বৃত্ত সরষে বেচে দেয়।
এই আঁখ বাড়ি এবার কাটার সময় হয়েছে। আঁখ পেকেছে। পুরুষ্টু হয়েছে। আর কয়দিন পর কাটা হবে। তারপর রস মারা হবে।
ছোট সময়ে দেখেছি। আঁখ কাটা শুরু হলেই সামনে আঁখ মাড়াই-এর কল বসবে। দুটো মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে কপি কলের মতো। দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি। চাষের গরুকে তার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে চারপাশে ঘোরাবে। আট দশটা আঁখ এক সঙ্গে ওই গাছের গুঁড়ির ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে আঁখের থেকে রস বার করে আনা হবে। তার পর দোপাখা উনুনে রস জাল করে আঁখের গুড় তৈরি হবে। আঁখের ছিবড়ে গুলো রস জাল তৈরি করার জালন হিসেবে কাজে লেগে যায়। তারপর বড়ো বড়ো কলসিতে করে সেই আঁখের গুড় চলে যাবে গঞ্জের হাটে।
আমরা ছোট সময়ে কাঁচা শালপাতার ঠোঙা তৈরি করে এক ঠোঙা কিংবা দুঠোঙা গরম গুড় ভাগে পেতাম। এখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাঝে মাঝে গরম গুড় খাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
ও নাতবৌ মাদুরটা দুয়াড়ে পাতি দে।
তোমাকে আর ব্যস্ত হতে হবে না। ওরা কেউ বসবে না। তোমার বাগানটা একটু ঘুরে ফিরে দেখবে। মন চাইলে কয়েকটা বেগুন, সিম, ঝিঙে ছিঁড়ে নেবে।
জ্যেঠু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বাচ্চাটা কোন জনের ?
আমার বড়ো নাতির ছেইলে।
তারমানে তোমার পুতি!
হ।
মিত্রারা আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে।
একটা বছর সতেরোর মেয়ে একটা মাদুর নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।
তোমার কোলে কি ওর ছেলে ? আমি খগেন জ্যেঠুর দিকে তাকালাম।
জ্যেঠু হাসছে।
হা সে রামপুরার নগেন মান্নাকে তোর মনে আছে।
নাপিত ঘরের ?
হ।
কামারপাতার পেছনে আমাদের জমিটা চাষ করতো।
হ।
আমি সেই জমিটা বাসন্তীমাকে দিয়ে দিয়েছি।
সেউ লিয়ে সে মন্ডল ঘরের জামাইটার সঙ্গে কততো গন্ডগোল। চিকনা ছ্যাল বলে নগনার ব্যাটাটা আবার চাষ করতিছে। নাত বউমাটি তার মেয়ে।
একটা দা দাও।
দরকে টুকু বুইস। বৌমরা আইল।
এখন না। আগে গোটা কয়েক আঁখ কাটি।
নাত বৌ ছোট হাঁসুয়াটা লিয়ে আয়।
জ্যেঠু পারবে নি।
খুব পারবে। গেল হপ্তায় পুন্যার গাছে উঠে আম পারছে।
মিত্রারা চোখ বড়ো বড়ো করেছে। ইসিরা মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
খগেনজ্যেঠু বক বক করে চলেছে।
পুন্যা আমায় এসে কইল খগেনদা কি করি বলো তো ?
তা আমি কইলি কি হছে বল।
তা কইল, অনি এতো বড়োটা হছে এখনো সেউ স্বভাব।
কিসের স্বভাব ক।
মো হরে গাছকে উইঠে আম পারতিছে।
তা আমি কইলি, ঔটা ওর স্বভাব লয় বুঝছু, লেসা। বড়ো হছে ঠিক, লেসা যায় নি। ঘরকে এলেই এউ সব গাছপালা দেখলি লেসা চাগাড় দেয়।
তা তুই এক কাজ কর।
কইলো বলো।
কইচাটাকে দিয়ে কিছু আম আর কঁতবেল ওর দরকে পাঠি দে।
মিত্রারা সকলে ফিক ফিক করে হাসছে। মিলি দেখলাম দিদির সঙ্গে ফিস ফিস করছে।
তারমানে ট্রানস্লেটার। দিদিও হাসছে।
খগেনজ্যেঠু মিত্রাদের দিকে তাকিয়েছে।
হ গো বৌমা। ওর আর চিকনার জালায় গ্রামে টেঁকা দায় ছ্যাল। মনামাস্টারকে কত নালিশ করছি। ওনকাকে কিছু কইলে হা সে সাঁওতাল মৌসুমি আর মেছুনী এসে গাল দিত। কইতো, তোর বংশে আউশা ধরু।
এখন অনি কততো বড়ো হচ্ছে। কততো তার নাম ডাক। মোদের গেরামের গব্ব।
কতো বড়ো বড়ো লোক, মিনেস্টেররা অনির জন্য এই গেরামে পায়ের ধুলো দেয়ঠে।
অখন কেউ চুরি করলে আর কিছু কই নি।
ভাবি অনি আর চিকনার মতো যদি দু-একটা এউ গেরামে জমমায়। এউ কইচাটার বাপ তো অনি বলতে অইজ্ঞান।
খগেনজ্যেঠু মিত্রাদের দিকে তাকিয়ে কোলের ছেলেটাকে দেখাল।
মিত্রাদের চোখের রং বদলে গেছে।
তুমি এদের জান না জ্যেঠু। এরা ভীষণ লোভী। তোমার সব গাছ থেকে একটু একটু ফল পাকড় ছিঁড়ে নেবে। আমি বললাম।
তা হউক।
নাত বৌ একটা ছোট ধানকাটার দা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। আমি ওর হাত থেকে দা-টা নিয়ে আঁখ বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম।
মিত্রারা কল কল করতে করতে পেছন পেছন আসছে।
মাঝে মাঝে চাপা হাসির শব্দ চারদিক ভেসে বেরাচ্ছে।
অনিদা বেশ মোটা মোটা।
পেছন ফিরে তাকালাম। টিন চোখ মেরে হাসছে।
দু-চারটে ছোট করে কেটে দিও পেটে ঢুকিও নেব। বাকি সব গোটা গোটা।
আমরা খাব না। তনু বলে উঠলো।
উঁ খেতে পেলে শুতে চায়। এইই জুটছিল না। কত কষ্টে ম্যানেজ হলো। মিলি বলে উঠলো।
একটা ফাউ পেলি। মিত্রা সামান্য গম্ভীর। চোখে মুখে রং ছড়িয়ে পড়েছে।
মিলি হেসে ফেললো। যে গাছে নারা দেবে কিছু না কিছু ফল পাবেই।
আমরা আঁখ বাড়ির মধ্যে ঢুকে পরলাম।
মিত্রাদি তোমরা আঁখ কাট, আমরা কটা বেগুন কুমড়ো তুলি। মিলি বললো।
যে যার মতো ছিটকে গেল। মিত্রা, তনু, দিদি আমার ছায়া সঙ্গিনী।
এক একটা আঁখের ঝাড়ে গোটা দশেক করে আঁখ রয়েছে। কোন কোন ঝাড় আমার মাথার সমান কোন কোনটা আমার মাথার থেকে একহাত উঁচু।
বুবুন।
পেছন ফিরে তাকালাম।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে। দেখলাম তনু, মিত্রা, দিদি ছাড়া একমাত্র টিনা রয়েছে।
সবার চোখেই অচেনাকে চেনার আনন্দ।
তুই গতকাল কোন দিক থেকে আঁখ চুরি করেছিলি।
আঙুল তুলে দেখলাম ওই মাথা থেকে।
একবার দেখাবি চল।
হাসলাম।
ও রকম করিস কেন চল না।
আমার পেছন পেছন আয়।
আমি আঁখ ঝারের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে একবারে নদীর কিনারায় চলে এলাম।
ওদের সেই ঝারটা দেখালাম, যেখান থেকে আমি আঁখ চুরি করেছিলাম।
এখনো আঁখ উবড়ে তোলার স্পষ্ট ক্ষতচিহ্ন গাছের গোড়ায় অক্ষত হয়ে রয়েছে।
ওরা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
তোকে কেউ দেখতে পায় নি।
সবেমাত্র ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল বছরের প্রথম বৃষ্টি, তাই কেউ আর বাইরে বেরোয় নি।
তুই আঁখ ভাঙলি কি করে।
এই যে আঁখের গিঁট গুলো দেখছিস হাঁটুর মাঝখানে রেখে একটু চাপ দিবি মট করে ভেঙে যাবে।
তুই একটুও কিছু ভুলিস নি, তাই না।
হেসে ফেললাম।
মিত্রা তনুর দিকে তাকিয়েছে।
তুই তুললি কি করে।
বৃষ্টি পড়ে মাটিটা নরম হয়েছিল। তাছাড়া আসার সময় একটা বাঁশের কঞ্চি ভেঙে এনেছিলাম। কঞ্চিটা দিয়ে গোড়ার মাটিটাকে একটু খুঁচিয়ে দিলাম। মাটিটা আলগা হয়েগেল। তারপর টেনে তুলে নিলাম।
কি করে করলি দেখা।
চুরি বিদ্যে শিখছিস। ভাল নয়। নেশা হয়ে যাবে।
হোক। তুই দেখা।
আয়।
একটু এগিয়ে, আমি বেছে বেছে একটা আঁখ ঝাড়ের নীচে থেবড়ে বসে পরলাম।
একটা মোটা মতো আঁখ ধরে একটু চাগাড় দিলাম। দেখলাম মাটিটা আলগা হয়ে গেল। হাতের দাটা দিয়ে গোড়ার মাটিটা সামন্য খসিয়ে টান মারতেই মাটি থেকে আঁখের কান্ডটা বেরিয়ে এলো। আঁখ ঝাঁড়ের বাঁধনটা সামান্য আলগা করে ঝাড় থেকে আঁখটা বার করে নিয়ে এলাম।
মিত্রারা হাসছে। ওদের চোখে বিষ্ময়।
তুমি তো পাক্কা চোর। শব্দ না করেই চুরি করতে বেশ পটু। তনু বলে উঠলো।
আমি চিকনা এরকম কতো চুরি করেছি।
এবার আঁখটাকে ভাঙ।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
আঁখটাকে হাঁটুর সাহায্যে মট মট করে তিনটে টুকরো করে দিলাম।
অনিদা। টিনা আমার দিকে তাকিয়েছে।
ওটাকে ছয় টুকরো করো।
কেন।
করো না। তারপর বলছি।
হবে না।
দা দিয়ে কাটো।
আমি একটু হেসে, দা দিয়ে টুকরো টুকরো করলাম।
আমার হাতে দাও।
মিত্রারা টিনার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি টিনার হাতে দিলাম।
টিনা জামা তুলে পেটে গুঁজতে শুরু করেছে।
করছিস কি! বুবুন বসে আছে। মিত্রা বলে উঠলো।
থাক। তুমি ওদিকে ঘুরে তাকাও। এদিকে দেখবে না। ভেবে নাও তুমি আঁখ তোলো নি।
টিনা আমার দিকে তাকিয়ে কট কটিয়ে উঠল।
তনু, দিদি হেসে গড়িয়ে পরে।
টিনা সাবধান। অভ্যাস নেই, কোথাও বেটক্কর খোঁচাখুঁচি লেগে যাবে। বটা বেচারা কান্না কাটি করবে। আমি বললাম।
করুক, তোমার কি। তুমি এবার গোটা গোটা কয়েকটা কাটো। প্রত্যেকের ভাগে একটা করে।
ওরা টিনার কান্ড কারখানা দেখে হেসে যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি করো। মিত্রাদি দেখোতো বোঝা যাচ্ছে।
দেখলাম টিনা জামাটা ধরে টানাটানি করছে। আমি হাসছি।
মিত্রা, তনু, দিদি তিনজনে তিনজনকে জড়িয়ে ধরে হেসেই চলেছে।
কাউকে বলবে না। বাড়িতে গিয়ে বার করবো।
দেখলাম আঁখ বাড়ির ভেতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বনি এসে হাজির।
মিত্রাদের ওরকম ভাবে হাসতে দেখে স্বাভাবিক ও একটু অবাক হয়েছে।
তুই এসে গেছিস বেশ করেছিস। টিনা বলে উঠলো।
ওরা কোথায় ?
ওরা ব্রিঞ্জল তুলছে।
অনিদা পটাপট আর একটা ভেঙে টুকরো করে দাও।
মিত্রারা হেসেই চলেছে। আমিও হাসছি।
আবার দাঁত বার করে। বলছি না ওরা আসার আগে ভেঙে দাও। বনি পেটে গুঁজে নিক।
টিনা তুই থাম। মিত্রা বললো।
থামবো কেন। পার্মিসন পেয়েছি। বেশি কিছু বললে আঁখ বাড়িটা কিনে নেব।
বনি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ওর চোখ মুখ দেখে বুঝছি।
আমি একটা আঁখ আবার ভেঙে টুকরো করে দিলাম।
বনি জামাটা তুলে পেটে গুঁজে নে।
বনি টিনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছে।
ননসেন্স বুঝতে পারছিস না।
বনি মাথা দোলাচ্ছে।
টিনা জামা তুলে বনিকে দেখাল।
এইভাবে। অনিদার দিকে পেছন ফিরে পেটে গুঁজে নে।
বনি হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পরলো।
মিত্রারাও কেউ গম্ভীর নেই।
বনি আমার দিকে পেছন ঘুরে পেটে গুঁজে নিল।
আঁখ বাড়িটা ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের জন্য একটা করে আঁখ তুললাম। সব গোটা গোটা।
আঁখ বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এলাম তখনো মিত্রারা হেসে চলেছে।
আমাদের দেখে মিলি চেঁচিয়ে উঠলো, মিত্রাদি বেগুন, সিম, গিমেশাক তুলেছি।
মিত্রা হাসতে হাসতেই বললো, বেশ করেছ।
তোমরা অতো হাসছো কেন বলোতো ?
মরতে গেছিলি কেন ওই পাশে। মিত্রাদিদের হাসি পাচ্ছে তাই হাসছে। টিনা বলে উঠলো।
তবু মিলিদের চোখমুখ থেকে বিষ্ময় যাচ্ছে না।
কাস্তেটা ফেরত দিয়ে আমরা সকলে আবার নৌকয় এসে উঠলাম।
মিত্রারা কনটিনিউ হেসে চলেছে।
মিলিরা লম্বা লম্বা আঁখ নিয়ে নৌকর গলুইতে বসলো।
তুই দেখলি না টিনা ও পাশে কতো বেগুন হয়েছে। লাউ, কুমড়ো, সিম, ঝিঙে….। মিলি বললো।
লাউ, কুমড়োই খা।
মিত্রাদের হাসি থেমে নেই। একবার করে বনি আর টিনাকে দেখে আর ফুলে ফুলে হেসে ওঠে।
আমি বাঁশের ঠেলায় নৌককে মাঝ নদীতে নিয়ে এলাম।
নৌক চলতে শুরু করলো।
সবাই বসেছে। টিনা, বনি দাঁড়িয়ে আছে।
কিরে টিনা বসে পর। কেমন হাওয়া দিচ্ছে দেখছিস, উল্টে যাবি। মিলি বলে উঠলো।
মিত্রা, তনু, দিদি জোড়ে হেসে উঠলো। সুরো কানে ফোন তুলেছে।
কিরে ছুটকি তখন থেকে তোরা তিনজন হেসেই চলেছিস হাসি আর থামছেই না।
ইসি চেঁচিয়ে উঠলো।
অনিও দেখছি মুচকি মুচকি হাসছে।
মিত্রাদির হাসার রোগ হয়েছে। টিনা গড়গড় করে উঠলো।
মিত্রা ইশারায় মিলির দিকে তাকিয়ে দেখাল, দেখ টিনা আর বনির পেটটা কেমন উঁচু।
খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি মিত্রাদি। টিনা বলে উঠলো।
মিলির চোখ গোল গোল। কিরে টিনা!
তোরা ওপাশে মরতে গেছিলি কেন। না গেলে ভাগ পেতিস।
তারমানে!
বনি, টিনা বুবুনের মতো….।
মিত্রার কথা শেষ হলো না। হাসির ছব্বায় চারদিকে অনুরণনের সৃষ্টি হলো।
গাঢ়ল অদিতি। মিলি চটাস করে অদিতিকে একটা চাপর মারলো।
আমি কি করলাম! অদিতি চেঁচিয়ে উঠলো।
বেগুন খাব, বেগুন খাব। খা বেগুন। মিলি মুখ ভেটকেছে।
বনি জামাতুলে সুরোকে দেখাচ্ছে।
ইসি চেঁচিয়ে উঠলো, ওরে অনি আছে।
থাকুক।
বনি আমাকে একটা দিস। সুরো চেঁচাল।
কেন ওই লম্বা একটা তোর জন্য অনিদা এনেছে।
এটার থেকে ওটার স্বাদই আলাদা।
কথা বলতে বলতে আমরা আমাদের ঘাটে চলে এলাম। ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বড়োমারা সব দল বেঁধে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে আবার একচোট হাসি।
সত্যি নাজমা তুমিও ওদের পাল্লায় পরলে। ছোটোমা চেঁচিয়ে উঠলো।
তখনো হাসি থামে নি। মিলি হাসছে ঠিক তবু ওর চোখে মুখে না পাওয়ার অভিব্যক্তি।
মিলি তুই বরং কনিষ্ককে নিয়ে….। মিত্রা বলে উঠলো।
দূর আমারটা যেমন একটা ঢেঁড়স, টিনারটা তেমনি ঘুম কাতুরে। আর অদিতিরটা গাড়ল গোবিন্দ। কিছু বললেই বলবে সবার সঙ্গে অনির তুলনা করলে চলবে।
আমি মিলির দিকে তাকিয়ে হাসছি।
তুমি একবারে হাসবে না। তুমি যত নষ্টের গোড়া। মিলি ঝাঁজিয়ে উঠলো।
কিরে মিত্রা, মিলি খেপেগেছে কেন ? ছোটোমা পাড় থেকে চেঁচাল।
চুরির ভাগ পায় নি।
দেখলাম কনিষ্ক-বটা হাসতে হাসতে নদীর বাঁধে বসে পরলো।
নীরু এগিয়ে এসেছে।
শ্রীপর্ণাকেও ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
নৌক ঘাটে ভিড়িয়ে টেনে ধরলাম।
নীরু বললো। ম্যাডাম লম্বা লম্বা লাঠিগুলো আমাদের দিন নিয়ে যেতে সাহায্য করি।
একবারে দেবে না মিত্রাদি আমরা কষ্ট করবো, ওনারা ভোগ করবেন। মিলি আবার ঝাঁজিয়ে উঠলো।
বাবাঃ ফোর ফর্টি। নীরু বলে উঠলো।
মিত্রাদের হাসি থেমে নেই।
অদিতি আঁখ গুলো দে, তুই আমি সুরো নেব, দেখি কে হাত লাগায়। মিলির গলায় সেই ঝাঁজ।
নীরু হাওয়া বেগতিক দেখে ওপরে উঠে গেছে।
আমি একে একে সবাইকে হাত ধরে ধরে নমালাম।
মিলির হাতটা ধরতেই খিঁচিয়ে উঠলো, দেবনা এমন।
যা বাবা ওকে মারছিস কেন। মিত্রা বলে উঠলো।
তুমি একবারে কথা বলবে না।
তনু, দিদি মিলির কান্ডকারখানা দেখে হেসেই যায়।
আজ আর কাউকে ধরতে হলো না। তর তর করে সকলে ওপরে উঠে গেল।
হাসির ঢেউ চারদিকে ম ম করছে। মিলি চিল্লাচ্ছে। অদিতি বার বার বলছে, অনিদা যে এরকম কান্ড করবে আমি কি করে জানবো বল।
আমি নৌককে নদীর পারের সঙ্গে ভাল করে গেঁথে ফিরে তাকালাম।
ওরে তোদের কি একটুও লজ্জা সরম নেই। কনিষ্করা আছে। বড়োমার গলা পাচ্ছি।
থাকুক, আমরা কি এখন কচি খুকীটি। টিনা চেঁচিয়ে উঠলো।
আর কিছু শোনা যাচ্ছে না শুধু হাসি।
ওপরে উঠে এসে দেখলাম মিলি দাঁত দিয়ে আঁখের ছিবড়ে ছাড়াচ্ছে।
আমার দিকে তাকিয়ে একবার বাঁকা চোখে হাসলো।
তোলা থাকলো এর শোধ নেব।
বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে সবাই লম্বা লাইন করে ফিরলাম। মাসীমনি, সোনাআন্টি, জ্যেঠিমনি বার বার আমার দিকে তাকায় আর হাসে। ওরা ও বাড়িতে গেল আমি এ বাড়ির পথ ধরলাম।
চা খাবি না। বড়োমা পেছন থেকে ডাকল।
ভিঁজে জামা-কাপরটা ছারি।
আমি আমার বাড়ির পেছন পাশ দিয়ে ঢুকলাম।
সকালবেলা যে কাদা কাদা ভাবটা ছিল এখন অনেকটা শুকিয়ে গেছে। প্যাচ প্যাচানি ভাবটা আর নেই। আর ঘণ্টা দেড়েক আকাশটা এরকম ঝক ঝকে থাকলেই মাটির ওপরের অংশের জলটা টেনে যাবে।
নিচের বারান্দায় রান্নাঘরের সামন দেখলাম একবালতি জল রাখা আছে।
আগে দেখি নি। মনে হয় ছেলেমেয়েরা নিচে থাকার জন্য এই উপকরণের আমদানী।
আমি একমগ জল নিয়ে পা ধুয়ে নিলাম।
নিচের ঘর সব বন্ধ। তারমানে ছেলেময়েরা কোথাও বেরিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম।
ঘরটা বেশ পরিষ্কার করে গোছান। বিছানায় একটা খুব সুন্দর চাদর টান টান করে পাতা।
এদিক ওদিক তাকালাম আমার গামছা দেখতে পাচ্ছি না। আলনা থেকে একটা টাওয়েল নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবীটা খুলে ফেললাম। টাওয়েলটা সবে কোমরে জড়িয়েছি দরাম করে দরজাটা খুলে গেল। তনু-মিত্রা এসে হাজির।
কিরে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলাম না।
সব সময় শব্দ করে উঠতে হবে তার কি মানে আছে। মিত্রা দরজার অর্গলে হাত দিয়েছে।
ওটা কি করছিস!
তনু এসে সটাং আমার টাওয়েল চেপে ধরেছে।
খুব খুশিখুশি মনে হচ্ছে।
ভীষণ। মিত্রা কাছে এসে জড়িয়ে ধরে গালে চকাত করে একটা চুমু খেয়ে নিল।
তনু আমার ঠোঁটটাতে একবার ঠুকরে দিল।
আরি ? সক্কাল সক্কাল গরম খেয়ে আছো মনে হচ্ছে।
সক্কাল সক্কাল নয় কাল রাত থেকে।
মিত্রা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
একটু আধটু খারাপ হলে ক্ষতি নেই।
সকাল থেকে একফোঁটা চা পেটে পরে নি।
এইতো এখন পরবে। ও বাড়িতে সবাই সাজিয়ে গুছিয়ে বসছে।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
দিদি এখন সেই চোখটা উধাও।
দেখি দেখি। মিত্রা আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
ঠিক ধরেছিস। চোখ গেল চোখ গেল বলে চেঁচা।
চেঁচালেও ফিরে আসবে না। তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
যততো সব পাগলের প্রলাপ।
ঠিক আছে আমরা দুজনে পাগল, দিদি নিশ্চই পাগল নয়। টিনা, বনি নিশ্চই পাগল নয়।
আমাকে একটা পাজামা-পাঞ্জাবী দে পরি। কেউ এসে পরলে বিপদ।
কেউ আসবে না। সবাই ও বাড়িতে জমিয়ে গল্প করতে বসেছে।
ওদের দিকে তাকালাম খুশিতে ওদের চোখ মুখ চক চক করছে।
আজ তোকে এতো ভাললাগছিল কি বলবো। বার বার মেয়ের কথা মনে পরে যাচ্ছিল।
কেন ?
তুই যখন আঁখটা তোলার সময় আমাদের বোঝাচ্ছিলি। তখন তুই অনি নোস, সত্যিই তুই বুবুন। গ্রামের নিপাট একটা হাবা-গোবা ছেলে, সহজ সরল সাধারণ। তোর অবচেতন মনের ছবি তখন তোর চোখে মুখে। তুই যেন তোর শৈশবে ফিরে গেছিস। আমরা সবাই যেন এক একজন চিকনা।
আমি দিদিকে বলেছিলাম দেখবে ওকে তখন আমি খোঁচাব ও বাধ্য ছেলের মতো আমার কথা শুনবে। আমাকে বোঝাবে। যতক্ষণ না বুঝছি ধৈর্য ধরে বোঝাবে।
ওদের আমি তোর স্কুলের কথা বলেছি, বকুল বাঁশি তৈরির কথা বলেছি। এও বলেছি, এতো ঝড় ঝাপ্টা ওর ওপর দিয়ে গেছে, তুমি দেখ ঠিক ওই মুহূর্তে ও যেন কেমন হয়ে যায়। একবারে অন্য মানুষ। তখন তুমি বুবুনকে চোখের সামনে যে ভাবে দেখছো ঠিক তার উল্টো।
না রে, ঠিক তা নয়।
আমার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
ছোট থেকে আমার কোন বন্ধু ছিল না। বাপ-মা মরা ছেলে, কাকা চোখের আড়াল করতে চাইত না। আমার পাহাড়াদার মৌসুমী মাসি। তারও নিজের কিছু কাজ থাকত। আমি সর্বক্ষণ মৌসুমী মাসির পেছন পেছন। মাসি পুকুরে স্নান করছে, আমি গাছ, পাখির সঙ্গে কথা বলছি।
মাসি টবায় ছেনি জালে মাছ ধরছে। আমি মাছ বেছে বেছে ঘটিতে রাখছি।
মাসি ধানখেতে নেমে ধান গাছের গোড়ার আগাছা বাছছে। আমি ইঁদুরের গর্তে বেড়া কলমির ডাঁটা ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইঁদুর বার করার চেষ্টা করছি। একটা ইঁদুর হয়তো বেরিয়ে ছুটে পালাল, আমি অনন্দে লাফিয়ে উঠলাম।
একটু বড় হতে এক-পা দু-পা করে বেরতে শিখলাম। গাছে চড়তে শিখলাম।
এর গাছের আম, তার গাছের জামরুল তখন হাতের নাগালে। ধরা না পরার জন্য নিত্য নতুন বুদ্ধি এ্যাপ্লাই করতাম। দেখতাম সব ক্ষেত্রে জিতে যাচ্ছি। কেমন যেন নেশায় পেয়ে বসলো।
কাকার মারকে বেদম ভয় পেতাম। তবু নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ। কিছুতেই ভুলতে পারতাম না। সেই সব স্মৃতিগুলো মগজে এখনো খোদাই হয়ে আছে।
চেষ্টা করলেও কিছুতেই পলি পড়ে না।
(আবার আগামীকাল)