২১৫ নং কিস্তি
তনু একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।
ব্যবস্থা করতে হবে না। সবাই আসছে।
কেন!
এলেই জানতে পারবে।
আমাদের একবার ম্যাসেজ করতে পারতিস। মিত্রা এসে পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে শুরু করলো।
আমি চুপ করে রইলাম।
আজ মেয়ের চোখে আমার একুশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কয়কটা দিন খুঁজে পেলাম।
মিত্রার গলায় আবেগের সুর। তনুর চোখে খুশির ঝিলিক।
আমি তবু কিছুটা তোকে পেয়েছি। তনু কিছুই পায়নি।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে।
চোখের পাতা থিরি থিরি করে কাঁপছে। আয়ত চোখ আমার চোখে রাখলো। তনু পাশে দাঁড়িয়ে।
ওরা আজ ওদের বাবা, মামা, মশাই, আঙ্কেলকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। এই মানুষটা যে ওদের কাছে একবারে অচেনা অজানা মানুষ। সচরাচর এই মানুষটাকে দেখা যায় না। আজ ওরা একান্তভাবে অনুভব করলো। মাঝখান থেকে আমি, তনু কাঠ গোড়ায় দাঁড়ালাম।
আমি দুজনকে বুকে টেনে নিলাম।
বিশ্বাস কর।
ঠিক এই জায়গাটা ওদের বোঝাতে পারি না বুঝলি বুবুন। তোদের বাবা, মামা, মশাই, আঙ্কেল আমাদের খুব কাছের, তবু যেন মনে হয় ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। ঠিক ওই মুহূর্তে ও আমাদের দুজনের থেকে শতেক যোজন দূরে থাকে।
আষাপুরা স্কুলে সেই ছোট্ট জানালাটায় বসে তোর চোখ দেখেছিলাম। আজ মেয়ে দেখলো।
পশ্চিম আকাশের কালো মেঘটা তখন….।
তনু আমার ঠোঁটে ঠোঁটটা চেপে ধরলো। খিল খিল করে হেসে উঠলো।
দেখ দিদি ওর চোখ দুটো দেখ, যেন কতো অপরাধ করে ফেলেছে।
জানিস বুবুন ঠিক এই জায়গাটায় আমরা দু-জনেই মরেছি। সেটা ওদের বোঝাই কি করে বলতো।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
আর ভুল হবে না।
সারা জীবনে তুই প্রায় একলক্ষ বার এই কথা বলেছিস।
মিত্রা।
নিচ থেকে ছোটোমার গলা পেলাম। দুজনেই আমাকে ছেড়ে দিল।
তোরা ওপরে?
হ্যাঁ।
নাজমা এসেছে। অনি কোথায়?
এখানে আছে। এসো।
আমি আলমাড়ির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি দিয়ে চুলটা আঁচড়াতে শুরু করলাম।
দিদি, ছোটোমা ওপরে উঠে এলো। ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।
কিরে, তুই কোথায় যাবি!
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। তনু হাসছে।
তুমি আর আগুনে ঘি দিও না। মিত্রা বললো।
মানে!
একটু আগে যুদ্ধ করছিলাম।
কেন বলবি তো!
এই পাজামা-পাঞ্জাবীটা পরছিল। মিত্রা আলনায় রাখা পাজামা-পাঞ্জাবী দেখাল।
ছোটোমা হেসে উঠলো, দিদিও হাসছে।
বলে কি থাকবো তো এই ঘরে, ম্যাক্সিমাম ওই বাড়ি…।
তোমায় কি বলছিলাম নাজমা।
ছোটমা আমার দিকে তাকাল, সাত জন্মের চস্বর।
দিদি শরীরে ঢেউ তুলে হাসছে।
চা খাবি?
আমি তনুর দিকে তাকালাম।
আমাকে এরি মধ্যে বলা হয়ে গেছে। বলেছি একটু পরে সব এই বাড়িতে আসছে।
অনিমেষদা সেই জন্য পাঠাল। দেখো দিখিনি বাবুর বর্তমান অবস্থান।
কেন ওখানে আড্ডা জমছে না। আমি বললাম।
তোকে ছাড়া আড্ডা জমে। দিদি, সামন্তদার গুষ্টির তুষ্টি করে ছেড়ে দিচ্ছে।
রেসিপিটা তাহলে ভালো জমেছে কি বলো?
হ্যাঁ।
ছোটোমা হাসছে।
তোর সঙ্গে এখন কথা বলা যাবে না।
কেন?
অনেক কাজ।
তোমার!
বড়া ভাজতে বসিয়েছি।
খাওয়ার জন্য আমি রেডি।
ছোটোমা বেরিয়ে গেল। দিদি হেসেই যাচ্ছে।
তুমি হাসছো কেন।
আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারতিস।
তনু জোরে হেসে উঠলো।
ঠিক আছে কালকে নিয়ে যাব।
কালকে বৃষ্টি পড়বে?
এই সময়টা বৃষ্টির সিজিন।
বসির আজ তোকে দেখে ভীষণ ইমপ্রেসড। ওর এখনও বিষ্ময়ের ঘোর কাটে নি।
আমি দিদির দিকে তাকিয়ে।
বার বার তোর দাদাকে বলছে। অনিমামাকে এতো কাছ থেকে আগে কখনো দেখিনি। আমার কাছে অনিমামা আজ সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ। ভীষণ লাইভ।
দিদি এক নিঃশ্বাসে বলে চলেছে।
তুমি এখানে একটু জায়গা কিনে অনিমামার মতো একটা বাড়ি বানিয়ে দাও। এখানে থেকে যাই।
আমি হাসছি।
তুই আজ আবার গাছে উঠেছিলি?
ওরা খেঁজুর পেড়ে দিতে বললো।
সেই জন্য গাছে উঠে পরলি!
আমি হাসছি।
আর কোনও দিন উঠবি না। দিদির কণ্ঠে স্নেহের ধমক।
তোমার জায়গাটা কেমন লাগছে?
এতো নির্জন আগে কখনও দেখিনি। কতো গাছ। ঝড়টা যা উঠেছিল না। আমরা সবাই ওই সামনেটায় দাঁড়িয়ে একটু ভিঁজলাম।
দিদির চোখ মুখটা ঘন ঘন বদলে যাচ্ছে।
এখানে আসার আগে মিত্রা বলছিল।
মিত্রা, তনু দুজনেই দিদির দিকে তাকিয়ে। দিদি কলকল করে চলেছে।
আগে কখনও মাটির বাড়ি দেখিনি। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যি অবাক হয়েছি। দোতলা মাটির বাড়ি!
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম এবার সকলে আসছে।
জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। আকাশের মুখ ভার সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
এইবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
কিরে শরীর মন সব ঠিক আছে?
বিধানদা ঘরে ঢুকলো। পেছন পেছন সবাই। দেখলাম মাসীমনিও এসেছে।
বড়োমা ঘরে ঢুকে তনুদের দিকে তাকাল।
তোরা বলেছিলি?
কি! মিত্রা বললো।
গাছে উঠেছিল কেন?
তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেন উঠেছিল জিজ্ঞাসা করো?
আমি ওর বউ হলে দু-দিনে ঢিঁট করে দিতাম।
তনু, মিত্রা দু-জনে শরীরে ঢেউ তুলে হেসে উঠলো। ওদের হাসির ছোঁয়া সবার ঠোঁটে।
ভাগ্যিস তুমি অনির বউ হও নি। তাহলে ইতিহাসটাই আলাদা করে লেখা হতো।
দাদা বলে উঠলো।
তোমাকে কথা বলতে বলেছি। বড়োমা ধমকে উঠলো।
সবাই হাসছে। আমি খাটে বসলাম।
বড়োমা এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলো। আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বড়া ভেজেছো।
ছোটো ভাজছে, নিয়ে আসছে।
ডাক্তারদাদা, সোনাআন্টি হেসে উঠলো।
ওমা দুটোতে কেমন ঢেউ তুলে তুলে হাসে দেখো।
বড়োমার কথায় আমিও হেসে ফেললাম।
বল না।
কি বলবো।
সবাই হাসাহাসি করছে, বড়োমার কোনও তাপ উত্তাপ নেই।
একবার পীরবাবার ওখানে নিয়ে যাবি।
এই বৃষ্টিতে!
না। কাল।
রোদ উঠুক। মাঠ ঘাট এখন কাদা প্যাচপেচে। যেতে গেলে আছাড় খাবে।
কেন চিকনা বললো, সব মোরাম ফেলা হয়ে গেছে।
চিকনাকে নিয়ে যেতে বলো।
বড়োমা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তোকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি এদের নিয়ে চলে যেতে পারবো।
রাস্তায় শেয়াল আছে। পক্কেকে তাড়া করেছিল।
কখন!
নদীর ধার দিয়ে যখন ফিরছিলাম।
দেখছিস মিত্রা, কি তেঁদর ছেলেপুলে। এত কথা বললো, এই কথাটা বলে নি!
মিত্রা হাসছে।
ও আফতাব তুমি কি বলছিলে বলো অনিকে।
আফতাবভাই হাসছে।
আজ তুমি ঘটক। আমি বড়োমার দিকে তাকালাম।
বড়োমা হাতটা তুললো কানটা ধরার জন্য, আমি জড়িয়ে ধরলাম।
কিরে আদর শুরু হয়ে গেছে। ছোটোমা ঘরে ঢুকে মিত্রার দিকে তাকিয়েছে।
পেছনে দেখলাম বৌদি রয়েছে ইসি, মিলি, টিনা, অদিতিও রয়েছে। সবার হাতেই কিছু না কিছু রয়েছে। বুঝলাম আমিষ, নিরামিষ ভাগ করা।
জমাট আসর বসার সাজ সরঞ্জাম চলে এলো।
ছোটো, বড়া এনেছো। ডাক্তারদাদা বললো।
এনেছি। মিলি।
বলো।
আলাদা আলাদা করে রাখ। ছোঁয়া ছুঁয়ি যাতে না হয়।
আচ্ছা।
আরে! এতো বড়া বড়া করে পাগল করে তুললো। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
তুমি এর মর্ম কি বুঝবে।
আমি বুঝব না কি তুমি বুঝবে।
মিলির হাত থেকে নিয়ে ছোটোমা সেন্টার টেবিলে আলাদা আলাদা ভাবে সব রেখে গোছাচ্ছে। আমি একটা বড়া তুলে বড়োমার মুখের সামনে ধরলাম।
বড়োমা হেসে ফেললো।
ডাক্তারদার আগে তুমি একটা মেরে দাও।
সবাই হাসে।
বড়োমা হাফ নিল আমি হাফটা নিজের মুখে ঢুকিয়ে দিলাম।
মীর আবার এততো মাছ এনেছে। ওই পাশে কোথায় জাল ফেলেছিল। বড়োমা বললো।
কি মাছ?
তুই যে চুনো ধরে এনেছিস ওই রকম।
বাছছে কে?
নীপা দেখিয়ে দিয়েছে। ভজা আর ভেঁদো দুজনে বাবু হয়ে বসে গেছে।
ছোটোমা সকলকে চা এগিয়ে দিল। আমাকেও দিল।
চায়ে চুমুক দিয়ে হাসিমাখা চোখে রাঘবনের দিকে তাকালাম।
ডাক্তারদাকে দিয়ে নিজের কাজটা বেশ গুছিয়ে নিলে। তোমার ফাইলটায় সই হয়েছে?
রাঘবন কোনওপ্রকারে সেন্টার টেবিলে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে, থলথলে শরীরটা কাঁপিয়ে জোরে হেসে উঠলো।
রাঘবনের ওই রকম অট্টহাসিতে সকলে অবাক। সবাই সবার মুখের দিকে তাকায় আর রাঘবনের মুখের দিকে তাকায়।
আমি মিটি মিটি হাসছি।
অতো হাসলে চলবে। ভাবী বসে আছে। মেয়ে, জামাইকে ডেকে খবরটা দাও।
রাঘবন হাসতে হাসতেই বললো, তুই বহুত নম্বরী আছিস।
সবার চোখেই বিষ্ময় একবার আমার দিকে একবার রাঘবনের দিকে তাকায়।
অনি ব্যাপারটা কি! বিধানদা বললো।
আমি হাসছি। রাঘবনের দিকে তাকালাম।
কালকে থেকে বহুত কপচেছো। ওয়ান সাইড গেম খেলে বেড়িয়ে গেছ। এবার নিজের মুখে খবরটা খোলশা করে বলো।
তুই থামবি।
কেন থামবো।
তুই ঠিক খবর পেয়েগেছিস। রাঘবন চায়ে চুমুক দিয়ে আবার হেসে ফেললো।
সেটা তুমি ভাল করেই জান।
রাঘবন, ব্যাপারটা কি? আফতাবভাই তাকাল।
যতো সব ভুল ভাল কথা।
তাহলে তুমি ওর কথায় সায় দিচ্ছ কেন?
ভাবী তোমার থেকে দুটো ডালের বড়া দাও তো। আমি বললাম।
দাঁড়া তোর কাছে গিয়ে বসি।
মিত্রা উঠে ভাবীর জায়গায় গেল ভাবী আমার পাশে এসে বসলো।
চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। ভুরু নাচিয়ে বললো, কি হয়েছে রে?
রাঘবনের দিকে তাকালাম।
এবার বুঝছো। আর তর সইছে না। এবার পাশে বসে পাকরাও করেছে। আমি কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব।
বনি আর নাগেশ দরজার মুখে উঁকি মারলো।
কি গো বৌদি! হঠাৎ ম্যাসেজ! বনি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
বোস। তোর বাবা আর অনিদার ডুয়েট শুরু হয়েছে।
কেন!
কাল একটা গল্প শুনেছিলি। আজ আর একটা গল্প লেখা শুরু হয়েছে।
যাঃ! বনি হাসছে।
দেখছিস না। মা উঠে বুবুনের পাশে চলে গেছে।
সত্যি! বনি বাবার দিকে তাকাল।
না রে মা।
তাহলে তুমি বৌদির কথার প্রতিবাদ করছো না কেন?
সময় হয় নি তাই।
নাগেশ তুমি কিছু জানো। বনি, নাগেশের দিকে তাকাল।
না। যা জেনেছি তোমাকে কাল বলেছি।
আমি বনির দিকে তাকালাম।
আমি বলবো, কি দিবি।
পেটে একটা ঘুসি দেব। মুখ থেকে চা, বড়া দুটোই গলগল করে বেরিয়ে আসবে।
দেখ কথার ছিড়ি। বড়োমা বললো।
অনিমেষদা, বিধানদা মাথা দুলিয়ে হাসছে।
সরোতো একটু—বনি সবাইকে টপকে পা উঁচিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো।
দাঁড়া দাঁড়া শেষ চুমুকটুকু দিয়ে নিই। না হলে গায়ে পড়ে যাবে।
আগে বলো।
আমি ঠোঁটে কাপটা ছোঁয়ালাম। বনি আমার দিকে তাকিয়ে।
বড়োমাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বনির দিকে কাপটা এগিয়ে দিলাম।
আগে এটা রাখ।
বনি ভাল মেয়ের মতো কাপটা নিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখল।
রাঘবন আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।
বনি আমার পায়ের কাছে হাঁটু মুরে বসে পরলো।
কনুই দুটো আমার দুই থাইতে ভর দিয়ে গালে হাত রেখে আমার মুখের দিকে তাকাল।
খুব ইন্টারেস্ট না।
হাতের কনুই দুটো কোথায় আছে দেখেছো।
দেখেছি।
থাই ফাটিয়ে দেব।
সে তুই সব সময় দিচ্ছিস।
বলো না।
আমি নীচু হয়ে বনির কানে কানে বললাম। তোর বাবা প্রাইমিনিস্টারের সচিব হয়েছে।
সত্যি!
আমি মাথা দোলালাম।
মুহূর্তের মধ্যে বনির চোখ দুটো চক চক করে উঠলো। আমার পায়ের কাছ থেক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমার গলা জাপ্টে ধরে আমার কোলে বসে পরলো।
হাম হুম করে আমারে কপালে চোখে গালে পাগলের মতো চুমু খেতে শুরু করলো। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। খাটে ধুপুস করে পড়েগেলাম। বনি আমাকে জাপ্টে ধরে আমার বুকে আছড়ে পড়লো।
তখনও ও হালুম হুলুম করে চলেছে।
বড়োমা রে রে করে উঠলো।
করছিস কি তোরা। বেচারা রুগনো মানুষ কোথাও লেগেটেগে যাবে আবার।
বনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। খুশিতে ওর পরিতৃপ্ত চোখ-মুখ।
দিলি তো আমার সারা মুখে থুতু লেপে।
নিজেই বুক থেকে ওর্ণাটা টেনে নিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিল।
আনন্দের আতিশয্যে আবার একবার আমার কপাল ঠুকরে দিল।
বহুত ঝামেলা করছিস।
আমার বুকে শুয়েই নাগেশের দিকে তাকাল।
নাগেশ।
নাগেশ বনির দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে।
বনি বুড়ো আঙুল দেখাল।
সত্যি! নাগেশের চোখ চক চক করে উঠলো।
দাঁড়াও আমি সুরোদিকে খবরটা দিই। একমাত্র সুরোদিই হিন্টস দিয়েছিল।
নাগেশ ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেল।
বনি আর কিছুতেই উঠছে না।
উঠবি, আমার পেট ফেটে যাবে।
যাক।
বনি আমার শরীরে ভর দিয়ে উঠে বসলো।
বড়োমা, বনির দিকে তাকিয়ে। মিত্রারাও তাকিয়ে আছে বনির দিকে। ঘরের সবার চোখে বিষ্ময়।
বনি বাবার মুখের দিকে তাকাল। তুমি এতো বড়ো খবরটা….।
বড়োমার গলা জড়িয়ে কানে কানে বলে দিল। তারপর নিজের মার গলা জড়িয়ে বলে দিল।
ও অনিমেষ বনি বলে কি!
ততক্ষণে মা-মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে। রাঘবনের দিকে তাকিয়ে আছে।
কি বলবে তো! বেশ বুঝলাম অনিমেষদার গলায় উত্তেজনার পারদ।
রাঘবন নাকি প্রধানমন্ত্রীর সচিব হয়েছে।
এ্যাঁ। বিধানদা বলে উঠলো।
এবার সবার চোখের রং বদলে গেল।
আফতাবভাই অবাক চোখে রাঘবনের দিকে তাকিয়ে।
রাঘবন উঠে ডাক্তারদাদা, সোনাআন্টি, মাসীমনিকে প্রণাম করে এদিকে এগিয়ে এলো।
দাদার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললো।
বিশ্বাস করুণ সকালে এরকম একটা ম্যাসেজ পেয়েছি। অফিসিয়ালি এখনও আমাকে জানান হয়নি। আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। হয়তো দিল্লীতে গেলে আমাকে বলা হবে।
দাদা রাঘবনের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
কাল রাতে তুমি একরকম গল্প শোনালে। আজ একরকম গল্প শুনছি। এটা তো হঠাৎ করে ডিসিসান হওয়ার নয়।
আমার একটা প্রমোশন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই জায়গায় প্রমোশন হবে আশা করিনি।
তুমি কালকে বলেছিলে ও তোমার কোনও ক্ষতি করে নি। বরং উপকার করে। এটা কি সেইরকম কোনও উপকার?
রাঘবন হেসে ফেললো। অনিমেষদা, বিধানদাও হাসছে।
ডাক্তার। দাদা বলে উঠলো।
বলো।
তুমি কালকে যে কথাটা রাতে শুয়ে শুয়ে বলছিলে, তাহলে সেটা মিললো।
তোমার সব তাইতে বেঁড়ে ওস্তাদি।
মিত্রা, তনু, ইসি জোরে হেসে উঠলো।
আজ বাদে কাল তুমিও ঘাটে যাবে, আমিও যাব।
আচ্ছা তুমি কখনও মাপজোক করে হাঁটা চলা করেছো, কথা বলেছো? বলতে পারো, তোমার ডাক্তারীশাস্ত্রে কাটা-ছেঁড়াটা তুমি মাপজোক করে করেছো। দাদা বললো।
অনি নিজেও একটা বড়ো ডাক্তার। তবে আমার মতো নয়। এই কথাটা তোমাকে বহুবার বুঝিয়েছি। নতুন করে বলতে হবে। ডাক্তারদাদা বললো।
না। এখানেও তাহলে গিভ এন্ড টেক পলিসি। যা ও অনিমেষ, বিধানবাবুর সঙ্গে করে।
মাসীমনি, জ্যেঠিমনি, সোনাআন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন রাঘবন, এবার বসো। দাদা রাঘবনের দিকে তাকাল।
রাঘবন নিজের জায়গায় বসলো।
তবু ওর বড়োমাকে টুক টুক করে দু-চার কথা বলে। আমাকে পাত্তাই দেয় না।
কেন তোমার হিংসে হচ্ছে। বড়োমা দাঁতে দাঁত চেপে খিঁচিয়ে উঠলো।
ঘরে এবার হাসির ঢি ঢি পড়ে গেল।
তোমাকেও বলি, তুমি ওর কথা একবারে সহ্য করতে পারো না। ডাক্তারদাদা হাসছে।
কেন তোমার বন্ধুকে বলতে পার না। ওরকম চিমটি কাটা কথা বলে কেন?
চুপ করে থাকলেই পার।
কেন চুপ করে থাকতে যাব। ওর খাই না পরি।
বিধানদা হাসতে হাসতে হাত তুলেছে, এবার তুমি থামো।
বনি ওর মাকে ছেড়ে আমার গলা জড়িয়ে পাশে বসে পরলো।
মিত্রা, তনু হাসছে ঠিক কিন্তু ওদের চোখ মুখ বলছে ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
সুরো ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই সবাইকে টপকে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
আমার মাথাটা জাপ্টে ধরে নিজের শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিল।
আচ্ছা তোরা কি শুরু করেছিস বলতো। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
তোমার ছেলেকে বলতে পারছো না। সুরো তার ওপর চেঁচাল।
বড়োমা হেসে ফেললো।
কি দাপট দেখেছিস। মনেহয় বৌদির গলা পেলাম।
বনি তুমি ওই ঠ্যাংটায় বসো আমি এই ঠ্যাং-এ।
সুরো দেখিস। মিত্রা বললো।
তোমার কোনও ভয় নেই। অক্ষত থাকবে। দুজনে একটু গোঁতাগুঁতি করে নিই।
মিত্রা, তনু দুজনেই জোরে হেসে উঠলো।
ওদের দুজনের আদরের ঠেলায় আমার নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে।
সুরো আমার নাক টেপে তো বনি আমার গাল খামচায় মুখ চিপে ধরে।
ম্যাসেজটা কাল এসেছিল। সুরোর কপট গম্ভীর স্বর।
আমি কিছুটা গঁ গঁ করলাম।
বনি মুখটা ছাড়ো। আমি ঠিক কথা বার করে নেব।
আমার পায়ে লাগছে।
লাগুক। আগে সবার সামনে সত্যি কথা বলবে?
না।
নাক টেনে ছিঁড়ে দেব।
নিঃশ্বাস নিতে পারব না, মরে যাব।
নাক না থাকলে কেউ মরে না। মুখ দিয়ে নেবে।
বুঝতে পারছি ঘরের সকলে ওদের কীর্তি-কলাপ দেখে হাসছে।
ওরে তোরা কি করছিস!
ইসলামভাই-এর গলা পেলাম। বুঝলাম খবরটা ছড়িয়ে গেছে।
একবারে কথা বলবে না দাদাভাই। তেঁদরের হাড়। কাল রাত থেকে জাল ফেলা হচ্ছে।
না ফেল নি।
ফেলো নি—দেখাচ্ছি মজা, সুরো আরো জোরে নাকটা চেপে ধরলে।
আর ব্যক্তিটি কে?
জানি না।
আমি সুরোকে কাতাকুতু দিতে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। বনি হাতটা চেপে ধরলো।
কে ব্যক্তিটি কে?
জানি না।
সব জেনে ফেলবে।
সুরো আমার পেট চিমটে ধরলো। আমি সুরো, বনির কোস্তাকুস্তির চোটে হেসে যাচ্ছি।
আগে ছাড়।
বলে ফেল ছেড়ে দেব।
তোর বড় জানে।
বড় জানে, শুভ জানে শুধু বনি, সুরো জানে না। বনি, সুরোকে জানতে হবে।
আ আ লাগছে লাগছে লাগছে। বলছি।
আগে বলো।
আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে।
আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেব। আগে বলো।
আর রাঘবন। কে হচ্ছে কৃপা।
ওদের দুজনের আদরের যন্ত্রণায় ঘরের কারুর মুখ দেখতে পাচ্ছি না।
কৃপা কে—বিনোদ না অর্জুন?
একটা লোক।
সে তো বুঝলাম। নতুন আমদানী। লোকটা কে?
একটু জল দে।
জল দেব, চা দেব, বড়া ভেজে দেব।
ছাড় না। ও তো বলবে বলছে। বড়োমা বললো।
এতক্ষণ তেল দিচ্ছিলে, বার করতে পেরেছিলে। সুরো আবার ঝামটে উঠলো।
তুমি এর মধ্যে ঢুকছো কেন। ওটা ওদের ভাইবোনের ব্যাপার। বৌদির গলা পেলাম।
কোথায় লেগেটেগে যাবে।
লাগুক।
বুঝতে পারছি ঘরের সকলে ওদের রকম সকম দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ও পিসি তুমি বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করছো। মেয়ের গলা পেলাম।
আগে দেখিসনি, এখন দেখ। চিমটি কেটে তোর বাবার গায়ের মাংস সব খুবলে নেব।
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও, রোগা পেটকা শরীর।
রোগা পেটকা শরীরে কিরকম খেলটা দেখাচ্ছে বুঝছিস না। আমরা টেনসনে মরি। উনি ওনার তালে। আগে বলো, কৃপা কে?
একজন স্টেনোগ্রাফার।
ওটাকে আবার কি কাজে লাগিয়েছ। আমার বড়ের মতো না শুভর মতো।
কোনও কাজে লাগাই নি।
থাকে কোথায়?
দিল্লীতে।
এই ভদ্রলোক তোমায় খবর পাঠিয়েছিল রঘুআঙ্কেলের ফাইলে সই হচ্ছে?
বুঝতে পারছি আমার কথায় ঘরে হাসাহাসি হলেও কেউ কেউ নড়ে চড়ে বসেছে।
ও চিঠি টাইপ করেছিল।
সুরো নাকটা ছেড়ে দিল। আমার মুখটা ওরে বুকে চেপে ধরলো।
ভীষণ জ্বালা করছে।
স্নেহের আঁচল দিয়ে আমার জল ভরা চোখ মুছিয়ে দিল। দুজনেরি চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।
জুতো মেরে গরু দান।
তবু তো দিচ্ছি। তুমি তো তাও দাও না। জোর করে না চাইলে তোমার কাছে কিছুই পাওয়া যায় না। সব সময় তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হয়।
আমি দুজনকে জড়িয়ে ধরেছি।
কালকে ম্যাসেজটা পড়ার পর ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কাউকে বলি নি। একমাত্র আমি, নাগেশ, বনি জানতাম।
কখন পড়লি!
তুমি খেতে খেতে চলে এলে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর রঘুআঙ্কেল বললো, বনি একবার দেখতো অনি ঘুমচ্ছে কিনা।
বনির পেছন পেছন আমি এলাম। ঘর অন্ধকার। পাখাটা বন বন করে ঘুরছে।
তুমি খাটে শুয়ে আছ।
পা টিপে টিপে তোমার কাছে গেলাম। অনেকক্ষণ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
দেখলাম তুমি অভিনয় করছো না, সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছো। মাথার শিয়রে মোবাইলটা ব্লিঙ্ক করে যাচ্ছে। একটু অবাক হলাম। তুমি ঘুমচ্ছ তোমার মোবাইল খোলা। ব্যাপারটা কি!
মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম। দেখলাম একটা ম্যাসেজ এসেছে।
লোভ সামলাতে পারলাম না। খুলে ফেললাম। মাত্র কয়েকটা শব্দ। আর-এর ফাইল সই হয়েছে কে। সেণ্ডার যিনি তার ফোন নম্বরটা এখানকার নয়। কোড নম্বর। দেখে বুঝলাম নম্বরটা বাইরের।
ভয় পেয়েছিলি কেন?
তুমি তো ছাগলকে আদর করে পেট পুরে কাঁঠালপাতা খাওয়াও। তখন সে বুঝতেও পারে না সময় হলেই তাকে তুমি হাঁড়ি কাঠে চড়িয়ে বলি দেবে।
সুরোর গালটা টিপে দিলাম।
বিশ্বাস করি কি করে। এমন ঘটনা চোখে দেখেছি যে।
আমি সুরোর দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।
হয়তো আমি কোনও দিন আমার অজান্তেই কোনও অন্যায় করে ফেলবো, আমাকেও এইভাবে বলি দেবে।
এইবার বারাবারি শুরু করলি।
বিশ্বাস করো। কাল সারারাত আমি, বনি, নাগেশ ঘুমতে পারি নি। তুমি ওইভাবে চলে এলে। তারপর তোমার মোবাইলে এই রকম একটা ম্যাসেজ এলো। কিসের ফাইল সই হলো! তোমার ফাইল সই হওয়া মানে পরের দিনের সূর্য সে দেখতে পায় না।
সুরোর মুখের দিকে তাকালাম।
একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছিলাম আর মানে রাঘবন আঙ্কেল হবে। তাহলে কি রাঘবন আঙ্কেল….।
আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি।
কাল একটা অন্যায় করে ফেলেছি।
সুরো মুখ নামিয়ে নিল।
বিশ্বাস করো। কথাটা মনে আসাতে কোনও কিছু মাথায় আসছিল না। বাধ্য হয়ে বিনদভাইকে ফোন করেছিলাম।
আমি হেসেফেললাম। নম্বর পেলি কি করে?
ওর কাছ থেকে একপ্রকার জোর করে ফোন নম্বরটা নিলাম।
সুরো আমার দিকে তাকাল। চোখের পাতা কাঁপছে।
রাগ করলে।
ভী..ষ..ণ।
আমার গলার টিউনিংয়ে সকলে হেসে ফেললো।
সুরো হাসছে না।
বিনদভাই যখন বললো, তুমি অনিদার বোন। আমি তোমাকে সুরোদি বলবো। তুমি বিশ্বাস করতে পারো। অনিদা জীবনে কখনও এইরকম কোনও কাজ করতে পারে না। তুমি যদি ঘণ্টা দুয়েক সময় আমাকে দাও, আমি তোমাকে ম্যাসেজটা কে করেছিল বলতে পারি।
ভোরের দিকে বিনদভাই ফোন করে শুভ সংবাদটা দিয়েছিল। ওর কথা ঠিক বিশ্বাস করি নি। অপেক্ষা করছিলাম। তোমার মুখ থেকে শুনবো।
মেলা বকিস না, চা বড়াভাজা খাওয়াবি বলেছিলি।
বড়োমাকে বলি।
কেন, ঝেড়ে না কাশলে ভালো লাগছে না।
তুই বলতো সুরো আমরা শুনবো। বিধানদা বলে উঠলো।
সুরো, বনি দুজনেই আমার কোল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
দাদার কষ্টটা তোমরা কেউ বুঝবে না। বাবা, তুমি, প্রবীরকাকু, অনুপকাকু, রূপায়ণকাকু, তোমরা সকলে শুধু তোমাদের দিকটা ভাব। দাদা সকলের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের কথা ভাবতে ভুলে গেছে। আমিও স্বার্থপর….।
কথা বলতে গিয়ে সুরোর গলাটা ধরে এলো। চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো।
নির্মল পরিবেশটা হঠাৎ কেমন থম থমে হয়ে গেল।
(আবার আগামীকাল)