২১৬ নং কিস্তি
বিধানদা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এলো। সুরোর দুই কাঁধে হাত রেখে একবার ঝাঁকুনি দিল।
সুরো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।
সুরোর মুখটা তুলে ধরলো। সুরোর চোখ বন্ধ। থিরি থিরি কাঁপছে।
বিশ্বাস কর। তোর মতো করে কখনও ভাবি নি। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছি।
সুরো চোখ খুলেছে। চোখের পাতায় শিশিরের ছোঁওয়া।
তোমরা সবাই দাদার ওপরটা দেখলে, একবার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলে না।
বিধানদা, সুরোকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি তোকে কথা দিচ্ছি মা। ওকে রিলিফ দেব। আর কয়েকটা দিন সময় দে।
সুরো বিধানদার বুকে আশ্রয় নিয়েছে।
বড়োমা আমার হাতটা চেপে ধরলো।
আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম। চোখটা কেমন ছল ছল করছে।
আসরটা আর জমলো না। ভেঙে গেল।
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।
ঘরটা অন্ধকার। মিত্রা, তনু আমাকে অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
ওদের হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার কোনও উপায় নেই।
বাইরে অঝোড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। যেন আকাশটা ফেটে ফুটে চৌচির। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে চারদিক আলো হয়ে উঠছে। তার সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ করে মেঘ ডেকে উঠছে।
জানলার দিকে তাকালাম। জানলার পাল্লা দুটো হাট করে খোলা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে।
মাঝে মাঝে দমকা ঝোড়ো বাতাস বইছে।
একটু কাত হয়ে জানলার দিকে তাকালাম। তনুর খোলা বুক আমার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। মিত্রার একটা ঠ্যাঙ আমার শরীরে। আমি যেন ওর পাশ বালিশ। কি নিশ্চিন্তে দুজনে ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
কাল সুরোর কি যে হলো, কে জানে। তারপর আর আড্ডাটা বেশি জমে নি। ঠান্ডার আমেজে সকলে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলাম। আমি মিত্রাদের আগে এসে খাট দখল করেছিলাম। কখন ঘুমিয় পরেছি তা নিজেও জানি না। মিত্রারা নিজে নিজে এসে তাদের মতো শুয়েছে।
এইখাটে দুজনে ঠিক ঠাক শোয়া যায়? তবু তিনজনে গোঁতা গুঁতি করা চাই।
কতোবার বলেছি তোরা খাটে শো আমি সোফায় শুয়ে পড়ি। হবে না। কতো মান অভিমান।
বাধ্য হয়ে ওদের কথা মেনে নিয়েছি।
দুজনের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।
আকাশের বুক চিরে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঝলসে উঠলো তীব্র আলোর করাল রেখা। চারিদিকটা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে কর্কশ শব্দে মেঘ গুরগুর করে উঠলো। গাছপালা, মাটি থিরথির করে কেঁপে উঠলো। গাছের পাখিরা তীব্র স্বরে ডেকে উঠলো। দূরে কেউ শঙ্খ বাজাল। তার মিহি শব্দ ভেসে আসছে।
আতঙ্কের এক স্বপ্নিল পরিবেশ।
খড়ের চালে মুর্হু মুর্হু বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা আছাড় খেয়ে পড়ছে। এক অদ্ভূত সুরের মুর্চ্ছনায় চারদিক ম ম করছে।
মিত্রা দেখ দেখ বৃষ্টিটা কি জোড়ে নেমেছে।
মিত্রাকে ঠেলা দিলাম।
তনু চোখ খোলো, দেখো ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে।
দুজনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ খুললো।
অন্ধকারের মিহি আলোয় আমি ওদের স্বপ্নিল দুটো ডাগর চোখ দেখতে পাচ্ছি।
জানলার দিকে তাকা।
তনু পাশ ফিরলো। মিত্রা আমার শরীরের ওপর ভড় দিয়ে জানলার দিকে তাকিয়েছে।
আবার বিদ্যুতের চমক। মেঘের গর্জন। এবার শঙ্খের আওয়াজ আরও তীব্র হলো।
তনু আমার শরীরে সঙ্গে আরও গভীর ভাবে শরীরটাকে মিশিয়ে দিল।
হাওয়ার বেগে গাছের পাতা আপান খেয়ালে দুলছে।
সবচেয়ে আনন্দ ওদের। মনের সুখে বৃষ্টির জলে নিজেকে স্নাত করছে। কতদিন পরে বৃষ্টি নেমেছে। প্রায় পাঁচ মাস। ওদের অপেক্ষার দিন শেষ। এবার ভূমি ঋতুমতী হবে। ওরা সেই ভূমির রস সিঞ্চন করে ডাগুর ডুগুর দেখতে হবে, ফুল ফুটবে তারপর ওরা ফলবতী হবে। প্রকৃতি সত্যি তার আপন খেয়ালে চলে। নিয়ম শৃঙ্খলা হীন বহেমিয়ান জীবন। কোনও আইনের শাসন মানে না। তার নিজের আইন সে নিজ হাতে রচনা করে। তারই সৃষ্টি সুসভ্য মানুষ যখন তাকে বাঁধতে চায় সে যেন পাগল হয়ে যায়। ভেঙে চুরে দুমড়ে সব একাকার করে দেয়।
মিত্রাদি এ কি বৃষ্টি গো বাপের জন্মে দেখিনি।
মিত্রা, তনুর কথায় ফিক করে হাসলো।
অতো বড়ো গাছটা কেমন হাওয়ার বেগে বেঁকে বুঁকে যাচ্ছে দেখছো।
আমি তনুর দিকে তাকিয়ে।
সব সময় একটা….।
তনু আমার নাকটা চেপেধরে নাড়িয়ে দিল।
নতুন শিখেছো মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, সুরো শিখিয়েছে। এবার হয়েছে।
তুমি প্রথম শুরু করলে।
বেশ করেছি। কালকের থেকে অনেক কিছু জমে আছে, মাথায় রাখবে।
গরম তেল কানে বেশ ভালোই ঢালা হয়েছে মনে হচ্ছে।
দেখছো দিদি দেখছো।
তোকে বলেছি, রয়ে সয়ে উত্তর দিয়েছিস কি মরেছিস, কাট কাট উত্তর দিবি।
আমি হাসলাম।
চলো বাইরের বারান্দয় গিয়ে বসি।
তিনজনেই উঠে বসলাম।
তনু কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে না। মিত্রা বললো।
হ্যাঁ গো, বেশ শীত শীত করছে।
এয়ারকন্ডিশনের বাবা।
একটা কিছু জড়িয়ে নে। আমি বললাম।
ওরা বেরিয়ে আসার আগেই আমি বারান্দায় চলে এলাম।
খরের চাল চুঁইয়ে তীরবেগে জল নিচে আছাড় খেয়ে পড়ছে।
ছড় ছড় করে একটানা একটা শব্দ।
একটু ঝুঁকে নিচের দিকে তাকালাম। জায়গাটা এরিমধ্যে কেমন গর্ত হয়েগেছে।
ভিঁজে মাটির গন্ধে চারদিক ম ম করছে। ঠিক সোঁদা সোঁদা নয়। একটু অন্যরকম।
একটানা বৃষ্টির শব্দ। নিশুত রাত।
আমি একবারে বারান্দার ধারে এসে বসলাম।
সামনের খামার জলে থই থই। খামার পেরিয়ে ছোট্ট খেতটায় এরিমধ্যে জল দাঁড়িয়ে গেছে।
বিদ্যুতের সামান্য ঝিলিক, সামনের আতাগাছটায় চোখ চলে গেল।
একটা প্যাঁচা পাতার আড়ালে বসে পা-দুটো দিয়ে একটা ডালকে শক্ত করে ধরে আছে। হাওয়ার তোড়ে গাছের ডাল দুলছে। সেও দুলছে। প্যাঁচাটা ভিঁজে একবারে স্যাঁতসেতে হয়ে গেছে। ভয়ার্ত চোখ দুটো প্রকৃতির এই পাগলপনা থেকে বাঁচার তাগিদে আশ্রয় খুঁজছে। উৎসুক চোখে এক দৃষ্টে বারান্দার দিকে তাকিয়ে। এরা দিনকানা। দিনে দেখতে পায় না। রাতে এদের প্রখর দৃষ্টি।
নিশ্চই প্যাঁচাটা আমাকে দেখে ফেলেছে।
এই সামান্য রাতটুকু ওরা জীবন-জীবিকার তাগিদে লড়াই করে। আজ সেটুকুও নিস্ব করে প্রকৃতি ওদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। কি নিষ্ঠুর প্রকৃতি।
নিজের মনে নিজে হাসলাম। কেন আমি এই কথা মনে করছি। এর তো একটা গূঢ় ব্যাখ্যা আছে। সারভাইভ অফ ফিটেস্ট।
চারদিকে তারস্বরে গ্যাংর গ্যাং, গ্যাংর গ্যাং করে ব্যাঙ ডেকে চলেছে। এই শব্দের একটা আলাদা সুর আছে, আলাদা মাদকতা, তার লয় মাত্রাও ভিন্ন। এই সুর দুঃখের নয়। আনন্দের। নতুন জলে গা ভেঁজাও। মনের আনন্দে মাঠের জলে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে লাফিয়ে লাফিয়ে চলো। মিলিত হও সঙ্গিনীদের সঙ্গে। এ যেন একে অপরকে কাছে ডাকার শব্দ। নিজের পৌরুষত্ব প্রতিষ্ঠা করার শব্দ। ওরা যেন তারস্বরে চিল্লিয়ে বলছে, আমাদের সময় হয়েছে। অদ্ভূত একটা স্বপ্নিল পরিবেশ। প্রকৃতি যেন চারদিকে মায়ার জাল বিছিয়ে রেখেছে। জলের ঝাপটায় বারান্দার একপাশ ভিঁজে সপসপে হয়ে গেছে।
মিত্রা, তনু দুজনে একটা করে চাদর জড়িয়ে আমার পাশে এসে বসলো।
বুবুনরে বেশ ঠাণ্ডা তোর শীত করছে না। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
না।
তুই তো গ্রামের ছেলে।
হাসালাম।
দিদি বাথরুম পাচ্ছে। তনু বলে উঠলো।
সত্যি তোর সময়ের জ্ঞান নেই।
কি করবো পেয়ে গেছে।
আমি তনুর দিকে তাকালাম।
একবারে ওইভাবে তাকাবে না। মুখ ঝামটাল।
ওই কর্নারে চলে যাও। বারান্দার শেষপ্রান্তের দিকে হাত তুললাম।
তোমায় বলেছি।
আরে বাবা করেই দেখো না। যা বৃষ্টি পরছে মিলে মিশে সব একাকার হয়ে যাবে।
মিত্রা হেসে গায়ে ঢলে পরলো।
তোকে এখানে আসার প্রথম দিনের গল্প বলেছি।
ও মানুষ নাকি।
ঠিক আছে বাবা এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তোমার যেখানে খুশি যাও।
একবারে ওদিকে তাকবে না।
তনু বারান্দার শেষ প্রান্তে চলে গেল।
মিত্রা হাসছে।
আমি সামনের দিকে তাকিয়েছি।
বৃষ্টির বিরাম নেই সে তার আপন খেয়ালে ঝড়েই চলেছে।
মিত্রাও তাকিয়ে আছে।
বুবুন।
উঁ।
বন্যা হলে কি করবো?
এই বৃষ্টিতে বন্যা হবে না।
কি করে বুঝলি?
মাঠ যেভাবে ফুটি ফাটা হয়েছিল, এই রকম বৃষ্টি তিন-চারদিন টানা হলে তবে জল জমবে।
ওই তো সামনের খতটাতে জল জমে গেছে।
কাল সকালে দেখবি সব শুকিয়ে গেছে। চাষের সময় মাটির তলা থেকে যা জল তোলা হয়েছে, সেটা আগে পূরণ হোক তারপর বন্যা।
তুই এতো বুঝিস কি করে?
তুইও যদি তিন চারটে বর্ষা গ্রামে থাকিস বুঝে যাবি। এর জন্য বিদ্যে বুদ্ধির দরকার লাগে না।
ওরে বাবারে….।
তনুর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে চমকে তাকালাম। দেখলাম তনু মাটিতে গড়া গড়ি খাচ্ছে।
পরি কি মরি করে ছুটে গেলাম। মিত্রাও পেছন পেছেন এলো।
তনু চিতপটাং হয়ে শুয়ে। ম্যাক্সি নিষিদ্ধ সীমানা ছাড়িয়ে মাথায় উঠছে।
আমি ওর হাতটা ধরে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
শয়তান মজা হচ্ছে। তনু ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
কাদায় পুরো লেপ্টা লেপ্টি।
আমি হেসে ফেললাম।
তুই পরে গেলি কি করে! মিত্রা বললো।
তুমি এতদূরে এসেছো কেন! একটু ভেতরে বসে করলে কি ক্ষতি হতো? আমি বললাম।
কামড়ে হাতের মাংস তুলে নেব।
তোর কোমোরে লাগেনি তো। মিত্রা বললো।
তনু আমার হাতটা ধরে উঠে বসেছে। আমি হাসছি।
হাসাচ্ছি দাঁড়াও।
আমি ওকে বুকের সঙ্গে আঁকুড় করে ধরে দাঁড় করালাম।
বার বার ওপরের দিকে তাকাচ্ছে।
উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জাপ্টে ধরে কাঁধে মাথা রেখেছে।
ভয় পেয়ে পড়েগেলে না পা পিছলে….।
একটা অদ্ভূত শব্দ হল।
মা গো বলে মিত্রা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
ওই দেখো আবার! তনু বলে উঠলো।
দুজনে আমাকে সামনে পেছনে জড়িয়ে ধরেছে।
তোরা এরকম করলে আমি দেখবো কি করে। আমাকে দেখতে দে।
তোকে দেখতে হবে না। এখান থেকে চল।
আমি কোনও প্রকারে পকেটে থেকে মোবাইলটা বার করলাম।
মোবাইলের কি-তে হাত পরতেই স্ক্রিনের লাইটটা জলে উঠলো। এই অন্ধকারে এই আলোটাই যথেষ্ট উজ্জ্বল। দুজনে আমাকে সামনে পেছনে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে ধরে আছে।
মোবাইলের আলোটা ওপরের দিকে তুলে ধরতেই আমি অবাক হয়েগেলাম। দেয়ালের কার্নিশে একটা সাদা প্যাঁচা বসে আছে। জুল জুল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
নিজের মনে নিজে হাসলাম।
প্রত্যেকটা প্রাণের মধ্যে বাঁচে থাকার কি অদম্য বাসনা।
মিত্রা দেখ দেখ কি সুন্দর।
না দেখবো না।
এ দৃশ্য তুই কোটি টাকা দিলেও দেখতে পাবি না।
দু-জনেই মুখ তুলে তাকিয়েছে।
প্যাঁচা!
লক্ষ্মীপ্যাঁচা। দেখছিস কিরকম ধব ধবে সাদা।
কোথা থেকে এলো! তনুর ঠোঁটে অস্পষ্ট শব্দ।
প্রকৃতির খাম খেয়ালি পনায় বাঁচার তাগিদে আশ্রয় নিয়েছে।
মোবাইলের আলোটা নিভে গেল। আবার কি-তে হাত দিয়ে জ্বালালাম।
প্যাঁচাটা আমাদের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।
দিনের বেলা হলে হয়তো দেখতে পেত না। এখন নিশুত রাত ওদের চোখে সূর্যের জ্যোতি।
তনুর চোখে বিষ্ময়।
ও তো তোমার আমার মতো শিক্ষিত নয়।
দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে।
ভেবেছে তুমি হয়তো ওকে ওর নিশ্চিন্ত জায়গা থেকে উৎখাত করতে এসেছো। তাই ডানা ঝাপ্টে শব্দ করে তোমাকে ভয় দেখিয়েছিল। তুমি পা পিছলে চিৎপটাং।
তুমি ভয় পেতে না?
ঠিক ভয় পেতাম না। তবে শব্দটা কেন হলো জানার জন্য উৎসাহ বোধ করতাম।
তনু আমার বুকে ঠোঁট ছোঁয়াল।
মিত্রা?
উঁ।
আগে দেখেছিস?
না।
সচরাচর এদের দেখা যায় না। এদের দেখা নাকি সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আমরা তাহলে সৌভাগ্যবান বলো? তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
কি জানি হবে হয়তো। এর একটা জুরিদার আছে।
কোথায়?
সামনের আতাগাছটায়।
কি করে বুঝলি?
তখন বিদ্যুতের আলোয় আবিষ্কার করলাম। ওটা ছেলে, এটা মেয়ে।
মিত্রা হাসলো।
হাসলি কেন?
তোর কথা শুনে।
তুই যেমন জীবনে একা বাঁচতে পারিস না। এরাও একা একা বাঁচতে পারে না। ঠিক একটা সঙ্গিনী জুটিয়ে নেয়। সঙ্গিনীকে এরা বেশ যত্ন আত্তি করে। সঙ্গিনীকে নিশ্চিত আশ্রয়ে রেখে পুরুষ প্যাঁচাটা বাইরের গাছে বসে ভিঁজছে।
ওরা আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
মন হচ্ছে সঙ্গিনীটা মা হতে চলেছে।
মিত্রা ফিক করে হাসলো।
তনু হাফ না পুরো? আমি তনুর দিকে তাকালাম।
কি!
যা করতে এসেছিলে এখানে।
ধ্যুস।
যাও ম্যাক্সিটা চেঞ্জ করে আসো।
আমি ওদের অর্গল মুক্ত হয়ে বারান্দার এপাশে চলে এলাম।
বৃষ্টি থেমে নেই। তবে মেঘের গর্জন বিদ্যুতের চমক এখন অনেকটা ম্রিয়মান।
মাঝে মাঝে দু-একবার চিরিক চিরকি করে উঠছে।
মিত্রা এসে পাশে বসলো। তনু ভেতরে গেছে।
আমি খামারের দিকে তাকিয়ে আছি।
তুই কি করে বুঝলি?
কি?
প্যাঁচাটা মা হতে চলেছে।
সে অনেক কথা।
বল না একটু শুনি।
মাঝে মাঝে কৈশোরের দিনগুলো মনে পড়লে নিজে নিজেই হাসি। সত্যি মনাকাকা আমার জন্য কত টেনসন ভোগ করতো। একে বন্ধুর মা-বাপ হারা ছেলে। তার ওপর ওরকম গেছো বাঁদর। আমাকে পোষ মানাতে হিমসিম খেয়ে যেত সকলে।
আমি একটু থেমে থেমে বলছি। চোখ সামনের খামারের দিকে।
খোলা আকাশ, অকৃপণ প্রকৃতি, আমাকে কিছুতেই একা থাকতে দিত না। বার বার ওই বাঁশ বাগান আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। তখন এই বাঁশ বাগান আরও ঘনো ছিল। দিনের বেলাতেই কাকী যেতে ভয় পেত। প্রচুর সাপ ছিল।
ভূত প্রেত কাকা বিশ্বাস করতো না। তবে হাওয়া টাওয়াতে কাকা বিশ্বাস করতো।
সেটা আবার কি!
ওই বাঁশ বাগানে অশরীরীদের উৎপাত। ওই অঞ্চলটা নাকি তাদের যাওয়া আসার পথ। তারা যে যাওয়া আসা করতো আমি কোনওদিন তাদের দেখিনি। তাদের গায়ের হাওয়া আমার গায়ে লাগলে শরীর খারাপ করতো। কাকার উৎকণ্ঠা বারতো। এই অশ্বিনী খুড়োকে ডাকতো, অমলদাদু এসে ঘরে খুঁটি গাড়তো। ঝাড়ফুঁক, এ্যালোপ্যাথ দুটো সমান তালে পাশাপাশি সহাবস্থান করতো।
যতক্ষণ না আমার শরীর ঠিক হচ্ছে। ততক্ষণ দু-জনের নিস্তার নেই। খাওয়া থাকা সব এখানে। কতো জরিবুটি, ট্যাবলেট তখন আমদানি হতো। কাকী কালমেঘ থেকে নিমপাতা যতো রকমের তেঁতো হতে পারে সব খাওয়াতো। তেঁতোর চোটে শরীর এমনিই ঠিক হয়ে যেত। শরীর ঠিক হলে চলতো পথ্যের ঠ্যালা। মৌসুমী মাসি সিঙ্গি, কই, মাগুর, ল্যাটা, কুচে। খুঁজে খুঁজে ঠিক আমার জন্য নিয়ে এসে হাজির।
যেতিস কেন?
কি করে তোকে বোঝাই।
বাঁশ বাগানের পেছন দিকে একটা বড়ো জামরুল গাছ ছিল। বেশ বড়ো বড়ো জামরুল হতো। আর একটা জাম গাছ। অন্যান্য গাছে সকলে ভাগ বসালেও ওই দুটো গাছ ছিল শুধু আমার।
কেন!
ওখানে ভূত থাকতো। ভূতের ভয়ে কেউ ও পাশ মারাত না। আমি একা রাজ করতাম। মনের সুখে গাছে উঠে জামরুল চিবতাম। একটা জামরুল চিবোলে হাফ গ্লাস জল খাওয়া হয়ে যেত।
মিত্রা হাসছে।
তনু আমার আর এক পাশে এসে বসলো।
বসন্তকালে তোরা এখানে আসিস নি। এলে দেখতিস, কতো কোকিল। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কুহু কুহু করে তোর কান ঝালাপালা করে দেবে।
জামরুল গাছটায় গোটা আটেক কাকের বাসা ছিল। প্রথম প্রথম গাছে উঠলেই ওরা আমাকে ঠোক্কর দিত। তারপর দেখলো এতো আমাদের কোনও অনিষ্ট করে না। তখন আমাকে বন্ধু বলে মেনে নিল। আমিও প্রত্যেকদিন খাওয়ার থালায় কিছুটা করে ভাত রাখতাম। খাবার শেষে বাসন নিয়ে পুকুরে ডোবাতে এসে এক ফাঁকে টুক করে গিয়ে ওদের দিয়ে আসতাম।
কতোদিন ওদের বাসায় মা কাকগুোলকে চুপচাপ পেটের তলায় ডিম নিয়ে বসে তা দিতে দেখেছি। কিছুক্ষণ তা দেয়। আবার ডিম থেকে উঠে ঠোঁট দিয়ে ডিমটাকে গড়া গড়ি খাওয়ায়।
বাবা কাকটা মাঝে মাঝে উড়ে এসে বসে। মা কাকটা ক্যাঁড়র ক্যাঁড়র করে হাঁ করে। বাবা কাকটা মুখের খাবার মা কাকটাকে খাইয়ে দিয়ে উড়ে চলে যেত।
একদিন দাঁত মাজতে মাজতে এসে দেখি দুটো কাকের ডিম নিচে পড়ে আছে। ফেটে ফুটে ভেতর থেকে কুসুম বেরিয়ে গেছে।
তখন মনে হয় আমি ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেন। ঠিক মনে নেই। তবে সিক্সই মনে হচ্ছে।
ভাবলাম রাতে ভূতে এসে ডিমটা ভেঙে ছানাটাকে খেয়ে চলেগেছে।
রাগও হলো, মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভূতটাকে হাতের সামনে পেলে ওর গলা টিপে ধরতাম। আর কাকটাকে দেখতে পাব না।
মিত্রা তনু মুচকি হাসছে।
ও মা! ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি মা কাকটা বাসায় বসে ডিমে তা দিচ্ছে। তর তর করে গাছে উঠে পড়লাম। দেখলাম সত্যি ব্যাটা ডিমে তা দিচ্ছে। নিশ্চিন্ত হলাম তাহলে ভূতে অন্য কারোর ডিম নিয়ে খেয়েছে। মুখ ধুয়ে এক পেট মুড়ি খেয়ে উনা মাস্টারের কাছে দে দৌড়।
মন পড়ে আছে জামরুল গাছে। কাল দেখেছি দুটো ডিম ছিল আজ গাছের নিচে দুটো ডিম পড়ে আছে। তবু কাকটা তা দিচ্ছে।
মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন। আসার সময় ভানুকে বললাম।
দিলো দুমুড়ো গালাগাল। চিকনাকে বললাম। বললো, স্যারকে বলে দেব, তুই ওখানে গেছিস।
মহা বিপদ।
দুপুরে কাকীমা যখন খেয়ে দেয়ে একটু শুয়েছে আমি ফুরুত। সোজা জামরুল গাছে চড়ে বসলাম। হ্যাঁ ঠিক দুটো ডিম। কাকটা চোখ বন্ধ করে তা দিচ্ছে। একবার আমর দিকে চোরা চাহুনি মেলে তাকাল। ঠিক লোক কিনা।
আমি কিছুক্ষণ জামরুল খেয়ে চলে এলাম।
তারপর দিন জামরুল গাছের তলায় গেছি। দেখি একটা ছেলে কোকিল একটা ময়ে কোকিল জামরুল গাছের ডালে নাচানাচি করছে। ছেলে কোকিলটা গলা ফাটিয়ে তারস্বরে কুহু কুহু করছে আর মেয়ে কোকিলটা ক্যাঁড়র ক্যাঁড়র করে একটা অদ্ভূত আওয়াজ করছে।
উনা মাস্টারের কাছ থেকে ফিরে এসে স্নান-টান করে খেয়ে দেয়ে স্কুলে যাব।
খেতে বসে কাকীমাকে বললাম।
কাকীমা কিছুক্ষণ আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। তারপর ধমকে উঠলো।
তুই আবার ওখানে গেছিস, খুব মার খেতে ইচ্ছে করে তাই না।
গুম হয়ে থাকলাম।
খাওয়ার ঠিক শেষের দিকে কাকীমা বললো। কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়ে।
তাহলে কোকিলগুলো কাকের ডিমগুলো নিচে ফেলে দিয়েছিল!
হ্যাঁ।
কি হিংসুটে!
কাকীমা হাসলো।
ওরা বাসা বাঁধতে পারে না। তাই কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। কোকিলের ডিম কাকের ডিম দেখতে এক। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর, কোকিলটা যখন একটু বড়ো হবে তখন আপনা থেকেই উড়ে চলে যাবে। দেখিসনা কাক আর কোকিল দুটোই কালো।
কাকীমার কথাটা ঠিক ঠিক মনে ধরলো না। মনে মনে বললাম, এর শেষ দেখতেই হবে।
স্কুল থেকে ফিরে কোনওপ্রকারে নাকে মুখে চাড্ডি গুঁজেই দে দৌড় জামরুল গাছ।
কাকীমা সব জানতো।
কাকা ফিরে খোঁজ করলেই বলতো কামারপাতায় গেছে খেলতে।
আমি ওই পথ দিয়ে আসছি।
আমি কি ওর পেছন পেছন ঘুরবো। কাকীমা মুখ ঝামটানি দিত।
ছেলেটাকে একটু চোখে চোখে রাখবে তো। না হলে একবারে বকে যাবে।
বকে গেলে তোমার জন্য যাবে। ছেলেমানুষ একটু এদিক সেদিক যাবে না। তোমার মতো ঘরে বসে বসে গুলতানি মারবে। বজ্র আঁটুনি ফোস্কা গেড়ো। কাকীমা গজ গজ করতো। আমি জামরুল গাছের ঝাঁকরা পাতার আড়ালে বসে পুকুর ঘাটে কাকা-কাকীমার তরজা শুনতাম।
দাঁড় কাক আর পাতি কাকের মধ্যে দেখবি আকাশ পাতাল তফাৎ। দাঁড়কাকটা মিশ মিশে কাল। পাতি কাকটা ছাই রং-এর। দাঁড় কাক অনেকটা কোকিলের মত দেখতে।
আমার কেমন যেন নেশায় পেয়ে বসলো। প্রত্যেকদিন স্কুল থেকে ফিরেই আমি জামরুল গাছে গিয়ে উঠতাম। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে কিনা।
ঠিক কতদিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছিল মনে নেই। একদিন ওই রকম স্কুল থেকে ফিরেই জামরুল গাছে উঠেছি।
দেখি কোকিল আর কাকের ডাকে চারদিক ম ম করছে।
কাক গুলো মাঝে মাঝে কোকিলদের তাড়া করছে, কোকিল দুটো একবার এইডালে একবার ওই ডালে উড়ে পালিয়ে যায়।
বাসার দিকে তাকিয়ে দেখি মা কাকটা একটা ডিম ঠোকরাচ্ছে। লাল টুকটুকে একটা মুখ সামান্য দেখা যাচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে ডিমের ভেতর থেকে একটা ছানা বেরিয়ে এলো। এতোটুকু।
তারপর আর একটা ডিম থেকেও বাচ্চা বেরলো। ওটা পুরো দেখেছি। তারপর ডিমের খোলা গুলো ঠোঁটে করে বাসার বাইরে নিচে ফেলে দিল।
মা কাকটার সে কি আনন্দ তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। চোখ দুটো কুত কুত করছে। মা কাকটার চেঁচা-মিচিতে আরও অনেক কাক চলে এলো।
তখন কোকিল দুটোকে যেন মনে হচ্ছে অচ্ছুত।
বাবা কাকটা উড়ে এসে বসতেই মা কাকটা কাছ ঘেঁসে বসলো। বাবা কাকটা ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে সোহাগে সোহাগে ভরিয়ে দিল। মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের আনন্দে দুজনে তখন মসগুল। মুখে একটা অদ্ভূত শব্দ ক্যাঁড়র ক্যাঁড়র।
তখন এত কিছু বুঝতাম না এখন বুঝি ওটা ওদের অনন্দের বর্হিপ্রকাশ। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল আর থাকতে পারলাম না। গাছ থেকে নেমে সোজা চলে এলাম। কাকীমাকে এসে সমস্ত কথা বললাম। কাকীমা হাসলো।
একটু বড়ো হলে ধরে আনতে পারবি।
হ্যাঁ।
নিয়ে আসিস, পুষবো।
কাকীমার প্রচ্ছন্ন স্নেহে আমার আনাগোনা বারলো। দিনে দুবার থেকে চারবার হয়ে গেল।
ঘন ঘন পায়খানার নাম করে গাছে উঠে বসে থাকতাম।
মা কাকটা দেখলাম এবার মাঝে মাঝে উড়ে চলে যেত। খাবর এনে ওদের খাওয়াতো। মা কাকটা উড়ে এলেই বাচ্চাদুটো হাঁ করে কেমন চিঁহি চিঁহি করে উঠতো।
মা কাকটা ওর ঠোঁটের খাবার বাচ্চা দু-টোর হাঁ করা ঠোঁটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিত। মাথা নেড়ে নেড়ে বাচ্চা দুটো গিলে খেত।
প্রথম অবস্থায় ওদের গায়ে একটাও পালক ছিল না। হাড় গিলে গিলে চেহারা। আস্তে আস্তে ওদের গায়ে পালক হলো। মিশ কালো।
একদিন খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই কাক, কোকিলের তারস্বর চেঁচামিচি শুনতে পেলাম।
বিছানা থেকে উঠেই খিড়কি দরজা খুলে দে দৌড়।
জামরুল গাছের তলায় গেছি। দেখি কাক আর কোকিলের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বুঝলাম নিশ্চই মা কাকটা বুঝতে পেরে গেছে এটা ওর বাচ্চা নয়। কাক আর কোকিলের ডাকে চারদিকের বাতাস ভাড়ি হয়ে উঠেছে। আমি গাছে উঠলাম। দেখলাম বাচ্চাগুলো বাসার বাইরে একটা ডালে বসে থর থর করে কাঁপছে। মাঝে মাঝে কু কু করে ডেকে উঠছে।
তারা তারি করে ডাল বেয়ে ওদের কাছে গেলাম। দুটোকে কোনপ্রকারে আঁকুড় করে ধরে গেঞ্জির মধ্যে ঢুকিয়ে নিলাম। গাছ থেকে নেমে এলাম। সেদিন কাক,কোকিল দুজনেই আমার মাথা ঠুকরে ফুলিয়ে দিয়েছিল। কয়েকদিন বেশ ব্যাথা ছিল।
গাছ থেকে নেমে বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে পুকুর ধারে আসতেই কাকার মুখো মুখি।
আমার দু-হাতে কোকিলের ছানা। কাকার রক্ত চক্ষু। বুঝলাম আজ আমার কপালে দুঃখ আছে। কাকা হুঙ্কার ছাড়তেই, কাকীমা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
একবারে ওর গায়ে হাত তুলবে না। আমি ওকে বলেছি।
কাকীমা আমাকে আড়াল করেছে, আমি কাকীমার আঁচলের তলায় ঢুকে পড়েছি।
কাকা এক তরফা কাকীমার ওপর তরপে গেল। কাকীমা আমাকে আড়াল করে ভেতরে নিয়ে এলো। কাকার ভয়ে আমিও তখন কোকিল ছানার মতো থর থর করে কাঁপছিলাম।
কাকীমা সেই দুটো কোকিল ছানাকে একটা ঝুড়ির তলায় রাখলো।
মুখ ধুয়ে মুড়ি খেতে খেতে কাকীমাকে সমস্ত কথা বললাম।
কাকীমাকে সেদিন প্রথম কাঁদতে দেখলাম। মুখটা কেমন থমথমে। কাকীমার করুণ মুখটা দেখে সেদিন আমার বুকটা প্রথম ব্যাথা ব্যাথা করে উঠলো।
কাউকে কিছু বলিনি।
তখন ছোট ছিলাম অতোটা বুঝিনি। কিন্তু কাকীমার সেই করুণ মুখটা এখনও আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে আছে।
জানিস মিত্রা, সরোগেটেড মাদার, ভারাটে মা কাকে বলে তখন বুঝতাম না।
আজ এই চরম সত্যটা অনুভব করি।
কাকীমা কাক, আমার মা কোকিল।
(আবার আগামীকাল)