আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লির বিধানসভা ভোট। দিল্লি বিধানসভা ভোটে বিজেপি একটানা ছ’বার পরাজিত হয়েছে। প্রথমে তিনবার কংগ্রেসের কাছে, পরের তিনবার বিজেপিকে হারিয়েছে আম আদমি পার্টি। হিসাব বলছে প্রায় তিন দশক ধরে বিজেপি দিল্লিতে ক্ষমতায় নেই। তাই সপ্তমবার বিধানসভা ভোট তরণি পেরতে মরণপণ লক্ষ্য নিয়ে ময়দানে নেমেছে। লক্ষ্যনীয়, গত তিনটি লোকসভা ভোটে বিজেপি দিল্লির সমস্ত আসন জিতলেও বিধানসভা ভোটে তারা কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি। এর মধ্যে রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বে একাধিক রদবদল ঘটেছে, নতুন মুখকেও সামনে আনা হয়েছে তা সত্ত্বেও বিধানসভা ভোটে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। তাই এবার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে থেকেই নতুন কোনো মুখ নয়, দলের সবথেকে বড় আশা-ভরসা নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-সহ বিজেপির প্রথম সারির নেতাদেরকেই ভোটের ময়দানে দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে যে আসন্ন দিল্লি বিধানসভা ভোটের ফলাফলে বিজেপির গত তিন দশকের পুরনো ছবিটা কি বদলাবে?
উল্লেখ্য, নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেও লোকসভা ভোটে বিপুল ভোটে জয়ের পর দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভরাডুবি হয়। তারপর থেকে দিল্লিতে সেই হারের ঐতিহ্য অব্যাহত। তাই এবার টানা ছ’বারের খরা কাটাতে পদ্মশিবির আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। আপ এবং কেজরিওয়ালকে নরেন্দ্র মোদী যেমন নিয়মিত আক্রমণ করে চলেছেন তেমনি বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা দিল্লির বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে অনুরোধ করেছেন, যাঁরা টিকিট পাননি, তাঁরা যেন নির্দল প্রার্থী হিসেবে লড়ে দলকে ডোবানোর পথে না হাঁটেন। এর আগে বিজেপি ও কংগ্রেসের বড় নেতারা ক্ষমতাসীন দিল্লি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। মোদী তো আপকে কটাক্ষ করে ‘আপ-দা’ বলেও সম্বোধন করছেন, কখনও ‘আপদ’ বলছেন। “দিল্লিতেও একটাই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- আপ-দা সহ্য করব না, বদলে ছাড়ব। এখন দিল্লি উন্নয়নের ধারা দেখতে চায়।” এমনটাই বলছেন মোদী। অন্যদিকে, অমিত শাহ কেজরিওয়ালকে কটাক্ষ করে বলেছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনকে ‘শীশ মহল’ বানিয়েছিলেন।
এবারের বিধানসভায় দিল্লির দুই প্রধান দল বিজেপি ও কংগ্রেস ক্ষমতাশীল কেজরিওয়াল সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি থেকে শুরু করে দিল্লির উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। উল্লেখ্য, কংগ্রেসকে দিল্লির ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল আম আদমি পার্টি। তবে কেজরিওয়াল সরকারের বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল-সহ একাধিক পরিষেবার নীতিকে দিল্লির বাসিন্দারা পছন্দ করেন। তারা এও মনে করেন যে আপ সরকার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, সেটা তারা পূরণ করে। তাই তারা বিজেপিকে ভোট দেয় না। তাছাড়া দিল্লিতে বিজেপির তেমন কোনও মুখ নেই যার উপর দিল্লিবাসী আস্থা রাখতে পারেন। কেন্দ্রীয় স্তরে মোদীর উপর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলেও দিল্লিতে গেরুয়া শিবিরে এমন কোনো মুখ নেই যে কেজরিওয়ালকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। ১৯৯৩ সালে বিজেপি শেষবার দিল্লি বিধানসভায় জিতেছিল। সেবার কংগ্রেসের ঝুলিতে পড়েছিল ৩৫ শতাংশ এবং বিজেপি পেয়েছিল ৪৩ শতাংশ ভোট। সেবার অবশ্য বিজেপির জয়ের জন্য ভোট ভাগাভাগির বিষয়টা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ৪৯টি আসন পেয়েও বিজেপিকে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনবার (প্রথমবার মদন লাল খুরানা, তারপর সাহেব সিং ভার্মা এবং সবশেষে সুষমা স্বরাজ) মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হয়েছিল। এরপর ২০১৩-র দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩১টি আসন, ২০১৫ তে মাত্র তিনটি আসন এবং ২০২০ সালে আটটি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দিল্লির সাতটির মধ্যে সবকটি আসনই জিতেছিল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, দিল্লির ভোটাররা ঠিক করে ফেলেছেন যে তারা লোকসভায় বিজেপিকে এবং বিধানসভায় আম আদমি পার্টিকে ভোট দেবেন।
দিল্লিতে বিজেপির শক্তিশালী নেতৃত্ব না থাকাটা বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পক্ষে একটি বড় কারণ। এছাড়া দিল্লির বস্তি, দলিত ও মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপির পক্ষে নেই, সেটাও বিধানসভা ভোটে না জেতার একটি অন্যতম কারণ। যদিও বিজেপি দিল্লিতে নানা পন্থা ব্যবহার করে দিল্লিবাসির মন জয়ের চেষ্টা করেছে। কখনও কিরণ বেদীকে এনে, কংগ্রেস থেকে অরবিন্দর সিং লাভলিকে নিয়ে এসে আবার কখনও বা ডা. হর্ষবর্ধনের উপর বাজি ধরছে। দিল্লিতে এইভাবে নেতা বদল করলেও এমন কোনো নেতাকে সামনে আনতে পারেনি যার প্রভাব ভোট যুদ্ধে ইতিবাচক হয়। সব ধরনের ভোটারদের কাছে টানতে বিজেপি বিগত কয়েক বছরে দিল্লির পূর্বাঞ্চলী, পাঞ্জাবী ইত্যাদি সম্প্রদায় থেকে আসা নেতাদের রাজ্য সভাপতি করেছে। যেমন বর্তমান রাজ্য সভাপতি বীরেন্দ্র সচদেব এবং আদেশ গুপ্তা, মনোজ তিওয়ারি, সতীশ উপাধ্যায়, বিজেন্দ্র গুপ্তা, হর্ষবর্ধন, ওপি কোহলির মতো নেতা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউই বিধানসভা ভোটে জিততে পারেনি। লক্ষ্যনীয় বিজেপি শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর যেখানেই জিতেছে, সেখানে কংগ্রেসকে পরাজিত করে জিতেছে।
আপ এতদিন বিনা মাসুলে বিদ্যুৎ, পানীয় জল পরিষেবা দিত, এ বার তারা মহিলাদের ২,১০০ টাকা অনুদান ও বয়স্কদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ‘সঞ্জীবনী প্রকল্পে’ ভর করে ফের ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে। যদিও কংগ্রেসও মহিলাদের জন্য ২,৫০০ টাকা করে মাসিক অনুদান ও ২৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে দিল্লির মহিলা ভোটব্যাঙ্কের জন্য মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের মতো বিজেপিও ‘লাডলি বহেন’ ধাঁচের কোনও প্রকল্পের প্রতিশ্রুতির কথা ভাবছে বলে জানা গিয়েছে। আপ সরকার এখন ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনা মাসুলে জোগায়। শোনা যাচ্ছে বিজেপি ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুতের কথা ভাবছে। মন্দির, গুরুদ্বারায় ৫০০ ইউনিট পর্যন্ত নিখরচায় বিদ্যুৎ এবং নিখরচায় পানীয় জল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। যদিও বিজেপি নেতারা জানেন, অরবিন্দ কেজরীওয়ালের জনপ্রিয়তার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো নেতা বিজেপির দিল্লিতে নেই। কিন্তু এবারও পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি হলে বিজেপির পক্ষে তা চূড়ান্ত অস্বস্তিকর হবে তাই দিল্লির ময়দানে মোদী-শাহ সক্রিয়।