সংসদে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বিল চলতি শীতকালীন অধিবেশনেই পেশ হতে পারে বলে জোর জল্পনা। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নেতৃত্বাধীন কমিটি একযোগে এর সুপারিশ করেছিল। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে সুপারিশ জমা পড়ে এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করে। এবার সর্বসম্মতি আদায় করতে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হতে পারে বলে খবর। সেখানে আলোচনা হতে পারে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এমনকি বিলের সঙ্গে যুক্ত অন্যদেরও রাখা হতে পারে। অর্থাৎ অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভার স্পিকারদেরও ডাকা হতে পারে। জানা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়ারর কথাও ভাবা হচ্ছে। এত সব হতে পারের কারণ হল, বিলটি পাস করানো খুব সহজ সরল বিষয় নয়। এর জন্য কেন্দ্রকে যথেষ্ট কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। কারণ এটি পাশ হওয়ার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল, যে কারণে কেন্দ্র সর্বসম্মতি পাওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তায় রয়েছে। এছাড়াও ‘এক দেশ এক নির্বাচন বিল’ আইন হিসেবে কার্যকর করতে গেলে, আরও ছ’টি সংশোধনী বিল আনতে হবে এবং দেশের সংবিধানও সংশোধন করতে হবে। আর তা করতে গেলে সংসদে মোদি সরকারের পক্ষে লাগবে দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন।
এই মুহূর্তে সংসদের দুই কক্ষেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে ঠিকই কিন্তু গত লোকসভা ভোটের পর বিজেপি-র আর সেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কারণ, আসন সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। তার ফলে বিল পাস করানোর ক্ষেত্রে বিজেপিকে তার জোট শরিকদের উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ এখন পরিস্থিতিটি দাড়াচ্ছে বিজেপিকে বিল পাস করাতে গেলে রাজ্যসভায় অন্তত ১৬৪ জন সাংসদের সমর্থন পেতে হবে। সংসদের বর্তমান হিসাব অনুযায়ী উচ্চকক্ষের ২৪৫টি আসনের মধ্যে, এনডিএর-র দখলে রয়েছে ১১২টি আসন অন্যদিকে বিরোধীদের দখলে ৮৫টি। তার মানে দুই তৃতীয়াংশ নয়। আর লোকসভার মোট আসন সংখ্যা ৫৪৫, সেখানে এনডিএ-র আসন সংখ্যা ২৯২। তার মানে এনডিএ-র দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন পেতে অন্তত ৩৬৪ সাংসদের সমর্থন পেতে হবে। এই অবস্থায় এনডিএ-কে নির্ভর করতে হচ্ছে পরিস্থিতির। কারণ, বিল পাস করানোর ক্ষেত্রে ভোটাভুটিতে সংসদে কতজন সাংসদ অংশ নিচ্ছেন আর কত জন উপস্থিত রয়েছেন সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, সংসদে উপস্থিত সাংসদ্দের সংখ্যাই শুধু নয়, ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়া সাংসদদের নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ণয় করা হতে পারে। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল কেন এক দেশ, এক নির্বাচন’ পরিকল্পনা করেছে বা এর পিছনে বিজেপির উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা যে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী নয় তা বিরোধী নেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্যে স্পষ্ট। যারা রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন তারাও জানেন যে এটি ২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে একটি৷ তাই এমন ধারণার অবকাশ নেই যে মোদি সরকার বা বিজেপি এটি বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগী হয়েছে। বরং বলা যায় এটি আরএসএস-র একটি গেমপ্ল্যানের অংশ যার মধ্যে দিয়ে তারা দেশের রাজনৈতিক দখলকে আরও শক্তিশালী করতে চায় যাতে এ দেশে তাদের শাসনকাল আরও অর্ধশত কাল পাকাপাকি হয়।
তাই বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের সমস্ত নির্বাচন একসঙ্গে করাতে সক্রিয় মোদি সরকার। আর তারা কারন হিসাবে এই তত্ত্ব খাড়া করছে যে এতে সময় ও অর্থ দুই বাঁচবে। বার বার নির্বাচন করতে উন্নয়নের কাজ থমকে থাকে সেটাও হবে না। যদিও গোড়া থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে বিজেপি বিরোধী প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল। তাদের মত, রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে এবং বিরোধীদের একেবারে সাফ করে দিতেই মোদি সরকার ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ আইন চালু করতে চাইছে। কেবল তাই নয়, এই আইন আসলে নির্বাচন তুলে দেওয়ার আইনসঙ্গত প্রচেষ্টাও বটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একসঙ্গে সবকটি নির্বাচন জনগণের বিচারশক্তিকে দুর্বল করবে। কারণ চলতি নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচন, বিধানসভা নির্বাচন এবং স্থানীয় পুরসভা বা পঞ্চায়েত ভোট আলাদা করে হয়। এতে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির কাজকর্মের হিসাব বুঝে নেওয়া অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকা একটি দল যদি ভালো কাজ কিংবা কাজ না করার হিসাব অনুসারে একই দলকে কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে এমনকি স্থানীয় প্রশাসনে গ্রহণ বা বর্জন করার সামান্য হলেও সুযোগ থাকে। কিন্তু একসঙ্গে সবকটি নির্বাচন হলে নির্বাচিত নেতারা নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী সাড়ে চার বছর নাও হতে পারেন। সেই অবস্থায় ক্ষমতায় থাকা দল মানুষের কথা চিন্তা না করে রাজ্য বা দেশের নীতি প্রণয়ন করতে পারে এবং নিজেদের সবার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেহেতু পাঁচ বছর পর ফের নির্বাচন তাই ক্ষমতায় থাকা দল নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে জনগণের জন্য সামান্য কিছু সুযোগ ঘোষণা করতে পারে। হতেই পারে জনগণ চার বছর আগে সরকারের ভুল নীতির কথা সেভাবে চিন্তা করলো না। তাই ‘এক জাতি, এক নির্বাচন’ ব্যবস্থা একভাবে জনগণের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। এটা গণতন্ত্রকে হাইজ্যাক করার শামিল হবে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে প্রথম ধাপে বিধানসভা নির্বাচন এবং দ্বিতীয় ধাপে ১০০ দিনের মধ্যে পৌরসভা বা পঞ্চায়েত নির্বাচন করা।
বলাই বাহুল্য বিরোধিদের তরফে তীব্র বিরোধিতা আসবে। কারণ, সবকটি নির্বাচন একসঙ্গে হলে দু-একটি বড় দল যে পরিমাণ অর্থ নির্বাচনে খরচ করবে, ছোট দলগুলির পক্ষে সেই অঙ্কের পাশাপাশি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তাছাড়া ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ চালু হলে, রাজ্যের স্থানীয় সমস্যাগুলি উপেক্ষিত থেকে যাবে। পাশাপাশি, নির্বাচনের পর খুব তাড়াতাড়ি সরকার পড়ে গেলে, বিকল্প ব্যবস্থার উল্লেখ নেই বলেও দাবি বিরোধীদের। তাদের অভিযোগ, ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে যে কমিটি তৈরি হয়েছিল সেই কমিটির অধিকাংশ ছিলেন বিজেপি ঘনিষ্ঠ। ফলে বিশেষ একটি দলের রাজনৈতিক স্বার্থ মাথায় রেখেই যে এই নীতি আনতে এত তৎপরতা তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।