আমার প্রিয় কবি তারাপদ রায়ের এই নামে একটি কবিতা আছে। এটা অবশ্য বাঙালির জীবনে নতুন কোন কথা নয়। ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে’, ‘গোল্লায় গেছে’, ‘ভোগে গেছে’, ‘অধঃপাতে গেছে’ জাতীয় কথাবার্তা শুনতে শুনতে আমরা বাঁচি এবং মরেও যাই। তবুও শেষ হয় না আক্ষেপ, শুধু বিলাপের বয়স বাড়ে। লেখার শিরোনামটিতে প্রিয় পাঠক একটু চমকাতে পারেন, অনেকেই ভেবে নিতে পারেন, এই ‘আকাট’ মালটা আবার ‘সিরিয়াস’ হওয়ার ভঙ্গী দিচ্ছে। তার উত্তরে বলা যাক, যে আক্ষেপগুলি মানুষ বার্ধক্যে পৌঁছে করতেন, এখন তা দুনিয়াদারি মোটেই দেখা হয়নি এমন ছেলেছোকরাও করছেন! এমনকি যার সর্বনাশ হতে বাকী ছিল না, তিনিও ‘সর্বনাশ’ হয়ে গেছে বলে জুড়ে দিয়েছেন চিলচিৎকার!
রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমা, খেলা, শিল্প সবেতেই নাকি চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে! অন্তত লোকজনের কথা শুনলে তাই তো মনে হয়! মনে হয়, শুধু ‘গলার জোর’ ছাড়া আর কিছুরই সর্বনাশ হওয়ার বাকি নেই। বাঙালির ওটুকুই শুধু টিঁকে আছে। যাকগে গলার জোরটুকু সর্বনাশের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে জেনে আশ্বস্ত হই, তা গেলে আমাদের আর কিছুই থাকতো না!
সর্বনাশের হাহাকার সবচেয়ে বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায়। অডিও-ভিডিও-টেক্সট এবং উপস্থাপকদের নিখুঁত ভঙ্গী সবকিছু মিলিয়ে সেখানে যাকে বলে সর্বনাশের নিরন্তর গ্রাফিক ডেসক্রিপশন। কে কত খারাপ, কে কতটা খারাপ কাজ আরও খারাপভাবে করেছেন তার যেন এক তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে সেখানে! সেসবের বর্ণনা দিতে দিতে উপস্থাপক ও অংশগ্রহণকারী উভয়পক্ষই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাৎক্ষনিক তর্কবিতর্কের আসরে একপক্ষ আরেকপক্ষের দিকে তেড়ে যান! ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনের শেষে সেই উত্তেজনা চরমে ওঠে। চলতে থাকে একের পর এক সর্বনাশের বিবরণ — বাঙালির সর্বনাশের কাহিনী শুনতে শুনতে চোখে নামে ঘুমের ঘোর। পরেরদিন আবার নতুন কোন সর্বনাশের বিবরণ শোনার জন্য প্রস্তুত হই আমরা।
ধৈর্যশীল পাঠক যারা এটুকু পড়তে পেরেছেন, তাদেরও নিশ্চয় এতক্ষণে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাবছেন লোকটা আসলে কি বলতে চাইছে? থিমটা কি? এ কোন টিমের লোক? আজ্ঞে সেসব কিছুই নয়, আসলে আমাকে কেউ তাদের টিমে নেয়নি। তাই সর্বনাশ কতটা হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না। গোলা লোকজনদের যা হয়, সবকিছুই দেরিতে বুঝি। মুদির দোকান থেকে মাছবাজার, ভিড়ে কেউই যাদের কোন জায়গা ছেড়ে দেয়না। আমরা পিছিয়ে পড়ি, পড়ে গিয়ে আরও পিছই। আমি জনগণও নই, তারা তো শক্তির উৎস। সর্বশক্তিমান নেতারাও তাদের আদর করে মিটিং মিছিলে ডেকে নেন, বিপদে পড়লে ডাকেন।
চতুর্দিকে সর্বনাশ হয়ে গেছে শুনতে শুনতে এখন ভাবছি মা তো সবই জানেন, তিনি এসে আমাদের এবার বলুন – কোন সর্বনাশ হতে আমাদের বাকি আছে? কি সর্বনাশই বা আমাদের হবে? নাকি সর্বনাশ হওয়ার মত কিছু আমাদের ছিলই না? নাকি আমরা বুঝতেই পারিনি “আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে”। খেঁকি কুকুরকে অ্যালসেশিয়ান কিংবা বানরলাঠি গাছকে কৃষ্ণচূড়া ভাবলে যা হয় আর কী!
Khub bhalo laglo Ranjan Da… Onekdin por abar apnar lekha porlam…
ভালো থেকো সুপ্রিয়