চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাঙালির চড়কপূজা। গ্রীষ্মের চড়া রোদে তেতে পুড়ে বিকেলের চড়কপুজোর জন্যে অপেক্ষায় থাকে আমবাঙালি। কলকাতার প্রাচীন বাসিন্দা ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি সংলগ্ন বাজারে হত চড়ক। এখনও হয়। তবে সে জৌলুস আর নেই।
চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর ‘হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান’ বইটিতে চড়কের দেবতাদের নামের উল্লেখ করা হয়েছে৷ ‘এই উপলক্ষে পূজিত প্রধান দেবতার নাম কালার্করুদ্র৷’ তিনি লিখেছেন, ‘এই প্রসঙ্গে অর্চিত দেবীর নাম নীল চণ্ডিকা বা নীল পরমেশ্বরী৷’
সম্ভবত ‘কালার্করুদ্র’ শিবেরই একটি রূপ৷ ‘চণ্ডিকা’ তেমনি দুর্গার একটি রূপ৷ বস্তুত চড়কপুজোর বাণ-বঁড়শি ফোঁড়া, কাঁটা ঝাপ, বঁটি ঝাপ ইত্যাদি প্রিমিটিভ ও ভয়ংকর পর্ব দেখে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী চড়ককে প্রাচীন ‘পাশুপত’দের অনুষ্ঠান বলে ভেবেছেন৷ পশুপতি বা শিবের ভক্তদের বিশেষ সম্প্রদায় হচ্ছে এই পাশুপতগোষ্ঠী৷
আমার মনে হয় ‘চড়ক’ শব্দটির মধ্যেই চড়কের দেবতার নাম লুকিয়ে আছে৷ ‘কালার্করুদ্র’-র আর একটি নাম ছিল সম্ভবত ‘চণ্ডার্ক’। চণ্ড শিবের আর এক নাম। অর্ক সূর্যের নাম। চণ্ড আর অর্ক একদেহে চণ্ডার্ক। চণ্ডার্ক > চণ্ডাক্ক > চণ্ডাক > চণ্ডক > চড়ক।
বস্তুত চৈত্রের শেষলগ্নে সূর্যের প্রখর দহনবেলায় শিবের উৎসবে দুই দেবতাকে যেন একই অঙ্গে পূজা করা হয়। চণ্ডার্ক নামে কোনও দেবতার নাম পুরাণে পাইনি। কিন্তু চণ্ডার্ক নামে শৈবতীর্থের উল্লেখ পেয়েছি নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ-এ।
আবার চড়কে পূজ্য ‘নীল চণ্ডিকা’ দেবী হলে, দেবতার নাম ‘চণ্ডক’ হওয়ার সম্ভবনা প্রবল৷
‘চড়ক’ শব্দটির নামেই তাই শিব৷ চড়ক শতকরা একশোভাগ শিব বা মহাদেবের পুজো৷
অন্য একটি মত হল ‘চড়ক’ একটি বৌদ্ধ অনুষ্ঠান৷ সম্রাট অশোকের সময় নিম্নবর্গীয় মানুষদের মধ্যে এই পার্বণটির প্রচলন ঘটে৷ ‘চণ্ডক’ একজন বৌদ্ধ দেবতার নাম হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় চণ্ডক নামটি আছে। অচলায়তন নাটক থেকে উদ্ধৃতি দিলেই বোঝা যাবে, —
“প্রথম শোণপাংশু। সেইজন্যেই তো ও-জিনিসটা কী রকম দেখতে ইচ্ছা করে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আমাদের মধ্যে একজন, তার নাম চণ্ডক—তার কী জানি ভারি লোভ হয়েছে; সে ভেবেছে তোমাদের কোনো গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়ে আশ্চর্য কী-একটা ফল পাবে—তাই সে লুকিয়ে চলে গেছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। কিন্তু শোণপাংশু বলে কেউ তাকে মন্ত্র দিতে চায় না; সেও ছাড়বার ছেলে নয়, সে লেগেই রয়েছে। তোমরা মন্ত্র দাও না বলেই মন্ত্র আদায় করবার জন্যে তার এত জেদ।
প্রথম শোণপাংশু। কিন্তু পঞ্চকদাদা, আমাদের ছুঁলে কি তোমার গুরু রাগ করবেন?
পঞ্চক। বলতে পারি নে — কী জানি যদি অপরাধ নেন। ওরে তোরা যে সবাই সবরকম কাজই করিস — সেইটে যে বড়ো দোষ। তোরা চাষ করিস তো?
প্রথম শোণপাংশু। চাষ করি বৈকি, খুব করি। পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব ক’ষে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।”
হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় ‘কলিকাতার চড়ক পার্বণ’-এর যে বিবরণ পাচ্ছি তা হল:
‘কলিকাতা সহরের চার দিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্চে, চড়্কীর পিঠ সড়্ সড়্ কচ্চে, কামারেরা বাণ, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে — সর্ব্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নূপুর, মাথায় জরির টুপি, কোমোরে চন্দ্রহার, সিপাইপেড়ে ঢাকাই সাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে ছোবান গাম্চা হাতে বিল্বপত্র বাঁদা, সূতা গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁশারির আনন্দের সীমা নাই — ‘আমাদের বাবুদের বাড়ি গাজোন৷’
আরও যা বিবরণ পাচ্ছি —‘ক্রমে দিন ঘুনিয়ে এলো, আজ বৈকালে কাঁটা ঝাঁপ৷ আমাদের বাবুর চার পুরুষের বুড়ো মূল সন্ন্যাসী কানে বিল্বপত্র গুঁজে হাতে এক মুঠো বিল্বপত্র নিয়ে ধুক্তে ধুক্তে বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো, সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েছে, সুতরাং বাবু তারে নমস্কার কল্লেন; মূল সন্ন্যাসী এক পা কাদা শুদ্ধ ধোব ফরাশের উপর দিয়ে বাবুর মাতায় আশীর্বাদের ফুল ছোঁয়ালেন, — বাবু তটস্থ৷’
‘আজ কার সাধ্য নিদ্রা যায়৷ — থেকে থেকে কেবল ঢাকের বাদ্যি,সন্ন্যাসীর হোররা ও ‘বলে ভদ্দেশ্বর শিবো মহাদেব’ চীৎকার’৷
বাঙালির উৎসব, ব্রতপার্বণের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এক বা একাধিক দেবদেবীর পুজো বা আরাধনা করা হয়৷ কিন্তু ‘চড়কদেবতা’ নামে কোনো দেবতার নাম কোনো বইয়ে উল্লিখিত হয়নি৷
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে পাওয়া যায়, সংস্কৃত ‘চক্র’ থেকে ‘চড়ক’ শব্দের উৎপত্তি৷ ‘শিবের গাজন মহোৎসবে চড়কগাছে ঘুরিয়া চক্রভ্রমণ৷’ অর্থাৎ ‘চক্র’ শব্দ থেকে চক্র, চর্কো হয়ে চড়কো তথা চড়ক শব্দের আগমন৷
বা, চক্র > চকর > চরক > চড়ক।
এই ব্যাখ্যাই বাঙালি বিশ্বাস করে এসেছে বরাবর। কারণ বিকল্প ব্যাখ্যা কেউ দেয়নি। নতুন কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে বাঙালি পণ্ডিতদের রে রে করে তেড়ে আসার অভ্যাস আছে। চক্র থেকে চড়ক হয়েছে, না চণ্ডক থেকে চড়ক হয়েছে, তা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। চড়কপূজা কথাটিতে চড়ককে দেবতার আসনেই বসানো হয়েছে। যেমন কার্তিকপূজা, গণেশপূজা, বিশ্বকর্মাপূজা। চণ্ডকপূজাই কি ক্রমে ক্রমে চড়কপূজা নামে পরিচিত হল?