বহু রাজ্য অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে। মুকেশ অম্বানী তো তাঁর সমস্ত দপ্তরকে পুরো দিনটাই ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। গোটা এলাকা জুড়ে ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ বাজছে আর সেই তালে নাচছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। টন টনে ফল ফুল ট্রাকে চেপে আসা ধূপ দ্বীপে গদগদ করছে ভক্তি। ১২০০ কিলো ওজনের লাড্ডু। আকাশ বাতাস কাঁপানো ধ্বনি ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় সিয়ারাম’… বড় বড় প্রেক্ষাগৃহে টিকিট কেটে দেখানো হচ্ছে এই আয়োজন। কালো গ্রানাইট পাথরে তৈরি ৫১ ইঞ্চি মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা যেন নতুন রামায়ণ রচনা। এই কর্মসূচি ঘিরে সংবাদ পত্র বিশেষ করে নিউজ় চ্যানেল লাগাতার যে কভারেজ করে যাচ্ছে তা কার্যত বুঝিয়ে ছাড়ছে গোটা দেশের কোথাও আর কোনো দুঃখ-কষ্ট-অভাব-সমস্যা বলে কিছু নেই!
মন্দির সম্পূর্ণ হতে আরও সময় লাগবে কিন্তু হুটোপাটি করেই দরোজা খুলে দিতে হল কারণ, লোকসভা ভোটের বড়জোর দু’মাস বাকি। অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের উদ্যোগ থেকে আয়োজন এবং জাঁকজমক স্বাধীন দেশের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা। মাত্র কয়েক একর জমির ওপর বহুকালের একটি ধর্মীয় কাঠামো যেভাবে ‘বিতর্কিত’ পরিচয়ে একটি দেশের সমাজ ও রাজনীতিকে উথালপাথাল করেছে এমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কলঙ্কিত করে রামমন্দির আন্দোলনের সূচনা করে দেশের শাসনক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদী শক্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি হল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়েই। গত তিন-চার দশকে ভারতের ভূ-রাজনীতির মানচিত্রে যে তুমুল রদবদল ঘটেছে তার পেছনে বহু আর্থ-সামাজ-রাজনৈতিক কারণ অবশ্যই আছে কিন্তু এককভাবে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিষয়টি আমূল পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। অন্তত যেদিন থেকে বাবরি মসজিদ চত্বরেই রাম মন্দির তৈরি করার দাবী জানিয়েছে বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরও প্রায় চল্লিশ বছর কোনও ধর্মের মানুষেরই ‘বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি’ নামে পরিচিত উপাসনালয়ে প্রবেশধিকার ছিল না।সরকার মূল ভবনটি তালাবন্ধ রেখেছিল। যেখানে মুসলিমরা এক সময় নিয়মিত নামাজ পড়তেন সেখানে কেন হঠাৎ তালা ঝোলাতে হলে আর প্রায় ৩৭ বছর পর কেন সেই তালা খুলে দিয়ে মন্দিরের ‘শিলান্যাস’ করতে দেওয়া হল, এখনো অনেকে সেই প্রশ্ন করেন। কাকতালীয় হলেও দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর নির্দেশেই বিতর্কিত স্থান তালাবন্ধ হয়েছিল, সেই তালা খুলেছিল তাঁরই দৌহিত্র রাজীব গান্ধীর সরকার। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালের লোকসভায় বিজেপি ২টি আসন পেয়ে খাতা খুলেছিল। তখন দেশে রাম মন্দির ঝড় ওঠেনি। ১৯৮৯-এর লোকসভা, দেশে রাম মন্দির আন্দোলন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, বিজেপি জিতে নেয় ৮৫টি আসন। পরের বছর আডবাণীর ঐতিহাসিক রথযাত্রা। ভিপি সিংহ সরকার পড়ে যাওয়ায় ১৯৯১-তে ফের লোকসভা ভোট। বিজেপি একলাফে পৌঁছে গেল ১২০-তে। ১৯৯৬ সালের লোকসভায় ১৬১টি আসন জিতে বিজেপি বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার টিকলো মাত্র ১৩ দিন।
এরপর এইচ ডি দেবেগৌড়া ও আই কে গুজরালের দুটি মিলিজুলি সরকার চলে কিছুদিন করে। ১৯৯৮-র লোকসভায় ১৮২টি আসন জিতে ফের একক বৃহত্তম দল বিজেপি। তৈরি হল ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স ওরফে এনডিএ। কিন্তু সেটিও টেকে ১৩ মাস, যদিও এক বছর পর ফের লোকসভা ভোটে ফিরে এসে এনডিএ পুরো ৫ বছর টিকে থাকে। ২০০৪-র লোকসভায় এনডিএ-র অপ্রত্যাশিত ভরাডুবি হলে ক্ষমতা দখল করে ইউপিএ। ২০০৯ সালেও ক্ষমতায় ফেরে ইউপিএ সরকার। বিজেপির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। অটলবিহারী বাজপেয়ী অবসর নেন, আডবাণী দলে গুরুত্ব হারান, উল্কার মত উত্থান ঘটে নরেন্দ্র মোদীর। বিশেষত ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গার জেরে বিতর্কিত মোদী হয়ে ওঠেন বিজেপির প্রধান মুখ। তাঁরই নেতৃত্বে ২০১৪ সালে ২৮২টি আসন জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় ফেরে বিজেপি। ২০১৯ সালেও দ্বিতীয়বারের মত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগষ্ঠিতা অর্জন করে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি।
এই রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে যে রামমন্দির আন্দোলনের বিরাট ভূমিকা আছে তা অস্বীকার করা যায় না। কেবল তাই নয়, হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের প্রসারে কংগ্রেসের দ্বিধান্বিত ভূমিকা অনেকাংশেই দায়ী, এর জন্য তারা দেশের মুসলিম জনসমর্থন অনেকটা হারিয়েছে। মুসলিম সমাজ ক্রমশ কংগ্রেসের প্রতি ভরসা হারিয়েছে, হিন্দি বলয় বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকে কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। লোকসভায় উত্তরপ্রদেশের মোট ৮০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস টিকে আছে মাত্র সোনিয়া গান্ধীর আসন রায়বেরিলি। তবু কেন রাম মন্দির, রাম সুতোর রাজনীতি দিয়ে ঘিরতে হয় দেশ? গত লোকসভার ৩০৩ আসন টপকাতে হলে দক্ষিণ ভারতের আসনগুলি পেতে হবে, ৪০০ আসন জেতার ডঙ্কা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, এদিকে উন্নয়ন, কোটি কোটি যুবকের চাকরি-সমেত যাবতীয় প্রতিশ্রুতির ঢোল ফেঁসে গিয়েছে তাই লোকসভার আগে ধর্মের সুচারু মোড়কে হিন্দু ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহযোগিতায় হিন্দু ভোট একত্র করে ভোট বৈতরণী পাড়।