বৈশাখ মাস শুরু হয়েছে।এই মাসটি মূলত ভগবান বিষ্ণু এবং পরশুরামের পুজোর শ্রেষ্ঠ মাস। বিশ্বাস করা হয় যে বৈশাখ মাসে পুজো, ব্রত পালন ও উপবাস করলে জীবনে সুখ সমৃদ্ধি আসে। বৈশাখ মাসে বরুথিনী একাদশীর উপবাস পালন করা হয়, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত।
পদ্মপুরাণ অনুসারে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে বরুথিনী একাদশীর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির কোন এক সময় শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে বাসুদেব, বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম কি ও তার মাহাত্ম্য কেমন? তা দয়া করে আমাকে বলুন।’
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে রাজন! এই একাদশীর নাম বরুথিনী একাদশী। এটি ইহলোকে মহাসৌভাগ্য প্রদান করে, এই ব্রত পালনে প্রেমানন্দ লাভ হয়। সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি ভক্তদের দুঃখ থেকে রক্ষা করে এবং তাদের পার্থিব সুখ এবং মুক্তি প্রদান করে। ভাগ্যহীনা নারীও এই ব্রতের প্রভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে জন্মমরণ চক্র থেকে মুক্তি লাভ করে।
জনশ্রুতি আছে যে, ব্রহ্মার পঞ্চম মাথা কেটে ফেলার পাপ থেকে মুক্তি পেতে ভগবান শিব স্বয়ং বরুথিনী একাদশী ব্রত করেছিলেন। এর ফলে তিনি ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পান। ধুন্ধুমার মান্ধাতা প্রভৃতি রাজগন এই ব্রত পালন করে বৈকুন্ঠে গমন করেছিলেন। অযুত বৎসর ব্যাপী তপস্যার ফল এক বরুথিনী ব্রতে লাভ হয়। কুরুক্ষেত্রে এক মন সোনা দানের ফল বরুথিনী ব্রতের সমান। অশ্ব, গজ, ভূমি, তিল, স্বর্ণ, অন্ন দান ক্রমে ক্রমে শ্রেষ্ঠতর। অন্নদানের থেকেও কন্যা ও গোদান শ্রেষ্ঠ।বরুথিনী ব্রতে সকল ফলই লাভ হয়। বরুথিনী ব্রতের দিন শ্রীমধুসূদনের পুজো করে রাত্রি জাগরন করলে ব্রতির সকল পাপ দূর হয়। পাপভীরু মানুষ যমের যাতনা থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য অবশ্যই এই ব্রত পালন করেন।বরুথিনী একাদশীর পরের দিন ১০০ কন্যাদানের সমান গুরুত্ব বহন করে।
বরুথিনী একাদশী কবে : এই বছর বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথি শুরু হবে (২০২৫ সালের) ২৩ এপ্রিল বিকেল ৪টে ৪৩ মিনিটে। এটি ২৪ এপ্রিল দুপুর ২টো ৩২ মিনিটে শেষ হবে। এমন পরিস্থিতিতে, ২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল বরুথিনী একাদশীর উপবাস পালন করা হবে।
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, বরুথিনী একাদশীর উপবাসের পারণ ২৫ এপ্রিল পালন করা হবে। এই দিন ভোর ৫টা ৪৬ মিনিট থেকে ৮টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত উপবাস ভাঙতে পারেন।
শুভ যোগ : বরুথিনী একাদশীর দিনে, শতভিষা নক্ষত্রের যোগ হবে, যা সকাল ১০টা ৪৯ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এই দিন, ব্রহ্ম যোগেরও সংযোগ হবে, যা বিকাল ৩টে ৫৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এর পরে ইন্দ্র যোগ তৈরি হবে।
ব্রত কথা : দানশীল ও তপস্বী রাজা মান্ধাতা একদিন বনে ধ্যান করছিলেন, সেই সময় একটি ভালুক তাকে আক্রমণ করে। ভাল্লুকটি রাজার পা ধরে টানতে শুরু করেন অসম্ভব যন্ত্রণা সত্বেও , রাজা তার ধ্যান থামাননি এবং এক মনে ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। কোন এক সময় ভাল্লুক রাজার পা টানতে টানতে বনে নিয়ে চলে যায়।। ভক্তের কষ্ট দেখে ভগবান স্বয়ং প্রকট হয়ে তার সুদর্শন চক্র দিয়ে ভল্লুকটির মাথা কেটে ভক্তকে রক্ষা করেন।
কিন্তু ভাল্লুকের হামলায় রাজা মান্ধাতার পা ইতিমধ্যেই আহত ছিল এবং এবং সেটি নষ্ট হয়ে যায়। রাজন ভগবানকে জিজ্ঞাসা করেন, তার এই কষ্টের কারণ কি? ভগবান তখন তাকে স্মরণ করায় তার গতজন্মের পাপকর্মের কথা। ভগবান বিষ্ণু রাজাকে
তার স্বাস্থ্য এবং শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বরুথিনী একাদশী ব্রত পালন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।মথুরায় গিয়ে এই ব্রত পালন ও বরাহ রূপের পুজোর পরামর্শ দেন রাজাকে। এই ব্রতর পুণ্য প্রভাবে রাজা পুনরায় নব দেহ লাভ করবেন বলে জানান ভগবান।
রাজা ব্রত গ্রহণ করেন এবং ভগবান বিষ্ণুর বরাহ অবতারের কাছে প্রার্থনা করেন। পরবর্তীকালে, তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং অবশেষে স্বর্গে পৌঁছান। ভগবান বিষ্ণু পুনরায় নিশ্চিত করেন যে এই ব্রত পাপ দূর করে এবং মুক্তি নিশ্চিত করে। যারা অসুস্থ বা ভীত তারা এই পবিত্র উপবাস পালন করতে পারেন এবং ভগবান বিষ্ণুর কাছ থেকে সুরক্ষা পেতে পারেন।
পুজা পদ্ধতি : বরুথিনী একাদশীতে, ভক্তরা কঠোর উপবাস পালন করেন। একাদশীর একদিন আগে অর্থাৎ দশমীতে একটি সাধারণ খাবার খেয়ে তারা শুরু করেন।
বরুথিনী একাদশীর দিন, খুব ভোরে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরুন। এরপর ঘরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে ও পুজোর স্থানে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি স্থাপন করুন।
এরপর ভগবানকে ফুল এবং হলুদ মিষ্টি উৎসর্গ করুন। এরপর খাঁটি দেশি ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালান। সেই সঙ্গে এই দিন ভগবান বিষ্ণুকে হলুদ ফল নিবেদন করুন। জীবনে সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের জন্য প্রার্থনা করার সময় ভগবান বিষ্ণুর মন্ত্র জপ করুন ও বরুথিনী একাদশীর ব্রত কথা পাঠ করুন। পুজো শেষে আরতি করুন এবং অভাবীদের দান করুন।
একাদশীতে ব্রতিগণ সম্পূর্ণরূপে শস্য পরিহার করেন, দ্বাদশীর দিন ভোর পর্যন্ত উপবাস রাখেন। কিছু খাদ্যদ্রব্য যেমন ভাত, ছোলা, কালো ছোলা, মসুর ডাল, মধু, সুপারি এবং আমিষ খাবার সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলেন।একাদশীর সময় শিম এবং শস্য খাওয়া হয় না, কারণ এই দিনে এই দুটি খাবার পাপ দ্বারা দূষিত বলে বিশ্বাস করা হয়। একাদশীর সময় শুধুমাত্র ফল, শাকসবজি এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়া হয়। এই ত্যাগের সময় একাদশীর সূর্যোদয় থেকে একাদশীর পরের দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত চলে।
ভগবান বিষ্ণুর, বিশেষ করে তাঁর বামন অবতারের পূজা, বরুথিনী একাদশী ব্রতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভক্তরা তাদের উপবাসকে ফলপ্রসূ করার জন্য সম্পূর্ণ নিয়মানুবর্তিতার সাথে বিশেষ পূজা করেন। তারা ঘুম, ক্রোধ, জুয়া, শরীরে তেল দেওয়া এবং খারাপ চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকেন। ভক্তরা এই পবিত্র উপবাসের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য ব্রহ্মচর্য, দানশীলতা এবং আত্ম-সংযমও মেনে চলেন।
বরুথিনী একাদশীতে বিষ্ণু সহস্রনাম এবং ভগবদগীতার মতো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শোনা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়। ভক্তরা ভজন গেয়ে এবং ভগবান বিষ্ণুর গল্প শুনে দিনটি কাটান। এই দিনে সাধ্যমত দান করাও অত্যন্ত শুভ।