প্রাচীন কবি কালিদাস বলেছেন, ‘আশ্বাসঃ পিশাচো হপি ভোজনেন’। অর্থাৎ পিশাচকেও ভোজন দ্বারা বাগে আনা যায়। কথাটা হাস্যরসাত্মক হলেও বাস্তব সত্যের খুব কাছাকাছি। পরবর্তীকালেও বহু কবি ও লেখক সুযোগ পেলেই সুখাদ্যের ব্যাখ্যায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন।
গৃহিণী যদি সু-রাঁধুনি হন তাহলে কর্তার মান ভাঙাতে বেশি অনুনয় করতে হয় না। প্রাচীনকালে রন্ধনশৈলীকে চৌষট্টি কলার অন্যতম কলা বলে গণ্য করা হতো। বস্তুত রন্ধনশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সুকুমার কলা বলে গণ্য করা হতো। আদিম মানুষ সব খাদ্য কাঁচা খেতে অভ্যস্ত ছিল। আমিষ-নিরামিষ সবই কাঁচা খেত। যেই আগুন আবিষ্কৃত হলো অমনি কাঁচা ছেড়ে ঝলসে খেতে শুরু করল। ক্রমে মানুষের রুচি বদলাতে লাগল।
কাঁচা খাওয়ার বদলে রেঁধে খাওয়ার রীতি শুরু হলো এবং সেদিন থেকে রান্নার প্রক্রিয়া নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলো এবং সব আবিষ্কারের মতো রান্নার নতুন নতুন পদ আবিষ্কার হু হু করে বাড়তে ও বদলাতে লাগল। রন্ধনশিল্পীরা ক্রমে খাদ্যের নানা পদ সৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
বৈদিক সংস্কৃতে ভোজন শব্দের দুটি অর্থ ছিল। সে সময় ভোজন অর্থে সুখানুভূতি এবং খাদ্য দুটোই বোঝানো হতো। ভোজনে জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াও যে একটা তৃপ্তি বা আনন্দের অনুভূতি আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্যই বোধ করি সর্বস্তরের মানুষ কমবেশি সবাই সুখাদ্যের অনুরাগী ও অনুসারী। অনেকে আছেন যারা হয়তো ভোজনবিলাসী নন কিন্তু ভোজনরসিক, পরিমাণে খান অল্প কিন্তু যেটুকু খান তা হতে হয় স্বাদু ও পরিতৃপ্তিদায়ক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তবালা দেবীর মেয়ে বাসন্তীকে লিখেছেন, ‘আমাকে পেটুক বলে যদি কল্পনা কর তাহলে ভুল করবে। আমি যতটা খাই তার চেয়ে গুণ গাই বেশি’ কবি নিজে নতুন নতুন রান্না আবিষ্কার করতেন। তিনি রান্নায় ব্যস্ত পত্নীর পাশে মোড়া নিয়ে বসে নতুন রান্নার ফরমাস করতেন, নানাভাবে রান্নার নতুন পদ্ধতি শেখাতেন স্ত্রীকে। তবে এ কথা মানতেই হয়, ভোজনবীরের সংখ্যাও আমাদের সমাজে নেহাত কম নয়। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘মধ্যযুগের বাঙ্গালা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নবাবী আমলে বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী জমিদার রাজস্ব বাকির দায়ে বন্দিভূত হইয়া গোটা একটা খাসি রাঁধিয়া একাকী নিঃশেষ করায় বাকি খাজনা হইতে রেহাই পাইয়াছিলেন।’ রাজা রামমোহন রায়ও নাকি একা একটি আস্ত পাঁঠা খেতে পারতেন। রাজা রামমোহন রায়ের মতো বিস্ময়কর উদাহরণ ইউরোপেও আছে। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোও নাকি এক বসায় একটি ষাঁড়ের অর্ধেক ভোজন করতে পারতেন।
প্রাচীন ইউরোপে বিশেষ করে রোমান ও গ্রিকদের আহার-বিহার ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানা যায়। ভোজনবিলাসী হিসেবে প্রাচীন রোমান ও গ্রিকদের খ্যাতি ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তাঁদের প্রথম স্মরণীয় রান্নার বইয়ের লেখক অ্যাপিকিয়াস (Marcus Gavius Apicius) ছিলেন খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের শৌখিন খাদ্যরসিক। তিনি লিখেছেন খাওয়া-দাওয়ার ওপর চমৎকার একটি বই। মহাকবি হোমারের (Homer) লেখায় পাওয়া যায় প্রতিটি ভোজের সযত্ন ও সবিস্তার বর্ণনা। এ ছাড়া প্রাচীন ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসও (Herodotus) সে সময়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে লিখে গেছেন বিস্তর। অন্যদিকে মহাভারতের দ্রৌপদীকে একবারের জন্যও রন্ধনশালায় দেখতে পাওয়া যায় না। রামায়ণে সীতা রামের সঙ্গে ১৪ বছর দন্ডকারণ্যে বনবাসে কাটালেও এক দিনের জন্যও সীতাকে রান্না করতে দেখা যায় না। সব সময় রামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণকেই খাবারের জোগাড়যন্ত্র করতে দেখা যায়। এজন্যই বোধহয় লেখক ও কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘ভোজনশিল্পী বাঙালি’ গ্রন্থে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘বনবাসী রাম-লক্ষ্মণকে আমরা মাঝে-মাঝেই দেখি মৃগয়া-হত রাশি-রাশি পশু নিয়ে বাড়ি ফিরতে — গোসাপ, বুনো শুয়োর, নানা জাতের হরিণ; পুঁথিতে এও পড়া যায় যে তিনজনেরই প্রিয় খাদ্য ছিল শল্যপক মাংস — যাকে আমরা আজকাল বলি শিক-কাবাব; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত আর কোনো তথ্য জোগানো হয়নি। মৃত পশুর ছাল-চামড়া কে ছাড়াতো, কে কাটতো টুকরো ক’রে, কে ধরাতো উনুন, শিকে বিঁধে আগুনে ঝলসাবার ভার থাকতো কার উপর, কোন ধরনের পানীয়ের সঙ্গে সেই “অগ্নিতপ্ত পবিত্র” মাংস কণ্ঠনালী দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হতো, সঙ্গে থাকতো কোন কোন ফল অথবা সবজি — এই সবই স্রেফ আমাদের কল্পনার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
সেই প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের মূল কাঠামোটি মোটামুটিভাবে ঠিক থাকলেও সময়ের ব্যবধানে ভারতবর্ষে তথা এই বঙ্গে নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে প্রতিনিয়তই যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সব অনুষঙ্গ। প্রাচীনকালে বাঙালির খাওয়া-দাওয়া প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইটিতে লিখেছেন, ‘ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে-দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। ভাত-ভক্ষণের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান। উচ্চকোটির লোক হইতে আরম্ভ করিয়া নিম্নতম কোটির লোক পর্যন্ত সবারই প্রধান ভোজ্যবস্তু ভাত। ভাত রাঁধার প্রক্রিয়ার তারতম্য তো ছিলই, কিন্তু তাহার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই বলিলেই চলে। উচ্চকোটির বিবাহভোজে যে-অন্ন পরিবেশন করা হইত সে-অন্নের কিছু কবি শ্রীহর্ষের বিবরণ নৈষধচরিতে দময়ন্তীর বিবাহভোজের বর্ণনায় পাওয়া যায়। গরম ধূমায়িত ভাত ঘৃত সহযোগে ভক্ষণ করাটাই ছিল বোধ হয় সাধারণ রীতি। নৈষধচরিতের বর্ণনা বিস্তৃততর — ‘পরিবেশিত অন্ন হইতে ধূম উঠিতেছে, তাহার প্রত্যেকটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আর একটি বিচ্ছিন্ন (র্ঝঝরে ভাত), সে-অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু ও শুভ্রবর্ণ, সরু এবং সৌরভময়। দুগ্ধ ও অন্নপক্ব পায়েসও উচ্চকোটির লোকেদের এবং সামাজিক ভোজে অন্যতম প্রিয় ভক্ষ্য ছিল। ’
ভোজনরসিক বলে বাঙালির সুখ্যাতি থাকলেও চট করে কোনো বিদেশি অনুষঙ্গ নিজ রসুইঘরে ঢোকাবে এতটা উদার বাঙালি কোনোকালেই ছিল না। আর সেজন্যই পর্তুগিজ, ইংরেজ, ফরাসি কিংবা দিনেমাররা ইউরোপ থেকে বহু কিছু নিয়ে এলেও সেগুলোকে নিজের করে নিতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল বাঙালির। বিশিষ্ট লেখক ও ইতিহাসবিদ শ্রীপান্থ আমাদের জানাচ্ছেন, ফুলকপির চাষ ভারতে শুরু হয় ১৮৫০ সালে। বাঁধাকপি তার কিছুটা আগে। টমেটো অবশ্য ভারতে আসে আরও কিছুকাল পরে, ১৮৮০ সাল নাগাদ। কিন্তু কলম্বাসের আবিষ্কার সেই গোল আলু ভারতে আসে ১৭৮০ সালে। ১৮৩০ সালের দিকে দেরাদুন পাহাড়ের ঢালে আলুর ব্যাপক চাষাবাদ শুরু হয়। কিন্তু কলকাতার বাজারে গোল আলু বিক্রি হতে শুরু করে তার অনেক আগেই। তবে বাঙালি সমস্ত সবজির মধ্যে আলুর মাহাত্ম্যটাই বোধ করি সবার আগে ধরতে পেরেছিল। অন্য বিদেশি সবজিগুলো বাঙালির হেঁসেলে ঢুকতে তার পরও বেশ কিছুদিন নেয়। সে বিষয়ে আমরা জানতে পারি বিখ্যাত লেখক প্রবোধকুমার সান্যালের বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘বনস্পতির বৈঠক’ গ্রন্থটি থেকে। তিনি ১৯২০ সালে বাঙালির ভোজ্যপণ্যের একটি চিত্র এঁকেছেন তার বইয়ে। বইটির প্রথম খন্ডের ১৬৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘শীতের দিনে হাঁটা সুবিধে। নির্জন নিরিবিলি গ্রামের পথ, বন-বাগান ক্ষেতখামার ছাড়িয়ে চলেছে সে। মাঝে মাঝে খড়ের গাড়ি, তার পিছু পিছু যাচ্ছে গাড়িগাড়ি ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন আর মুলো। টমেটোর নাম ছিল বিলেতি বেগুন, তার সঙ্গে বীট, গাজর, সয়াবিন, লেটুস — এসব কোনটাই কেউ তখন খেত না! বাজারেও তাই ওসব আসত না। ওসব গাড়ি যেত ইংরেজদের হগসাহেবের বাজারে।’
অনেক অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে এটা আসতেই পারে যে, মাছ, মাংস ও বহুরকম ব্যঞ্জনে বাঙালি কী ধরনের মসলা ব্যবহার করত। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, নিম্নকোটির লোকজন তাদের রান্নার কাজে সাধারণ মসলারই ব্যবহার করত। প্রাচীনকালে মরিচ তো ভারতবর্ষে ছিলই না। ভারতবর্ষে প্রথম মরিচ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটক ভাসকো দা গামা। এ বঙ্গে ১৬০০ সাল নাগাদ তরকারিতে মরিচ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতে মরিচ আসার আগে ঝালের জন্য গোলমরিচ ও আদা ব্যবহৃত হতো। অন্যান্য মসলা যেমন ধনে, জিরা এগুলো তো ছিলই আরও ব্যবহৃত হতো হলুদ। তবে হলুদের ব্যবহার আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় প্রথম শুরু হয় তারপর ধীরে ধীরে ব্যঞ্জনে হলুদ ব্যবহৃত হতে থাকে। গরিব মানুষ সাধারণ মসলা ব্যবহার করলেও উচ্চকোটির মানুষ কিন্তু তাদের রান্নায় ব্যবহার করত শতেক মসলা। আবুল ফজল লিখেছেন, ‘প্রথমত, ঘিয়ের মাত্রাহীন ব্যবহার। ঘি আসত নাকি হিসার থেকে। প্রতিদিন মন মন ঘি খরচ হয়েছে আকবরের রন্ধনশালায়। দ্বিতীয়ত, মসলার ব্যবহার। এমন কোনো মসলার নাম খুঁজে পাওয়া শক্ত যা মুঘল রন্ধনশালায় ব্যবহার করা হয়নি। উচ্চশ্রেণির নানা ধরনের চাল আসত নিকট দূরের নানা এলাকা থেকে। মাংস ও ফলফলারিও তা-ই। ফলের জন্য কাশ্মীর, আফগানিস্তানেও হানা দিতে কসুর করতেন না রন্ধনশালার অধ্যক্ষরা। তাদের প্রধানকে বলা হতো “মির বাকওয়াল”। পাচকরা ছিল নানা দেশের ওস্তাদ। তাদের প্রধানকে বলা হতো “মির বাবুর্চি”। তিনি মান্য ব্যক্তি। তাঁকে সম্বোধন করা হতো “হাকিম হুনান” বলে।’ পাঠক জেনে অবাক হবেন যে, প্রাচীনকাল থেকেই সনাতনধর্মের মানুষের কাছে পিয়াজ ও রসুন খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। হিন্দুরা মনে করতেন পিয়াজ ও রসুন ম্লেচ্ছদের খাবার। পিয়াজ, রসুনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হতো হিং। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে রচিত রামায়ণে আমরা দেখি হিং দিয়ে আগুনে ঝলসে খাওয়া হচ্ছে সবরকম মাংস। আবার এর ঠিক ২ হাজার বছর পর অর্থাৎ ১৬০০ সালে বিজয়গুপ্তের লেখা মনসামঙ্গলে কবি লিখেছেন, ‘রন্ধন রান্ধিয়া সোনাই করিল ভাগ ভাগ/হিঙ্গ মরিচে রাঁধিলে শ্বেত সরিষার শাগ। ’
বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে কোনো তরকারিতে ঝোল খাওয়া। কলকাতায় একবার এ সময়ের জনপ্রিয় লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী আমাকে একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়েছিলেন, নাম ‘ঝালে ঝোলে অম্বলে’। মনে আছে বেশ খেয়েছিলাম সেদিন। যা হোক, অনেকে হয়তো বলে উঠবেন — এ আবার কী কথা! তরকারি হবে অথচ ঝোল হবে না, এ কি হয়! জি জনাব, সত্যি বলছি। প্রাচীনকালে কোনো ব্যঞ্জনেই ঝোল খাওয়া হতো না। রামায়ণ, মহাভারতে শতরকম মাছ, মাংস হিং দিয়ে যে ঝলসে খাওয়া হতো সে কথা তো আগেই বলেছি। এ ছাড়া মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার লেখায়ও ঝোল খাওয়ার কোনো উল্লেখ নেই। তিনি লিখেছেন, ‘মুসলিম ধনাঢ্যদের ভাত ও রুটি ছাড়াও পরিবেশিত হতো রোস্টেড বা ঝলসানো মাংস, মুরগির মাংস।’ রুটির মধ্যে ‘সামসুক’ নামেও একটি রুটির উল্লেখ করেছেন তিনি। সেটি গোলাকার, কিন্তু ভিতরে থাকত সুমিষ্ট প্রলেহ। একবার মুহাম্মদ বিন তুঘলক এক বড় খানার আয়োজন করেন একজন মান্য কাজির সম্মানে। খাদ্য ছিল রুটি, মস্ত মস্ত খন্ড করে ঝলসানো ভেড়ার মাংস, ঘিয়ে চোবানো গোলাকার পিঠে, বাদাম ও মধু। মাংসে নাকি তিল তেলের মিশ্রণ ব্যবহার করা হতো এবং পরিবেশন করা হতো চীনামাটির পাত্রে। তারপর ‘হাসমি’ ও ‘আল কুহিরিয়া’ নামে পুডিং। শরবত দিয়ে আরম্ভ ও পান-সুপারি দিয়ে সমাপ্তি।
ঝোল খাওয়ার প্রথম নজির মেলে চৈতন্য চরিতামৃত, ধর্মমঙ্গল ও মনসামঙ্গল কাব্যে। কবি নারায়ণদেব লিখেছেন, ‘ভাজিয়া তুলিল কথ চিথলের কোল/মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।’ ধারণা করা হয়, ১৫০০ সাল নাগাদ বাঙালি তরকারিতে ঝোল খাওয়া শুরু করে।
ঝোল সম্পর্কে বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, ‘পূর্ববাংলার গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর জাহাজের খালাসিরা যে মুরগির ঝোল রান্না করে সেরকম ঝোল ভূ-ভারতে আর কেউ রাঁধতে পারে না। সেজন্যই বোধকরি স্বামী বিবেকানন্দ বাংলাদেশের ঝোলের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। কোনো এক সূর্যগ্রহণের দিনে স্বামীজি তাঁর এক শিষ্য বলরাম বসুর বাড়িতে শিষ্যের হাতে সেবা গ্রহণে উৎসাহী হয়েছেন। স্বামীজি পূর্ববঙ্গজ শিষ্যের হাতে পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে রান্না খেতে চাইলেন। যোগীন মা রান্নার কাজে সাহায্য করছিলেন। স্বামীজি মাঝে মাঝে রান্নাঘরে এসে রান্নার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। কখনো বলছিলেন, “দেখিস মাছের ‘জুল’ যেন ঠিক বাংলাদেশি ধরনের হয়”। ভাত, মুগ ডাল, কই মাছের ঝোল, মাছের টক ও মাছের সুক্তুনি রান্না হতে না হতেই স্বামীজি খেতে বসে গেলেন। তিনি মাছের সুক্তুনি খেয়ে খুশি হলেন, মাছের “জুল”-কে ঝাল বললেন। মাছের টক খেয়ে বলেন, “এটা ঠিক বর্দ্ধমানী ধরনের হয়েছে”। দই, সন্দেশ দিয়ে তিনি আহার শেষ করলেন। আহার শেষে তামাক টানতে টানতে বললেন, “যে ভালো রাঁধতে পারে না, সে ভালো সাধু হতে পারে না — মন শুদ্ধ না হলে ভালো সুস্বাদু রান্না হয় না”। ’
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।