শনিবার | ২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:২৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
সিন্ধু সভ্যতার ভূখণ্ড মেলুহা-র সঙ্গে বাণিজ্যে মাগান দেশ : অসিত দাস তদন্তমূলক সাংবাদিকতা — প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি : দিলীপ মজুমদার হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল-স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটির : ড. দীপাঞ্জন দে রামমোহন — পুবের সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলে গেলেও শেষ জীবনে পিছু ছাড়েনি বিতর্ক : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাওবাদী দমন না আদিবাসীদের জমি জঙ্গল কর্পোরেট হস্তান্তর : তপন মল্লিক চৌধুরী জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রী অপরা একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত পর্যটন মানচিত্রে রামমোহনের জন্মভূমিতে উন্নয়ন না হওয়ায় জনমানসে ক্ষোভ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সংগীতে রবীন্দ্রনাথ : সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোয়ার সংস্কৃতিতে সুপারি ও কুলাগার কৃষিব্যবস্থা : অসিত দাস পুলওয়ামা থেকে পহেলগাঁও, চিয়ার লিডার এবং ফানুসের শব : দিলীপ মজুমদার ক্যের-সাংরী কথা : নন্দিনী অধিকারী সুপারি তথা গুবাক থেকেই এসেছে গোয়ার নাম : অসিত দাস রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় উনিশের উত্তরাধিকার : শ্যামলী কর কেট উইন্সলেটের অভিনয় দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জিং ভূমিকার ৩টি চলচ্চিত্র : কল্পনা পান্ডে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (ষষ্ঠ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস ভারতের সংবিধান রচনার নেপথ্য কারিগর ও শিল্পীরা : দিলীপ মজুমদার চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

‘ইউলিসিস সিন্ড্রোম’ : স্থবির দাশগুপ্ত

স্থবির দাশগুপ্ত / ১০৩৭ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ২২ মে, ২০২৩

“বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল”

নামজাদা হাসপাতাল। আধুনিকতায় ফাঁকি নেই, যাবতীয় সাজসরঞ্জাম মজুত। কর্তৃপক্ষের শ্যেনদৃষ্টি: ডাক্তারদের সেবাকর্মে যেন ঘাটতি না-থাকে, রোগীর প্রাপ্যে যেন খামতি না-থাকে। আজকাল আইন-আদালত থেকেও গা বাঁচিয়ে থাকতে হয়, পানের গায়ে চুন যেন জ্বলজ্বল করে। রোগীপত্তর নিয়ে দড়ি টানাটানির বাজার, বদনাম যেন না-জোটে।

বৃদ্ধ ভর্তি হলেন। ভর্তির হ্যাপা নেই মোটে, এ তো আর সরকারি হাসপাতাল না। প্রস্টেট গ্ল্যান্ডটা বড় হয়েছে, অপারেশন করিয়ে নিলেই শান্তি, ডাক্তারের আশ্বাস। পছন্দের ডাক্তার— প্রশান্ত, ইউরোলজিস্ট। নামের সঙ্গে চেহারার অবিকল মিল, চোখেমুখে একটা বিচক্ষণতার ছাপও মূর্তিমান। বেশ নাম করেছেন ইদানীং। নতুন এসেছেন এই হাসপাতালে।

“খরচ-খরচার কথা তো বললেন, কিন্তু ক’দিন থাকতে হবে, ডাক্তারবাবু?”

“ক’দিন আর, এই ধরুন মেরেকেটে দিন পাঁচ-সাত। ভর্তি হবেন একদিন, তারপর অ্যানাস্থেটিক চেক-আপ। ব্যাস্, পরের দিন অপারেশন। তারপর দিন কয়েক দেখেশুনে আপনাকে ছেড়ে দেব। চিন্তা নেই।”

“চিন্তা নেই তো? কোনও কমপ্লিকেশন হবে না তো?”

“দেখুন, একেবারে হলফ করে তো বলতে পারি না, তবে তেমন কিছু হওয়ার কথা না, এটকুই বলতে পারি।”

বৃদ্ধ বিপত্নীক, নিঃসন্তান। ছোট ভাইয়ের সংসারে বাস। সঞ্চয় কিছু আছে, সেই ভরসায় দিনাতিপাত। “আসলে কী জানেন তো, আপনার সুনাম শুনেছি বলেই এই হাসপাতালে আসা, নইলে আমাদের আর তেমন সামর্থ্য কই! টাকা-পয়সা যা বললেন, যাহোক করে যোগাড়যন্ত্র করে নেব। তারপর আপনিই ভরসা।”

সেই ভরসায় রোগী ভর্তি হলেন। যত্নআত্তি মন্দ না। সিস্টাররাও সদাহাস্যমুখী। নতুন পরিবেশে ধাতস্থ হতে একটু সময় তো লাগেই। “আমার অপারেশনটা কি কালকেই? কখন, সিস্টার? ভাইকে জানাতে হবে তো…।”

“না, কাল তো হবে না। অ্যানাস্থেটিস্টকে জানিয়েছি, উনি কালই কয়েকটা টেস্ট করিয়ে নিতে বললেন। তারপর এসে দেখবেন।”

“কিন্তু টেস্ট তো আমার হয়ে গেছে, প্রশান্ত ডাক্তার করিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, ওগুলো রুটিন। রিপোর্টগুলো আপনাদের কাছে জমা দিলাম তো।”

“হ্যাঁ, দেখেছি, জানিয়েও দিয়েছি। কিন্তু উনি বললেন, ওগুলো দু’সপ্তাহ আগেকার রিপোর্ট, রিসেন্ট রিপোর্ট চাই। উনি আবার আমাদের এই হাসপাতালের রিপোর্টই পছন্দ করেন কিনা!”

বৃদ্ধ নিরুপায়, সিস্টারও। অতএব পরের দিন সকালেই দ্বিতীয়বার রুটিন পরীক্ষা। রিপোর্ট আসতে সন্ধে। প্রশান্ত ডাক্তার এলেন, মনোযোগ দিয়ে রিপোর্টগুলো দেখতে দেখতে মুখে যেন ঈষৎ বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো… কার প্রতি তা তক্ষুনি বোঝা গেল না। কিন্তু মৃদু হেসে বৃদ্ধকে বললেন, “সব তো ঠিকই আছে মনে হয়। এবার অ্যানাস্থেটিস্ট আসুন, দেখুন। একদিন দেরি হয়ে গেল, তবে কালই অপারেশন।”

বৃদ্ধ বহুদর্শী— আশ্বাসবাণী শুনেও যেন সংশয় সহজে কাটে না। তাই প্রতীক্ষা, অ্যানাস্থেটিস্ট যে কখন আসবেন! ইতিউতি ব্যস্ত সিস্টাররা বললেন, “আসবেন, আসবেন, উনি ব্যস্ত মানুষ তো, একটু রাত হবে হয়তো। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন। আপনার ডাক্তারবাবু তো বলেই গেলেন, কালই অপারেশন।”

তবু ঘুম আসে না। শুয়ে-বসে-পায়চারি করতে করতে রাত ন’টা বাজলো, হন্তদন্ত হয়ে অ্যানাস্থেটিস্ট ঢুকলেন। দুয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন… “ডায়াবিটিস নেই তো?” “কই, না তো। আছে বলে শুনিনি কখনও।”

এই ডাক্তার যেন আরও বেশি মনোযোগী। প্রশ্ন করছেন, তবে উত্তরটা ঠিক কতটা শুনছেন বোঝা মুশকিল। ভুরূ কুঁচকে রিপোর্ট দেখতে দেখতে বললেন, “কিন্তু… আচ্ছা, হার্টের রোগ-টোগ নেই তো, ব্লাড প্রেশার? ওষুধ-টষুধ খান?” “কই না তো, কোনও ওষুধ তো খেতে হয় না।”

পাশে দাঁড়ানো সিস্টার মাথা নেড়ে বললেন, ‘না স্যার, ওসব কিছু নেই।”

গম্ভীরমুখে ডাক্তার বললেন, “হুম্ম!”

তারপর সব কাগজপত্র সরিয়ে ব্লাড রিপোর্ট দেখতে দেখতে বললেন, “না সিস্টার, আমার ভাল লাগছে না। হিমোগ্লোবিনটা কমছে, দেখেছেন? ওটা আবার করতে দিন, কালই।”

বলেই উঠে পড়লেন। বৃদ্ধ ততক্ষণে অজানা আশঙ্কায় সঙ্কুচিত। মৃদুস্বরে আকুতি ভেসে এল, “ডাক্তারবাবু, খুব খারাপ কিছু কি দেখলেন? কাল আমার অপারেশনটা হবে না?”

ফিরে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ডাক্তারবাবুর আশ্বাস, “অপারেশন হবে, তবে কালকে না। ভয় পাবেন না, সব রিপোর্ট মোটামুটি ঠিকই আছে। তবে কী জানেন, আরেকটু ভাল করে দেখে নেওয়াই ভাল। দিনকাল ভাল না, কীসে যে কখন কী হয়ে যায়… একটু সাবধান থাকাই তো ভাল, তাই না?”

কীসের থেকে সাবধান, কতটা সাবধান ইত্যাদি সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বৃদ্ধ তখন কাতরপ্রায়। কোথাও কি খানিক বেসুরো ঠেকছে? মাথায় হাত বুলিয়ে সিস্টার বললেন, “অতো ভাববেন না, কাল সকালে আপনার ডাক্তারবাবু তো আসছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখবেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।”

ঘুম হল, ক্ষণভঙ্গুর। দুঃস্বপ্নও দেখলেন যেন… রিলে রেস-এর মতো ডাক্তাররা আসছেন, বারবার ব্যাটনের হাতবদল… কিন্তু রেস যেন শেষই হতে চায় না! সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হল। ব্লাড টেস্ট হল, আবার, হিমোগ্লোবিন। রিপোর্ট আসতে দেরি হল না। কিছুক্ষণ পরে সিস্টার এসে জানালেন, “আপনাকে একজন ফিজিশিয়ান দেখতে আসছেন।” বলে, মুচকি হেসে তাঁর প্রস্থান। মিষ্টি হাসির প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ ভাবলেন, নামজাদা হাসপাতালই বটে, যত্নের তুলনা নেই, তবে বদহজম না-হলেই মঙ্গল! রাত্রে দেখা দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়লো। কিন্তু সে যে দুঃস্বপ্ন না, নেহাতই সত্যি তা তখনও বোঝেননি।

এর পর ফিজিশিয়ান এলেন, রিপোর্ট দেখলেন। গম্ভীর মুখে সিস্টারকে বললেন, “ঠিকই তো আছে, দু’সপ্তাহ আগে ছিল 11.5, আর এখন 10.5। অসুবিধে কোথায়?” সিস্টার নিরুত্তর। তারপর কী যেন ভেবে ফিজিশিয়ান বললেন, “তবে, অ্যানাস্থেটিস্ট যখন বলছেনই… বোন ম্যারোটা একবার দেখতে হয়। হিম্যাটোলজিস্টকে খবর দিন।” যাওয়ার সময় সঙ্কুচিত বৃদ্ধের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বয়েস হয়েছে তো, একটু ভাল করে দেখে নেওয়াই ভাল, বুঝলেন না!”

কী আর বুঝবেন বৃদ্ধ। জীবনে এমন বন্দীদশা তো ঘটেনি আগে! এর পর সত্যিই রিলে রেস। হিম্যাটোলজিস্ট এলেন। বোন ম্যারো হল। রিপোর্ট নরমাল।

কিন্তু দু’সপ্তাহে হিমোগ্লোবিন কেন কমে গেল তার উত্তর মিলল না। তার মানে, এবার বুঝতে হবে, হয় স্টম্যাক থেকে নয়তো কোলন থেকে ব্লিডিং হচ্ছে কিনা। তাই গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্ট এলেন। এন্ডোস্কোপি, কোলনোস্কোপি হয়ে গেল। সব রিপোর্টই নরমাল। তাহলে?

দিন সাতেক পরের দৃশ্য—হাসপাতালের ‘সি ই ও’র অফিস। বিরাটাকার টেবিলের চারপাশে ডাক্তাররা বসে। একপাশে সদাহাস্যমুখী সিস্টার। যেন মোনালিজা, হাসির অর্থ বোঝে কার সাধ্য!

টেবিলে চাপড় মেরে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত ডাক্তার বললেন, “হচ্ছেটা কী? এসব কী হচ্ছে, বলতে পারেন? একটা ছোট্ট অপারেশন করতে চেয়েছিলাম, এই তার পরিণাম?”

সি ই ও: “আঃ, অত এক্সাইটেড হবেন না, আমি সব শুনেছি। কিন্তু হাসপাতালের ভুলটা কোথায়, বলুন। যা হয়েছে, হচ্ছে, সবই তো পেশেন্ট-এর স্বার্থেই, নাকি!”

প্রশান্ত: “কার স্বার্থে সেটাই তো প্রশ্ন। হিমোগ্লোবিন ১ কমে গেলে এতগুলো ইনভেস্টিগেশন করতে হবে, কোন যুক্তিতে? বোঝান তো।”

অ্যানাস্থেটিস্ট: “এ কী, কেন কমল, আপনি দেখবেন না?”

প্রশান্ত: “কী দেখব? বাড়া-কমা? সে তো চলতেই থাকে। আমি তো রোগীকে ভাল করে দেখেছি, কথা বলেছি, একজামিন করেছি। ইনভেস্টিগেট করবার মতো কিছু তো দেখিনি। যতটুকু করেছি, সেটা রুটিন। আমার ক্লিনিকাল একজামিনেশনের কি কোনও দাম নেই? ওসব ফালতু? আপনি পেশেন্টকে একজামিন করেছেন?”

অ্যানাস্থেটিস্ট : “অতো কথা বলতে পারব না। আর ভাই, একজামিন করেই কী হবে? আমাকে অ্যানাস্থেশিয়া দিতে হবে। আগে রিপোর্ট দেখব, তারপরে তো। ফালতু রিস্ক আমি নিতে পারব না। কী থেকে কী বেরিয়ে পড়ে কেউ কি জানে? তাছাড়া, আপনি একজন বৃদ্ধের অপারেশন করছেন, চেস্ট এক্স রে করিয়েছেন, স্ক্যান তো করেননি।”

সি ই ও: (আঁতকে উঠে) “অ্যাঁ! স্ক্যান করাননি? সে কী! স্ক্যান তো আপনাকে আরও ডিটেল ইনফর্মেশন দেবে, নাকি? আর আমাদের এখানে তো এখন বললে মাত্র দু’ঘন্টায় স্ক্যান হয়ে যায়। আপনি তো জানেন।”

অ্যানাস্থেটিস্ট : “তাই তো। বুড়ো মানুষ। প্রস্টেট অপারেশন করবেন, বলছেন। ক্যানসার কিনা দেখে নেবেন না? যদি সেটা চেস্ট-এ ছড়িয়ে গিয়ে থাকে? এসব ভাববেন না?”

প্রশান্ত : “ওসব নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? সেতো আমি দেখে নেব। আপনার কি ধারণা, এসব আমি ভাবিনি, কিছুই দেখে নিইনি? আপনার কাজটা কী? আপনি কি ক্যানসার খুঁজে বেড়াবেন, নাকি রোগীকে রিলিফ দেবেন আগে, কোনটা?”

সি ই ও : “আরে ভাই, রিলিফ-টিলিফ পরে ভাববেন। আগে নিজের রিলিফের রাস্তাটা ক্লিয়ার করে রাখুন। বলছি তো, দিনকাল ভাল না। বুঝতে চান না কেন? একটা লিটিগেশন হলে তো কাগজেপত্রে ছয়লাপ করে বেরোবে। সামলাবে কে?”

প্রশান্ত : “থামুন! বাজে বকবেন না। শুধু লিটিগেশনের ভয়! ফিজিশিয়ানই বা কী কারণে হিম্যাটোলজিস্টকে ডাকেন, বলতে পারেন? এনি গুড রিজন? এভাবে লিটিগেশন এড়াবেন?”

ফিজিশিয়ান : “না, আমি মানছি, তেমন কোনও কারণ ছিল না। তবে কী জানেন, একজন অ্যানাস্থেটিস্ট ইনসিস্ট করছেন, তাঁর কথা আমি অমান্য করি কীকরে, বলুন?”

প্রশান্ত: “আগে তো নিজের বিদ্যেবুদ্ধিকে মান্য করুন, তারপর অন্যকে মান্য-অমান্যর কথা ভাববেন। হিম্যাটোলজিস্টই বা কোন বুদ্ধিতে বোন ম্যারো করে ফেললেন?”

হিম্যাটোলজিস্ট : “আরে, আমি কী করবো? আমাকে রেফার করলে কিছু তো একটা করতে হয়!”

প্রশান্ত: “পেশেন্টকে ছুঁয়ে দেখেছেন? কথা বলেছেন? ওসব কিছু বুঝি করতে নেই, না? আর বলিহারি আমাদের গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্ট! কেউ বললো, আর অমনি গলায় আর পায়ুদ্বারে নল ঢুকিয়ে দিলেন, না? এইসব কি ডাক্তারি, না অন্য কিছু!”

গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্ট : “না, তা কেন? কিন্তু হিমোগ্লোবিন ১ কমলেও তার তো একটা কারণ থাকবে, নাকি? সেটা খুঁজে বার করতে হবে না? ব্লিডিং ছাড়া অন্য কারণ তো নেই। তাহলে তার সোর্স খুঁজে বার করতে হবে না? সেটা না-করা তো নেগলিজেন্স-এর পর্যায়ে পড়ে। এসব না-করে আপনি অপারেশন করে ফেললেন, শেষে তেমন কিছু একটা বেরোল, আপনি তখন কী করবেন? পেশেন্ট আপনাকে ছাড়বে? হাসপাতালকে? কোর্ট, আইন? আপনি সতর্ক থাকবেন না?”

প্রশান্ত : “সতর্ক? আলবৎ থাকবো। হিমোগ্লোবিন বাড়া আর কমার পিছনে রোগের বদলে কত শারীরবৃত্তীয় কারণ থাকে, সেটা জানাবো, বোঝাবো। শরীরটা তো ডাইনামিক। তাই পেশেন্টকেও সামলাবো, ডাক্তার হিসেবে সেই দায়িত্ব আমার। আর কোর্টকে সামলাবে আমাদের ডাক্তারি বিদ্যা। আইন কোনও যাদুবিদ্যা না, ওটা কাণ্ডজ্ঞানের কথা বলে। এই তো দিনকয়েক ধরে এতকিছু করে ফেললেন, ফটাফট! কিছু কি পেলেন? কিস্যু না! এবার তাহলে কী বলবেন? বলবেন, ক্ষতি তো কিছু হয়নি! আসলে ক্ষতি যে কী আপনারা বোঝেনই না। কী জানেন, আপনারা ডাক্তারিটাই করছেন না। যেটা করছেন, দেখছি, ওটাকে বলে ইউলিসিস সিন্ড্রোম।”

ফিজিশিয়ান “সেটা আবার কী? সিন্ড্রোম? মানে, কোনও অসুখের কথা বলছেন?”

প্রশান্ত: “হ্যাঁ, অসুখই বটে, তবে ওটা ডাক্তারদের অসুখ! কেমন জানেন? এই যে, পেশেন্ট বেশি কথা বললে বিরক্ত হয়ে যাওয়া, সবসময় নার্ভাস থাকা, অজানা ভয়, উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা, এ সবই ওই অসুখের লক্ষণ। সেই ইউলিসিস-এর গল্পটা মনে করুন। কী করতে যুদ্ধে গেলেন, তারপর কীসের ফেরে দশ বছর দিকশূন্যপুরের আনাচে কানাচে কাটিয়ে শেষমেশ শূন্য হাতে ঘরে ফিরে এলেন। আপনাদেরও একই অবস্থা। পেশেন্ট কী চায় ভুলে গেলেন, ঠিক কী করতে হবে তাও ভুলে বসলেন। ভুল-ভ্রান্তি আর মোহের জগতে ঘুরেই চলেছেন। একেই বলে, ইউলিসিস সিন্ড্রোম! এর চিকিৎসা দরকার, জানেন?”

অ্যানাস্থেটিস্ট: “চিকিৎসা মানে?”

প্রশান্ত: আবার টেবিল চাপড়ে বললেন, “মানে, সদর দপ্তরে বোমা মারা… বুঝলেন?”

গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্ট: “ধ্যাত! ওভাবে বলছেন কেন? আমি তো দেখলাম, আরও অনেকগুলো ব্লাড টেস্ট আপনি করাননি, এড়িয়ে গেছেন। আফটার অল, মডার্ন মেডিসিন তো এসব করতে বলেই, তাই না? তার বদলে আপনি তো কম্প্রোমাইজ করতে বলছেন।”

প্রশান্ত: “মোটেও না, মডার্ন মেডিসিন ওসব করতে বলেনি। বলেছে, ডাক্তারিতে মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে। এই যে আপনারা বলছেন, আমি চেস্ট-এর স্ক্যান করাইনি। করাইনি, ঠিকই করেছি। কিন্তু করালে কী হত? এরপর আপনারা চেস্ট স্পেশ্যালিস্ট ডাকতেন। তিনি এসে বলতেন, কই, তেমন কিছু তো দেখছি না, তাহলে পেটের একটা স্ক্যান হয়ে যাক! তাই তো? এগুলোই কম্প্রোমাইজ। আমি কম্প্রোমাইজ করতে বলছি না, শুধু মাপের মধ্যে থাকতে বলছি।”

সি ই ও: “মানে?”

প্রশান্ত: “মডার্ন মানে বোঝেন? সেকি হাতে গরম হালুয়া? তা তো না। জানেন, মডার্ন মেডিসিন কথাটা আসলে একটা টটোলজি—একই কথা দু’বার করে বলা। মেডিসিন মানেই মডার্ন। ওই দুটো শব্দ নিয়ে পিছোতে থাকলে আপনি ল্যাটিন ‘মোডাস’ আর সংস্কৃত ‘মাত্রা’ শব্দে পৌঁছে যাবেন। দুটোরই মানে হল, মাপ। তার মানে, আপনি মেপে মেপে হাঁটবেন, মেপে মেপে ওষুধ দেবেন। মাত্রাজ্ঞান, বুঝলেন? পরিমিতি বোধ। ওটা না-থাকলে ডাক্তারি হয় না। আপনারা আসলে সেই আপ্তবাক্যটা ভুলেই মেরেছেন, ‘জীবনের মতোই চিকিৎসাবিদ্যাতেও, অনেক কিছু আছে যা করে ফেলা যায়, কিন্তু, অল্প কিছুই আছে যা সত্যিই করা উচিৎ, আর অতি সামান্য কিছু আছে যা অবশ্যই করতে হবে’।” ভুলেই গেলেন, তাই না?”

সভাস্থল কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ। সমবেত ডাক্তাররা অতি মনোযোগ সহকারে, কেউ চশমা মুচছেন, কেউ আপন নখদর্শনে ব্যাপৃত, কারোর ঊর্ধমুখ সিলিংপন্থী। উপস্থিত সিস্টারের মোনালিজাহাসি অক্ষুণ্ণ।

নীরবতা ভঙ্গ করে সি ই ও বললেন, “হুঃ, তাহলে আপনি সরকারি হাসপাতালের প্রফেসরি নিলেই পারতেন, এখানে যে কেন এলেন, স্যার!”

প্রশান্ত ডাক্তারের ঝটিতি জবাব, “আপনিও তো পোস্তাবাজারে দোকান দিলে পারতেন, এখানে কেন!” বলেই যেন মনে হল, দরজার কোণে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর রোগী, সেই বৃদ্ধ—বিস্ফারিত নেত্রদ্বয়! চমকে উঠে সিস্টারের দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত বললেন, “দেখুন তো, ওই যে, পেশেন্ট বোধহয় কিছু বলতে চান। দেখুন না একবার, প্লীজ!”

“অ্যাঁ! তা কীকরে হয়…” বলতে বলতে সিস্টার একবার দরজার কাছে গিয়ে এদিক-ওদিক দেখে ফিরে এসে বললেন, “আপনি ভুল দেখেছেন, স্যার! পেশেন্ট তো আজ সকালেই বন্ডে সই করে বাড়ি চলে গেলেন। সঙ্গে ছিলেন ওনার ভাই।”

***

আধুনিক ডাক্তারি নিয়ে একটা আদ্যন্ত ভুল, স্থূলদর্শী ধারণা সমাজজীবনে–ডাক্তারি সমাজেও– ছড়িয়ে আছে। অনেকে আজকের সুরম্য, তারকাখচিত কর্পোরেট হাসপাতাল দেখে মোহিত হয়ে পড়েন। সেটা অন্যায় না, অস্বাভাবিকও না। কিন্তু ওই বিদ্যুন্মালার চারপাশে যে ঘন অন্ধকারটুকু আছে, সেই অভিমানী আকাশটাকে উপেক্ষা করাটা অন্যায়, অবিমৃশ্যকারিতা। চমৎকারী দেখানো ডাক্তারির লক্ষ্য না। তার লক্ষ্য আরো অনেক বড়, অনেক বিস্তৃত তার কাজের পরিধি। ডাক্তারের কাছে রোগীর প্রাথমিক চাহিদা আর আকাঙ্ক্ষা হল, স্বস্তি — কষ্টকর উপসর্গ থেকে মুক্তি।

আধুনিক ডাক্তারি বিজ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই অসহায়, সীমাবদ্ধ তার ক্ষমতা। একসময় সেকথা সে মাথা নত করে স্বীকার করতো; সেই নম্রতাই ছিল তার পরিচয়। একটা সময় ছিল যখন সে কথায় কথায় ওষুধ লিখতো না, বরং নিজেকে নিষ্ক্রিয় রেখে দেহপ্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতো। ডাক্তারির পাঠ্য বইতেও সেই শিল্পপাঠের উপদেশ থাকতো, বলা হত, ‘মাস্টারলি ইনঅ্যক্টিভিটি’— সুনিপুণ নিষ্ক্রিয়তাও একটা চিকিৎসা। কিন্তু ডাক্তারির অতি-আধুনিক চেহারায় সেই নম্রতা নেই, সে এখন অতিচঞ্চল আর বাকপটু। অনেক কিছুই সে আজও জানে না, অথচ দেহপ্রকৃতির স্বভাবও কিছু পালটে যায়নি; লোকে আজও একই চাহিদা নিয়ে, একই আশায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।

প্রযুক্তি তার দুয়ার খুলে দিয়েছে, তাই উন্নত ডাক্তারির নাম করে তদন্ত (ইনভেস্টিগেশন) এখন সহজসাধ্য, তবে তার উপযুক্ত কারণটা খুঁজে বার করা সহজসাধ্য না। কারণ, রোগীর অসুস্থতার চরিত্র নিয়ে যখন ডাক্তারের কোনো প্রাথমিক ধারণাই থাকে না তখন কোনো নির্দিষ্ট, লক্ষ্যভেদী পরীক্ষার বদলে তদন্ত হয়ে যায় এলোপাথাড়ি—‘র‍্যান্ডম’। এসব যাঁদের অপছন্দ তাঁরা বলেন, এতে রোগীর লাভ কী? উত্তর হল, ক্ষতিই বা কী? অধিকন্তু ন দোষায়! বিজ্ঞানী ব্লেইজ পাস্কাল নাকি বলতেন, ভগবান আছে কিনা সেই তর্কে গিয়ে লাভ নেই। বরং ভগবানের অস্তিত্ব মেনে নেওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, কোনোদিন যদি একথা প্রমাণ হয় যে ভগবান বলে কিছু নেই তাহলেও তাঁদের কোনো ক্ষতি তো নেই!

চিকিৎসায় কিন্তু অধিকন্তু খুবই দোষায়! তাতে অকারণ খরচ বাড়ে, রোগীর উদ্বেগ বাড়ে, ডাক্তারের ধন্দও বাড়ে। তাই ‘লেস ইজ মোর’ কথাটাই বেশি দরকারি। গ্রীক পুরাণের বীর ইউলিসিস-এর কথা এই কারণেই বলা। ট্রয়-এর যুদ্ধ জয় করেই ফিরে আসবেন নিজের শহরে, সুন্দরী স্ত্রীর কাছে, এই ছিল ইউলিসিসের মনোবাসনা। ফিরে তিনি এলেন বটে, কিন্তু দশ বছর পরে। যদিও এতকাল যুদ্ধে কাটেনি। ট্রয় থেকে নিজের দেশ ইথাকায় ফিরে যাওয়ার পথে নানান বিচিত্র, মায়াময় আর ভয়ংকর অ্যাডভেঞ্চার কেড়ে নিল তাঁর দশ-দশটা বছর। সেগুলো যে সম্পূর্ণ অবান্তর সেকথা ইউলিসিস বোঝেননি। ডাক্তার আর রোগীর অবস্থাও অনেক সময় হয়ে যায় ওই ইউলিসিস-এর মতো। রোগীকে অমনভাবে ঘুরপাক খাওয়ানোর পিছনে ডাক্তারের যে কোনও বদ মতলব আছে তা না; অনেক সময় রোগীও ভাবেন, যা হচ্ছে সবই তাঁর মঙ্গলের জন্য।

এই অবান্তর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার অপর নাম, ‘ইউলিসিস সিন্ড্রোম’! এ এক বিভ্রান্তি, একটা অদ্ভুত সংকট। এ নিয়ে ডাক্তারি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, আলোচনাও হয়েছে। শব্দবন্ধটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন, মারসার র‍্যাং নামে একজন প্রসিদ্ধ, ব্রিটিশ শল্যবিদ। তারপর অনেকেই এটি আধুনিক চিকিৎসার নানান প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন। তার মানে, আধুনিকতার দাপটে ডাক্তার বা রোগীর সংকট কমেনি; বরং বলা যায়, বেড়েছে। তার মূল কারণ, আমরা যাকে আধুনিকতা বলে বরণ করে নিচ্ছি তা আসলে পশ্চাদগামিতা। ব্যাধি আবিষ্কারই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, ওতেই নাকি সার্থকতা; কীভাবে রোগীর সাক্ষাৎ কষ্টের উপশম দেওয়া যায় সেকথা নাকি পরে ভাবলেও চলবে—এই উগ্র ধারণা মধ্যযুগের সঙ্গে মানানসই। তাই পশ্চাদগামী।

রাষ্ট্রের আলাপবিলাপ আর প্রলাপেও কেবল মধ্যযুগের ছায়া। কবে যে ‘আলোকসম্ভবা উষার ওষ্ঠপুটে ভৈঁরোর অস্ফুট আলাপ’ শুনবো, সেই আশাও ক্রমাগত পশ্চাদগামী, যেন।

সূত্র : আরেক রকম দশম সংখ্যা ২০২৩


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “‘ইউলিসিস সিন্ড্রোম’ : স্থবির দাশগুপ্ত”

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন