ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
অষ্টম অধ্যায়
একটি জীবনবৃত্তান্ত (রিজিউমে)
সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙলার খাদ্যদ্রব্যের বাজার দর — মুরল্যান্ডের তত্ত্ব খণ্ডন
আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় ১ টাকায় ৩-৪ মণ চাল মিলত। ব্যতিক্রম ছিল ফসল ভাল না হওয়া বা বাজারে চাল অমিল হওয়া বছরগুলোয়। স্বাভাবিকভাবে সে সময় চালের দাম বাড়ত। শায়েস্তা খানের সময়ে টাকায় ৮ মণও চাল পাওয়া গিয়েছে (গুলাম হুসেইন সালাতিন, প্রাগুক্ত, ২২৮)। মুর্শিদকুলি খানের সময়ও প্রতি টাকায় ৫-৬ মণ চাল মিলত বাংলায় (প্রাগুক্ত, ২৮০-৮১)। বাংলার বৈচিত্রময় চালের দিকে লক্ষ্য রাখলে বুঝতে পারব, ১৭২৯ সালে মিহি চালের ১ মণ ১০ সেরের দাম ছিল এক টাকা, মোটা চালের দাম ছিল টাকা প্রতি ৭ মণ ২০ সের (এস ভট্টাচার্য, প্রাগুক্ত, ২১৩)। কিন্তু দাম যাই হোক, ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট পরিমান লাভ না করলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে পূর্বদেশিয় দ্বীপুঞ্জগুলিতে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করত না। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে বাংলা থেকে মুসলিপত্তনে খাদ্য পণ্য রপ্তানি প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, বাংলার ভুট্টার (গম?)… এই অঞ্চলে এত বেশি দাম যে সেটি এই অঞ্চলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দরে, কখনো কখনো একশ শতাংশ লাভ থাকে (এইচ দাস, প্রাগুক্ত, ১২০-২১)।
আকর্ষনীয় বিষয় হল, যতদূরসম্ভব বাংলার শাসকেরা এই ভূখণ্ড থেকে খাদ্যদ্রব্যের রপ্তানির নীতি সমর্থন করেছেন। হয়ত বাংলার খাদ্যশস্য প্রাচুর্যের জন্যেই তাদের এই সিদ্ধান্ত। ১৬৮৬তে ডাচ সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, বাংলায় চাল, গম, মাখন, তেল ইত্যাদির ওপর শুল্ক ধার্য হত না (geen thol schuldigh zijn) (কেএ, ১৩১১, ১২০২)। তারিখইবাংলা এবং রিয়াজুসসালাতিনে বলা হচ্ছে মুর্শিদকুলি খান চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেন (সালিমুল্লাহ, প্রাগুক্ত, ১১২; গুলাম হুসেইন সালাতিন, প্রাগুক্ত, ২৮০-৮১)। যদিও এই মন্তব্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা ডাচ এবং ব্রিটিশ মহাফেজখানায় পরস্পরবিরোধী তথ্য পাচ্ছি। হয়ত খাদ্যদ্রব্যের রপ্তানির ওপর নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কিছু বছরের জন্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়ে থাকবে। মনে হয় দীর্ঘ সময়ের জন্যে চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বলবত ছিল না। আমরা ডাচ মহাফেজখানার তথ্য থেকে জানতে পারছি, ১৭০৮/০৯-তে বাংলা থেকে নিয়মিত বিপুল পরিমান চাল রপ্তানি হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাদ্রাজে চাল রপ্তানি করেছে (উদাহরণস্বরূপ ১৭১৩-র জন্যে দেখুন, বিজিএলএন্ডজে, খণ্ড ৯০, ৮১; ১৭২০-র জন্যে বিপিসি, খণ্ড ৪, ২৯৪রেক)। আমাদের মনে হয় নির্দিষ্ট কোনও এক বা দুই বছর চাল উতপাদনে অপ্রতুলতার জন্যে সাময়িক সময়কালে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি আটকাতে (কেএ, ১১৫৮, ৯০৭ভিও; কেএ, ১২০৫, ৫৪৮-৪৯) চাল রপ্তানি বন্ধ করা হয়ে থাকতে পারে।
ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির রপ্তানি তালিকা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, বাংলায় রপ্তানি বাণিজ্যর সূত্র ধরে বাংলায় অন্যান্য পণ্যের উতপাদন যেমন বাড়ছিল, একইভাবে রেশমের উৎপাদনও বেড়েছে, বুননও সমানতালে বেড়েছে। কিন্তু তার রপ্তানির চাহিদা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলার বাজারে রেশমের দামস্তরে লক্ষ্যণীয় প্রভাব পড়ে নি। নানান চলকের প্রভাবে কোরা রেশমের দাম বাংলা বাজারে অস্বাভাবিক ওঠাপড়া করেছে (জোড়াপাতার তালিকা ২ দেখুন কোরা রেশমের দামের জন্যে। দাম বাড়ত-কমত উৎপাদনের পরিমানের ওপর নির্ভর করে, আর রেশমের পাইকারি ক্রেতা ডাচ, ব্রিটিশ এবং দেশিয় বণিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্যে)। কিন্তু দামের এই ওঠা-পড়ার উদাহরণ থেকে বলা যাবে না নির্দিষ্টভাবে রেশমের দামের উর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছে। বুনন শিল্পের বিপুল বৈচিত্রের জন্যে বুনন সামগ্রীর দামের সিরিজ করা হয়ত সম্ভব নয়, কিন্তু একই ধরণের কাপড়ের আকার, পরিমান, উৎপাদনের ভৌগোলিক এলাকায় ১৭১০ থেকে ২০ বছরের উতপাদিত কাপড়ের যে কোনও চার বছরের দামের ফারাকের হিসেব নেওয়া যায়, তাহলে দেখব যে বছরের পর বছর দামের বৃদ্ধি ঘটে নি (জোড়াপাতা ই দেখুন)। ফলে দামস্তরে লক্ষ্যণীয়ভাবে কিন্তু পরিবর্তন ঘটে নি। বিশেষ করে এই কথা বলতে পারি খাদ্যদ্রব্যের দামস্তর আলোচনায়। ভাবা দরকার যদি খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি ঘটত লক্ষ্যণীয়ভাবে, তাহলে বাংলার দুটি মূল রপ্তানি পণ্য, রেশম এবং কাপড়ের দামও বৃদ্ধি ঘটত।
স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটা উঠে আসে, বাংলার রপ্তানি বৃদ্ধির জন্যে যে বিপুল অঙ্কের দামি ধাতু এবং দামি মুদ্রার আমদানি ঘটছিল বাংলায়, এই পরিমান সম্পদের আমদানির প্রভাব কেন বাংলার দামস্তর এবং অর্থনীতির ওপর পড়ল না? আগে আমরা বলেছি, ইয়োরোপীয় ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী এবং দেশিয় বণিকদের ছাড়াও ডাচ এবং ব্রিটিশ কোম্পানি রূপো আমদানি করে বছরে ৪০/৫০ লক্ষ টাকার ব্যবসা করত বাংলায়। কিন্তু এই পরিমান রূপোর বিন্দুমাত্র ধাক্কা পড়ে নি বাংলার দামস্তর বা অর্থনীতিতে। কারণ এই রূপোর একটা বড় অংশ পশ্চিম ভারতে বেরিয়ে যেত। মাত্র একটা অংশ সঞ্চয় হিসেবে থাকত। বলা দরকার বাংলা থেকে উত্তর ভারতে বিপুল পরিমানে সম্পদের নির্গমন ঘটেছে। বিভিন্ন কেন্দ্রিয় আমলা এবং ব্যবসায়ী, বাংলার সম্পদকে দিল্লি এবং আগরায় নিয়ে গিয়েছে অর্থে রূপান্তরিত করে। কোম্পানির খাতাপত্র থেকে পরিষ্কার আমলা এবং সুবাদারেরা কি বিপুল পরিমানে সম্পদ বাংলা বাইরে নিয়ে গিয়েছে।
বাংলার নবাব শায়েস্তা খান ২০ বছর বাংলায় বিপুল পরিমানে লুঠ চালান। ১৬৭৩এর জুনে ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের বক্তব্য যে শায়েস্তা খায় সম্রাটকে ২ কোটি টাকা দিয়ে তার বাংলার নবাবি নিশ্চিত করেছেন (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, হুগলী, খণ্ড ৪, অংশ ১, ৫৪)। ১৬৭৮-এ সোনা এবং গয়না/অলঙ্কার ছাড়াও শায়েস্তা খানর সিন্দুকে অন্তত ৪০ কোটি টাকা জমা আছে (ওসি, ২০ জানু, ১৬৭৮, ৪১৩৪, ৩৮ খণ্ড)। ১৬৭৯-এর নভেম্বরে তিনি পাদসাহকে ৩ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে পদত্যাগ করেন (হোম মিসলেনি, ৬০৩ খণ্ড, ১৫৪)। ১৬৯৩-তে যখন তিনি আগরায় মারা যান, ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের অঙ্ক, তখন তার সম্পত্তি ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং, যে সম্পদ্দের বিপুল অংশ বাংলায় নবাবি করে অর্জিত (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, মিসলেনি, খণ্ড ৩এ, ২৬০)। বাংলায় আসা সব সুবাদার বিপুল পরিমানে সম্পদ লুটে নিয়ে গিয়েছে। জে এন সরকার শায়েস্তা খান দশ বছরে ৯ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছে, খান জাহান বাহাদুর খান এক বছরে ২ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছে, আজিমুশ্বান নয় বছরে ৮ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছে (জে এন সরকার, প্রাগুক্ত, খণ্ড ২, ৪১৩)। ব্যবসায়িরাও এদের খুব পিছনে পড়েছিল না। খেমচাঁদ শাহ, ১৬৮০-র দশকে বাংলায় ব্যবসা করা গুরুত্বপুর্ণ গুজরাটি ব্যবসায়ী, তার মেয়ের বিয়ে দিতে দেশে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে গিয়েছে (বাউরি, প্রাগুক্ত, ১৫২-৫৬)। মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, সে সময় তার জমা ছিল ৯০ হাজার টাকার কাছাকাছি অঙ্ক, এবং সে সেই অঙ্ক নিজের দেশে নিয়ে যায়, এবং তার উত্তরাধিকারী যে বাংলায় আর ব্যবসা করেছে তার কোনও প্রমান নেই (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, হুগলী, খণ্ড ১১, ১৮৭)। ফলে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বাংলার সম্পদের নির্গমন বিপুলাকারে দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। ফলে ব্যবসার বিপুল বৃদ্ধি সত্ত্বেও, বিপুল সম্পদ বাংলায় আসা সত্ত্বেও, বাংলার পার্থিব দামস্তরে, খাদ্যপণ্যে কোনও লক্ষ্যণীয় বৃদ্ধি ঘটে নি, এবং অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলের তুলনায় বাংলার দামস্তর অনেক নিচে ছিল।
সমাপ্ত