ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
অষ্টম অধ্যায়
একটি জীবনবৃত্তান্ত (রিজিউমে)
সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙলার খাদ্যদ্রব্যের বাজার দর — মুরল্যান্ডের তত্ত্ব খণ্ডন
বাংলায় খাদ্যদ্রব্য শস্তা এবং চাষ করে প্রচুর পরিমানে শস্য, ফসল উৎপন্ন হয়, এই তথ্য সপ্তদশ শতাব্দের শেষে এবং অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথম দিকে বাংলায় আসা মুসাফিরেরা বার বার বলে গিয়েছেন। আমরা আগেই দেখেছি, সপ্তদশ শতাব্দের শুরুত্ব পাইরাড ডি লাভাল মন্তব্য করেছিলেন বাংলা শুধু ভারতের নানান প্রান্তে চাল সরবরাহ করে তাই নয়, গোয়া এবং মালাবারেও বাংলার প্রচুর চাল যায়; এছাড়াও চাল রপ্তানি হয় সুমাত্রা, মলুকাস এবং সুন্দা দ্বীপুঞ্জের অন্যান্য দ্বীপে, যেখানে বাংলা মমতাময়ী মায়ের মত তাদের খাদ্যদ্রব্যের প্রায় সব কিছুই সরবরাহ করে থাকে (পাইরাড ডি লাভাল, প্রাগুক্ত, ৩২৭; এমএপি, মেইলিঙ্ক রোয়েলোফজ, প্রাগুক্ত, ৬৮)। বার্নিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন, বাংলার চাল পাটনা, মুসলিপত্তম এবং করমণ্ডল উপকূলের নানান প্রান্ত, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে বহুল পরিমানে রপ্তানি হয় (বার্নিয়ে, প্রাগুক্ত, ৪৩৭)।
বাংলার এই পারম্পরিক খাদ্যদ্রব্য রপ্তানিকর্ম সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ এবং অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথমার্ধ অবধি অবাধে চলেছে। বাংলার শস্তা খাদ্যশস্যের রপ্তানি বিদেশি মুসাফিরদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাংলায় বেড়াতে আসা সে সময়ের মুসাফিরদের বয়ানে আমরা সে তথ্য জানছি। বার্লো ১৬৯২-তে লিখছেন, এই স্থানে বিপুল পরিমানে উত্তম খাদ্যশস্য মেলে… সব খাদ্যশস্যই অতীব শস্তা (এডওয়ার্ড বার্লো, বার্লোজ জারনাল, ১৬৭০-৯৭, খণ্ড ২, ৪৩৭)। ১৬৯৯-তে ব্রিটিশ রাজদূত উইলিয়াম নরিস বলছেন বাংলা মুসলিপত্তনমে চাল সরবরাহ করে, বাংলা থেকে যদি ঠিক সময় সে এলাকায় চাল না যায় তাহলে সেই এলাকার মানুষেরা না খেতে পেয়ে মরার অবস্থা হয় (এইচ দাস, দ্য নরিস এম্বাসি টু আওরঙ্গজেবম সম্পাদনা এস সি সরকার, ১২০)। ১৭০৬-০৭এ আলেকজান্ডার হ্যামিলটন বাংলা সম্বন্ধে লিখলেন, বাংলায় যে শস্তাদরে খাদ্যশস্য পাওয়া যায়, তা অচিন্তনীয় (এ হ্যামিলটন, প্রাগুক্ত, খণ্ড ২, ১৩)। এই বক্তব্যর প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আমাদের মুরল্যান্ডের তত্ত্ব মেনে নেওয়া বেশ কঠিন। অথচ তিনি দাবি করছেন সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার খাদ্যশস্যের বাজার দর বিপুল বেড়েছিল এবং বাংলার দামস্তর ভারতের অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার দামস্তরের কাছাকাছি পৌঁছয়।
মুসাফিরদের লিখিত বক্তব্য ছাড়াও আমরা এ বাবদে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহাফেজখানার তথ্য ব্যবহার করতে পয়ারি। ডাচেরা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের উপকূল এলাকার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বাংলা থেকে খাদ্যদ্রব্য, দানাশস্য রপ্তানি করত। ডাচ মহাফেজখানায় রাখা তথ্য আমাদের সে সময়ের ভারতীয় বাণিকদের খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির নানান তথ্য ঘাঁটার সুযোগ করে দেয়। ব্যবসায়ীরা লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবসা করত। পরশ্ন উঠতে পারে যে সব খাদ্যশস্য ব্যবসা করে তাদের যথেষ্ট লাভ দিত না, সেই সব পণ্য নিয়ে ব্যবসা তারা করবেই বা কেন? বাংলার ব্যবসায়ীরা যে সব খাদ্যদ্রব্যবাংলা থেকে রপ্তানি করত, সেগুলির মধ্যে প্রধানতম ছিল চাল, গম, মাখন, তেল — এছাড়াও ছিল চিনি। চিনি বিপুল পরিমানে বাংলা থেকে পারস্যে রপ্তানি হত। চাল, গম আর মাখন এই সময় সারণি ধরে করমণ্ডল উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে মুসলিপত্ত, এবং জাফনাপত্তমে যেত। এছাড়াও অনিয়মিতভাবে যেত সুরাট, বম্বে, গোয়া এবং কালিকটে (কে এর বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক খণ্ড)। এছাড়াও খাদ্যদ্রব্যগুলি প্রচুর পরিমানে রপ্তানি করা হত শ্রীলঙ্কা (গালে), মালদ্বীপ, এছাড়াও আচিন, কেডা, মলুকাস, সিয়াম, ম্যানিলা এবং টেনাসেরিমের মত পূর্ব দ্বীপুঞ্জগুলিতে আর পশ্চিমে মোকায় মাঝেমধ্যে কিন্তু বিরল নয় (প্রাগুক্ত)। বে অঞ্চলের নানান পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাত্রাকরা সব থেকে লাভের, এই প্রস্তাবনা লিখে টমাস পিট সপ্তদশ শতাব্দের তৃতীয় পাদে লন্ডনের কর্তাদের জানাচ্ছেন চাল, গম, মাখন, ইত্যাদি নিয়মিতভাবে বাটাভিয়া, মালদ্বীপ, আচিন এবং করমণ্ডল উপকূলে রপ্তানি হচ্ছে (বিএম, এডি ম্যানু, ৩৪১২৩, ৩৪)। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, চালের মত দানাশস্য কেন দক্ষিণের নানান এলাকা যেমন শ্রীলঙ্কায় অথবা দক্ষিণপূর্বের দ্বীপপুঞ্জগুলোয়, তার কাছের করমণ্ডল থেকে না সংগ্রহ করে, বাংলা থেকে এই দূরত্ব ও দুর্গম পথ বেয়ে নিয়ে যাওয়া হত। একটা যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর হল, বাংলার মৌল খাদ্যদ্রব্যর দাম এতই কম ছিল যে, তার সঙ্গে ব্যবসায়িক লাভ, যত্রাপথের খরচ ধরেও সেগুলি লাভজনক দামে রপ্তানি করা যেত সহজেই।
ভারতীয় বণিকেরা পরিমানগভাবে যে পরিমান চাল বাংলা থেকে রপ্তানি করতেন, তার অঙ্ক খুব কম ছিল না। ডাচ কোম্পানির তালিকা থেকে আমরা বাংলার বন্দর থেকে দেশিয় মালবাহী জাহাজ করে যত পরিমাণ চাল বাৎসরিক রপ্তানি হত, তার তালিকা পাচ্ছি। ডাচেদের সূত্র আমাদের জানাচ্ছে ১৬৮২-তে ১৯,১৭০ মণ চাল রপ্তানি হয়েছিল। এই পরিমান পরের বছরেই আরও বেড়ে হবে ৬২,৫০০ মণ এবং ১৬৮৪-তে ৬৫,৫০০ মণ (কে এ, ১২৭৬, ১১৭৯ ভিও; কে এ, ১২৯২, ৫৩৫০ ভিও)। শতাব্দের শেষে রপ্তানি অঙ্ক খুব একটা কম ছিল না। ১৬৯৮-তে ৬৫,৫০০ মণ রপ্তানি হয়, পররের বছর কমে হয় ৩১,৮৫২ মণ (কেএ, ১৫০০ ৭১-৭৪, ১৪০-৪২; কেএ, ১৫১৬, ১২২-২৭)।
এই তালিকার সঙ্গে বিভিন্ন ইওরোপিয় কোম্পানি তাদের ভারতজোড়া বিভিন্ন কুঠিতে এবং এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানোর তালিকা যোগ করা যায়, তাহলে অঙ্কটা চমকে দেওয়ার মত হবে। ১৬৫০-এর শেষের দিকে ডাচেরা যখন শ্রীলঙ্কা শাসন করা শুরু করে, তখন তারা তাদের উপনিবেশের জনগণ এবং নিজেদের কর্মীদের নিয়মিত খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করার দায়িত্ব নেয়। তারা বাংলার কুঠিয়ালদের যতটা সম্ভব চাল পাঠাবার নির্দেশ দেয় এবং তাদের নির্দেশ দিয়ে বলে এর সঙ্গেই তারা যেন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এই দ্বীপে চাল রপ্তানি করার জন্যে উৎসাহ দেয়। এই মুহূর্তে আমি শুধু অঙ্ক কষে বার করলাম, ডাচেরা বাংলা থেকে শ্রীলঙ্কা, বাটাভিয়া এবং মালাক্কায় ১৬৭৪/৭৫-এ পাঠাচ্ছে ১৭,৪৭,৮৮১ পাউন্ড বা ২৭,১০১ মণ (কেএ, ১১৯৬, ৫৯৬রেক, ৬০৩ভিও)। যদিও এই অঙ্কের অধিকাংশটাই শ্রীলঙ্কায় গিয়েছে, কিন্তু বাতাভিয়া বা মালাক্কায় যে পরিমান রপ্তানি হয়েছে সেই অঙ্কটা খুব একটা ফেলে দেওয়ার নয়। এই অঞ্চলে গম আর মাখন ঐ বছরে রপ্তানি হয়েছে ৫,৮৭,২৪৯ পাউন্ড এবং ৫৯,৬২০ পাউন্ড যথাক্রমে (প্রাগুক্ত)। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়মিত মাদ্রাজে চাল রপ্তানি করত। ১৬৮৫-তে চালের সঙ্গে অন্য খাদ্যদ্রব্য তারা আচিনে পাঠায় (ডিবি, ১৫ অক্টো ১৬৮৫, ৯১ খণ্ড, ১৯)। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তারা বাংলা থেকে সেন্ট হেলেনায় চাল পাঠাচ্ছে (বজি এল এন্ড জে, ৯২ খণ্ড, ৮৩)। এই যে বিপুল অঙ্কের নানান খাদ্যদ্রব্য বিভিন্ন এলাকায় রপ্তানি হচ্ছে সেই প্রবণতা থেকে প্রমান করা যায় খাদ্যদ্রব্য, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই বাংলায় তুলনামূলকভাবে শস্তা ছিল। (চলবে)