ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
অষ্টম অধ্যায়
একটি জীবনবৃত্তান্ত (রিজিউমে)
কোম্পানি মূলত দালাল-মধ্যস্থ মার্ফত কারিগরি উতপাদন সংগ্রহ করত এবং তারা কোনও দিন সরাসরি কারিগর উতপাদকেদের থেকে পণ্য কেনার অধিকারী ছিল না। কোম্পানি মধ্যস্থ-দালালদের দাদন বা অগ্রিম দিত, যারা সেই অগ্রিম বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কারিগরদের পণ্য সংগ্রহের জন্যে দিত। আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সে সময় সারা বাংলার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দাদন ব্যবস্থা খুবই ব্যপ্ত ব্যবস্থা ছিল। কারিগরদের কোথাও অগ্রিম কোথাও উতপাদনের কাঁচামাল দেওয়া বহুকালের প্রতিষ্ঠিত প্রথা। এই মধ্যস্থ-দালালদের কাজ শুধুই ‘মধ্যস্থতা’ করা ছিল না। তারা বিপুল সম্পদের অধিকারী ছিলেন এবং বহু সময় বহু এই ধরণের মধ্যস্থ কোম্পানি নিরপেক্ষভাবে দেশিয় এবং এশিয়াজুড়ে আন্তর্জাতিকস্তরে বিপুল পরিমান ব্যবসা করতেন। কখনো তারা মহাজন বা ব্যাঙ্কার এবং স্রফের কাজও করতেন। আমাদের মনে হয়েছে কোম্পানি এই বহুক্ষমতাধর বহুউপযোগী মানুষদের চরিত্র খুব একটা বুঝে উঠতে পারে নি এবং বহু সময়ে তাদের সাধারণ দালাল হিসেবেই গণ্য করেছে। ব্যবসা ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক এবং পরস্পরের মধ্যে দ্বৈরথের অবস্থা ঘনিয়ে এলে কোম্পানি সাধারণভাবে তাদের মাথা নামানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা যে সেই কাজে খুব একটা সফল হয়েছে বলা যাবে না।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা মধ্যস্থ-দালালদের (যাদের অধিকাংশ নিজেদের জোরেই কোম্পানি নিরপেক্ষভাবেই সারা এশিয় জোড়া ব্যবসা করতেন, রাজনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষমতাবানও ছিলেন) সংগঠিত করে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি তৈরি করার উদ্যম নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল দালাল-মধ্যস্থদের ক্ষমতা খর্ব এবং নিয়ন্ত্রণ করা। কোম্পানির আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়িদের তৈরি ব্যাডডেট থেকে উদ্ধার পাওয়া। অধিকাংশ সময় কোম্পানি যে পুঁজির অভাবে ভুগত, সেই অবস্থাকে প্রতিরোধ করাও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কোম্পানির পরিকল্পনা ছিল ব্যবসায়ীদের জয়েন্ট স্টক কোম্পানি তৈরি করে দিলে, ব্যবসায়ীরা তাদের অর্থ দিয়ে মাঝেমধ্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুঁজির ঘাটতি উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে। মাদ্রাজে, কোম্পানির সঙ্গে জুড়ে থাকা ব্যবসায়ীদের এই ধরণের জয়েন্ট স্টক কোম্পানি তৈরি করে দিয়ে সেখানে নানান সমস্যা অনেকটা মিটিয়েছিল কোম্পানির আমলারা। কিন্তু বাংলায় সে কাজটা তারা করে উঠতে পারে নি ব্যবসায়ীদের সক্রিয় প্রতিরোধে। বাঙলার আদি ব্যবসা ব্যবস্থায় মধ্যস্থ নিয়োগ করা ব্যবসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সেই প্রথা মেনেই যে সব জাহাজ বাংলায় সম্পদ নিয়ে আসত, সেই সব জাহাজ লন্ডনে ফিরে যাওয়ার সময় যেসব বাঙলার পণ্য নিয়ে যেত সেগুলো কেনা হত এই মধ্যস্থ মার্ফত। তাই কোম্পানি নিজের ব্যবস্থাপনা চাপিয়ে দিতে পারে নি, বরং বাঙলার আদি ব্যবস্থাপনাকে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির বিপুল বৃদ্ধির পিঠেপিঠি সত্য হল, বাংলায় একই সময়ে আমাদানি বৃদ্ধি ঘটেছে — যদিও সেটা অধিকাংশ দামি ধাতু আর ধাতুর মুদ্রা ছিল। দামি ধাতু আর মুদ্রা ছাড়া অন্য বিদেশি পণ্যে খুব একটা বিস্তৃত বাজার বাংলায় ছিল না বললেই চলে এবং সে বাজারটা প্রচণ্ড অস্থিতিস্থাপকও ছিল। যে সব ইওরোপিয় পণ্য বাংলায় আসত তার অধিকাংশ ছিল ধনীদের ব্যবহারের জন্যে আয়েশদ্রব্য বিশেষ, ফলে বড় শহরের বাইরে তারা বাজার ছিলই না বললে চলে। টিন, কাঁসা, দস্তা ইত্যাদির মত অদামি ধাতু এমন কি বাংলায় আনা দামি ধাতু মুদ্রার খুব সীমিত বাজার ছিল। যখন চাহিদার থেকে আমদানির পরিমান বেড়ে যেত, তখন পণ্যগুলি গুদামে জমে থাকত এবং স্বভাবিকভাবে দামও বিপুলভাবে কমে যেত। আমাদের আলোচ্য সময়ে সাধারণত আমদানি পণ্যের বাজারে মাঝেমধ্যেই তুলনামূলকভাবে মন্দা দেখা দিয়েছে যদিও আমদানির পরিমান এবং মূল্যমান খুব একটা বেশি ছিল না কারণ বিপুল গরীবির দেশে মানুষের কেনার ক্ষমতাও ছিল না। দামি ধাতুর একমাত্র চাহিদা ছিল, কিন্তু সেটা সীমাবদ্ধ ছিল, রূপোর জন্যে রাষ্ট্রীয় কাজে মুদ্রা তৈরিতে(আর সোনা হলে ধনীদের সম্পদ সংগ্রহে এবং আয়েশদ্রব্যে — অনুবাদক)। এটাও গুরুত্বপুর্ণ যে যে পরিমান রূপো বাংলায় আসত, সেটি সম্পূর্ণভাবে শুষে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। ফলে বিপুল পরিমান রূপো আমদানির কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েনি বাঙলার বাজারে, পণ্যমূল্যের ওপর। দেয়ার ইজ নো এভিডেন্স অব এনি প্রাইস রেভলিউশন অব ইওরোপিয়ান ভ্যারাইটি অন বেঙ্গল। হয়ত রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যে এবং সেই সংক্রান্ত দামি ধাতু আমদানির জন্যে মনিটাইজেশনের প্রাবল্য খুবই কম ছিল। অধিকাংশ আগত সম্পদ, মনে হয়, দেশের সঞ্চয় হিসেবে জমে থাকত।
বাঙলার নিজের অর্থনীতি ইওরোপিয় কোম্পানির কাজকর্মে উতপাদন স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ইতিহাসে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির রপ্তানিকর্ম নতুন একটা নতুন ঘটনা ছিল, কিন্তু কোনও প্রমান ছাড়াই বলছি, ইওরোপিয় বাজারে বিপুল রপ্তানি সত্ত্বেও বাঙলা অন্যান্য এলাকার পরম্পরার রপ্তানি বাজারে কিন্তু ধ্বস নামে নি বা সেই সব বাজারের চাহিদা নিয়মিত পূরণ করেছে। আমরা বলতে পারি আমাদের আলোচ্য সময়ে নানান ধরণের রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটেছিল। বাঙলার কারিগরেরা ইওরোপিয় বণিকদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অন্য রপ্তানি বাজারকে উপেক্ষা করে নি। এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে রেশম বাণিজ্যের উদাহরণে। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির পাশাপাশি পরম্পরার গুজরাটি এবং উত্তর ভারতীয় বণিকেরা রেশম পণ্য কিনতে থাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। স্থানীয় নানান তথ্য থেকে এমন কোনও প্রবণতার কথা পাচ্ছি না যা দিয়ে প্রমান করা যাবে, কোম্পানিগুলোর রপ্তানি বাণিজ্যের খরিদদারির জন্যে আগরা আর সুরাটের বণিকদের রপ্তানির পরিমান লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। ফলে নতুন বাজারের চাহিদা পূরণে, বাংলা সুবার তিনটি মূল রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছিল কাপড়, কোরা রেশম এবং সোরা, কিন্তু সেই বৃদ্ধির কোনও পরিমানগত বৃদ্ধি আজ আর মাপন করা সম্ভব নয়।
তবে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির রপ্তানি তালিকার দিকে নজর দিলে আমরা হয়ত আন্দাজ করতে পারব রপ্তানি পণ্যের উতপাদন ক্ষমতার কতটা বৃদ্ধি ঘটেছিল। আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, তার শেষের দিকে ব্রিটিশ আর ডাচ কোম্পানি বাংলা থেকে বছরে গড়ে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার পরিমান বিভিন্ন ধরণের টুকরো কাপড় (পিসগুডস), ৩ লক্ষ ৫০ হাজার পাউন্ডের কোরা রেশম, ৪৫ লক্ষ পাউণ্ডের সোরা রপ্তানি করেছে। একমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধিই বাঙলার এই ধরণের পণ্যের বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধিকে সামলাতে পারত। এখানে সব থেকে গুরুত্বপুর্ণ তথ্যটি হল, এই যে বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটল, সেটা ঘটানোর জন্যে বাঙলার কারিগরদের প্রযুক্তির প্রাথমিক এমন কি উৎপাদন এবং ব্যবসার ব্যবস্থাপনার কোনও পরিবর্তন ঘটাতে হয় নি — তাহলে প্রশ্ন হল, কিভাবে এই উৎপাদন বৃদ্ধিটা ঘটল? কোনও সরাসরি প্রমান ছাড়াই একটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য উপপাদ্য খাড়া করছি। কোরা রেশমের ক্ষেত্রে প্রতি একরে উৎপাদনের হার না বাড়িয়ে ভূমিতলে চাষ বাড়ানো হয়েছে, এবং বাংলায় চাষের হাতিয়ার এবং চাষের পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে নি। নতুন চাষের জমি বাড়ানোর হয়েছে হয় নতুন জমিতে চাষ করে অথবা কিছু চাষের জমিকে রেশম চাষের জন্যের রূপান্তরিত করে। (চলবে)