ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
সপ্তম অধ্যায়
বাঙলার ব্যবসা জগতে কোম্পানি
বাংলায় আমদানি
আগের অধ্যায়গুলিতে আমরা বাংলা থেকে কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের ক্রমবৃদ্ধির ঘটনাবলী আর তথ্যাবলী বিশদে আলোচনা করেছি। আমাদের এই সময়ের বাঙলার অর্থনীতির চরিত্র বর্ণনা করতে হলে, একইসঙ্গে সে সময়ের বাঙলার রপ্তানি বাণিজ্য, পণ্য উতপাদন এবং তার সঙ্গে আমদানি পণ্যের বিস্তৃত আলোচনা করতে হবে। কিন্তু এই আলোচনার প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু হল, বাড়তে থাকা রপ্তানি বাণিজ্যের দরুণ বাংলায় দামি ধাতু আর ধাতু মুদ্রার (যা দিয়ে ধার মেটানো হত) বিপুল পরিমানে আমদানি এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রিত আমদানির, যার ওপর কড়া নজরদারি চলত। ব্রিটিশ আর ডাচ দুই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইওরোপ থেকে যতটা পারা যায় সম্পদ বাংলায় আমদানি করে নিজেদের পুঁজি বাড়ানো। আমরা এর আগে আলোচনা করেছি (সুপ্রা, অধ্যায় ৫, ১), কিভাবে দামি ধাতু রপ্তানির বিরুদ্ধে ইংলন্ডের জনসমাজ একাট্টা হয়ে আন্দোলন করেছে এবং ১৭০২-এর আইন অনুযায়ী কোম্পানি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে ব্রিটেন থেকে তার মোট রপ্তানির একের দশমাংশ হবে দেশিয় উতপাদন। ডাচেদের যদিও মার্কেন্টালিস্ট কোনও ইনহিবিশন ছিল না, কিন্তু তাদের পূর্ব দেশের বাণিজ্যে এই ধরণের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়তে হয় নি। একইসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার ডাচেদের বাংলা বাণিজ্যের একটা বড় অংশের বিনিয়োগ আসত তাদের আন্তঃএশিয় ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে, ফলে তাদের হল্যান্ড থেকে তাদের খুব বেশি সম্পদ বহন করে আনতে হত না।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চার ধরণের পণ্য আমদানি করত — দামি ধাতু এবং ধাতু মুদ্রা ধাতু মুদ্রা, পশম এবং ব্রডক্লথ, নানান ধরণের পণ্যদ্রব্য আর গুদামজাত করার জন্যে পণ্য। এই আমদানিগুলির মধ্যে দামি ধাতু এবং ধাতু মুদ্রা সব থেকে বেশি গুরুত্বের আমদানি হিসেবে গণ্য হত আমাদের আলোচ্য সময়ে। ১৬৮২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনিক সুবিধের জন্যে বাংলাকে আলাদা প্রেসিডেন্সি ঘোষণা করার আগে অবদি ইংলন্ড থেকে পাঠানো সমস্ত জাহাজ প্রথমে মাদ্রাজ আসত দামি ধাতু নিয়ে। সেই অর্থের একটা পরিমান তারা বাংলায় বিনিয়োগ করত পণ্য কেনার জন্যে। তবে সেই বিনিয়োগের পরিমান কত ছিল, সেই পরিমান আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে সপ্তদশ শতকের আশির দশকে কোস্ট এন্ড বে অঞ্চলে পাঠানো নানান রকম আমদানি করার পণ্যের তুলনামূলক অংশিদারি নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ আমরা ১৬৬৮/৬৯ এবং ১৬৭৭/৭৮ দুটি বছরের আমদানি পণ্যের কত অংশ কোস্ট এন্ড বেতে পাঠানো হয়েছিল তার হিসেবে পেয়েছি যথাক্রমে ১৫১৬৩৪ পাউন্ড এবং ২২৬৭৩৫ পাউন্ড। এগুলি নিম্নলিখিতভাবে পাঠানো হয়েছিল —
১৬৬৮/৬৯ থেকে ১৬৭৭/৭৮
দামি ধাতু ডিলারে শতাংশে ডলারে শতাংশে
সোনা ১০৪৮১২ ৬৯.৪ ১৪৮৮২৬ ৬৫.৭
রূপো ৩২০৫৪৭ ২১.১ ৬১২৫৯ ২৭.০
মোট ১৩৬৮৫৯ ৯০.৫ ৬১২৫৯ ৯২.৭
ব্রডক্লথ ৬৫৫৭ ৪.২ ১২৫৫ ০.৬
অন্যান্য পণ্য ৭৮০৯ ৫.১ ১৪৩২০ ৬.৩
গুদামজাত ও অন্যান্য ৪০৯ ০.২ ১০৭৫ ০.৫
মোট ১৫১৬৩৪ ২২৬৭৩৫
ওপরের তালিকা থেকে পরিষ্কার মোট আমদানির মোট মূল্যের মধ্যে দামি ধাতুর আমদানির অংশিদার ছিল ৯০ শতাংশেরও বেশি। সম্পদের ক্ষেত্রে সোনার, মূল্য এবং পরিমান ছিল সর্বাধিক, যদিও বছরের পর বছর মোট দামি আমদানিকৃত ধাতুর মধ্যে সোনার অংশিদারি কমছিল। বলাযেতে পারে আশির দশকের পর থেকে বাঙলার সোনা আনার পরিমান কমতে থাকে এবং তারপরে বন্ধ হয়ে যায়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা এই তালিকা থেকে বাঙলার আমদানি পণ্যগুলির মধ্যে মোট আমদানির পরিমানের মধ্যে সব কটি আমদানির অংশিদারি আলাদা আলাদাভাবে কত ছিল, সেটা বোঝার চেষ্টা করব। এই তালিকায় আমরা ১৬৮২/৮৩, ১৬৯৯/১৭০০, ১৭১৮/১৯ এই তিন বছরে কোম্পানি যেসব পণ্য আমদানি করত তার বিস্তৃত তালিকা (কোম্পানির আমদানির বিস্তৃত তথ্য নেওয়া হয়েছে একাউন্ট্যান্ট গেনারেল ডিপার্ট্মেন্টের ১১ রেঞ্জের নানান প্রাসঙ্গিক খণ্ড থেকে)
১৬৮২/৮৩(%) ১৬৯৯/১৭০০(%) ১৭১৮/১৯(%)
(ডলারে) (ডলারে) (ডলারে)
দামি ধাতু
সোনা ৯৪৩১৭(৩৫%) — —
রূপো ১৭৩১৮৮(৬৪.৩৫) ১৬৮৯০৩(৯৪.৩%) ১৬৮৫৬০(৯০%)
মোট ২৬৭৫০৫(৯৯.৩৫%)
ব্রডক্লথ ৪৬৬(০.১৭%) ৪৬৬৫(২.৬%) ১১৩১০(৬%)
নানানপণ্য ৭৮৬(০.২৮) ১৪৮১(০.৮%) ৪৭০০(২.৫%)
গুদামজাত এবং অন্যান্য ৫৪৩(০.২০%) ৪২৭৩(২.৩%) ২৮১৭(১.৫%)
মোট ২৬৯৩০০ ১৭৯৩২২ ১৮৭৩৮৭
আমাদের এই আলোচনায় ওপরে উল্লিখিত দুটো তালিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ – বিশেষ করে দামিধাতুগুলির অংশিদারি বিষয়ে। প্রথম তালিকায় সোনার অংশিদারি বেশি, কিন্তু দ্বিতীয় তালিকার শেষ বছরে দেখতে পাচ্ছি যে সোনাকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছে রূপো। বাংলায় সোনাম মুদ্রায় বদল করার সময় কোম্পানিকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষতি সহ্য করতে হত (সুপ্রা, অধ্যায় ৫, ১), সেই জন্যে তারা বারবার লন্ডনকে লিখত বাংলায় সোনা না পাঠানোর জন্যে। এই অনুরোধ মান্য করে লন্ডনের কর্তারা ১৬৮৬তে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলায় সোনার জায়গায় রূপো পাঠানো হবে (ডিবি, ১৪ জানু, ১৬৮৬,ন ৯১ খণ্ড, ৪৮) এবং এর পর থেকে বাংলায় কোম্পানি সোনা আমদানি করে নি। শুধু ব্রিটিশেরাই নয়, ডাচেরাও আমদানি করা সোনায় ক্ষতি সহ্য করত। ১৭৯৮/০৯ সালের ডাচেদের হিসেবের খাতা আমাদের জানাচ্ছে, ৫০,০০০ সোনা ডুকাট বিক্রি করে ১৭,৭৩৭ ফ্লোরিন ক্ষতি করেছে (কে এ, ১৬৬৯, বেঙ্গল, খণ্ড ২, ১২৮-৮৫)। এর থেকে পরিষ্কার, দামি ধাতুর বাজার ছোট ছিল এবং সেখানেও চাহিদা ছিল মূলত রূপোর।
বাংলায় ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির আমদানির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দুটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে — দামি ধাতুর স্থিতিস্থাপক চাহিদা এবং মুদ্রা ব্যবস্থা বিষয়ে দামি ধাতুর বাজারের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নীতির গভীর সংযোগ ছিল। মুদ্রা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে, তোষাখানার প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমান দামি ধাতু সংগ্রহ করার। ফলে রাষ্ট্রীয় টাঁকশালে কর্তৃপক্ষ মুদ্রা তৈরিতে যেহেতু ধাতুই নেওয়াই পছন্দ করত, তাই যে কোনও সময়ে তার কাছে দামি ধাতু গ্রহন যোগ্য পণ্য ছিল। বাঙলার টাঁকশাল সাধারণত সোনার মুদ্রার চাইতে রূপোর মুদ্রা বেশি চালানো পছন্দ করত। ফলে টাঁকশালগুলিতে সোনার থেকে রূপোর চাহিদা অনেক বেশি ছিল এবং বহুসময় সোনার দাম খুব পড়ে যেত, কারণ সোনা অব্যবসায়িক কাজেই বেশি ব্যবহার হত। এছাড়াও কেন্দ্রিয় তোষাখানায় সিক্কা রূপি আকারে রাজস্ব পাঠাতে হত, ফলে আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সময়ে রূপোর চাহিদা অনেক বেশি ছিল (সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা এবং বিহার উড়িষ্যার বাৎসরিক রাজস্ব আদায় হত ২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা (৪০ দামে ১ রুপি ধরে)। এরমধ্যে বাঙলার অবদান ছিল ১ কোটি ৩১ লক্ষ, বিহারের ১ কোটি ২ লক্ষ এবং ওড়িষ্যার ৩৫ লক্ষ। বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিশদ জমা হাসিল তথ্যাবলীর জন্যে দেখুন ইরফান হাবিবের দ্য এগরারিয়ান সিস্টেম অব মুঘল ইন্ডিয়া, ৪০০-৪০২; মুরল্যান্ড, প্রাগুক্ত, ১৮০-৮১। সালিমুল্লাহ (প্রাগুক্ত, ৬৩-৬৪) বলছেন মুর্শিদিকুলি খাঁ বছরে দিল্লিতে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় পাঠাতেন)। বাঙলার অধিকাংশ শাসক অভিজাত, যারা বদলি হয়ে কিছু দিনের জন্যে বাংলা শাসন করতে আসতেন, তারা ব্যস্ত থাকতেন, কিভাবে তাদের ভাগ্য ফেরানো যায় সেই পরিকল্পনায় এবং তাদের সুবার দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদনে খুব বেশি উতসাহও ছিল না – তারা জমানো অর্থ রূপোর মুদ্রায় ভাঙিয়ে নিতেন। ফলে সব দিক দিয়েই, সে সময় বাংলায় রূপোর চাহিদা অনেক বেশি ছিল (১৬৭৩ সালে ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা লিখছেন, শায়েস্তা খান সম্রাটকে ২ কোটি টাকা দিয়ে তার নবাবের পদ বহাল রেখেছেন, দেখুন পূর্বের ফ্যাক্টরি রেকর্ডস, হুগলী, ৪ খণ্ড, অংশ ১, ৫৪। আবার ১৬৭৯ সালে জানাগেল তিনি সম্রাটকে ৩ কোটি টাকা দিয়ে নবাবি হাসিল করেছেন, দেখুন হোম মিসলেনি, ৮০৩ খণ্ড, ১৫৪। তিনি বাঙলার নবাব ছিলেন ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ১৬৯৩ সালে তিনি যখন আগ্রায় মারা যান, ব্রিটিশ ফ্যাক্টরেরা জানাচ্ছেন, তিনি ৪ কোটি ৫০ লক্ষ পাউন্ড স্টার্লিং রেখে গিয়েছেন, যার অধিকাংশ অংশ তিনি বাঙলার নবাবি করতে গিয়ে জমিয়েছিলেন, দেখুন ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, মিসলেনি, খণ্ড ৩এ, ২৬০, ২৫ জানু ১৬৯৪)। (চলবে)