ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ষষ্ঠ অধ্যায়
চিনি, সুতো এবং অন্যান্য রপ্তানি পণ্য
সপ্তদশ শতকের মাঝখান থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি রেশম ব্যবসায় কোমর বেঁধে নামে। ১৬৭১ সালে কোম্পানি তার সব ধরণের আমলা এবং বাংলায় ব্যবসা করা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদেরকে পূর্ণিয়া রেশম নিয়ে ব্যবসা করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। রেশম ব্যবসা এতই লাভজনক ছিল যে, কোম্পানি চিনা রেশম এবং রট রেশম ব্যবসাতে অন্য দেশওয়ালির প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া ১৬৮২ থেকে শুধুই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাদে, কোনও ব্রিটিশের কোরা রেশম নিয়ে ব্যবসা নিষিদ্ধ হল। এখন থেকে বাংলার ইওরোপগামী রেশম ব্যবসায় কোম্পানির পকড় সম্পূর্ণ হল (বালকৃষ্ণ, প্রাগুক্ত, ১৪৫; ডিবি, ১৮ ডিসেম্বর, ১৬৭১, ৮৭ খণ্ড, ৫০৮; ৬ নভেম্বর, ১৬৭৮, ৮৯ খণ্ড, ৬; ৩ জানুয়ারি, ১৬৭৯, ৮৯ খণ্ড, ২৭; ১৫ জানুয়ারি ক ১৬৮২, ৮৯ খণ্ড, ৪৫২; ১৫ ফেব, ১৬৮২, ৪৫৬, ৪৭১)। ১৬৭৩/৭৪ সালের বরাতে বাংলার কোরা রেশমের প্রথম চাহিদার ব্যাপকতা বোঝা গেল। সে বছর কর্তারা ৪৭০ থেকে ৫৭০ বেলের বরাত দিলেন। তবে ১৬৭৪/৭৫ থেকে ১৬৭৮/৭৯ অবদি বরাতের পরিমান ৬০০ থেকে ৯০০ বেলের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। তারপর থেকেই বাংলার রেশমের চাহিদা খুবই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৬৭৯/৮০ সালে বরাত ১২০০ বেল, আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। ১৬৮০/৮১তে বরাত হল ১৮০০ বেল, ১৬৭৯/৮০-র তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। ১৬৮১/৮২-তে বাংলার বিপুল কোরা রেশম কেনার বরাত আসে। সে বছরে কোম্পানি ১০,০০০ বেলের বরাত দেয়, প্রতিবেলে ১৬০ সের পরিমান সুতো ছিল যা আগের বছরের তুলনায় ৫ গুণ বেশি। পরের বছর হল ১১,৫০০ বেল, এবং ১৬৮৩/৮৪তে আরও বেড়ে হল ১২,০০০ বেল।
সপ্তদশ শতকের মাঝখান থেকে লন্ডনের কর্তারা বাংলার কুঠিয়ালদের রেশমে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। ১৬৭৫-এ তারা হুগলী এজেন্সিকে ২০,০০০ পাউন্ড কোরা রেশম সংগ্রহের কাজে বিনিয়োগ করতে বলে এবং একই নির্দেশ আবার দেয় ১৬৭৬ সালে (ডিবি, ২৪ ডিসেম্বর, ১৬৭৫, ৮৮ খণ্ড, ২৩৮; ১৮ ডিসেম্বর, ১৬৭৬, ৮৮ খণ্ড, ৩৯১)। কোম্পানি রেশমের ওপর যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করল, তার প্রভাব নিশ্চিতভাবে বাৎসরিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনায়, দৃশ্যত অন্য পণ্য কেনার গুরুত্বের ক্ষেত্রে গিয়ে পড়ার কথা। ১৬৮১-তে কর্তারা শুধুই কাশিমবাজারে ৮০,০০০ পাউন্ড পাঠালেন, যে আর্থিক অঙ্কটি, প্রত্যেক বছর এই অঞ্চলে পাঠানো অর্থের তুলনায় অনেক বেশি (ডিবি ৫ জানুয়ারি ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ২৭৮-৭৯)। বাংলার কুঠিয়ালদের বারবার রেশম ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে নির্দেশ এসেছে যাতে আরও বেশি রেশম কেনা যায়। উদাহরণস্বরূপ ১৬৮১-র জুলাইতে কর্তারা জানালেন, ‘আপনারা বুঝে নিন, যে চিঠিটি আমরা আপনাকে লিখছি, তার মৌল উদ্দেশ্য হল, আগে আমরা আপনাদের কোরা রেশম কেনার যে বিপুল বরাত দিয়েছি তাতে বলা ছিল আপনাদের হাতে যদি অর্থ না থাকে তালে আপনারা এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিল করে অর্থটা তুলে নিন যাতে রেশম শিল্পে নিয়মিত বড় বিনিয়োগ করা যায়। এই চিঠিতে আরও বলা হল, এই গুণমানের যত পরিমান রেশম আপনারা বাজার থেকে তুলতে পারেন তুলুন, এর কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই, এবং জাহাজ যখন ইওরোপের পানে ছাড়বে তখন সোরা বা হলুদ না বেশি ভরে সেই জাহাজে বেশি করে কোরা রেশম ভরে পাঠান’ (ডিবি, ২২ জুলাই ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৩৬২-৬৩)।
২২ এপ্রিল ১৬৮১-র চিঠিতে কোম্পানি কেন কোরা রেশম-এর ব্যবসায় কুঠিয়ালদের আরও বেশি বিনিয়োগ করতে বলছে তার কারণ ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে … আমরা আপনাদের ওপর সব থেকে বড় গুরুত্বের দায় চাপিয়ে বলছি, আমরা যত পণ্য ইংলন্ডে আমদানি করি, সেগুলির তুলনায় এটি সব থেকে লাভের পণ্য এবং সব থেকে দামি জাতীয় পণ্য হয়ে উঠেছে, যে পণ্য আমাদের গরীব উৎপাদকেদের দিলে তারা কিছু কাজ করতে পারে, আমাদের সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বিপুল ব্যবসা করা যায়’ (ডিবি, ২২ এপ্রিল, ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৩৩০)।
ঐ চিঠিতেই কর্তাদের পক্ষ থেকে আরও বলা হল, ‘…আমরা তোমাদের জানাচ্ছি ভগবানের ইচ্ছেতে আমাদের ব্যবসায় আমাদের কোম্পানির প্রত্যেক বছর নতুন নতুন জাহাজ বাড়ছে এবং ব্যবসাও সেই অনুপাতে বেড়ে চলেছে; কিন্তু ব্যবসা বাড়াতে আমাদের মনে দ্বন্দ্বও তৈরি হচ্ছে। যদি আমরা বিপুল পরিমানে হলুদ, লাক্ষা এবং অন্যান্য সাধারণ পণ্য আমদানি করি, তাহলে আমরা আমাদের বাজারকে ছোট করে ফেলব এবং তারা এমন কিছু লভ্যাংশ দেবে না যা দিয়ে আমরা আমাদের খরুচে জাহাজের বহর পালতে পারি। উলটো দিকে আমরা যদি মিহি পণ্যে বিনিয়োগ বাড়াই তাহলে আমাদের সমস্যা হল সেগুলিতে আমাদের বিপুল লাভ দেবে ঠিকই, কিন্তু সেগুলির টনেজ এতই কম হবে যে বিশাল দামি পণ্য নিয়ে আমাজের জাহাজ মাঝ সমুদ্রে ডুবে যেতে পারে। এইসব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমরা ঠিক করেছি আমরা রেশম ব্যবসায় বেশি মনযোগ বিনিয়োগ করব। ইওরোপে রেশমের ব্যবসার সর্বব্যাপী, বিশেষ করে মোটা আকারের রেশম সুতোটার চাহিদা সব থেকে বেশি, এবং আমরা যদি সব থেকে বড় দুতিনটে জাহাজ রেশম আমদানিতে লাগিয়ে দিই (আমাদের যে জাহাজ সরবরাহ করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে) তাহলে বিপুল পরিমানে সেগুলি আমদানি করলে আমাদের সব মিলিয়ে লাভই হবে (ডিবি ২২ এপ্রিল ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৩৩১)।
রেশমের ব্যবসা আটের দশকে বিপুল বাড়ার উদাহরণ পাচ্ছি ১৬৮১-র নভেম্বরে। এই সময় লন্ডনের কর্তারা কুঠিয়ালদের বলে ‘…সুদে ১ লক্ষ পাউন্ড, বিনা সুদে আরও বেশি টাকা জোগাড় করে রেশমে বিনিয়োগ করে সেই পণ্য আমাদের কাছে এই বছরের জাহাজেই পাঠাও’ (ডিবি ১৮ নভেম্বর ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৪১৯)। ডাচদের বিনিয়োগের পরিমানও বাড়তে থাকে সমান্তরালভাবে আটের দশকে এবং ইওরোপের বাজারে রেশমের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে, এবং রেশমের দাম সেই দশকে ১৬৫৪-র স্তর ছাড়িয়ে যায় (কে গ্ল্যামান, ডাচ এশিয়াটিক ট্রেড, প্রাগুক্ত, ১২৫)।
কিন্তু ১৬৮৪/৮৫ থেকেই ব্রিটিশদের রেশম বরাত আবারও দ্রুত কমতে থাকে ১৬৮৬/৮৮ অবদি — রপ্তানি হয় ১৫৩০ থেকে ১৬৯০ বেল। দেশের মন্দার বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখে ১৬৮৮-র আগস্টে কর্তারা লেখেন কোরা রেশমের দাম অনেক পড়েছে এবং কলকাতার কুঠিয়ালদের তারা নির্দেশ দিয়ে বলে যে সম্ভব হলে আগের দামের ২০ শতাংশ কম দামে পণ্য কিনতে পারলে কিনুক নইলে নামমাত্র পণ্য পাঠাক (ডিবি, ২৭ আগস্ট ১৬৮৮, ৯১ খণ্ড, ৫৭৫)। কিন্তু ইওরোপিয় যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বাংলার রেশমের চাহিদা হঠাতই বেড়ে যায়। ১৬৯৩-তে লন্ডনের কর্তারা লিখলেন, ভারত থেকে পাঠানো পণ্যগুলির মধ্যে বাংলার রেশম সব থেকে আকর্ষণীয় পণ্য, যেটা এই যুদ্ধের জন্যে তুর্কি ব্যবসা থেমে গেলেও আমাদের অপরিমিত অর্থ দিয়েছে (ডিবি, ২৭ অক্টোবর, ১৬৯৩, ৯২ খণ্ড, ২৯৭)। ১৬৯৩ এবং ১৬৯৪-এর চিঠিতে কুঠিয়ালদের নির্দেশ দেওয়া হল যতটা পারা যায় কোরা রেশম পাঠাতে। নতুন শতাব্দ যত কাছে এগিয়ে আসতে থাকে, ইওরোপে আরও বেশি রেশমের বিক্রির সুযোগ বাড়ে এবং সেই সঙ্গে দামও বাড়ার সুযোগ তৈরি হতে থাকে। ইতালির সঙ্গে যুদ্ধে ইওরোপের সব থেকে বড় রেশম সরবরাহকারী ইতালিয় রেশম আসা বন্ধ হয়ে যায়, ফরাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে তুর্কি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ইতালি, তুর্কি আর ফ্রান্সের রেশম উতপাদন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে ১৬৯৮-র আগস্টে লন্ডনের কর্তারা বাংলার কুঠিয়ালদের নির্দেশ দেয় যতবেশি সম্ভব রেশম পাঠানোর জন্যে — তারা বললেন, আপাতত ইওরোপজুড়ে কোরা রেশমের চাহিদা আর দাম বাড়বে (ডিবি, ২৬ আগস্ট, ১৬৯৮, ৯৩ খণ্ড, ১০২)। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুই দশকে বরাতের পরিমান খুব বেশি বাড়ে নি বরং উঠেছে-নেমেছে নিয়মিত। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুই দশকে ব্রিটিশ কোম্পানির কোরা রেশম বরাতের ছয় বছর অন্তরের হিসেব
প্রথম ৬ বছর দ্বিতীয় ৬ বছর তৃতীয় ছয় বছর
বছর পরিমান(পাউন্ডে) বছর পরিমান(পাউন্ডে) বছর পরিমান
১৭০২/৩ ৬০০০০ ১৭০৮/০৯ ১১০০০০ ১৭১৪/১৫ ৬০০ বেল
১৭০৩/০৪ ১৯০০০০ ১৭০৯/১০ ৫০০০০ ১৭১৫/১৬ ৬০০
১৭০৪/০৫ ১৯০০০০ ১৭১০/১১ ২০০০০ ১৭১৬/১৭ ৬০০
১৭০৫/০৬ ৫০০০০ ১৭১১/১২ ৪০০০০ ১৭১৭/১৮ ৩০০
১৭০৬/০৭ ৭৫০০০ ১২০০০০ ১৭১৯/২০ ১৫০
মোট ৭২৫০০০পাউন্ড ১৭১২/১৩ ১৮০০০০ ১৭১৮/১৯ ৩০০
১৭০৭/০৮ ১৬০০০০ ১৭১৩/১৪ ৫২০০০০পাউন্ড ২৫৫০ বেল
গড়ে প্রায় ১২১০০০ পাউন্ড গড়ে প্রায় গড়ে প্রায় ৪২৫ বেল
বা
৭৮০০০ পাউন্ড ১২১০০০ পাউণ্ড, প্রতিবেল ৪মণ, প্রতি মণ ৭৫ পাউন্ড
উলটো দিকে বাংলার রেশম নিয়ে ডাচেদের বরাত কিন্তু ব্রিটিশদের মত খুব বেশি ওঠানামা করে নি। রেশম নিয়ে ডাচ বরাত এই সময়জুড়ে ব্রিটিশদের তুলনায় বেশ বেশি ছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুদশকে ডাচ কোম্পানির ছয় দশক ধরে কোরা রেশমের ব্যবসা—
প্রথম দ্বিতীয় বছর পরিমান (ডাচ পাউণ্ড) বছর পরিমান (ডাচ পাউণ্ড)
১৭০৪/০৫ ২৭০০০০ ১৭১১/১২ ১৬৮০০০
১৭০৫/০৬ ২৬২০০০ ১৭১২/১৩ ১৬৪০০০
১৭০৬/০৭ ২৭৫০০০ ১৭১৩/১৪ ১৬২০০০
১৭০৭/০৮ ২৬০০০০ ১৭১৪/১৫ ২০৯০০০
১৭০৮/০৯ ২০৪০০০ ১৭১৫/১৬ ১৯৭০০০
১৭১০/১১ ১৬৪০০০ ১৭১৬/১৭ ২৪৬০০০
মোট ১৪৩৫০০০ ১১৪৬০০০
গড় ২৩৯১৬৬ ডাচ পাউন্ড গড় ১৯১০০০ ডাচ পাউন্ড (চলবে)