ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ষষ্ঠ অধ্যায়
চিনি, সুতো এবং অন্যান্য রপ্তানি পণ্য
অন্য পণ্য
আলোচ্য পণ্য ছাড়াও ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলা থেকে আরও কিছু অপ্রধান পণ্য রপ্তানি করত যেমন বোরাক্স বা হলুদ, কড়ি, রেডউড, লাক্ষা। সুতির কাপড়, সোরা বা রেশম ছিল ব্রিটিশ কোম্পানির প্রধানতম রপ্তানি পণ্য। এগুলোর তুলনায় অপ্রধান পণ্য খুবই কম পরিমানে রপ্তানি হত এবং এসব পণ্য রপ্তানি করে খুব লাভ পাওয়া যেত না। কিন্তু ইওরোপগামী জাহাজের খোলের শূন্যস্থান পূরণ করে জাহাজের ওজন ভারি করতে, অর্থাৎ ব্যালাস্ট হিসেবে ব্যবহার করতে এই পণ্যগুলি রপ্তানি জরুরি ছিল। বাংলা থেকে রপ্তানি হওয়া সব পণ্যই বাংলাজাত ছিল না যেমন লাক্ষাদণ্ড আসত পেগু থেকে বা কড়ি আসত মালদ্বীপ থেকে। বিনিময় মাধ্যম কড়ি কিন্তু কোম্পানির জন্যে খুবই লাভের পণ্য ছিল। প্রথমে তারা মালদ্বীপের কড়ি বাংলায় এনে সরাসরি ইংলন্ডে নিয়ে যেত। সেই কড়ি চলে যেত আফ্রিকায়। কড়ির বিনিময়ে দাস কিনে বিভিন্ন দেশে বাগিচায় বিক্রি করত দাস ব্যবসায়ীরা। আমাদের আলোচ্য সময়ের প্রথম দিকে কড়ি বরাতের পরিমান ৫-১০ টনের বেশি ছিল না। পরের দিকে এটির পরিমান ১০০ টন অবদি পৌঁছায়। লাক্ষা বাংলাতেও পাওয়া যেত। কিন্তু কোম্পানি পছন্দ করত পেগুর সব থেকে ভাল এবং কালো লাক্ষা। এই পণ্যের বরাতের পরিমান ঘোরাফেরা করত ৫০ থেকে ১০০ টনের মধ্যে। বোরাক্সও ভাল পরিমানে রপ্তানি হত। বরাতের পরিমান ছিল ১০০ থেকে ১৫০ ডুপার; ১ ডুপার = ২ মণ। ১৬৮৫তে লন্ডনের কর্তারা ৮টাকা দামে ৩০০ ডুপার বরাত দেয়। এর বেশি দামে কিনতে বারণ করে (ডিবি, ১৮ ফেবরুয়ারি, ১৬৮৫, ৯০ খণ্ড, ৪৩১)।
সোরা ছাড়াও পাটনা বিপুল পরিমানে হলুদ উৎপাদন করত। সপ্তদশ শতকের পাঁচের দশকে এই পণ্যের বরাত খুবই কম ছিল। ১৬৫৭তে ১০ টন ১৬৫৯-এ ৩০ টন (ডিবি, ৩১ ডিসেম্বর, ১৬৫৭, ৮৪ খণ্ড, ৩৮৫-৮৬; ২৮ জান, ১৬৫৯, ৮৪, ৪১২)। কিন্তু আটের দশক থেকে জাহাজের চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় হলুদের বরাত ২৫০ টন পর্যন্ত ওঠে। তবে সেই বরাত কয়েক বছরের জন্যে ছিল, ১৬৮৩ লন্ডনের কর্তারা লিখলেন হলুদ খুব নিস্তেজ (ডাল) পণ্য। ১৬৯১তে তারা বাংলার কুঠিয়ালদের লিখলেন যেহেতু গত সাত বছর ধরে তারা প্রচুর হলুদ গুদামে জমিয়ে ফেলেছেন, তাই যেন বাংলার কুঠিয়ালেরা আর হলুদ না কেনে (ডিবি, ৫ জান, ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ২৬৫; ১৮ নভেম্বর, ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ৪১৪; ৫ সেপ্টেম্বর, ১৬৮৩, ৯০ খণ্ড, ২১৮; ১৮ ফেব, ১৬৯১, ৯২ খণ্ড, ১৪৭-৪৮)। আটের দশক থেকে তারা কাশিমবাজারের লাক্ষার কেনার জন্যে উঠেপড়ে লাগলেন, কারণ এটি ছিল গুণমানে খুবই ভাল এবং সুন্দরও। ১৬৮২তে কর্তারা ৫০ টন লাক্ষার বরাত দিলেন এবং সেই দশকে এই পরিমানের আশেপাশে বরাত ইংলন্ড বাংলার কুঠিয়ালদের দিয়েছে। ১৬৮৮তে কোম্পানির কর্তারা লিখলেন বাংলার লাক্ষা অসাধারণ বিক্রিযোগ্য পণ্য এবং তারা বাংলার কুঠিয়ালদের যতটা পারা যায় লাক্ষা পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। ১৬৯১তে লিখলেন কাশিমবাজারের স্বচ্ছ লাক্ষা অসাধারণ পণ্য এবং বাংলার কুঠিয়ালের যত পরিমান পাঠাতে পারে, কোম্পানি তার থেকেও বেশি বিক্রি করার ক্ষমতা রাখে (ডিবি, ২৮ আগস্ট, ১৬৮২, ৯০ খণ্ড, ২৬; ৩০ সেপ্ট ১৬৮৪, ৯০ খণ্ড, ৩৭৩; ২৭ আগস্ট, ১৬৮৮, ৯১ খণ্ড, ৫৭৫; ১৮ ফেব, ১৬৯১, ৯২ খণ্ড, ১৪৭-৪৮)। কিন্তু লাক্ষার বরাত কোনওদিনই ৫০ টন পার হয় নি এবং আমাদের আলোচ্য সময়ে এই পরিমান কমে এসে গড়ে ১০ টনে দাঁড়ায় (১৭১৭/১৮ থেকে ১৭১৯/২০র তালিকা দেখার জন্যে দেখুন, ডিবি, ৯৯ খণ্ড, ২৯১-৯৩, ৫৪১-৪৪, খণ্ড ১০০, ১৬১-৬৪)।
কোরা রেশম
সোরা এবং সুতি বস্ত্রের পরের বাংলার ব্যবসা করা ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল কোরা রেশম। সপ্তদশ শতকের প্রথম পাদে ব্রিটিশ কোম্পানি মূলত ইংলন্ডের বাজারে রেশমের চাহিদা মেটাতে কোরা রেশম আমদানি করত ইতালি, ফ্রান্স এবং পারস্য থেকে এবং কিছুটা পরিমানে চিনাংশুক, চিনের রেশম ডাচ কোম্পানি উচ্চলাভে বিপুল পরিমানে রপ্তানি করেছে। ডাচেদের জাপান ব্যবসায় চিনা রেশম যেহেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছিল, ফলে ইওরোপে রপ্তানির জন্যে যে পরিমান পড়ে থাকত তার অঙ্ক বহু সময়েই তীব্রভাবে ওঠাপড়া করত এবং কখোনো কখোনো কোরা রেশম রপ্তানিও করতে পারত না তারা। ব্রিটিশেরা চিনা রেশমে হাত লাগালেও সেটা বিক্রি করে তাদের তেমন লাভ হয় নি। আর পারস্যের রেশম নিয়ে ডাচেদের উৎসাহ সেই শতাব্দে কমতে থাকে তার কারণ সেখানে রেশমের জন্যে দামি ধাতু দিয়ে ব্যবসা করতে হত। ব্রিটিশেরাও কিছু কাল পারস্যের রেশম রপ্তানি করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আলেপ্পোর বাজারে যতদিন ফরাসী আর ইতালিয়রা ব্যবসা করেছে, ততদিন পারস্যের রেশম রপ্তানি করে ব্রিটিশদের খুব একটা লাভ হয় নি। এ ছাড়াও পারস্যের শাহ রেশম নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করতেন এবং তার দেখাদেখি স্থানীয় আধিকারিকেরাও রেশম নিয়ে ব্যবসা আর দুর্নীতির জাল ছড়িয়ে দেওয়ায় ব্রিটিশ কোম্পানি পারস্যের রেশম বাজার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল। ফলে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ এবং ডাচ উভয় কোম্পানিই কোরা রেশমের সরবরাহের জন্যে, ভারত, মূলত বাংলার রেশম শিল্পের দিকে নজর ফেরাতে শুরু করে (বালকৃষ্ণ, প্রাগুক্ত, ৯৭-৯৮; কে গ্লামান, বেঙ্গল এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড এবাউট ১৭০০, বেঙ্গল পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট, ৭৬ খণ্ড, অনফশ১, জুবিলি নম্বর ১৯৫৭, ৩৩; কে এন চৌধুরী, প্রাগুক্ত, ২০৩-৫)।
ব্রিটিশদের বাংলার রেশমের প্রতি উৎসাহ আমরা লক্ষ্য করি ১৬১৫-র টমাস রো’র মুঘল দরবারে দৌত্যের সময় থেকেই। তার দৌত্যের অন্যতম উৎসাহ ছিল বাংলা এবং পারস্যের মধ্যে চলা রেশম ব্যবসা করার অধিকার অর্জন। কিন্তু তিনি বাংলা বিষয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারেন নি তিনি (দ্বিতীয় অধ্যায় দেখুন)। ১৬২০তে বাংলার রেশম ব্যবসার কথা লন্ডনের কর্তাদের জানান হিউজেস পাটনা থেকে। আমরা আগেই এই ঘটনা বিস্তৃতভাবে লিখেছি (ঐ), তিনি সুরাট কুঠিয়ালদের জানিয়েছিলেন আগরার তুলনায় ৩৫ শতাংশ শস্তায় বাংলার রেশম পাটনা থেকে পাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি জানিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে বরাতমত প্রচুর পরিমান পণ্য কোম্পানি বানিয়ে নিতে পারবে, দেশের যে কোনও উতপাদক অঞ্চল থেকে অন্তত ২০ শতাংশ কম দামে। কিন্তু বাংলার রেশম শিল্প নিয়ে তার উদ্যম মাঠেই মারা গেল। এর সঙ্গে পাটনায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ী পিটার মুণ্ডির ব্যবসায়িক উদ্যমটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। ১৬৩৪ সালে কোম্পানি জানতে পারল সেখানে ব্রিটিশ পাউন্ডের ৪ থেকে ৫ ফানম মূল্য প্রতি পাউন্ড, বা এক টাকায় রেশম পাওয়া যেতে পারে। মেরি নামক জাহাজে প্রতি পাউন্ড ২০ শিলিং দামে দুই বেল বাংলার রেশম পাঠানো হল, কর্তাদের নজর কাড়ার জন্যে(ওসি, ২৫ অক্টো, ১৬৩৪, ১৫৩৬, ১৫ খণ্ড; বালকৃষ্ণ, প্রাগুক্ত, ৯৮-৯৯)। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি, ১৬৫১ সালে হুগলীতে কুঠি খোলার পরেই ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলার রেশম ব্যবসায় ঠিকমত মনোনিবেশ করতে পারল।
বাংলার রেশম উৎপাদনের মূল কেন্দ্র ছিল কাশিমবাজার এবং মুর্শিদাবাদের আশেপাশের অঞ্চল [আজকের বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলকেও জুড়ে নিতে হবে]। তাভারনিয়ের বক্তব্য কাশিমবাজার একাকী সারা বছরে ২২ হাজার বেল, প্রতি বেল ১০০ পাউন্ড, রেশম উৎপাদন করত (তাভার্নিয়ে, প্রাগুক্ত, খণ্ড ২, ২-৩)। সপ্তদশ শতাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে কাশিমবাজার এবং তার প্রতিবেশী এলাকা সমূহ রেশম ব্যবসায় অসম্ভব উন্নতি করে। স্ট্রেইনশ্যাম মাস্টার ১৬৭৬ সালে আমাদের জানাচ্ছেন, কাশিমবাজার এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে বিপুল পরিমান তুঁত গাছ রয়েছে, যে গাছের পাতা গুটিপোকাকে খাওয়ানো হয়, এবং এই গুটি থেকে অত্যুৎকৃষ্ট রেশম উৎপন্ন হয়। ফলে এই অঞ্চলে প্রতি বছর প্রচুর পরিমান তুঁত গাছ লাগানো হয় (মাস্টারের ডায়েরি, প্রাগুক্ত, খণ্ড ২, ২৮)। (চলবে)