যে কোনো দেশের অর্থনীতির মূল কথাই হল সে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এটা বুঝবার জন্য অর্থনীতি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়না। দেশের মানুষ তার প্রয়োজনীয় এবং তার অতিরিক্ত কিছু কিনতে সক্ষম মানে সে দেশের অর্থনীতি গতিশীল। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায় সে দেশের অর্থনীতি তত গতিশীল হবে। কারণ, মানুষের কেনার ক্ষমতাই সে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে চাঙ্গা করে। আর এখানেই আমাদের অর্থনীতি কমজোরি কারণ, শিল্প থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদায় ঘাটতি রয়েছে বা দেশের সমগ্র বাজার মন্দায় আক্রান্ত। অর্থনীতির এই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে মানুষের চাহিদার পাশাপাশি তার পণ্য কেনার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তার মানে মানুষ যাতে পণ্য কিনতে পারে তাকে সেই ক্ষমতা জোগাতে হবে। পণ্য কেনার ক্ষমতা জোগানোর একমাত্র পথ মানুষের রোজগার বৃদ্ধি এবং মূল্যবৃদ্ধি রোধ। অর্থাৎ দেশের মাণূশেড় জীবনধারণের প্রয়োজনীয় খরচ— খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ছাড়াও যত ধরনের প্রয়োজন তার খরচ নামিয়ে আনতে হবে সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো পরোক্ষ করের বোঝা কমিয়ে।
প্রশ্ন, এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট কি সাধারণ মানুষের হাতে তার প্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেবে, যেখান থেকে দেশের নুয়ে পড়া অভ্যন্তরীণ বাজারকে চাঙ্গা করে তুলবে? বাজেটে নতুন করনীতির ঘোষণায় বছরে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত বারের ৭ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ বাড়িয়ে ১২ লক্ষ টাকা করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু পদ্ম সরকার নিশ্চয় জানেন দেশের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে বড়জোর ১০ কোটির রোজগার আয়করের আওতাভুক্ত, তার মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩.২ কোটি। বাকি যে ৭ কোটি (প্রায়) আয়কর দেন, তাঁরা উচ্চবিত্ত এবং ধনী। উল্লেখ্য, শিল্পপতিদের সংগঠন এবং অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরেই মানুষের কেনাকাটার ক্ষমতা বাড়াতে আয়কর কমিয়ে মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা জোগানোর কথা বলছিলেন। সরকার এবার সেই আলোচনায় সাড়া দিল। কিন্তু সরকার বাজেটে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে এবং মূল্যবৃদ্ধি রুখতে কি কি ব্যবস্থা নিল?
এবারের বাজেটে এমন কোনো পরিকল্পনা কি আছে যেখান থেকে কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে মানুষের রুজি-রোজগারের সংস্থান হবে। মানুষের রোজগার না বাড়লে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হবে কোথা থেকে। কিন্তু সরকার বাজেটে কর্মসংস্থানের কোনও দিশা দেখান নি। সরকারের বাজেট ভাবনা, কর ছাড়েই মানুষের হাতে যে অতিরিক্ত টাকা আসবে তা দিয়ে তারা বাড়ি-গাড়ি-ভোগ্যপণ্য কিনবে। আর তা থেকে যে চাহিদার সৃষ্টি হবে তা মেটানোর জন্য উৎপাদন পরিকাঠামো বাড়াতে হবে আর সেখান থেকেই হবে কর্মসংস্থান। কিন্তু সেই দায়-দায়িত্বও সরকার তথা অর্থমন্ত্রী সঁপে দিলেন বেসরকারি সংস্থাগুলির উপর। তাহলে কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের নীতিটি কেমন দাড়াল- গাছে কাঁঠাল পাকছে তুমি গোঁফে তেল দাও। অর্থমন্ত্রী হতে পারেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তনী কিন্তু রোজগেরে মধ্যবিত্ত করছাড়ের উদ্বৃত্ত পণ্য কেনায় ব্যয় করলে কিছুটা কর্মসংস্থান ঘটবে- এমন অর্থনীতি ভাবনায় বেকারত্বের মতো চরম সমস্যার সমাধানের কথা স্রেফ বুজরুকি ছাড়া আর কিছু যে নয় তা অর্থনীতির কিছুই বোঝে না এমন কাউকেও বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না।
চরম মূল্যবৃদ্ধির চাপে দেশের বেশি অংশের মানুষ হাঁসফাঁস করছে। খাদ্যপণ্য থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্রই মূল্য বেড়ে চলেছে মাত্রাছাড়া হারে। তার উপর ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা বেকার হয়ে বসে আছে। এই অবস্থায় এই ধরণের অসংখ্য মানুষের আয়কর ছাড়ে যদি সাশ্রয়ও হয় তাও একটা বড় অঙ্ক খরচ হয়ে যাবে চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির খাঁই মেটাতে। তাহলে কতজন মানুষ কতটুকু টাকা ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য ব্যয় করবে? বাস্তবে অধিকাংশ মানুষের হাতে অতিরিক্ত অর্থ বা কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই যে নেই। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তারাই বাজারের সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রেতা। তাদের রোজগার শুধু নয় কম নয়, আয়করের সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থনীতি সত্যি সত্যিই চাঙ্গা হতে পারে তাদের হাতে টাকার পরিমাণ বাড়লে। কিন্তু তাদের কেনার ক্ষমতা বাড়াতে এই বাজেটে সরকার কোনও পদক্ষেপই করেনি। উপরন্তু করছাড় দেওয়ায় যে ১ লক্ষ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব ঘাটতি তা এই জনগণের ঘাড়ের উপরই সরকার চাপিয়ে দিয়েছে। এই টাকা জোগাড় হবে কোথা থেকে? যেসব প্রকল্প কেন্দ্র সরকারের সাহায্যে চলে সেখানে ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ ছেঁটে ফেলা হয়েছে। রাজ্যগুলির জন্য অর্থ কমিশনের অনুদান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ বুলি আওড়ে গেলেও সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বাজেটে কোনও পদক্ষেপের কথাই নেই।