শুক্রবার | ১৩ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১২:০০
Logo
এই মুহূর্তে ::
পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী

মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী / ১৪০ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১১ জুন, ২০২৫

ঋষি জাবালীর নাম থেকে জব্বলপুরের উৎপত্তি। নর্মদার তীরে তীরে অজস্র সাধু সন্ন্যাসীদের আবাস। তার কিছু চোখে পড়ে। আর কিছু থাকে অন্তরালে। জাবালী ঋষির তপোভূমি এই জব্বলপুর।

চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত পঞ্চবটীতে নর্মদা নদীর ঘাট-এ নৌকো ভ্রমণ করতে করতে জানতে পারলাম এখানে প্রচুর হিন্দি সিনেমার শুটিং হয়েছে। নদীর মধ্যে এক স্থানে মার্বেল রকের দুটি পাহাড়ের মাঝে ফাঁক এত কম যে বাঁদর নাকি এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফিয়ে চলে যেত। তাই ঐ স্থানের নাম বান্দর কুন্দনি।

নৌকা ভ্রমণ শেষ করে পঞ্চবটী থেকে একটু এগোলেই ভেড়াঘাটের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির। পাহাড়ের মাথায় বৃত্তাকার মন্দির। উঁচু উঁচু একশো আট সিঁড়ি ভাঙার পর মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে হয়। এই মন্দির তৈরি হয়েছে কচ্ছপঘট রাজত্বে একাদশ শতাব্দীতে। মা দুর্গা সাংঘাতিক শক্তিশালী দৈত্য শুম্ভ-নিশুম্ভকে দমন করার জন্য চৌষট্টি যোগিনীর দ্বারা পরিবৃতা হয়েছিলেন। মা দুর্গা ও সম্মিলিত যোগিনীর দ্বারা দৈত্য বধ সম্ভব হয়। অপরূপ কারুকাজ পাথরের উপর। পাহাড়ের উপর থেকে নর্মদার রূপ অসাধারণ লাগে। কোনো ভিড় নেই। কোনো আড়ম্বর নেই। আছে শুধু অনির্বচনীয় ভালো লাগা এই মন্দির দর্শনে। চৌষট্টি যোগিনী মা দুর্গারই অপর রূপ। মা এদের তৈরি করেছিলেন দৈত্য দমনের উদ্দেশ্যে। প্রধান অষ্টযোগিনীর নাম ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রাণী ও চামুণ্ডা। যাঁরা যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কুমার কার্তিক, বরাহ, নরসিংহ ও ইন্দ্রের শক্তিস্বরূপ এবং চামুণ্ডা মা দুর্গার অপর রূপ।

এই মন্দির দেখে যোগিনী মন্দির সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ল। জানতে গিয়ে দেখলাম অনেক গল্প, অনেক গাথা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের কাহিনী আছে। যেহেতু তন্ত্র মন্ত্র জড়িয়ে আছে সেহেতু এই গাথাগুলিতে অলৌকিকতার ছড়াছড়ি। তার কতটা গ্রহণযোগ্য আর কতটা অতিরঞ্জিত সেটা ভাবতে গেলে এ লেখা এগোনো সম্ভব নয়। বরং রহস্যঘেরা তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে মানুষের আগ্রহ অসীম। তাই সেই রহস্যের খোঁজে কিছু অতিরঞ্জনকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিতে হবে।

প্রথমে খোঁজ নেওয়ার পালা ভারতের কোথায় কোথায় এখনও যোগিনী মন্দির রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের উত্তর পশ্চিমে উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত ঘেঁষা মিতাবলী, খাজুরাহো ও দুদানী, এছাড়া বাদো ও জব্বলপুরের নিকটবর্তী ভেড়াঘাটে (যেখান থেকে এই খোঁজ শুরু) এবং উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের নিকটবর্তী হীরাপুর ও ছত্রিশগড় সীমান্ত ঘেঁষা রানীপুর ঝারিয়াল এলাকায়। এছাড়া দিল্লী, রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ সীমান্তে হিঙ্গলগড়, উত্তরপ্রদেশের রিখিয়ান, বারাণসী, মধ্যপ্রদেশের লোকারি, শাদোল এবং তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে যোগিনী মন্দির একসময় ছিল, এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত।

যোগিনী মন্দিরগুলি সাধারণত জনবসতি থেকে দূরে, টিলা বা ছোট পাহাড়ের মাথায় টেবিলটপে ভূমি থেকে বেশ অনেকটা উঁচুতে একান্ত নিরিবিলি পরিবেশে গড়ে তোলা হত। এই মন্দিরগুলির নক্সা সাধারণত বৃত্তাকার, খুব কম ক্ষেত্রে আয়তাকার হত। খোলা আকাশের নিচে নির্মিত ছাদবিহীন এই মন্দিরগুলি ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নিদর্শন। বৃত্তাকার মন্দিরের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে যোগিনীদের মূর্তি স্থাপিত হত। কুলুঙ্গির সংখ্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চৌষট্টিটি হত। কখনও একাশি, কখনও বা বিয়াল্লিশ। যেমন ভেড়াঘাটে পূর্ববর্তীযুগে নির্মিত আটটি মাতৃমূর্তি সমেত একাশিটি মূর্তি রয়েছে। বৃত্তাকার যোগিনী মন্দিরগুলির মধ্যে এটিই বৃহত্তম। এর ব্যাস প্রায় ১২৫ ফুট। ভেড়াঘাটের মন্দিরকে শামান হেটলি ‘সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর ও সম্ভবত সর্বাপেক্ষা অধিক পরিচিত যোগিনী মন্দির’ বলে উল্লেখ করেছেন।

যোগিনী মন্দিরের মাঝখানে সাধারণত শিবমন্দির থাকে। বৃত্তাকার মন্দিরের মাথা বা ছাদ থাকে না। কথিত আছে এই যোগিনীরা আকাশপথে যখন তখন বিচরণ করেন। তাই মাথার আচ্ছাদন রাখা হয় না। যোগিনী মন্দিরের বিগ্রহগুলির বৈশিষ্ট্য হল যোগিনীরা সুন্দর দেহের অধিকারিণী হলেও প্রায়শই জীবজন্তুর মস্তকবিশিষ্ট হন। তবে এই মূর্তির ভঙ্গিমা সর্বত্র এক নয়। হীরাপুরের মন্দিরে সকল যোগিনীকে বাহন সমেত দন্ডায়মান দেখা যায়। কিন্তু রানীপুর ঝারিয়ালের মন্দিরে যোগিনীরা সকলে নৃত্যরত। আবার ভেড়াঘাটে দেখা যায় যোগিনীরা ললিতাসন অর্থাৎ রাজকীয় ভঙ্গিমায় উপবিষ্ট এবং শ্মশানের শবখাদক পিশাচ ও শৃগাল দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভারতে চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরগুলিতে যোগিনী মূর্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাঁরা সকলে দুঃখ, সুখ, আনন্দ, কামনা, বাসনা ইত্যাদি নানা প্রবৃত্তির প্রকাশক।

যোগীরা বলেন, দেহ থাকলে ছায়া থাকবে। যোগে দেহ রূপান্তরিত হয়। ছায়া সরে কায়া হয়। তিন ধরনের পরিবর্তন হয়। ধর্মকায়া, সম্ভোগকায়া, নির্মাণকায়া। যোগিনীরা সকলেই কায়াকল্পী। তাঁরা শরীর বদল করতে পারতেন। যাঁরা সিদ্ধ কায়াকল্পী, দেহ চলে গেলে তাঁরা একটি বিশেষ স্তরে বাস করেন। দেহের সঙ্গে লেগে থাকে নানা সংস্কার, অহংকার – এসব নিয়ে ওই বিশেষ স্তরে যাওয়া যায় না। এই বিশেষ স্তর হল বার্দো। দেহ যখন সব সংস্কার মুক্ত হয় তখন তান্ত্রিক যোগিনীরা বার্দোতে যেতে পারেন। সিদ্ধ যোগীরা বার্দোতে অবস্থানকারী যোগিনী আত্মাদের ডেকে কোনও ঘুমন্ত বা রুগ্ন দেহের ভিতরে পুরে ফেলে সেই দেহকে মানব কল্যাণের কাজে লাগাতে পারেন।

হিন্দুধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মেও বার্দো বলতে বোঝায় মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মাঝের অন্তর্বর্তীকালীন একটি বিশেষ অবস্থা, যেখানে আত্মা বিভিন্ন অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা অনুভব করে। এই অবস্থায় আত্মার ভবিষ্যৎ পুনর্জন্মের পথ নির্বাচন করা হয়।

যোগিনীদের সম্পর্কে একটি কাহিনী হল, দেবীকোটের দুই বোন কংখলা ও মেখলার বিবাহ হল এক সওদাগরের দুই ছেলের সঙ্গে। কিন্তু মেয়ে দুটি মন্দ ভাগ্যের। কেউ তাঁদের পছন্দ করে না। দুই দুখী বোন খবর পেল গ্রামে এক যোগী এসেছেন। দুজনে সেই যোগীর কাছে গেল। যোগী কাহ্ন তাঁদের বজ্রবাহারি দেবীর বীজমন্ত্র দান করেন, আর যোগ সাধনের অনেকগুলো মুদ্রা দেখিয়ে দিলেন। বজ্রবাহারি দেবীর গায়ের রং লাল, তিনি দ্বিভুজা, শবের উপরে নৃত্যরতা। সারা মুখে রাগ ও ভয়ের ছায়া। মাথার এক পাশ দিয়ে বরাহের মুখ বেরিয়ে আছে। দুই বোন এই দেবীর সাধনা টানা বারো বছর ধরে করে লোকপ্রিয়া হলেন।

চেহারা ভয়াবহ বলেই দেবীর নাম বজ্রবাহারি। সাধনায় দুই হাত অঞ্জলি করে বুকের কাছে এনে প্রণাম করতে হবে। তারপর একটা পা হাঁটু মুড়ে এবং অন্য পায়ে দাঁড়িয়ে আসনপিঁড়ি যোগ করে তর্জনী ও কনিষ্ঠা আঙুল দেবীর দিকে উঠিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্য আঙুল চেপে করণমুদ্রায় দেবীর সাধনা শেষ করতে হয়। সাধনশেষে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ দুই বোন নিজের মাথা কেটে গুরুকে দক্ষিণা দেন। এর আসল অর্থ জ্ঞান তরবারি দিয়ে অজ্ঞানতার মাথা কেটে ফেলা। অহং বিসর্জন দেওয়া। মাথা কেটে ফেলার জন্য দুই বোনকে ছিন্নমস্তার দুই বোন বলা হয়। দুই বোন যোগিনী হলেন এবং যোগশিক্ষা দিতে লাগলেন।

ভারতের যোগী যোগিনীরা রোজ রাতে নিজেদের আকাশ গমন বিদ্যা কাজে লাগিয়ে এক তীর্থ থেকে আর এক তীর্থে অনায়াসে চলে যেতেন। এমনকি রোজকার প্রাত্যহিক কাজকর্মও সেরে ফেলতেন আকাশ পথে। যাঁরা এরূপ করতে পারেন তাঁদের বলা হয় মায়াবী।

যাঁদের চৌষট্টি যোগিনী বলে চিহ্নিত করা হয়, নবম শতক থেকে যখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তান্ত্রিক মন্দিরগুলি তৈরি করা শুরু হল, তখন যোগিনী মন্দিরের ছাদ রাখা হল না। কারণ হিসেবে বলা হল, যাঁদের যোগসিদ্ধি আছে তাঁরা অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী। তাঁরা দেহ আশ্রয় করে কুম্ভকযোগে আসনটাকে জমি থেকে খানিকটা উপরে তুলে নিতেন। চারদিকের বায়ু থেকে নিজের দেহের ভেতরের বায়ুকে হালকা করে ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন। যোগের দ্বারা দেহের ভিতরে দুটি বিরুদ্ধ শক্তিকে একত্রিত করার উপায় আছে। মন্দের বিনাশ ঘটিয়ে ভালোকে ঊর্দ্ধে তোলার বিদ্যা প্রয়োগ করে কুন্ডলিনীর ঊর্ধ্বমুখ দশা প্রাপ্তিতে কালচক্র আবর্তনে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারেন যোগিনীরা। তাঁদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যই মন্দিরের ছাদ রাখা হয় নি।

বর্তমানে চৌষট্টি যোগিনীর সাধনা প্রায় নেই। খুব গুপ্তভাবে কয়েকজন সিদ্ধ সাধক নেপাল, বাংলা, অসমে ছড়িয়ে আছেন। যথার্থ শিষ্য না মেলায় এঁরা দীক্ষাদান বন্ধ করেছেন। এঁরা দেহ রাখলে যোগিনীক্রম বিলুপ্ত হবে। উত্তরপ্রদেশে ও ওড়িশার কিছু স্থানে কিছু সাধক থাকলেও তাঁরা সিদ্ধাই পেয়েই তার বিভূতি প্রকাশ করে ফেলে নিজের শক্তি নষ্ট করেছেন। এখন সাধারণ গুরুগিরিই তাঁদের সম্বল।

ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুচিন্তা করলে বৈরাগ্য আসে সাধকের। স্থূল শরীর থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গমন করে পরবর্তী যাত্রায় বেরিয়ে পড়া। আত্মার আগমন আর গমন, আত্মার যাওয়া আসা এগুলো রপ্ত করতে প্রয়োজন ঠিকঠাক একজন গুরুর। এগুলি গুরুমুখী বিদ্যা। কোনও খারাপ কাজে এই বিদ্যা ব্যবহার করলে এর সব শক্তি বিনষ্ট হবে। সাধক উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন অথবা প্রাণও চলে যেতে পারে।

এতসব খটোমটো সিদ্ধাই আর আকাশ গমনের কথা শুনে আমার একটাই কথা মনে আসছিল মন্দির চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে যে, বৈদিক যুগে বহু নারীঋষি ও নারী দেবীর নাম আমরা পাই দেবতাদের পাশাপাশি। যেমন ঊষা (ভোর), পৃথ্বী (আদিগন্তপ্রাণ), অদিতি (মহাজাগতিক নৈতিক নিয়মের প্রকাশক), সরস্বতী (জ্ঞান)। এছাড়া রয়েছেন দিনশনা, রাকা, ভারতী, মাহী এঁরাও। কিন্তু পুরুষ দেবতার সঙ্গে এঁদের নাম সমভাবে কোথাও উচ্চারিত হয় নি। হলে আমরা তেত্রিশ কোটি পুরুষ দেবতা ছেড়ে এঁদের নামজপ করতাম হয়ত। ঋষিদের মধ্যেও কজন মহিলা ঋষির নাম সামনে আসে? তবু নারী থেমে থাকেনি। যোগীর পাশে যোগিনীরাও সমানতালে এসেছেন। শুধু এসেছেন বললে ভুল হবে। এক্ষেত্রে যোগীদের চেয়ে যোগিনীরা এগিয়ে আছেন কারণ এঁদের জন্য আলাদা মন্দির তৈরি হয়েছে। আবার এমন মন্দির যেখানে নারী শক্তির মাথায় ছাদই নেই! আকাশ পথে উড়ান দিতে চাওয়া নারী সবসময়ই শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যান। সে দেবীই হোন বা ঋষি বা রাজরানী বা সাধারণী। কিন্তু যোগিনীরা ব্যতিক্রমী। তাঁরা শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত হন নি। নিজের মাথার ছাদটুকুও বিসর্জন দিতে একটুও ভয় পান নি। এখানেই যোগিনীরা মন কেড়েছেন।


আপনার মতামত লিখুন :

3 responses to “তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী”

  1. Bondona Paul says:

    অনেক কিছু জানতে পারলাম । খুব ভাল লাগছে ❤️

  2. Goutam Banerjer says:

    দু বাৱ গিয়েছিলাম, কিন্তু এত কিছু জানতাম না। খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন