বুধবার | ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৮:১১
Logo
এই মুহূর্তে ::
বিমানযাত্রীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকেই গেল : তপন মল্লিক চৌধুরী স্মরণে মননে জন্মদিনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : রিঙ্কি সামন্ত হুগলি জেলায় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় খালিয়াজুরি মৌজার প্রাচীন ইমারত : ফারুকুর রহমান চৌধুরী দুর্দৈবপীড়িত রবীন্দ্রনাথ : দিলীপ মজুমদার শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তার অপরাধ … ভিক্টর হুগো : অশোক মজুমদার হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে নতুন আলোকপাত : অসিত দাস বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ

স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ / ২১৮ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫

পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখিতে পাই প্রত্যেক জাতির সমাজ ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে নারী একাটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছেন। সাধকদের জীবনেও সাধিকাদের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সান্নিধ্যে আসা সাধিকাদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে সপ্তসাধিকার নাম খুঁজিয়া পাওয়া যায়। তাহাদের গুণ বর্ণনা করিয়া শেষ নয়। তথাপি ক্ষুদ্রাকারে কিছুটা তুলিয়া ধরার চেষ্টা করা হইলো।

জননী সারদামণি

পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীসারদাদেবীর পবিত্র নাম আজ দেশ-বিদেশে অগণিত ভক্তকণ্ঠে ধ্বনিত হইতেছে। শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর জীবন বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাই তিনি কন্যারূপে জনক-জননীর প্রগাঢ় স্নেহের অধিকারীণী, পত্নীরূপে স্বামীর চিরানুবর্তিনী, সন্ন্যাসিনীরূপে ত্যাগ ও সেবার প্রতিমূর্তি এবং জগজ্জননীরূপে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ত্রিতাপদগ্ধ মানবের ক্লেশদীর্ণ হৃদয়ে পরমশান্তিপদাত্রী।

শ্রীশ্রী ঠাকুর মাকে সসম্ভ্রমে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আমাকে সংসার পথে টেনে নিতে এসেছ?’ জগজ্জননী মা স্বভাব-সুলভ কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আমি তোমাকে সংসার পথে কেন টানতে যাব? তোমায় ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি”।

রানী রাসমণি

ঠাকুর বলিতেন, ‘রানী রাসমণী অষ্টনায়িকার একজন সপ্তসাধিকামালার একটি উজ্জ্বল রত্ব। তিনি পবিত্র-সলিলা- জাহ্নবীকুলে দক্ষিণেশ্বর শক্তিপীঠে নব্যযুগের শ্রেষ্ঠসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন-মঞ্চ নির্মাণ করিয়া ধন্যা হইয়া গিয়াছেন।

সিদ্ধসাধক রামপ্রসাদের জন্মভূমি হালিশহরের সন্নিকট কোণা নামক এক ক্ষুদ্রপল্লীতে এক দরিদ্র মাহিষ্য পরিবারে রাসমণি জন্মগ্রহণ করেন। রাজচন্দ্রের সাথে রানী পরিণয়সুত্রে আবদ্ধ হইলে ধনাঢ্য জমিদারগৃহে অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে বধূরূপে আসিয়াও রানী রাসমণী বিন্দুমাত্র গর্বিতা হইলেন না। ধর্মপ্রাণা রানীর বীর্যবত্তা ও দানশীলতা একদিকে যেমন তাঁহাকে গৌরবান্বিতা করিয়াছে, দক্ষিণেশ্বর শক্তিপীঠে মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠাও তাহাকে ধর্মজগতে প্রাতঃস্মরণীয়া করিয়া রাখিয়াছে।

একদিন রানী গঙ্গাস্নানান্তে মন্দিরে প্রবেশ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের পূজাদি দর্শন করিতেছিলেন। পুজান্তে প্রতিদিনের ন্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিনও জগন্মাতাকে ভজন শুনাইতেছিলেন। তাঁহার ভাব-ভক্তি রসাশ্রিত সঙ্গীত শ্রবণে সকলেই মুগ্ধ।মন্দিরাধিষ্টাত্রী জগজ্জননী মা সন্তানের কণ্ঠে সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্যাকুলতা ভরা আত্মনিবেদন শ্রবণ করিয়া প্রসন্ন হাসিতে যেন তাঁহাকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিতেছেন। ভক্ত ভাবাতিশযে আত্মহারা। অবিরাম অশ্রুধারায় তাঁহার গণ্ডস্থল প্লাবিত।

কিন্তু এই দিব্যানন্দ পরিবেশনের মধ্যেও রানী কোন গুরুতর বৈষয়িক ব্যাপার চিন্তা করিয়া হঠাৎ অন্যমনস্কা হইয়া পরিয়াছিলেন। অন্তর্যামী ঠাকুর তাঁহার সকল কথা জানিতে পারিয়া, “এখানেও এ চিন্তা’ বলিয়া রানীর কোমলাঙ্গে মৃদু আঘাত করিয়াও এ চিন্তা হইতে নিরস্ত হইতে শিক্ষা প্রদান করিলেন। শ্রীশ্রীজগদম্বার কৃপাপাত্রী রানী নিজের দুর্বলতা বুঝিতে পারিয়া লজ্জিতা ও অনুতপ্তা হইলেন এবং ঠাকুরের এই শিক্ষায় তাঁহার প্রতি রানীর ভক্তিশ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি পাইল।

যোগেশ্বরী ভৈরবী ব্রাহ্মণী

রানী রাসমণির অন্তর্ধানের স্বল্পকাল মধ্যেই দক্ষিণেশ্বর-তপোবনে শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনার গুরুরূপে আবির্ভূতা হইলেন সপ্তসাধিকামালার অন্যতম উজ্জ্বল রত্ব যোগেশ্বরী ভৈরবী ব্রাহ্মণী। যশোহর জেলার অন্তঃপাতী কোনো এক ব্রাহ্মাণ শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুকাল যাবৎ প্রবল গাত্রদাহে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করিতেছিলেন। সূর্যদয় হইতে যতই বেলা বাড়িতে থাকিত, গাত্রদাহ ততই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইত। যন্ত্রণায় অধীর হইয়া তিনি অনেকক্ষণ গঙ্গাজলে শরীর নিমগ্ন রাখিতেন এবং কখনও কখনও কুঠির ঘরের শীতল মর্মর মেঝেতে গৃহের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করিয়া গড়াগড়ি দিতেন। বহু অভিজ্ঞ চিকিৎসকের বিচিত্র বিধানের এই প্রদাহের কোনোপ্রকার উপশম ঘটিল না ৷ব্রাহ্মণী বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, প্রবল ঈশ্বানুরাগের ফলেই এই গাত্রদাহ উপস্থিত হইয়াছে এবং শাস্ত্রেও ইহার সম্যক সমর্থন রহিয়াছে। তিনি ঠাকুরের সর্বাঙ্গে চন্দন প্রলেপের এবং কন্ঠে পুষ্পমাল্য ধারণের ব্যবস্থা করিলেন। অনেক পণ্ডিতমন্য ব্যক্তি এই কঠিন ব্যাধির এত সহজ চিকিৎসাবিধি শ্রবণে বিদ্রূপের হাসি হাসিলেন এবং এক উন্মাদের সঙ্গে আরো একজন উন্মাদিনী সম্মিলিত হইয়াছে বলিয়া শ্লেষ করিতেও দ্বিধাবোধ করিলেন না। বস্তুত যেখানে কলিকাতা নগরীর বিশেষজ্ঞগণ রোগনির্ণয়ে ও তাহার চিকিৎসায় ব্যর্থকাম, সেখানে এই সন্ন্যাসিনীর অদ্ভুত বিধান যে ধৃষ্টতার চরম-নিদর্শন বলিয়া বিবেচিত হইবে তাহাতে আর আশ্চর্য কি? মধুরানাথ কিন্তু নতশিরে এই ব্যবস্থা মানিয়া লইয়া ব্রাহ্মণীর নির্দেশমত সব বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।আশ্চর্যের বিষয়, দিবসত্রয় এরূপ করার পরেই ঠাকুরের গাত্রদাহ সম্পূর্ণরূপে প্রশমিত হইল। তিনি পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া শিশুর মত আনন্দ করিতে লাগিলেন।

নব্য ভারতের প্রথম প্রভাতে যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভৈরবীকে আধ্যাত্নিক সাধনার আচার্যপদে অভিষিক্ত করিয়া সর্বাগ্রে নারীকে তাঁহার প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করিলেন।

গোপালের মা (অঘোরমণি দেবী)

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ভক্তসাধিকা অঘোরমণি দেবী ভক্তসমাজে ‘গোপালের মা’ নামে সৃপরিচিতা। দক্ষিণেশ্বরের অনতিদুরে পূতসলীলে জাহ্নবীতীরে কামারহাটীর পল্লীর জৈনক দরিদ্র ব্রাহ্মণ গৃহে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের এক শুভ বাসরে অঘোরমণির জন্ম হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্য আধ্যাত্মিক অনুভূতির সংবাদ চারিদিকে লোকসমাজে ছড়াইয়া পড়িল এই মঙ্গলবার্তা তপষিনী অঘোরমণির নির্জন কুটিরে পৌছিতেও বিলম্ব হইল না। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের এক শুভ হৈমন্তিক অপরাহে দত্তগৃহিনী, কামিনী নাম্নী অপর একটি রমনীকে সংগে করিয়া নৌকাযোগে দক্ষিণেশ্বরে অঘোরমনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ উভয়ের অন্তরের ভক্তিভাব ও মুখমণ্ডলে পরিব্রাজক অভিব্যক্তি দেখিয়া পরমানন্দিত হইলেন এবং সাদরে স্বগৃহে বসাইয়া তাহাদের সংগে দীর্ঘকাল ভগবৎপ্রসঙ্গ করিলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাদিগকে দেখিয়া পরে বলিয়াছিলেন, “আহা! চোখমুখের কি ভাব! ভক্তিপ্রেমে যেন ভাসছে-প্রেমময় চক্ষু। নাকের তিলকটি পর্যন্ত সুন্দর”।

ঠাকুরকে প্রথম গোপালরপে প্রত্যক্ষ করিবার পর গোপালের মার সে দর্শন সর্বক্ষণ না হইলে ব্যাকুল হইতেন তখনই গোপাল তাহার ললিত মধুর সুন্দর মূর্তি লইয়া তাঁহার সম্মুখে আবির্ভূত হইত। ব্রাহ্মণী শ্রীরামকৃষ্ণের দেহে গোপালকে পুনঃপুনঃ লয়প্রাপ্ত হইতে দেখিয়া উপলদ্ধি করিয়াছিলেন গোপাল ও শ্রীরামকৃষ্ণ অভেদ। অধিকন্তু তিনি ইহাও বুঝিয়াছিলেন যে, ভক্ত ও ভগবান এক।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের যে ছবিখানি গোপালের মা নিত্য পূজা করিতেন তাহা বেলুড়মঠে রক্ষিত হয় এবং ঠাকুর সেবায় দুইশত টাকাও তিনি সঙ্গে দিয়া গিয়াছিলেন। গোপালের মার জপমালাটি নিবেদিতা গ্রহন করেন।

যোগীন মা (যোগীন্দ্রমোহিনী বিশ্বাস)

শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাসঙ্গিনীরূপে যাঁহারা ধরাধামে অবতীর্ণা হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে শ্রীযোগীন্দ্রমোহিনী বিশ্বাস অন্যতমা।ইনি পরবর্তীকালে যোগীন মা নামে ভক্তসমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। ১৮৫১ খৃষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার কলিকাতার ৫৯/১নং বাগবাজার স্ট্রিটের খ্যাতনামা ধনাঢ্য চিকিৎসক শ্রীপ্রসন্ন কুমার মিত্র মহোদয়ের কন্যারূপে যোগীন মা জন্মগ্রহণ করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণভক্ত বলরাম বসু দুরসম্পর্কে যোগীনমার আত্মীয় ও প্রতিবেশী। তিনি যোগীন মার ভাগ্য-বিপর্যয় ও তজ্জনিত মানসিক অশান্তির কথা বিশেষভাবে অবগত ছিলেন। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামগৃহে পদার্পণ করিলে বলরাম যোগীন-মাকে স্বগৃহে আনয়ণ করিয়া ঠাকুরকে দর্শন করিবার সুযোগ করিয়া দিলেন। প্রথম দর্শনে যোগীন-মা ঠাকুরের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট বা শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইতে পারিলেন না। কারণ ঠাকুর তখন দিব্যপ্রেমে বিভোর হইয়া মদ্যপের ন্যায় টলিতেছিলেন এবং ঠাকুরকে তদবস্থায় দর্শন করিবামাত্র যোগীন-মার স্মৃতিপটে তাঁহার উছৃঙ্খল মদ্যপ পতির চিত্র ভাসিয়া উঠিল। তাই তিনি ভগবৎপ্রেমিকের ভাবাবস্থা বুঝিতে না পারিয়া ঠাকুরকেও তাঁহার চরিত্রহীন ষামীর মতই একজন মাতাল মনে করিয়া সেদিন সেস্থান হইতে কতকটা অশ্রদ্ধার ভাব লইয়াই ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু যোগীন-মার অজ্ঞাতসারে তাঁহার জীবন যাঁহার রাতুলচরণে চিরদিনের জন্য পবিত্র প্রসূনটির মত নিবেদিত হইয়া রহিয়াছে।এই প্রথম দর্শনের পর যোগীন মা অন্তরের টানে আরও কয়েকবার দক্ষিণেশ্বর-উদ্যানে গমন করিয়া ঠাকুরের প্রকৃত ভাবের সংগে সম্যক পরিচয় লাভ করিবার সুযোগ পাইলেন। যোগীন-মা অজ্ঞাত -প্রসূত যে গ্লানি প্রথম দর্শনে চিন্তে উপস্থিত হইয়াছিল তাহা চিরদিনের জন্য বিদুরিত হইল, ঠাকুরের অকুণ্ঠ সহানুভূতি ও অহেতুক ভালোবাসা তাঁহার সর্পিল বন্ধুর জীবনপথের অফুরন্ত পাথেয় হইয়া দাঁড়াইল।

এত নৈরাশ্য, এত দুঃখের পর শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমাকে দুর্গম জীবন পথের দরদী সঙ্গী রূপে পাইয়া যোগীন-মা প্রকিতিস্থা হইলেন। যোগীন-মা সম্বন্ধে শ্রীশ্রীমাও বলিতেন, ‘যোগেন আমার জয়া! আমার সেবিকা, বান্ধবী, আমার চিরসঙ্গিনী।“

শ্রীরামকৃষ্ণ যোগীন-মা সম্বন্ধে বলতেন, ‘যোগীন সামান্যা রমণী নহে; সহস্রদল পদের কুঁড়ি, সত্তর শুকায় না, ধীরেধীরে মুকুলিত হইয়া দিকে দিকে সৌরভ বিস্তার করে।”

গোলাপ মা (গোলাপ সুন্দরী দেবী)

সপ্তসাধিকামালার আর একটি অমূল্য রত্ব গোলাপ সুন্দরী দেবী। ইনি গৃহে অন্নপূর্ণা নামেও অভিহিতা হইতেন। উত্তর কলিকাতায় বাগবাজার পল্লীতেই স্বপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করিতেন। গোলাপ মার প্রতিবেশিনী শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তরমণী যোগীন-মার সংগে তিনি পূর্ব হইতেই বিশেষভাবে পরিচিতা ছিলেন। যোগীন-মা গোলাপ সুন্দরীর অন্তরের পু্জিভূত ব্যথা হৃদয়ঙ্গম করিয়া দক্ষিণেশ্বর মন্দিরনিবাসী মাতৃপ্রেমে মাতোয়ারা শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে একদিন তাঁহাকে সংগে করিয়া লইয়া গেলেন। শোকাতুরা ব্রাহ্মণী শ্রীশ্রীঠাকুরের পদপ্রান্তে বসিয়া নীরবে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারায় তাঁহার চরণযুগল ধৌত করিলেন। ভক্তবৎসল শ্রীরামকৃষ্ণ স্নেহার্দচিত্তে তাঁহাকে নানাভাবে সান্তনা দিয়া বলিলেন, ভগবান তোমার অশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছেন। অল্পদিনের মধ্যেই গোলাপ-মা ভক্তজননী শ্রীশ্রীমায়েরও অন্তরঙ্গ সঙ্গিনী হইয়া উঠিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই ব্রাহ্মনীকে স্নেহযত্ন করিবার জন্য শ্রীশ্রীমাকে নির্দেশ দিয়া বলিয়াছিলেন যে, গোলাপ ছায়ার মত তাঁহার চিরসঙ্গিনী হইয়া থাকিবে। শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছিল। গোলাপ-মা দীর্ঘ ছত্রিশ বৎসর অবিচলিত ভক্তি-শ্রদ্ধার সহিত শ্রীশ্রীমাকে সেবা করিয়াছিলেন।

ঠাকুরের শেষ পীড়ার সময় গোলাপ-মাও শ্রীশ্রীমা ঠাকুরানীর সঙ্গে শ্যামপুকুর ও দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করিয়া ঠাকুরের সেবাকার্ষে মাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করিয়াছিলেন। এইসময় গোলাপ-মার সরল স্পষ্ট কথায় ও নির্ভীক আচরণে কেহ কেহ বিরক্ত হইয়া ঠাকুরের নিকট তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতেন।ঠাকুর গোলাপ-মার তুষারশুভ্র অন্তরের সকল খবর জানিতেন। তাই তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত করিতেন না। গোলাপ-মা স্বপ্নযোগে সকল কথাই জানিতে পারিতেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘কি আশ্চর্য! সেই সময় কেউ ঠাকুরের কাছে আমার নামে কোনো কথা লাগালে স্বপ্নে দেখতুম ঠাকুর সেসব কথা আমাকে বলে দিচ্ছেন। …সমস্ত রাত্রি ঠাকুরকেই স্বপ্নে দেখতুম।’ ঠাকুরের এই অপার কৃপা লাভ করিয়া গোলাপ-মা এত গঞ্জনার মধ্যেও নির্বিকার থাকিতেন।

শ্রীশ্রীমা গোলাপ-মা সম্বন্ধে বলিতেন,” “গোলাপ কি কঠোর তপস্যায় না করেছে?গোলাপ জপসিদ্ধা।“

গৌরী মা (গৌরী পুরী)

শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক আদর্শকে আশ্রয় করিয়া দিকপালের মত এই রমণী তদানীন্তন নারীসমাজে যে কি প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন তাহা বাংলার ইতিহাসে সুবর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। ১৮৫৭ খরিষ্টাব্দে(১২৬৪বঙ্গাব্দো/ হাওড়া জিলার অন্তঃপাতি শিবপুর পল্লীর পার্বতীচরণ চট্টোপাধ্যায় এর দুহিতারপে তিনি সংসারে পদার্পণ করেন। মাতা গিরিবালা দেবী তাঁহার সর্বসুলক্ষণা কন্যাকে স্নেহভরে ‘মৃড়াণী’ বলিয়া ডাকিতেন। তাঁহার অপর নাম রুদ্রানী। পরবর্তীকালে ইনি বিভিন্ন ব্যক্তিদ্বারা গৌর-মা, গৌরী-মা, গৌরদাসী এবং সম্ন্যাসগ্রহণান্তে গৌরী পুরী নামে অভিহিতা হইয়াছেন। আবার স্বীয় স্ত্রীভক্তগণের নিকট তিনি ছিলেন ‘মাতাজী’। স্বগৃহে বিদুষী মাতার তত্বাবধানে মৃড়াণীর পাঠাভ্যাস আরন্ত হইলেও নিয়মিত। শিক্ষার জন্য কুমারী ফ্রান্সিস মেরিয়া মিলম্যান পরিচালিত একটি মিশনারী-বালিকা বিদ্যালয়ে তাঁহাকে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল। বালিকার মেধাশক্তি এত প্রখর ছিল যে, বালিকা অত্যল্পকালের মধ্যেই ছাত্রীগণের মধ্যে সর্ববিষয়ে সর্বেচ্চ স্থান অধিকার করিয়া বসিলেন এবং তাহার পারদর্শিতায় সন্তুষ্ট হইয়া তদানীন্তন লাটপত্রী তাহাকে স্বর্ণখচিত পেটিকা পুরস্কার প্রদান করিলেন।

চণ্ডীমামার ভবিষ্যবাণী ‘এ মেয়ে যোগিনী হবে” এবং দীক্ষাগুরুর আশীর্বাণী “হলদে পাখী ধরে রাখা দায়’ -আজ মৃড়াণীকে উদভ্রান্ত করিয়া তুলিল।

একদিন স্বজনগনের সংগে গঙ্গাসাগরসঙ্গমের মেলাদর্শনার্থে গমন করিবার সৃযোগ ঘটিল। মেলায় বিপুল জনসমাগম হইয়াছে। সকলেই তীর্থসলিলে স্নান, দেবদর্শন ও পূজায় ব্যস্ত। মৃড়াণী এই অপূর্ব সুযোগ পাইয়া সহসা জনসংঘমধ্যে আত্মগোপন করিলেন। বহু চেষ্টাতেও আত্মীয়গণ তাঁহার কোন সন্ধান না পাইয়া অগত্যা বিষন্ন চিন্তে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। স্বাধীনভাবে একদল সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর সংগে যৌবনে যোগিনী সাজিয়া উত্তর ভারতের পরম পবিত্র তীর্থ হরিদ্বার অভিমুখে রওনা হইলেন এবং সাধুসঙ্গে মূড়াণী গৌরী-মায়ী নামে পরিচিতা হইলেন। বৃন্দাবনধামে অবস্থান কালে বলরাম বসুর নিকট হইতে গৌরী-মা প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণদেব সন্বন্ধে জানিতে পারিলেন। ইহার কিয়দ্দিবস পর তিনি যখন পুনঃ শ্রীক্ষেত্রে যান হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় নামক জনৈক বৃদ্ধ তাহাকে একদিন শুনাইলেন, “মাগো! দক্ষিণেশ্বরে দেখে এলুম এক অসাধারণ মানুষ; অপরপ রূপ, জ্ঞানে ভরপুর, প্রেমে টুল উল, ঘন ঘন সমাধি।”

ঠাকুর একদিন শ্রীশ্রীমায়ের সন্মুখে গৌরী-মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুই কাকে বেশী ভালবাসিস।’ মাতৃগতপ্রাণা গৌরী অমনি গান গাহিয়া জবাব দিলেন —

“রাই হতে তুমি বড় নও

হে বাঁকা বংশীধারী ;

লোকের বিপদ হলে

ডাকে মধুসুদন বলে,

তোমার বিপদ হলে পরে

বাঁশীতে বল রাইকিশোরী।”

লজ্জাস্বরূপিনী মাতাঠাকুরানী আত্মপ্রশংসাশ্রবণে কুণ্ঠিতা হইয়া গৌরী-মার মুখ চাপিয়া ধরিলেন এবং ঠাকুর হার মানিয়া সানন্দে স্থানত্যাগ করিলেন।এমনি ছিল উভয়ের প্রতি গৌরী-মার নিষ্ঠা ও ভক্তি।

গৌরী-মা তাঁহার তপস্যাপূত কর্মময় জীবনের শেষ চল্লিশবৎসর বাংলার নারীসমাজের শিক্ষা ও উন্নতি বিধানের জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া গিয়াছেন তাহা বাংলার ইতিহাসে চিরম্মরণীয় হইয়া রহিয়াছো শ্রীশ্রীমা বলিতেন, “গৌরীদাসীর আশ্রমের সলতেটি পর্যন্ত যে উসকে দেবে, তার কেনা বৈকুণ্ঠ।”

লক্ষ্মী-দিদি (লক্ষ্মীমণি দেবী)

সপ্তসাধিকামালার শেষ রত্ন শ্রীলক্ষ্মীমণি দেবী। হুগলী জিলার কামারপুকুর গ্রামে যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যমাগ্রজ রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের কন্যারূপে ১২৭০ সালের ১লা মাঘ (১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারি) বুধবার সরস্বতী পূজার দিবসে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল হইতেই লক্ষ্মীমণির দ্বেবদ্ধিজে অগাধ ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল। এই ঈশ্বরানুরাগই পরিণত বয়সে তাঁহাকে অতুল আধ্যাত্মিক সম্পদের অধিকারিণী করিয়া তুলিয়াছিল। তিনি স্বল্পভাষিণী, খুব বুদ্ধিমতী ও অসাধারণ মেধাসম্পন্না ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ লক্ষীমণির বিবাহ-সংবাদ অবগত হইবামাত্র ভাবস্থ হইয়া অজ্ঞাতসারে বলিয়া ফেলিলেন, “লক্ষ্মী সত্বরই বিধবা হইবে।” শ্রীরামকৃষ্ণকে এইরূপ নিদারুণ উক্তির কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “আমি আর কি করিব? জগজ্জননী মা-ই যে আমাকে এইকথা বলিয়াছেন। লক্ষ্মী শীতলা-দেবীর অবতার বল্লাধার দুর্বল স্বামীর সঙ্গে এইরূপ ঐশীশক্তিসম্পন্না দেবীর সাহচর্য ও মিলন সম্ভব নহে।” ইতঃপূর্বে কামারপুকুরেও তিনি বলিয়াছিলেন, “লক্ষ্মী যদি বিধবা হয় তো ভাল হয়। তাহলে বাড়ীর দেবতাদের সেবাদি করতে পারবে।” তাঁহার ভবিষৎবাণী অচিরেই অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়া গেল। ঠাকুর লক্ষ্মী-দিদিকে একদিন স্নেহভরে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, “ঠাকুর-দেবতাকে যদি মনে না পড়ে তো আমায় ভাববি। তা হলেই হবে।” লক্ষ্মী-দিদিও গুরু ও ইষ্টে কোন ভেদবুদ্ধি রাখিতেন না এবং ঠাকুরকে অবতারী বলিয়া নির্দেশ করিতেন।

শ্রীশ্রীমা ও ঠাকুরের অতুল প্রেম.স্পর্শে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের ন্যায় তাঁহার হৃদয়ের দুকুল প্লাবিয়া উথলিয়া উঠিল। প্রায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাধু ও ভক্ত সেবায় ও সাধন-ভজনে নিযুক্ত থাকিয়া সদানন্দময়ী এই উচ্চসাধিকা শ্রীশ্রীমার সংগে কাটাইলেন। তাঁহার দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ সম্বন্ধে পরিবর্তী কালে লক্ষ্মী-দিদি সকলকে বলিতেন, ‘আমি শ্রীশ্রীমার সঙ্গে নহবৎ ঘরে থাকিতাম। লক্ষ্মী-দিদি শ্রীশ্রীমার সঙ্গে এ ক্ষুদ্র নহবৎগৃহে অবস্থান করিয়াও স্বর্গসুখ অনুভব করিতেন। লক্ষ্মী-দিদির প্রাণঢালা অতুলনীয় নেহ ও শিশুর সারল্য অতি সহজেই সকলের চিন্তকে জয় করিয়া ফেলিত তাই আজও শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত নারীগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম আদর্শ মহিলারপে তিনি জাতিধর্মনির্বিশেষে দেশবাসীর হৃদয়ের পূত প্রেমার্ঘ্য পাইয়া আসিতেছেন।

(স্বামী তেজসানন্দের সঙ্কলন থেকে সংগৃহীত)

পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন


StatCounter - Free Web Tracker and Counter Statcounter