শীতের কাঁপুনি শুরু। বাঙালির ঘরে পিঠে পুলির প্রস্তুতি। টাটকা ঝোলা খেজুরগুড়ের সঙ্গে পিঠে পুলি ও পায়েসের স্বাদই আলাদা। কিন্তু বাজারে আসল সুস্বাদু খেজুরগুড় মেলা ভার। এর আসল কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল বিগত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান বাড়ি-ঘর নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ক্রমেই খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে।এ চিত্র রাজ্যের সর্বত্র। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলি, হাওড়া বর্ধমান ইত্যাদি জেলায় খেজুর গাছ নিধন পর্ব শুরু হয়েছে। ফলে খেজুর রসের অভাব দেখা দিয়েছে। রুটি রোজগারের সমস্যায় পড়েছেন গাছিরা। আর সুস্বাদু খেজুরগুড় ও রস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভোজনরসিক বাঙালিরা। হরেক রকমের পিঠে-পুলি খাওয়ার ধূম এখন আর নেই। গত কয়েক বছর আগেও শীতকালে বিভিন্ন এলাকায় ‘গাছি’রা খেজুর গাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত থাকতেন। তাঁরা খেজুরের রস ও পাটালি গুড় বিক্রি করে আয় করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে গত কয়েক বছর ধরে তা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে।
খেজুর রস দিয়ে শীত মরসুমে পিঠে ও পায়েস তৈরির প্রচলন থাকলেও শীতকালীন খেজুর গাছের রস এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। আগের তুলনায় খেজুর গাছ কমে গিয়েছে। যা আছে তাও সঠিকভাবে পরিচর্যা না করা, নতুন করে গাছের চারা রোপণ না করা এবং গাছ কাটার পদ্ধতিগত ভুলের কারণে প্রতি বছর অসংখ্য খেজুর গাছ মারা যাচ্ছে। উল্লেখ্য ,এছাড়া এক শ্রেণির অসাধু ইটভাটা ব্যবসায়ী জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সর্বত্র পেশাদার খেজুর গাছিরা চরম সংকটে পড়েছেন। তারপরেও কয়েকটি এলাকায় গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ করছেন নামে মাত্র। ইতিমধ্যে ওইসব গাছিরা দুই বেলা রস সংগ্রহ করছেন। শিশির ভেজা ঘাস আর ঘন কুয়াশার চাদর, হেমন্তের শেষে শীতের আগমনের বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে। এসময় মরসুমি খেজুর রস দিয়েই গ্রামে শুরু হতো শীতের আমেজ। শীত যত বাড়তে থাকত খেজুর রসের মিষ্টতাও তত বাড়ত।
শীতের সঙ্গে রয়েছে খেজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। এসময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সু-মধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হত পিঠে, পায়েস ও গুড় পাটালি। এছাড়াও গ্রামে গ্রামে খেজুরের নলেনগুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় । গুড়ের মিষ্টির গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যেত। খেজুরগুড়ের পায়েস, গুড়ে ভেজা পিঠেসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের তো জুড়ি মেলাভার।
প্রসঙ্গত , কালের বিবর্তনে প্রকৃতি থেকে আজ খেজুরের রস প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। খেজুর রস দিয়ে গৃহবধূদের সুস্বাদু পায়েস, বিভিন্ন ধরনের রসে ভেজানো পিঠে তৈরির ধুম পড়ত। গ্রামের সাধারণ মানুষ শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ঠান্ডা খেজুর রস না খেলে যেন দিনটাই মাটি হয়ে যেত। কিন্তু ইটভাটার আগ্রাসনের কারণে আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ইটভাটায় খেজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও ইটভাটার মালিকেরা সবকিছু ম্যানেজ করে ধ্বংস করে চলেছে খেজুর গাছ। গত কয়েক বছর ধরে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছকে ব্যবহার করায় জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্রুত খেজুর গাছ নিঃশেষ হতে শুরু করেছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষ এখন খেজুর রসের মজার মজার খাবার অনেকটাই হারাতে বসছে।
আগের মত খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল আসলেই অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যায়। এদিকে খেজুর গাছ কমতে থাকায় চিন্তায় জেলার কৃষি দফতরগুলি। জেলায় কৃষি বিভাগ কৃষকদের খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশে সহ বিভিন্ন স্থানে কৃষকেরা খেজুর গাছ বসালে, তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।