গত কয়েক দিন ধরে এ রাজ্যের দৈনিকগুলির শিরোনাম দেখে এ কথাই মনে হচ্ছে, রাজ্যটা যেন জঙ্গি কার্যকলাপ আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আস্তানায় পরিণত হয়ে উঠেছে। আসাম পুলিশের সাহায্যে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন ‘আনসারুল্লা বাংলা টিম’-এর ৮ জঙ্গি গ্রেফতার হওয়ার পর জানা যাচ্ছে যে এদের কারও কারও এখানকার ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে এবং ভোটার কার্ড রয়েছে। অর্থাৎ খাতায়কলমে তারা ভারতীয় নাগরিক! তাও এক জায়গায় নয়, কারণ, মুর্শিদাবাদের কান্দি ও হরিহরপাড়া — এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এই ভুয়ো ভোটার কার্ড কারা কিভাবে তাদের বানিয়ে দিল? কারা কিভাবে তাদের নাম ভোটার তালিকায় তুলে দিয়েছিল? যার সাহায্যে তারা ভোটার কার্ড হাতে পেয়ে গেল? ভোটার তালিকায় নাম ওঠা বা ভোটার কার্ড তো সরকারি কাজ। তবে কি সরকারি কর্মীদের যোগসাজসেই এমন বেআইনি কাজ সম্পন্ন হয়েছে? তার মানে সরকারি দফতর থেকে যেসব স্থানীয় লোকজন ভোটার তালিকা এবং ভোটার কার্ডের কাজে বহাল হয়েছিল তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের গভীর যোগসাজসে এমন ভয়ঙ্কর দেশবিরোধী কাজ মোটা টাকার বিনিময়ে ঘটেছে। তার আগেও একটি সহজ প্রশ্ন আসে, কড়া নজরদারি থাকা স্বত্বেও সীমান্ত পেরিয়ে ওই জঙ্গিরা এদেশে প্রবেশ করল কীভাবে? কে বা কারা তাদের অনুপ্রবেশে সাহায্য করল? এই কি বিএসএফের নজরদারির নমুনা? নাকি সীমান্তেও টাকার বিনিময়ে এমন যাতায়াত হয়েই চলেছে? যারা ধর্মের জিগির তুলে ফতোয়া দেয়, তাদের আমরা মৌলবাদী বলছি, যারা নাশকতামূলক কাজ করে তাদের আমরা জঙ্গি বলছি কিন্তু যারা টাকা নিয়ে জঙ্গিদের অবাদ প্রবেশে সাহায্য করছে, ভুয়ো পাসপোর্ট বানিয়ে দিচ্ছে, ভোটার তালিকায় নাম তুলে দিচ্ছে, ভোটার কার্ড জঙ্গিদের হাতে তুলে দিচ্ছে, প্রত্যক্ষ এবং প্ররোক্ষভাবে দেশবিরোধী কাজ করছে এবং করতে সহায়তা করছে, তাদের আমরা কি নামে অভিহিত করবো? মৌলবাদী, জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী না দেশবিরোধী?
দেশের এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এই অবস্থায় কোথায় গীয়ে পৌঁছেছে তা সহজেই অনুমেয়। অথচ রাজনৈতিক দলগুলি দেশ বা মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রশ্নে পারস্পরিক চাপানউতোর, মেরুকরণের রাজনীতি, ভোটব্যাংক ইত্যাদি নিয়েই মেতে আছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ফায়দা যাদের অন্যতম লক্ষ্য তাদের একপক্ষ তখন বিএসএফকে দোষারোপ করছে অন্য পক্ষ এ রাজ্যের সরকারি ব্যবস্থার গাফিলতি বলে আঙ্গুল তুলছে। কিন্তু আসল প্রশ্ন যে দেশ এবং সাধারণ মানুষ কতটা বিপদের মধ্যে রয়েছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই কেবল ভোটের অনুষঙ্গে রাজনীতি খোঁজা, আর সেই কারণেই কেন্দ্র ও রাজ্যের দায়িত্ব নিয়ে তর্জা আর ভাষন। অথচ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের ২২১৭ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত থাকার কারণে এই রাজ্য জঙ্গি ও নাশকতামূলক কাজকর্মের একটি অবাধ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। এসব কথা দল বা নেতাদের মনে আসেনা, গুরুত্বসহকারে আলোচনাতেও আসে না, কেবলই রাজনীতির অন্ধ গলিতে ঘুরপাক খায়। কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত সতর্ক ভাবে সমাধান না করলে খুব বড় বিপদের মধ্যে পড়তে পারে এই রাজ্য, এই দেশ।
পাশাপাশি একটা প্রশ্ন অনেক প্রসঙ্গের মতোই অবধারিতভাবে এসে পড়ে এই সব রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দ কি সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবে? তাদের ভাবনা যে মুর্খামি এবং শয়তানি তা কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব ভাল করে জানে। কেবল তাই নয় কোন দলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জঙ্গিরা নিশ্চিন্তে ভারত বিরোধী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, কারা জঙ্গিদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সহজেই তৈরি করে দিতে সহযোগিতা করেছে তাও। অতএব জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে যখন এ দেশে আসছে, তখন বিএসএফ কি ঘুমোচ্ছে? অথবা পাসপোর্ট, ভিসা, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি তো কেন্দ্রের সংস্থাগুলি তৈরি করে- এধরণের অগভীর রাজনৈতিক কথায় সমস্যা বাড়তেই থাকে জঙ্গিরা ভাইরাসের মতো আনাচে কানাচে ছড়িয়ে যায়, মৌলবাদী কার্যকলাপ বাড়তেই থাকে, জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যত্রতত্র।
অন্যদিকে আরও একটি প্রশ্ন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম থেকে শুরু করে কথায় কথায় ‘এআই’ বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের কথা বলা হলেও পুলিশের কাছে আগাম খবর পৌছায় না কেন? ব্রিটিশ শাসনামলে এসবের একটা কিছুও তো ছিল না, অথচ প্রত্যন্ত গ্রামের যে কোনো বাড়ির হাঁড়ির খবর ইংরেজ পুলিশের কাছে পৌঁছে যেত। তখন গাঁ গঞ্জেও পুলিশের সোর্স ছিল। যারা সোর্স হিসাবে কাজ করত, তারা থানা থেকে টাকা পেত। এখন সে ব্যবস্থা নেই, কিন্তু কয়লা, গোরু পাচারের বখরার মতো সোর্সমানিও লুটে নেয় পুলিশ। তাই জঙ্গি আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে ভোটার কার্ড বানিয়ে ফেলে কিন্তু গোয়েন্দারা জানতে পারেন না। দেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলি নাক ডেকে ঘুমায় না বসে বসে আঙুল চোষে ঠিক বোঝা যায় না কিন্তু পুলিশের কাছে খবর জে থাকে না এর থেকে লজ্জা বা ঘেন্নার আর কি থাকতে পারে।