তানসেনের সমাধি, গোয়ালিয়র
আমাদের চালক আমাদেরকে নামিয়ে দিলো একটি গেটের সামনে। কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড বসে ছিলো অলসভঙ্গিতে। জিজ্ঞেস করলাম, তানসেনের সমাধি কোন্টা ?
সে আঙুল উঁচিয়ে সামনের উঁচু গম্বুজকে দেখিয়ে দিলো।
না, এটা তানসেনের সমাধি নয়। এটা তানসেনের গুরু মহম্মদ গাউসের সমাধি।
সমাধি চত্বরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে মহম্মদ গাউসের বিশালাকৃতি সমাধিসৌধ। সবাই এই সমাধসৌধের ছবি তুলে ফেসবুকে ‘তানসেনের সমাধি’ বলে পোস্ট করেন।
কিন্তু গাউসের সমাধির পিছনে, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, অনেকটাই ছোট একটি সমাধি — একটু উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপরে নকশাখচিত স্তম্ভ সহকারে দাঁড়িয়ে আছে। রোদে-বৃষ্টিতে সেই সমাধি এখন ম্লান ও আকর্ষণহীন। … তাই পর্যটকেরা সামনের বিশাল সৌধটি দেখেই ফিরে যান।
যাঁরা শেষপর্যন্ত তানসেনের অনাড়ম্বর সমাধি দেখেন ও হতাশ হন, তাঁরা পার্শ্ববর্তী একটি তেঁতুলগাছের পাতা ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে ফিরে যান, কারণ এই পাতা মুখে নিলে গলায় সুর-তাল-লয় আপনা থেকেই এসে যাবে!
মূলত ধ্রুপদ গায়ক তানসেন গোয়ালিয়রের সন্নিকটে বেহাত গ্রামের মকরন্দ পাণ্ডে/মিশ্রের পুত্র ‘রামতনু’ বা “তন্ন”। তানসেনের আসল নাম রামতনু পাণ্ডে কিংবা মিশ্র।
তানসেনের জীবন ও জীবনের তথ্য সবই রহস্যাবৃত ও বিতর্কিত। কতো কল্পনার গাছ তাঁকে ঘিরে পল্লবিত হয়। গল্পে-উপন্যাসে-চলচ্চিত্রে পরস্পর-বিরোধী অগণন তানসেনের উদয় হয়।
তানসেনের জন্মসাল নিয়ে বিতর্ক আছে। মোটামুটি ১৪৯২ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে তাঁর জন্ম। অনেকেই বলেন, ১৫০০ সালে। এমনকি সুনীতি চট্টোপাধ্যায় একটি হিন্দি কবিতা-সংগ্রহে কবিদের জীবনীপঞ্জি দেখে উল্লেখ করে বলেছেন, তানসেনের জন্ম ১৫৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দ। যদিও তিনি সেখানে কোনও তথ্যসূত্র দেখতে পারেননি।
প্রথম জীবনে ১০ বছর বয়সে বৃন্দাবনে গুরু স্বামী হরিদাসের কাছে গান শিখেছিলেন। পরে মহম্মদ গাউসের কাছ থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন এবং গোয়ালিয়র ঘরানার সঙ্গীত শৈলীর বিকাশ করেছিলেন।
তাঁর শিক্ষক হিসাবে আরও এক হরিদাসের নাম পাওয়া যায়, রেওয়া রাজ্যের হরিদাসের কাছে শেখেন তানসেন। … এই হরিদাস নামের বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞের নাম উল্লেখের ফলে সামান্য বিভ্রম তৈরি হয়।
গোয়ালিয়রের রাজা মান সিং তোমর ও তাঁর নবম পত্নী মৃগনয়নী ছিলেন সঙ্গীতের অনুরাগী। তানসেন প্রথম জীবনে তাঁদের সভায় যোগ দেন।
বিন্ধ্যপ্রদেশের রেওয়া রাজ্যে সভাগায়ক হরিদাস মারা গেলে রামতনু সেখানে সভাগায়ক হন। রাজা রামচন্দ্র বাঘেলার দরবার থেকে তাঁর গানের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাঁর নাম এসে পৌঁছায় সম্রাট আকবরের কানে, তিনি তানসেনকে আহ্বান করলেন তাঁর সভা অলঙ্কৃত করার জন্য। সম্রাটের পক্ষ থেকে জালাল খান কুরচি এসে পৌঁছোলেন রাজা রামচন্দ্রের পান্না-তে। তিনি রামতনু পাণ্ডেকে সঙ্গে নিয়ে আকবরের কাছে ফিরবেন।
তানসেন রাজা রামচন্দ্রের দরবারে মোটামুটি ৭ বছর কাটিয়েছিলেন। রামচন্দ্র প্রথমে তানসেনকে ছাড়তে চাইছিলেন না, কিন্তু সম্রাট আকবরের ইচ্ছাকে অমান্য করতেও সাহস করলেন না। অতএব তানসেন গেলেন আগ্রায় আকবরের সভায়। তানসেন ১৫৬০ বা মতাস্তবে ১৫৬২ বা ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের দরবারে আসেন।
আকবর প্রথম দর্শনে তানসেনের গান শুনেই তাঁকে তৎক্ষণাৎ ২ লক্ষ টাকা দিলেন এবং দিলেন “তানসেন” খেতাব।
তানসেন বেশি বয়সে বা অত্যন্ত পরিণত বয়সে আকবরের সভায় এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। আকবরের সভায় তানসেন যখন এসেছিলেন তখন তাঁর পুত্রেরা সুপ্রতিষ্ঠিত গায়ক। এঁরাও আকবরের সভায় যোগ দিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক আবুল ফজল তানসেন সম্পর্কে লিখে গেছেন, “তাঁর মতো গায়ক গত হাজার বছর ধরে ভারতে অজানা ছিলো । রাজসভায় সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে অন্তত ৩৬ জনের নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম । আকবরের দরবারে অসংখ্য সঙ্গীতজ্ঞ যুক্ত ছিলেন- হিন্দু, ইরানি, তুরানি, কাশ্মীরি, পুরুষ ও মহিলা উভয়ই। তাঁরা সাতটি দল গঠন করেছিলেন, সপ্তাহের একেক দিন একেক দল পারদর্শিতা দেখাত।”
তানসেন ছিলেন আকবরের দরবারে নবরত্নদের একজন। দরবারি কানাড়া, দরবারি কল্যাণ, দরবারি তোড়ি, মিঞা-কি -মল্লার, মিঞা-কি সারং , মিঞা-কি জয়জয়ন্তী ইত্যাদি রাগের স্রষ্টা তানসেন।
তানসেন “রাগমালা” ও “সংগীতসার’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেছিলেন ।
তানসেনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নানারকম গল্প প্রচলিত আছে। তানসেন বিয়ে করেছিলেন হোসেনি নামের এক সুন্দরী নারীকে। হোসেনির পিতা ছিলেন সারস্বত ব্রাহ্মণ। দারিদ্র্যের জ্বালায় দিল্লিতে সুলতান লোদির দরবারে সভাপণ্ডিতের চাকরি নিয়েছিলেন। ফলে ব্রাহ্মণ-সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত করে। অভিমানে, তিনি সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর কন্যা প্রেমকুমারীর নতুন নাম হয় হোসেনি। তাঁর সঙ্গে তানসেনের বিয়ে হয়। তাঁদের চার পুত্র ও এক কন্যা ছিলো।
কেউ কেউ আবার লিখেছেন, হোসেনি ছিলেন তানসেনের গুরু মহম্মদ গাউসের বংশের কন্যা, তানসেনের সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়েছিল। তানসেন ভালোবাসার টানে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ও ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
জনশ্রুতি এই যে গুরু মহম্মদ গাউস তানসেনের জিভকে নিজের জিভ দ্বারা স্পর্শ করেছিলেন এবং এইভাবে তাঁর নিজের গান গাওয়ার অসাধারণ দক্ষতা সঞ্চারিত করেছিলেন ছাত্র তানসেনের কাছে। … তাতেই ধর্মচ্যুত হন তানসেন।
কেউ কেউ আবার লিখেছেন, ১৫৬২ সালে আকবরের দরবারে আসার পর তানসেন ধর্মান্তরিত হন।
এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলছেন, তিনি ধর্মান্তরিত হননি। যদি হতেন, তাহলে মুণ্ডুমালা পরিহিত শিব, পার্বতী, গঙ্গা, ডমরু ইত্যাদি বিষয়ে ধ্রুপদের পদ লিখতে পারতেন না !!! তাঁর কন্যার নাম কী করে সরস্বতী থেকে গেল !!!
সুনীতি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : হিন্দুস্থানি স্কুল মুসলমানদের মধ্য-এশীয় ফার্সি, আরব এবং তুর্ক সঙ্গীত থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছে ! কোনও সন্দেহ নেই. এইভাবে কর্ণাটক স্কুলের চেয়ে কম বিশুদ্ধ হলেও, এটি আরও সমৃদ্ধ।
তানসেনের সময়ের যে কয়েকজন সঙ্গীতজ্ঞ সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন, তাঁদের মধ্যে
মাণ্ডুর বাজ বাহাদুর বিশেষভাবে স্বীকৃত । বাজ বাহাদুর সম্পর্কে আবুল ফজল লিখে গেছেন, অপ্রতিদ্বন্দ্বী । তিনি মালবের শাসক ছিলেন, কিন্ত ১৫৭২-এ রাজ্য হারিয়ে আকবরের সভায় যোগদান করেন।
আকবরের সময় মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো আগ্রা। তারপর ১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ রাজধানী ছিলো ফতেপুর সিক্রিতে। পরে জলের অভাব দেখা দেওয়ায় রাজধানী স্থানান্তরিত হলো লাহোরে। পরে আবার ফিরে এলেন আগ্রায়।
ফতেপুর সিক্রি বেড়াতে গিয়ে সেই লাল রঙের চত্বর দেখেছি যেখানে জলের ধারে বসে তানসেন গান গাইতেন ।
তানসেনকে ঘিরে কতো অলৌকিক গল্প ছড়িয়ে আছে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে। আকবর তানসেনকে এত ভালোবাসেন দেখে দরবারের কিছু গায়কের মনে প্রবল ঈর্ষা জেগে ওঠে, তাঁরা আকবরকে বলেন, তানসেনের কণ্ঠে ‘রাগ দীপক’ শুনেছেন ? আকবর শোনেননি, তাই তানসেনকে বললেন, রাগ দীপক শুনতে চাই !
তানসেন “রাগ দীপক” গাইতেন না, কারণ এটি গাইলে এমন তাপ তৈরি হবে যে এর গায়ক আগুনে ভস্মীভূত হতে পারেন। সম্রাটের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে না পারলেও, তানসেন তাঁর কন্যা সরস্বতীকে শিক্ষা দিয়ে প্রস্তুত করেছিলেন, যিনি “রাগ মেঘমল্লার” গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারবেন। তানসেন রাগ দীপক গাইতে শুরু করলে চারদিকে উত্তাপ বাড়তে থাকে। দরবার কক্ষে আগুনে জ্বলে ওঠে। সৌভাগ্যবশত, সরস্বতী মেঘমল্লার রাগ গেয়ে বৃষ্টিকে ডেকেছিলেন, যা আগুন নিভিয়ে দিয়েছিল এবং এর ফলে তানসেন এবং দরবার কক্ষ রক্ষা পেয়েছিল।
একবার সম্রাট আকবর হরিদাস স্বামীর গান শুনতে চাইলেন। কিন্তু স্বামী তো দরবারে আসবেন না। স্বামীর কাছে আকবরকে নিয়ে গিয়েছিলেন তানসেন। স্বামীর গান আকবরকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি অলৌকিক আনন্দে সংজ্ঞা-হারা হয়ে পড়েছিলেন এবং যখন তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন তিনি তানসেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তিনি (তানসেন) হরিদাস স্বামীর মতো গান করতে পারেন না। তানসেন উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি একজন পার্থিব শাসকের আনন্দের জন্য গান করেন, যেখানে তাঁর গুরু হরিদাস স্বামী গান করেন বিশ্বজগতের প্রভুর জন্য ।
তানসেনের মৃত্যুর সাল তাঁর জীবনের অনেক কিছুর মতো, তর্কাতীত নয় । কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, তানসেন ১৫৮৬ সালে আগ্রাতে মারা যান । আকবর ও তাঁর দরবারের বেশিরভাগ সভাসদ শেষকৃত্য শোভাযাত্রায় অংশ নেন। আবুল ফজলের লেখা অনুযায়ী, তানসেনের মৃত্যু হয়েছিল ১৫৮৯ সালে।
আকবরনামায় আবুল ফজল লিখছেন, “২৬ এপ্রিল ১৫৮৯ তারিখে মিঞা তানসেন মারা গেলেন। সম্রাটের আদেশে সব মিউজিশিয়ান ও গায়ক বিয়েতে যেভাবে গান হয় সেইভাবে গান গেয়ে তাঁর শবদেহের অনুগামী হলেন। বয়সের আনন্দ যেন তমসাবৃত হয়ে গেল, সম্রাট বললেন, তাঁর মৃত্যুতে হলো সঙ্গীতের বিনাশ। মনে হয়, সহস্র বছরে খুব কমই এসেছে তাঁর সমান মিষ্টত্ব ও শিল্প নিয়ে।”
তানসেনের দেহাবশেষ গোয়ালিয়রে তাঁর সুফি গুরু শেখ মুহাম্মদ গাউসের সমাধি কমপ্লেক্সে ইসলামি রীতিতে সমাহিত করা হয়।
তানসেনের সমাধির পাশেই আরও একটি সমাধি আছে। আমাদের কৌতূহল দেখে একজন স্থানীয় মানুষ জানালেন, এটি তানসেনের কনিষ্ঠ পুত্র বিলাস খানের সমাধি।
তানসেনের সব পুত্রেরাই সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। এই বিলাস খান — বিলাস খানি টোড়ি রাগের সৃষ্টিকর্তা। বিলাস খান জাহাঙ্গীরের রাজ্যকাল পর্যন্ত সভাসদ ছিলেন। রবাব ও বীণা-বাদক ছিলেন তিনি।
তানসেনের সমাধির কাছে ১৭-২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বার্ষিক উৎসব “তানসেন সমারোহে”র সময় উস্তাদকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।