বাংলার ধাতুপ্রক্রিয়াকরণ বিষয়ক জ্ঞানচর্চার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সেই পালবংশের রাজাত্বকাল থেকে এ বাংলার যেসব শিল্প উৎকর্ষতায় পৌছেছে তাদের মধ্যে তামা-পিতল শিল্প অন্যতম। একটা সময় ছিলো যখন গ্রাম জুড়ে শোনা যেতো কামারের হাতুরি পেটানোর আওয়াজ। কামারের সৃষ্ট আওয়াজের ছন্দে সৃষ্টি হতো তামা – কাঁসা– পিতলে এক বিস্তীর্ন ইতিহাস। তখন এই তামা পিতল থেকে গৃহস্থলীতে ব্যবহৃত তৈজস্ব উৎপাদন থেকে শুরু করে তৈরি হতো নিখুঁত নকশার সব ভাস্কর্য।
ভগভট্টের রসরত্নসমুচ্চয় যে বাংলার বা পূর্ব ভারতের জ্ঞানচর্চা বিষয়ক রচনা তার প্রমান ছড়িয়ে রয়েছে পাণ্ডুলিপির ভাষায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশ সেন বা অন্যান্য পণ্ডিত বলেছেন, যে আঙ্গিকে সংস্কৃত তিনি লিখেছেন তার চলন সংস্কৃতের থেকে বাংলার সঙ্গে অনেক বেশি মেলে। বাংলার তামা বা লোহা অথবা সামগ্রিকভাবে ধাতুর নামবাচক আসংখ্য উপসর্গ এবং অনুসর্গ রয়েছে যেমন তামাজুড়ি, তাম্রলিপ্ত, লোহাপুর ইত্যাদি — তাতে প্রমান হয় বাংলা একসময় ধাতু বিদ্যা চর্চায় বেশ প্রথমসারিতে ছিল। হীতেশ রঞ্জন সান্যাল বলছেন, বাংলায় সাঁওতাল সমাজ লোহা তৈরি করতেন। কিন্তু তারা তৈজস বা হাতিয়ার তৈরি করতেন না; সেই কাজটা করতেন সাঁওতাল গ্রামের বাইরে বসা বর্ণহিন্দু কামারেরারা।
আর তান্ত্রিক আচার/লোকাচারে রয়েছে ধাতুর নানান ধর্ম জানার জ্ঞান। শরীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিচ্ছবি। নিজেকে জানা আর ব্রহ্মান্ডকে জানা একই কথা। নানান তান্ত্রিকাচারে রয়েছে ধাতুকে ধারণ করার প্রক্রিয়া। এলকেমি বা কিমিয়াবিদ্যা — যাকে এতদিন পশ্চিম শুধু বিভিন্ন ধাতুকে সোনায় রূপান্তরের বিদ্যা বলে নানান সাহিত্যে প্রচার দিয়ে এসেছে, আদতে তা পরম্পরার ধাতু সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চার ইতিহাস। রসসার, রসরাজ, রসহৃদয়ের মত তান্ত্রিক গ্রন্থে বিশদে নানান ধাতুজ্ঞান বিশদে চর্চিত হয়েছে।
এত বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও দেশকে, সমাজকে, নিজের প্রাযুক্তিক জ্ঞানচর্চাকে ভুলে বহু পণ্ডিত এবং জ্ঞানী দেশিয় ধাতুবিদ্যাচর্চাকে দেখেছেন সাগরপারের পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার দর্পণে। তাঁদের বেড়ে ওঠার সময় পড়াশোনা যেহেতু পশ্চিমের জ্ঞানচর্চায় নিষিক্ত তাই তারা দেশজ ধাতুজ্ঞানচর্চার দেশিয় ভিত্তি খুঁজে পাননা, বহু সময়ে তাঁরা এই জ্ঞানগুলির ভিত্তিকে উপহাস করে থাকেন। ধাতুবিদ্যা চর্চা বিশ্লেষণে পশ্চিমের তত্ত্ব অবলম্বন করার ঐতিহ্য প্রবলতর। অথচ আজও সে সব ধাতুবিদ আছেন, তাঁরা জং ছাড়া তৈজস/হাতিয়ার তৈরিতে মাহির।
কাঁসা-পিতল-তামার নানান ধরণের তৈজস ব্যবহার কর ভারতের পরম্পরার সমাজ। বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের আপণ থোড় বড়ি আড্ডায় যে তামার গয়নাগুলো বিক্রি হয়, তা কিন্তু কেনেন পরম্পরার পরিবারগুলি। এখনো পর্যন্ত হাতে গোণা এক জন দুজন ভদ্রবিত্ত বাঙালি পরিবারকে এই গয়না কিনতে দেখেছি — কিনেছেন ঝাড়খণ্ড, বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মহিলারা। তারা এখনো বিশ্বাস করেন মানুষের দেহের সঙ্গে কিছু না কিছু তামা লাগিয়ে রাখা দরকার।
মিশ্র ধাতু বা সংকর ধাতু বিকাশের ভারতবর্ষীয় ইতিহাস বেশ আকর্ষক। সে তত্ত্ব এই ক্ষুদ্রপরিসরে বিশেদে আলোচনার সুযোগ নেই। কারিগরদের পরম পত্রিকার কয়েকটি ধাতু সংখ্যায় সেই সব মোটামুটি বিশদে আলোচিত হয়েছে। এখানে মূলসূত্র আলোচিত হল। কাঁসার ইংরেজি নাম বেল মেটাল — বিদেশিরা ভারতকে না জেনেই কাঁসাকে বেল মেটাল বা ঘন্টা তৈরির উপকরণ হিসেবে বর্ণিত করেছেন, কেউ বলছেন বেলজিয়াম থেকে এই ধাতুগুলি আসত বলে এর নাম বেল মেটাল। অথচ ভারতের ধাতুবিদ্যার ইতিহাস বেশ প্রাচীন, এবং বিশ্ব জ্ঞানচর্চায় তাঁদের অবদানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্য বলা দরকার।
পিতল — তামা ও দস্তার মিশ্রণে তৈরী সংকর ধাতু। পিতলে তামা ও দস্তার পরিমাণে তারতম্য ঘটতে পারে এবং এর ফলে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন ধরনের পিতল তৈরি সম্ভব। চীনে খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ পূর্বেও পিতলের ব্যবহার দেখা যায়। কাঁসাঃ হচ্ছে রাং বা টিন (Tin) এবং তামা (Copper) এর সংমিশ্রণে তৈরী একটি মিশ্র ধাতু। অনেকেই ধারণা করে থাকেন যে কাঁসা আর পিতল হচ্ছে একই জিনিস।কিন্তু পিতল হচ্ছে দস্তা (Zinc) এবং তামা (Copper) এর সংমিশ্রণে তৈরী একটি মিশ্র ধাতু।কাজেই কাঁসা আর পিতল একই জিনিস নই।এটি একটি মিশ্র ধাতু। তামাঃ ইংরাজি নাম কপার (Copper) একটি রাসায়নিক মৌল যার চিহ্ন Cu এসেছে ল্যাটিন শব্দ কিউপ্রাম (cuprum) থেকে এবং এর পারমাণবিক ক্রমাঙ্ক ২৯। তামা একটি নমনীয় ধাতু এবং এর তাপীয় ও বৈদ্যুতিক পরিবাহীতা খুব উঁচু দরের তাই অনেক বিজলিবাহী তারের মধ্যেই তামার তার থাকে।
বিশুদ্ধ তামা খুব বেশি নরম ও নিজস্ব উজ্জ্বল বর্ণ সমন্বিত কিন্তু আবহাওয়ার সংস্পর্শে এর বাইরে একটি লালচে-কমলা বিবর্ণ স্তর তৈরী হয়। তামা ও তামার বহু মিশ্র ধাতু (যেমন ব্রোঞ্জ, পিতল ইত্যাদি) অনেক হাজার বছর ধরে মানুষের নিত্য সঙ্গী। প্রাচীনকালে তামার অনেক খনির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সাইপ্রাস (লাতিনে Cyprus ক্যুপ্রুস্) দ্বীপের খনিগুলো সবচেয়ে তাৎপর্যময়। অনেকের মতে তামার ইংরেজি নাম কপার (লাতিন নাম Cuprum কুপ্রুম) শব্দটি এখান থেকেই এসেছে।
প্রত্যেক জেলায় কিছু না কিছু কাঁসা পিতলের কারিগর আছেন। কাঁসা পিতলের খুব বড় উৎপাদনের ক্ষেত্র ছিল বহরমপুরের খাগড়া, আজকের খাগড়াঘাট। আজ বহু সমস্যায় দীর্ণ, কিন্তু বাংলার জেলার পুরানো তামা-পিতল-কাঁসার দোকানে গেলে আজও তাঁরা সগর্বে খাগড়াই উৎপাদনের কথা লিখে রাখেন। অন্যান্য সামগ্রীর তুলনায় কাঁসার মূ্ল্য তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণেও ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অন্যদিকে কাঁচামালের মূল্যও অত্যন্ত চড়া। ফলে আগের মতো আর পুষিয়ে উঠতে পারছেননা কাঁসারুরা। কোনোমতে টানাপোড়নের মধ্যদিয়ে চলছে তাদের সংসার। শত প্রতিবন্ধকতা আর চরম হতাশার মধ্যেও কাঁসা শিল্পীরা সযত্নে কাঁসা দিয়ে কলস, বাটি, বালতি, পানদানি, প্রদীপ, চিলোমচি, ফুলের টব, গামলা, তবলা, ডিশ, থালা-বাসন, মূর্তি ও দাঁড়িপাল্লাসহ সৌন্দর্যবর্ধক নানা সামগ্রী তৈরি করে তা বাজারজাত করছেন। এই শিল্পকে ভর করে এখনও দেশের হাজার হাজার কাঁসা শিল্পী বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কাঁসা শিল্পীরা জানান, তারা ঢাকার বকশীবাজার থেকে ২০০-২২০ টাকা কেজি দরে কাঁচামাল কিনে নানা সামগ্রী তৈরি করে তা বিক্রি করেন মাত্র ২৭০ টাকায়। তবে পাইকাররা তাদের কাছ থেকে কম দামে কিনলেও বেশি দামে তা বিক্রি করে।
তামা-পিতল পরিষ্কারের কিছু পরম্পরার টোটকা খুব সহজেই দু-তিনটি উপকরণের সহায়তায় পরিষ্কার করে ফেলতে পারবেন পিতল,কাঁসা,তামা। বাসন মাজার ফোম নিন। ফোমের ওপর লবণ আর লেবুর রস ছিটিয়ে দিন। এবার এটি দিয়ে ভালোভাবে পিতলের বিভিন্ন জিনিস ঘষে নিন। প্রয়োজন মনে করলে পুনরায় লেবুর রস আর লবণ দিয়ে নিন। কালচে ভাব অনেকটাই চলে যাবে। সবশেষে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কাঁসা খুব পুরোনো কাঁসার জিনিস হলে ডিটারজেন্ট দিয়ে আলতো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। তুলনামূলক নতুন ও অমসৃণ উপরিভাগ হলে নরম ব্রাশে ডিশ সোপ নিয়ে ঘষুন। চকচকে ভাব চাইলে পিতল মেটাল পলিশ দিয়ে ঘষে নিতে পারেন। বাজারের সাধারণ টমেটো সস আর লবণ দিয়েই তামার বিভিন্ন জিনিস পরিষ্কার করে ফেলা সম্ভব। পরিষ্কার কাপড়ের ওপর টমেটো সস আর লবণ একসঙ্গে নিয়ে তামার জিনিস ঘষুন। একটু সময় নিয়েই কাজটা করতে হবে।