স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ভারতীয় নবজাগরেণ অন্যতম পথিকৃত। যে সমস্ত মনিষী ভারতকে আধুনিকতার আদর্শে উজ্জীবিত করেন তাদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ অন্যতম।
কলকাতার সিমুলিয়ার বিশ্বনাথ দত্ত এবং মা ভুবনেশ্বরী দেবীর পুত্র নরেন দত্ত একদিন সাধনা মাধ্যমে হন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর চিন্তা চেতনা, মেধা মনন, জ্ঞান, আদর্শ্, পাশ্চাত্য দর্শন, হিন্দুধর্মে মূল বাণী এবং তাঁর কর্মকান্ড এবং চিরন্তন বাণীর মঝে আধুনিকতার বহি:প্রকাশ ঘটেছে।
সন্ন্যাস জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত নরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মার কাছে শেখেন স্বধর্ম, বাবা পরিচয় করিয়ে দেন এক উদার সংস্কৃতির সঙ্গে। সাধারণ বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে তিনি সঙ্গীত ও ব্যায়ামেও পারদর্শী হন। যৌবনে তিনি ব্রাক্ষ্মসমাজ ও পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বি.এ. পাশ করে আইন পড়বার সময় পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অর্থাভাবে তাঁকে অনাহারে পর্যন্ত দিন কাটাতে হয়েছিল। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর গৃহী ভক্তদের অর্থানুকূল্যে তিনি অন্য গুরুভাইদের সঙ্গে বরানগরে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ স্থাপন করেন। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি পরিব্রাজনায় বেরিয়ে ভারত ও ভারতবাসীদের প্রতক্ষ পরিচয় লাভ করেন। এই সময়ে তিনি নানান শাস্ত্রও অধ্যয়ন করেন। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে তিনি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মাদ্রাজবাসী ও অন্যান্য বন্ধুদের সাহায্যে আমেরিকায় যান। সেপ্টেম্বরে এই সভার অধিবেশনে স্বামীজির বক্তৃতার ফলে ভারতের ধর্মমত ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিদেশীদের শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে যায়। আরও কিছুদিন ইউরোপে ও আমেরিকায় থেকে তিনি বক্তৃতা, শাস্ত্রব্যাখ্যা, বইলেখা ও ব্যক্তিগত আলোচনার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জীবন ও চিন্তাধারা সম্বন্ধে বিদেশীদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার কাজে নিযুক্ত থাকেন। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে ভগিনী নিবেদিতা বিবেকানন্দকে সর্বপ্রথম দেখেন। স্বামীজির বাণী তাঁর হৃদয়ে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি স্বামীজির আহবানে ভারতে আসেন। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে বিবেকানন্দ স্বদেশে ফেরেন আর দেশবাসীর কাছ থেকে তুমুল সম্বর্ধনা পান।
ভারতীয়রা চিন্তা চেতনা, শিক্ষদীক্ষায় পেছনে পড়ে থাকা জাতি বিদেশীদের এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করার কাজে নিযুক্ত থাকেন। স্বামী বিবেকানন্দেরে আগে এমন কোন হিন্দু সন্ন্যাসী ভারতবাসীকে নবজাগরণের বাণী শোনানি। রাজনীতিক না হয়েও তাঁর বক্তৃতা ও রচনা তেজ, বীর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাঙক্ষা, ভারতের ভাবী সম্ভাবনা ও অতীত মহিমার গৌরবানুভবের বার্তা প্রতিনিয়ত ধ্বনিত করে দেশের যুবকদের প্রাণে ও রাষ্ট্রজীবনে এক অভূতপূর্ব অনুভূতির জন্ম দেন।
কুসংস্কার মুক্ত অতীত ভারতের মহিমার গৌরবানুভবের বার্তা তিনিই প্রথম যুব সমাজকে শোনার আধুনিকতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। এক সময় এক শ্রেণির হিন্দুধর্ম্ গুরুরা হিন্দুধর্মে আদর্শ্ থেকে দূরে সরে যান। তারা বিভাজন পাকাপোক্ত ভাবে আসন গাড়ে। তার বেদান্ত দর্শন কে অপব্যাখ্যা করে সতীদাহের মতো বিধান নারীদের ওপর চাপিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম হিন্দুধর্মের অতীত কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কাজে-কর্মে,চিন্তা-চেতনায় তিনি কুসংস্কারকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি। সতীদাহ প্রথা নারীজাতির প্রতি জঘন্য অবিচার ও অত্যাচার বলে জোরালো মদ দেন।
তিনি মানুষের চিত্তের স্থিরতা ও অস্থিরতা প্রসঙ্গে বলেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের মনকে সর্বদা অশান্ত ও নিজের প্রকৃতির বশে চঞ্চল তিনি দেখেছিলেন, মানুষের মন সাধারণত বাইরের দিকে বেরোতে চায়। আর তার জন্য সে ইন্দ্রিয়গুলিকে অবলম্বন করে।তাই তিনি আত্মসংযমের উপর জোর দিয়েছিলেন। কারণ তিনি বলেছেন, সংযত মনের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছুই হয় না। আর যতই মনকে সংযত করা হয়, তার শক্তি তত বাড়ে।তাই তিনি এমন কিছু করতে বারণ করেছেন, যা মনকে অশান্ত করে চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। চিত্ত চঞ্চল মানুষ কখনো প্রতিষ্ঠা লাভ করে না।
স্বামী বিবেকানন্দের আধুনিক মনস্কতার ভাবনা আমরা পাই শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তার কথা থেকে। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে বলেন, শিক্ষা পরিপূর্ণতার এক প্রকাশ। তা মানুষের মধ্যেই থাকে। তিনি মনে করতেন, সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা যে মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে না, বা মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে না, যা খুব বেদনার বিষয়। বিবেকানন্দ শিক্ষাকে তথ্যের সমষ্টি মনে করতেন না। তার কাছে শিক্ষা ছিল আরও বেশি কিছু। তিনি শিক্ষাকে মানুষ তৈরি করার, জীবন দানের ও চরিত্র গঠনের মাধ্যম মনে করতেন। তিনি শিক্ষাকে মহান চিন্তার সমষ্টি মনে করতেন।
মহামানব স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের চরিত্র গঠন সম্পর্কে আধুনিক চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তার বক্তব্য ও কর্মে দ্বারা। চরিত্র গঠন প্রসঙ্গে তিনি ঈর্ষা ও অহংকার বাদ দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সচ্চরিত্রবান হতে মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, পবিত্রতা, ধৈর্য ও মানসিক দৃঢ়তা সব বাধা দূর করে দেয়। তাই তিনি সাহসের সঙ্গে কাজ করতে বলেছেন। যে কাজ ধৈর্যের সঙ্গে সঠিক ভাবে করা হয়, বিবেকানন্দের মতে, সেই কাজই সফল হয়। বিবেকানন্দের মতে, এর গোপন রহস্য হল আত্মবিশ্বাস।আত্মবিশ্বাস থেকে মানুষের মনে সৃষ্টি হয় ঈশ্বরবিশ্বাস।
নিজের উপর বিশ্বাস থাকলেই অন্তরের দেবত্ব জাগরিত হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ নারীর মর্যাদা দান প্রসঙ্গে যা বলেছেন নিঃসন্দেহে তা তার আধুনিক মনষ্কের পরিচায়ক। তিনি লিঙ্গ বৈষম্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছেন। তার মতে আত্মায় লিঙ্গ বা বর্ণভেদ করা অশাস্ত্রীয়। এমনকি যোগ্যতার নিরিখ বিচার করাও অন্যায়। এই নিরিখেই নারী ও পুরুষকে মানুষ বলে ভাবতে বলেছেন।তিনি নারীর মর্যাদা সম্পর্কে আধুনিক মতামত প্রকাশ করেছেন এই বলে, , জাতির উন্নতির মাপকাঠিই হল সেই জাতিতে নারীর মর্যাদা দান করে। বিবেকানন্দ পুরুষ ও নারীকে পাখির দুই ডানার সঙ্গে তুলনা করেছেন। পাখি যেমন এক ডানায় ভর করে উড়তে পারে না, তেমনি নারী জাতির অবস্থা উন্নত না হলে জগতের উন্নতি সম্ভব নয়। নারী জাতির আদর্শ হল মাতৃত্ব। অসামান্য, নিঃস্বার্থ, সর্বংসহা, ক্ষমাশীলা মায়ের আদর্শটিকে বিবেকানন্দ উচ্চ স্থান দিয়েছেন।।ভারতীয় জাতির যে দুটি অভ্যাসকে তিনি সবচেয়ে অকল্যাণকর বলে চিহ্নিত করেন, সে দুটি হল নারী জাতির প্রতি অবমাননা ও জাতিভেদ প্রথা।
স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মচিন্তায় আধুনিক মনষ্কতা ব্যক্ত হয়েছে সার্বজনীন ধ্যান ধারণায়। তিনি ছিলেন বেদান্ত দর্শনের অনুগামী। তিনি ধর্মকে আত্ম-উপলব্ধি বলেছেন। অপরের হিতের জন্য করা হয়, তবে তার সমষ্টিকেই ধর্ম বলা চলে। বিবেকানন্দ বলেছেন, ধর্ম হল মানুষকে পশু থেকে মানুষে পরিণত করা। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংসের থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব শিখেছিলেন, “জীবই শিব”। তাই তিনি “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”র উপর বেশি গুরুত্ব দেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর থাকেন। তাই মানুষের সেবা করাই ঈশ্বরের সেবা।
পরিশেষে বলতে হয় বিবেকানন্দ তাঁর চিন্তা ও সৃষ্টিতে আধুনিক এবং শাশ্বত আধুনিক। তাঁর মধ্যে ঘটেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক সম্মেলন।বিবেকানন্দ শুধু আজকের প্রেক্ষিতে নয়, সব সময় প্রাসঙ্গিক। তিনি একইসঙ্গে সমকালীন ও চিরন্তন।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গল্পকার ও কবি, লাঙ্গলবাধ, শ্রীপুর, মাগুরা, বাংলাদেশ।
সুন্দর লিখনী স্যার।এভাবেই চলতে থাক আপনার কলম। ভগবান আপনাকে সুস্থ রাখুন এই কামনা করি।
ধন্যবাদ।
ভালো লাগল
Thanka