অতিরিক্ত ঝাল মসলায় গড়গড়ে নয় অথচ সুস্বাদু পদ তৈরিতে ওস্তাদ ছিলেন আমাদের পূর্বসূরীরা।
খাবারের পুষ্টি, গন্ধ, রঙ এবং গঠন ধরে রাখতে এবং মাখন বা তেল ছাড়াই স্বাস্থ্যকর রান্না করার একটি ভালো উপায় হল স্টিমিং বা ভাপে রান্না। ইলেকট্রিক চুল্লি, মাইক্রোওভেন, স্টিমার, প্রেসার কুকার ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তির চল হবার আগে আমাদের ঠাকুমা দিদিমারা আধ কড়াই ফুটন্ত জলের মধ্যে মুখ বন্ধ টিফিন কৌটোয় মসলা মাখা মাছ কিংবা সবজি রেখে ভাপে রান্না করতো। এই ধরনের রান্নায় খাদ্যের পুষ্টিগুণ যেমন অধিক পরিমাণে রক্ষিত হয় ঠিক তেমনি স্বাদ গুনেও তার মান কোন অংশে পিছিয়ে থাকে না।
ছোটবেলায় মা কে দেখেছি, মুসুরির ডাল সুতির কাপড়ে পুঁটলি করে বেঁধে ফুটন্ত চালের মধ্যে দিতে। সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে সে ডাল মাখানির স্বাদ ভোলার নয়। আবার কখনও আলু-উচ্ছে, ঝিঙে, ঢেঁড়স সুতো দিয়ে বেঁধে ভাতে রান্না করতে। সেই সব সবজির স্বাদই আলাদা। এই রান্নাগুলিতে ভাজা বা কষানোর কোন প্রক্রিয়া থাকে না বলে সবজির ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। স্টিমিং নিশ্চিত করে যে বায়োটিন, রাইবোফ্লাভিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ভিটামিন-সি, বি-১২, নিয়াসিন, থায়ামিন এবং ভিটামিন-বি, পটাসিয়াম, ফসফরাস এবং জিঙ্কের মতো খনিজগুলি অক্ষত থাকে যখন আপনি দানাশস্য, শাকসবজি, মাছ মাংস ভাপে রান্না করেন।
আমাদের দেশে ভাপে রান্না করার রীতি শুরু হয়েছিল সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে। শিকার করা প্রাণীর মাংস উষ্ণ প্রসবণের মধ্যে রেখে পরিশ্রুত করতে গিয়েই হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষদের মাথাতে এই ধরনের রন্ধন প্রক্রিয়ার কনসেপ্ট আসে। আগেকার দিনে কাঁচা খাদ্য ছিল সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর! তবে কীটনাশক ভর্তি ফল ও শাকসবজির কারণে এখন আর সেটি সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে, খাদ্য স্টিমিং করা স্বাস্থ্যকর পদ্ধতির কাছাকাছি আসে কারণ এক্ষেত্রে খাবারের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলিকে অনেকাংশেই সংরক্ষিত হয়।যারা সীমিত ডায়েট করেন তাদের জন্য স্টিমড খাবার একটি আশীর্বাদ কারণ ভাজা খাবারের তুলনায় স্টিমড খাবারে ক্যালোরি এবং চর্বি অবশ্যই কম থাকে।
বাঙালি রান্নার আদিগুরু বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় ভাপা ও ভাতে রান্না নিয়ে অনেক চমৎকার তথ্য আমাদের দিয়ে গেছেন। বাঙালির রান্না ঘরে বহুল পরিচিত দুটি পদ হলো ভাপা ইলিশ ও ভাপা চিংড়ি। সাধারণত কচি লাউ বা কলাপাতায় ইলিশ আর গলদা চিংড়ি মাছ বেঁধে অন্নপাকের সময় হাঁড়ির মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়। অন্নপাকের শেষে হাঁড়ির মধ্যে থেকে ওই রাঁধা মাছ তুলে, কলা পাতায় বাঁধা হলে পাতা ফেলে আর লাউ পাতা হলে পাতা সমেত তেল, নুন মেখে দিয়ে খাওয়া হয়। বিপ্রদাসের মতে মাছ ভাপার জন্য ইলিশ মাছের পেটি হল সেরার সেরা। তিনটি কারণে পেটি মাছ, মাছের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় সুখাদ্য। পেটিতে তেলের ভাগ বেশি আর কাঁটা সংখ্যা অল্প ও কোমল। সেইজন্য প্রায় সব মাছের পেটি ভাপা রান্নার পক্ষে বেশি উপযোগী।
বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তার “পাক-প্রণালী” গ্রন্থে ইলিশ মাছ ভাপার এক জিভে জল আনা রেসিপি দিয়েছেন। পেটের মাছ বড় বড় চাকা করে কেটে সামান্য নুন মেখে ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। খাঁটি সরষের তেল নুন সামান্য হলুদ সরষে বাটা মাছে মেখে দিলে তাতে আর কোন মসলা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রথমে ভাত রান্না করে তা কোন পাত্রে ঢেলে ভাতের উপর একটু চেপে গর্ত মত করে তাতে একখানা কচি কলাপাতা পেতে মসলা মাখা মাছ রেখে তার ওপর আরেকটি একই মাপের কলা পাতা দিয়ে ঢেকে বাকি গরম ভাত উপরে ঢেলে আধাঘন্টা রেখে দিতে হবে। তাতেই প্রস্তুত অসামান্য এই ভাপে ইলিশ পদ।
ভাপা রান্নায় শুধু ইলিশ বা চিংড়িই নয়, চিকেনের পদও খুবই ভাল স্বাদের হয়। মাংস ভালো করে ধুয়ে নিয়ে কাজুবাদাম, সর্ষে, পোস্ত, নুন-গোলমরিচ-লেবুর রস বা আদা-কাঁচালঙ্কা-টক দই ইত্যাদি মাখিয়ে খানিকক্ষণ রেখে দিন। ম্যারিনেশন প্রোটিনের তন্তুকে নরম করে। তারপর টগবগে জল ফোটানো পাত্রে বা প্রেসার কুকারে কলা পাতায় মুড়ে টিফিনবাক্সে ভরে ভাপিয়ে নিন।
স্টিমিং বা ভাপে রান্না করার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখবেন যে বাষ্প গরম। যখনই আপনি স্টিমারটি তাপ বা কাউন্টার টপে রাখবেন সবসময় কভারটি ধীরে ধীরে এবং আপনার থেকে দূরে সরিয়ে খুলুন। ভারতে ইডলি এবং ঢোকলা খুব জনপ্রিয় স্টিমড স্ন্যাকস তাই এর জন্য বিশেষ কুকার পাওয়া যায়। এছাড়াও মনে রাখবেন যে প্রতিবার ঢাকনা সরানো হলে, সমস্ত বাষ্প বেরিয়ে যায় এবং ঠান্ডা বাতাস দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত হয়। এই বাতাস আবার গরম হতে একটু সময় লাগে। তাই বেশিবার ঢাকনা না খোলার চেষ্টা করুন।
রান্নার প্রতিটি ঘরানার সঙ্গে মিলেমিশে আছে ইতিহাসের গন্ধ। অবধ রান্না বা দমপুখত রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এরকম নানা জমজমাট গল্প। পারস্য ভাষায় ‘দম’ অর্থ প্রশ্বাস আর ‘পোখত’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রন্ধনপদ্ধতি। ভারতীয় উপমহাদেশে দমপুখত শব্দটির অপভ্রংশ ঘটে কোথাও কোথাও একে ‘দমপোক’ও বলে। সে যাই হোক, অযোধ্যার হেঁশেলকেই এদেশের দমপুখত রান্নার আঁতুড় ঘর বলা যেতে পারে।
সে বহু যুগ আগেকার কথা। একবার অবধ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে নবাব পড়লেন দারুণ চিন্তায়। প্রজাবৎসল নবাব বিশাল বিশাল উনুনে বড় বড় হাঁড়ি চাপিয়ে এলাহী খানাপিনার আয়োজন করলেন। ঠিক হলো সারাদিন ধরে অবিরাম রান্না চলবে। হাঁড়ির মধ্যে একসঙ্গে রাধা হবে মাংস, আলু, সবজি ও নানা পুষ্টিকর উপাদান রান্না হবে ঢাকা বন্ধ হাঁড়িতে ঢিমে আঁচে দীর্ঘ সময় ধরে। এর ফলে শক্ত খাবার শুষে নিতো সবরকম খাদ্য রস এবং পুষ্টিতে ঘাটতি পড়ত না এই হল অবধ ঘরানার দমপুখত রান্না প্রণালীর জন্ম ইতিহাস।
একসঙ্গে এক হাঁড়িতে ঢাকনা আটগোলা দিয়ে আটকে বেশি পরিমাণ খাবার রান্না করলেও তাপ সব জায়গায় সমানভাবে পৌঁছতে পারে। সাধারণ রন্ধন প্রণালীর মত নেড়েচেড়ে দেখা বা ঢাকনা খুলে সিদ্ধ হল কিনা ইত্যাদি দেখার কোন উপায় নেই। দমপুখত রান্নায় বিশেষ মুনশিয়ানার দরকার হয় যা কিনা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই অর্জন করা সম্ভব।
এই রান্নার মনমাতানো স্বাদ–গন্ধে অনন্য হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের উপকরণের ব্যবহার। ইন্টারনেটের যুগেও রেস্টুরেন্ট, বাড়িতে দমপুখত রান্নার জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। তাই অতিথি আপ্যায়নে, পরিবারের সবাইকে বা বন্ধুবান্ধবকে চমকে দেওয়ার জন্য যে কোন সময়ে বাড়িতেই বানিয়ে ফেলুন স্বাদে পুষ্টিতে ভরপুর ভাপে বা দমের ডিশ।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আলপনা ঘোষের বই মছলিশ এবং অন্যান্য।।
আমার মা এসব অনেক জানতো ও করতো। এখন আর হয় না।
শুনেছি মায়ের কাছে। থ্যাঙ্ক ইউ গো।
কত ভাপে রান্নার রেসিপি জানলাম। খুব প্রয়োজনীয় পোস্ট
খুব খুশি হলাম গো তোমার কমেন্ট পেয়ে।
বাহ! বেশ ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ।
তরকারিতে মসলা একটু বেশি দরকার। ভালো খুবই ভালো।
আপনার লেখা নস্টালজিক করলো,মনে পরে গেল মায়ের কথা,ভাতের মধ্যে এক
টুকরো কাপড়ে বাঁধা মুসুরদাল সেদ্ধ কাঁচা সরিষার তেল দিয়ে নিজে মেখে খাইয়ে
দিতেন,এখন আর হয় না।আপনার খোঁজী পত্রকারিতাকে হাজার সেলাম।
চেতনার ক্ষুধা মেটাবার সাথে সাথে রসনা লালসার রসে সিক্ত হলো লেখোনীর
সুন্দর উপস্থাপনে।আবার জানলাম না জানা ক্ষুধা নিবৃত্তীর ক্ষুরধার প্রবৃত্তি।
প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোলাগা ভালোবাসা।