অবাক পৃথিবী! অবাক মানবকুল! ভাগ্নের পদধূলিতে ধন্য মামার বাড়ি। মানব ও মানবদেবতার মিলনের স্থল আজ ভক্তদের মিলনক্ষেত্র। সেই মিলনক্ষেত্রে আজও কান পাতলেই শোনা যায় মামা — ভাগ্নে যেখানে, ভয় নেই সেখানে। সবুজ অরণ্য ও পাখ- পাখালির কূজনে টিনের ছাউনি এবং মাটির দেয়াল ঘেরা ঘরে মামা-ভাগ্নের স্পর্শ আজও অমলিন। কেবল গ্রামেরই মানুষ নয়, দূর-দূরান্তের মানুষেরা ছুটে আসেন এখানে। আসলে যে ভাগ্নের পদধূলিতে ধন্য হয়ে গেছে, সে কেবল আর মানুষ নন। সাক্ষাৎ দেবতা। পরমপুরুষ। পরমহংস। রামকৃষ্ণদেব। মামা হলেন পণ্ডিত নন্দকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়। মামী হরবিলাসিনী বন্দোপাধ্যায়। তিন সন্তানের প্রথম ছিলেন চন্দ্রমণি। ডাক নাম চন্দ্রা। আর ইনিই হলেন রামকৃষ্ণের গর্ভধারিনী মা। যিনি জন্মেছিলেন হুগলির আরামবাগের সারাটি গ্ৰামে। এক কথায় ঠাকুরের মামাবাড়ি। তাই নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারেনি বেলুড় মঠ ও মিশন কর্তৃপক্ষ। গত ১৯ নভেম্বর এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যথোচিত মর্যাদায় অধিগ্ৰহণ করল। ইতিমধ্যে এখানে গড়ে উঠেছে ঠাকুর রামকৃষ্ণ মন্দির। পাশেই চন্দ্রামণি ভবন ও অন্নপূর্ণা ভবন।
২.৭৭ একর জায়গায় সারাটি গ্ৰামে গড়ে উঠেছে মানুষের এক অভূতপূর্ব মিলনক্ষেত্র।
প্রসঙ্গত, ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাড়ি কামারপুকুরে। ঠাকুরের মামার বাড়ি কোথায় সেই বিষয়ে হয়ত অনেকের কাছেই অজানা। বেলুড় মঠের অধীনে আসার পরেই রামকৃষ্ণদেবের মা চন্দ্রামণি দেবীর বসত বাড়ি আরামবাগের সারাটি গ্রামে ছিল তা আরও স্পষ্ট হল।
মামাদের সেই পুরনো মাটির বসতবাড়ি আজ আর চোখে পড়বে না কিন্তু রয়ে গেছে ভিটেমাটি। যার স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়ায় এখানকার মানুষ। রামকৃষ্ণ মিশনের তত্ত্বাবধানে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মামার ভিটে সংরক্ষণ করা হয়েছে বছর কয়েক আগে। এখানেই গড়ে উঠেছে ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত মন্দির। প্রতি বছর ১৯ ও ২০ নভেম্বর দুই দিন ধরে চলে তার বাৎসরিক অনুষ্ঠান। সেখানেই ভিড় জমান গ্রামের বহু মানুষ। শুধু আরামবাগ নয়, আরামবাগ পেরিয়ে বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর থেকেও বহু মানুষ আসেন এই দিন রামকৃষ্ণদেবের মামার বাড়ি ভ্রমণ করতে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এই জায়গাতে তৈরি করেছে রামকৃষ্ণ চন্দ্রামণি আশ্রম। দূর দূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের এখানেই বসে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
উল্লেখ্য, ‘যত মত তত পথ’-র স্রষ্টাকে ঘিরে ভক্তদের শ্রদ্ধা আজও অটুট। ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় পরমপুরুষ, যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরুকে ঘিরে মানুষের অকৃপণ শ্রদ্ধা সামান্যতম বিলীন হয়নি। তাঁর প্রচারিত ধর্মীয় চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। বঙ্গীয় নবজাগরণের এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তার শিষ্যসমাজে, এমনকি তার আধুনিক ভক্তসমাজেও তিনি ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজিত হন।
প্রসঙ্গত, রামকৃষ্ণ পরমহংস পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাঁকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে। পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বল্পশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যাঁরা ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তাঁর কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই মধ্যে প্রধান শিষ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
উল্লেখ করতেই হয় ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেলুড় মঠ ও মিশনের অধীনে সারা বিশ্বে ২৮৩টি শাখা ছিল। গত ১৯ নভেম্বর রামকৃষ্ণের মামার বাড়ি অধিগ্রহণ করার ফলে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ২৮৪টিতে। এর মধ্যে ভারতে আছে ২১৬টি। এছাড়াও ২৪টি দেশে রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা আছে। কেবল মানবসেবায় নিয়োজিত। উল্লেখ্য, আমেরিকায় ১৪টি, ব্রাজিলে ৩টি, ২টি করে কানাডা, রাশিয়া, সাউথ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে বিদ্যমান। আশ্চর্যের বিষয় পাশ্ববর্তী বাংলাদেশে ২৭টি শাখা নিয়ত মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে চলেছে। সূত্রের খবর বিশ্বে ৬৮টি দেশে রামকৃষ্ণের ছায়া মানব বন্ধনে আবদ্ধ। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বেলুড় মঠে অবস্থিত। এর সঙ্গে যুক্ত হল রামকৃষ্ণের মামার বাড়িও। আপ্লুত ও গর্বিত ভক্তরা। এঁদের শেষ ইচ্ছেটুকুও পূর্ণ হল। এই আশ্রমে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভক্তিমূলক নানা অনুষ্ঠান হয়। এই সারাটির মন্দির গড়ে তোলার পিছনে এলাকার অসংখ্য মানুষের সহযোগিতা ও প্রয়াত পরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সম্ভবপর হয়েছে।
গত ১৯ নভেম্বর বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী লোকত্তরানন্দ। ছিলেন সারাটি রামকৃষ্ণ মিশনের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মহারাজ স্বামী প্রাণরূপানন্দ। আরামবাগের এসডিপিও সুপ্রভাত চক্রবর্তী প্রমুখ।
স্বামী প্রাণরূপানন্দ মহারাজ জানান, ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর এই মন্দিরের দ্বারোদঘাটন হয়। এই উপলক্ষে প্রতি বছর ১৯ ও ২০ নভেম্বর বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৪ নভেম্বর এখানকার যাবতীয় নথি বেলুড় মঠ কতৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৯ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে অধিগ্ৰহণ করে বেলুড় মঠ ও মিশন।
প্রসঙ্গত, শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ তাঁকে আপন জননীর আসনে বসাতেন। গুরুর প্রয়াণের পর উপদেশ ও উৎসাহলাভের আশায় ছুটে আসতেন তার কাছে। সামান্য গ্রাম্য নারীর জীবন অতিবাহিত করলেও তিনি তার জীবৎকালে এবং পরবর্তীকালে ভক্তদের নিকট মহাশক্তির অবতার রূপে পূজিত হন। চন্দ্রমণি দেবীর জন্ম হুগলির সারাটি-মায়াপুর গ্রামে, ইংরেজি ১৭৯১ সালে। পণ্ডিত নন্দকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হরবিলাসিনী দেবীর তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম ছিলেন চন্দ্রমণি। ডাকনাম চন্দ্রা। তিনি ছিলেন সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী এবং দীর্ঘাঙ্গী।প্রেরণাশক্তি হয়ে আছেন। স্বামীজির কাছে তিনি ‘স্পিরিচুয়াল জায়ান্ট’, রোমাঁ রোলাঁর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এক অমৃতভাণ্ড। সেই অমৃতভাণ্ডকে যিনি গর্ভে ধারণ করেছিলেন, তিনিও তাঁর বরেণ্য পুত্রের মতোই পূজনীয়া। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণজননী চন্দ্রমণি দেবী। চন্দ্রমণির পিতৃকুলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চা ছিল, যা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন চন্দ্রমণি এবং তাঁর একমাত্র ভাই আয়ুর্বেদ চিকিৎসক কৃষ্ণমোহন। চন্দ্রমণি অনেক রকম কবিরাজি ওষুধ এবং পথ্য জানতেন। তাঁর ভিক্ষাপুত্র কবিয়াল রামনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ম্যালেরিয়া থেকে এবং এক নামজাদা চিকিৎসককে বিস্মিত করে জনৈক জমিদারের নাতিকে টাইফয়েড থেকে বাঁচিয়ে তোলেন চন্দ্রমণি। কামারপুকুরের পাইন বংশ যখন ছোঁয়াচে মারণব্যাধিতে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ভয়ে গ্রামবাসীরা পাইনবাড়ির ছায়া মাড়াচ্ছে না, তখন চন্দ্রমণি কারও নিষেধ না মেনে পাইনবাড়িতে গিয়ে সেবাশুশ্রুষা করে পরিবারটিকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। সরল, মিষ্টভাষী, ভক্তিমতী চন্দ্রমণি ছিলেন সকলের প্রিয়, গৃহকর্মে নিপুণা এবং রান্নায় সিদ্ধহস্ত। সে যুগে কামারপুকুরের পাশ দিয়ে ছিল পুরী যাওয়ার রাস্তা। গ্রামের পান্থশালায় আশ্রয় নেওয়া শ্রীক্ষেত্রযাত্রী সাধু, ভক্তদের রেঁধে খাইয়ে চন্দ্রমণি বড় আনন্দ পেতেন।
পরিশেষে উল্লেখ করতেই হয় স্বামী ক্ষুদিরামের দেহাবসানে চন্দ্রামণির পরিবারবর্গের জীবনে বিশেষ পরিবর্তন উপস্থিত হল। দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর সুখে-দুঃখে যাঁকে জীবনের নিত্য সহচররূপে প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাঁকে হারিয়ে শ্রীমতী চন্দ্রা যে এখন জগৎ শূন্যময় দেখবেন এবং প্রাণে একটা চিরস্থায়ী অভাব প্রতিক্ষণ অনুভব করবেন এটাই স্বাভাবিক। সাত বছরের পুত্র গদাধর এবং চার বছরের কন্যা সর্বমঙ্গলাকে বুকে ধরে চন্দ্রাদেবী শ্রীশ্রীরঘুবীরকে অবলম্বন করে তাঁর দুঃখের দিনগুলি কোনরূপে কাটাতে লাগলেন।এর-ই মধ্যে বালক গদাধরকে নিয়ে বাপের বাড়ি সারাটি চলে আসেন। তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্র আজও রয়ে গেছে। তবে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো বর্তমানে বেলুড় মঠে সংগ্ৰহশলায় স্থান পেয়েছে।