সেখানে তপন মিশ্রর সখা ও প্রভুর মেসোমশাই চন্দ্রশেখর আচার্যের সঙ্গে প্রভুর সাক্ষাৎ হল। চন্দ্রশেখর দুঃখ করে প্রভুকে জানালেন, কাশিতে সর্বত্র কেবলই বেদান্ত চর্চা। ভক্তিহীন পন্ডিতদের কেবলই মায়া, ব্রহ্ম এবং ষড়দর্শনে ব্যাখ্যা করে দিন কাটে। কোথাও কৃষ্ণ কথা নেই।
মহাপ্রভু বললেন — দেখো আমি যে কৃষ্ণপ্রেমের ‘ভাবকালী’ নিয়ে এখানে এসেছি, তা যে কোন মূল্যেই বেচে যাব। শুনে উভয়ের আনন্দ আর ধরে না। প্রভুর সুন্দর প্রশান্ত মন্ডল, অঙ্গনিঃসৃত দিব্যপ্রভা, প্রেমাবেশ ও সাত্বিক বিচার যে শ্রবণ ও দর্শন করে, সেই বুঝতে পারে এ সন্ন্যাসী সামান্য লোক নয়-সাক্ষাৎ ভগবান।মহাপ্রভু সংসর্গে আসতে তাদের হৃদয়ে ভক্তির সঞ্চার হল।এইভাবেই প্রভু বারানসিতে জনসাধারণের মধ্যে অতুলনীয় প্রভাব বিস্তার করলেন।
বারাণসীতে মহাপ্রভুর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন ঘটনাগুলির মধ্যে সুবুদ্ধি রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি ছিল অন্যতম। একসময় এই সুবুদ্ধি রায় ছিলেন “গৌড় অধিকারী” অর্থাৎ গৌড় শহরের চৌধুরী বা কোতয়াল। হুসেন শাহ্ তার অধীনে কাজ করতেন।
একদিন সুবুদ্ধি রায় দীঘি কাটাচ্ছিলেন। সে কাজের তদারকের ভার ছিল হুসেন শাহ্-এর উপর। হুসেন শাহ্ গাফিলতিতে বিরক্ত হয়ে সুবুদ্ধি রায় তাকে একদিন চাবুক মেরেছিলেন। পরে এই হুসেন শাহ্ গৌড়-সিংহাসন অধিকার করে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ নামে খ্যাত হন। পূর্ব্বের মনিব বলে সুবুদ্ধি রায়কে তিনি খুব খাতির করতে থাকেন। তাঁর রাজ্যলাভে সুবুদ্ধি রায়ের সহায়তা ছিল। সুবুদ্ধি রায় তার রাজকার্যে নিযুক্ত হয়ে তাকে যথেষ্ট সহায়তাও করেন।
একদিন হুসেন শাহের প্রিয়তমা বেগম স্বামীর পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখে যখন জানলেন এর কারন সুবুদ্ধি রায়, তখন বেগম ভীষণভাবে রেগে গেলেন। স্বামীর প্রতি অত্যাচারের কথা অপমানিত বেগম সইতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন সুবুদ্ধি রায়কে হত্যা করার। হুসেন শাহ্ বিজ্ঞ, তিনি জানতেন যে সুবুদ্ধি রায় তাঁকে প্রাপ্য শাস্তিই দিয়েছিলেন, তাই তিনি কিছুতেই সুবুদ্ধি রায়কে হত্যা করতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু বেগম নাছোড়বান্দা।
বাদশা পড়লেন মহাবিপদে। অবশেষে মহামন্ত্রী দবির দাস (সনাতন গোস্বামী) পরামর্শ দিলেন সুবুদ্ধি রায়কে প্রাণে না মেরে জাতিচ্যুত করা হোক। কারণ সেকালে জাতিনাশ ছিল মৃত্যুতুল্য।
অবশেষে সুলতান “কারোয়ার পানী তার মুখে দেওয়াইলা”। ব্রাহ্মণ সমাজ তাকে ত্যাগ করল কারণ তিনি হলেন সমাজভ্রষ্ট। ধর্মরক্ষার জন্য সুবুদ্ধি রায় চললেন বারানসীতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান জানতে। সেখানে পন্ডিতদের কাছে ব্যবস্থা চাইলে কেউ বললেন, “তপ্ত ঘৃত খাঞা ছাড় প্রাণ”। অর্থাৎ তপ্ত ঘি মুখে ঠেলে প্রাণ বিসর্জন কর। শিহরিত হলেন সুবুদ্ধি রায়।
বাঁচার আর আশা নেই ভেবে মনের দুঃখে কি করবেন যখন স্থির করতে পারছিলেন না, তখন লোকমুখে শুনলেন শ্রী চৈতন্যদেবের বৃন্দাবন যাওয়ার পথে কাশীক্ষেত্রে এসেছেন।
আর বিলম্ব না করে সুবুদ্ধি রায় পতিতপাবন গোড়া চাঁদের কাছে গিয়ে তাঁর চরণাম্বুজে শরণাগত হয়ে নিঃসংকোচে জানালেন তার আসন্ন বিপদের কথা। তিনি সবশুনে অভয় দিলেন এই ঘোর কলিতে একমাত্র কৃষ্ণ নামই প্রায়শ্চিতদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ নিদান।
নিরন্তর কৃষ্ণনাম করলে পার্থিব ও বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। অনন্তর কৃপাসিন্ধু গোরাচাঁদের পরামর্শে সুবুদ্ধি রায় বৃন্দাবনে সে নিষ্কিঞ্চন বৈষ্ণব হয়ে সাধন ভজনে দিনযাপন করতে লাগলেন।
এইভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নামের মাধ্যমে শুদ্ধি করে নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থার নানা বিধিনিষেধ রোধ করে সমাজকে রক্ষা করেছিলেন। (ডঃ সুকুমার সেন তাঁর রচিত গ্রন্থ চৈতন্যাচরিতামৃতে এই কাহিনীটির উল্লেখ করেছেন।)
দশ দিন বারানসীতে অতিবাহিত করে বৃন্দাবন থেকে ফেরার পথে আবার এই তীর্থে আসবেন জানিয়ে ভক্তদের থেকে প্রভু বিদায় নিয়ে তিনি এলেন প্রয়োগে। ত্রিবেণীতে স্নান করে বিন্ধুমাধব দর্শনান্তে নিত্য কীর্তন করলেন। যমুনা দর্শন করে প্রেমাবেশে ঝাঁপ দিলেন প্রেমের ঠাকুর। তিনদিন প্রয়াগে থেকে জীবোদ্ধারের নিমিত্ত নামপ্রেম বিতরণ করতে করতে প্রভু মথুরায় পৌঁছলেন।
মথুরায় বিশ্রামঘাটে কৃষ্ণ নামে যমুনার জলে স্নান করলেন। মহাপ্রভুর কীর্তন মোহিত হয়ে গেলেন মথুরাবাসী। কৃষ্ণের পবিত্র জন্মস্থানে এসে কৃষ্ণ প্রেম তরঙ্গে মহাপ্রভুর হৃদয় উল্লাসিত হল। তার দুনয়ন দিয়ে অবিরত ধারা প্রবাহিত হল। বহুভক্ত ছুটে এল তাকে দেখার জন্য। তারই মধ্যে জনৈক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তার নৃত্য দর্শনে প্রেমাবিষ্ট হয়ে মহাপ্রভুর চরণে লুটিয়ে পরলেন। সেই ভক্তকে আলিঙ্গন করে পরিচয় জানলেন যে তিনি মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য। তাই শুনে প্রভু তাকে প্রণাম নিবেদন করলেন, তার ঘরে একদিন ভিক্ষা গ্রহণও করলেন।
এরপর সেই ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদাসকে সঙ্গে নিয়ে গৌরাঙ্গ চললেন তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত ব্রজধাম দর্শনে। প্রভুর আগমনের বৃন্দাবনও নবজীবন ধারণ করল। কার্তিক পূর্ণিমায় ভগবান চৈতন্য বৃন্দাবনে পৌঁছেছিলেন এবং এরপর তিনি মধুবন, তালবন, কোকিলবন, খদিরবনপ্রভৃতি বারোটি পবিত্র বন পরিদর্শন শুরু করলেন।
বনের পরিবেশ এবং বনবাসীদের চেতনা তাঁকে অনুভব করাল যে “বৃন্দাবন হল ভগবানের দিব্য আবাস। সেখানে ক্ষুধা, ক্রোধ বা তৃষ্ণা নেই। মানুষ এবং হিংস্র প্রাণী সেখানে দিব্য বন্ধুত্বের সাথে একসাথে বাস করে।” ( শ্রীমদ্ভাগবত ১০.১৩.৬০)
মহাপ্রভু যখন বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন গাভীগুলি তাঁর প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে চাটতে শুরু করেছিল। সমস্ত পাখি রাধা ও কৃষ্ণের মহিমা গাইতে শুরু করল, এবং ময়ূররা নাচতে লাগল। গাছগুলি কেঁপে উঠল, ভগবানকে ফুল দিয়ে স্নান করাল এবং তাঁর কাছে তাদের ফল অর্পণ করল।
বনে হাঁটার সময়, ভগবান দুটি তোতাপাখিকে সংলাপে লিপ্ত হতে দেখলেন এবং তাদের কথোপকথন শুনতে আগ্রহী হলেন। ইঙ্গিতে, তোতাপাখিগুলি তাঁর কাছে উড়ে গেল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাদের কথোপকথনের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। প্রথমে পুরুষ তোতাপাখি কৃষ্ণের সৌন্দর্য এবং গোপীদের উপর তাঁর প্রভাবের প্রশংসা করলেন। তারপর তোতাপাখি বলল যে কৃষ্ণের সঙ্গ এতটাই মোহনীয় ছিল যে লক্ষ্মীদেবীও গোপীদের সাথে কৃষ্ণের লীলায় অংশ নেওয়ার জন্য তপস্যা করেছিলেন — কারণ কৃষ্ণ হলেন জগৎমোহন, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের সকলকে আকর্ষণ করেন। স্ত্রী তোতাপাখি শ্রী রাধিকার মহিমান্বিত সৌন্দর্য, তাঁর মনোমুগ্ধকর গান এবং তাঁর প্রশংসনীয় বুদ্ধিমত্তার কথা বলেছিল। এইভাবে চৈতন্য মহাপ্রভু বনে রাধা ও কৃষ্ণের মধুর মহিমা উপভোগ করেছিলেন।
দ্বাদশবন পরিভ্রমণ করার পর তিনি ‘চব্বিশ ঘাটে’ এসে স্নান করলেন।এরপর চৈতন্য মহাপ্রভু অরিষ্ট গ্রামে পৌঁছান, যেখানে পাঁচ হাজার বছর আগে কৃষ্ণ অরিষ্টসুর রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। এই পর্বের ফলে শ্যামাকুণ্ড এবং রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব ঘটে। তবে, সময়ের সাথে সাথে, এই পবিত্র হ্রদগুলি প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউই চৈতন্যকে এগুলি খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারেনি।
জ্ঞানের আবাসস্থল হওয়ায় গৌরাঙ্গ কালীবদি (কালো ক্ষেত) এবং গৌরীবদি (সাদা ক্ষেত) নামে দুটি ধানক্ষেত খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই নীচু ধানি জমিতে নেমে তিনি স্নান করলেন এবং মাটি দিয়ে তাঁর শরীরে তিলক আঁকলেন। বিস্ময়বিষ্ট ভক্তদের প্রভু জানালেন এটাই রাধাকুণ্ড এবং পাশেরটি শ্যামকুণ্ড। এবার প্রভু কুসুম সরোবরে আসেন, অতঃপর গোবর্ধন দর্শন করেন।
গোবর্ধন পাহাড় দেখে তিনি আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়লেন এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। একটি গোবর্ধন শিলাকে কৃষ্ণ জ্ঞানে জড়িয়ে ধরলেন। গোবর্ধন গ্রামে পৌঁছে তিনি হরিদেবকে নামক কৃষ্ণ দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। পরম প্রেমে উন্মত্ত হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু হরিদেবের সামনে নৃত্য করলেন। তিনি ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করলেন এবং সেই রাত হরিদেব মন্দিরে কাটালেন।
গোবর্ধন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আরেকটি মন্দিরে, শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরী কর্তৃক আবিষ্কৃত গোপাল-বালক কৃষ্ণের সুন্দর দেবতা গোপাল রায় বাস করতেন। রাতের বেলায়, ভগবান চৈতন্য ভাবতেন যে গোবর্ধন পাহাড়ে আরোহণ না করে তিনি কীভাবে গোপাল রায়কে দেখতে পাবেন। স্বয়ং গোপাল তাঁর ইচ্ছা বুঝতে পেরেছিলেন এবং ছল করে গ্রামবাসীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেন যে তুর্কি সৈন্যরা তাদের মন্দির ধ্বংস করতে আসছে। তাই গ্রামবাসীরা দেবতাদের রক্ষা করতে ছুটে যান এবং গোপাল রায়কে গান্থুলি গ্রাম নামে একটি গ্রামে নিয়ে যান। পরের দিন, ভগবান চৈতন্য গোবিন্দ কুণ্ডে স্নান করেন এবং তারপর গান্থুলি গ্রামে গোপালকে দেখেন। তিনি পরমানন্দে গোপালের প্রেমে এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েন যে তিনি তিন দিন তিন রাত ধরে একটানা জপ করেন এবং নৃত্য করেন। চতুর্থ দিনে, গোপাল রায় তাঁর নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন।
এরপর ভগবান একের পর এক কাম্যবন এবং অন্যান্য বন পরিদর্শন করেন। তিনি পবন সরোবরে স্নান করেন এবং নন্দিশ্বর নামক পাহাড়ে আরোহণ করেন, যেখানে কৃষ্ণের পিতা মহারাজা নন্দের বাসস্থান ছিল।
বনের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় গোপ গণের বংশিধ্বনিতে চৈতন্যদেবের মন উল্লসিত হল। তিনি ভাবাবেগে অচৈতন্য হলেন। এমন সময় সেখানে পাঠান রাজকুমার বিজলি খান যাচ্ছিল। চৈতন্য প্রভুকে এই অবস্থা দেখে তিনি ভাবলেন তার সঙ্গীরা সন্ন্যাসীকে মেরে ফেলে সব সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। সেনাপতি নির্দেশে ভক্তদের দড়ি দিয়ে বাধা হলো। অল্প সময় পরে চেতনা ফিরে পেলেন। মহাপ্রভুর কাঞ্চনবর্নাদেহ, কর্নায়ত কমল নয়ন, আজানুলম্বিত ভুজ দর্শনে পাঠানরা মুগ্ধ হয়ে ভক্তদের বন্ধন মোচন করে দিলেন।
পাঠানদের মধ্যে একজন ছিলেন কোরানের পণ্ডিত। তার সঙ্গে নিমাই পন্ডিত শাস্ত্রবিচার শুরু করলেন। সর্বশাস্ত্রবিদ্ শ্রীচৈতন্য হিন্দুশাস্ত্র ও কোরানের তুলনামূলক আলোচনা করে যুক্তি দ্বারা বোঝালেন সকলের অন্তরে বাহিরে অবস্থিত সর্বকারণের কারণ এক পরমাত্মা অনন্ত আধারে, অনন্তভাবে ও অনন্তরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। হিন্দুর কাছে যিনি ‘সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্ম’ আবার মুসলমানদের কাছে থেকে ‘আল্লাহ আকবর’।
কৃপাসিন্ধু গোরাচাঁদের যুক্তিযুক্ত চমকপ্রদ বিচার বিশ্লেষণে পাঠানদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন এলো। সকলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণে প্রণত হয়ে তাঁর বৈষ্ণব আদর্শ অনুপ্রাণিত হলেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে সেদিন এভাবেই কোরান ও পুরাণের মেলবন্ধন ঘটেছিল। সম্প্রীতির চিরনিদর্শন হিসাবে ইতিহাসে এঁদের খ্যাতি হল ‘পাঠান বৈষ্ণব’ নামে।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরোচিত শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব — স্বামী সারদেসানন্দ, শ্রী গৌরাঙ্গচরিতসুধা — ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়; চৈতন্যময় নন্দ ও লোকনাথ স্বামীর লেখা এবং অন্যান্য।।