প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে চলা ফিনিক্স পাখি। ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মদিনে বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে তাঁর নেতৃত্বের গৌরবকে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু তাঁর এগিয়ে চলার পথটি ছিল না কুসুমিত। এজন্য কবি লিখেছেন-‘শেখ হাসিনা, আপনার বেদনা আমি জানি।/আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি।/বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে/আপনি পা রেখেছেন মাত্র।/আপনার পথে পথে পাথর ছড়ানো।/পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরুপথ।’ কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘পথে পথে পাথর’ কবিতায় অভিব্যক্ত এই কথাগুলোর সত্যতা রয়েছে শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যাচেষ্টার ঘটনায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। যা বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নৃশংস হামলা, কারণ রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যই এটি চালানো হয়। গ্রেনেড হামলায় আহতদের মধ্যে অনেকেরই জীবন এখনো দুর্বিষহ। তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাদের মানব ঢালের ফলে আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও, কানে আঘাত পান, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত তিনি ভুগছেন। আসলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করাই ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্য। তবে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলায় ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ এসেছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনায় চ্যালেঞ্জসমূহকে সামনে এনেছিল; স্পষ্টভাবে চেনা গেছে তাঁর শত্রুদের। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিএনপি’র আমলে ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনা হত্যা চেষ্টা মামলার রায়ে ৯ জনের ফাঁসির দণ্ড ঘোষিত হয়েছে। উপরন্তু ২৫ জনের যাবজ্জীবন, ১৩ জনের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার মতোই ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সন্ত্রাসীরা। ওই হামলায়ও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রেন বহরে হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। কিন্তু অপরাধীরা পার পায়নি। ২৫ বছর পর হলেও ১৯৯৪ সালের সবচেয়ে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর এই হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে।
লেখাবাহুল্য, শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আর যারা সেই চেষ্টা করেছিল তাদের কাউকে হত্যার চেষ্টা করা হয়নি। এখানেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পার্থক্য। ২১ বার হত্যা চেষ্টার মধ্যে ১৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কেবল চারটি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এসব হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬০ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে; আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এসব ঘটনার মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো বিচার পায়নি এখনো। শেখ হাসিনাকে যতবার হত্যাচেষ্টা করা হয় তার অনেক ঘটনায় মামলাও হয়নি। এমনকি হামলার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার নজিরও আছে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছিল, তার প্রতিটিরই বিচারে সময় লেগেছে এক যুগের বেশি। কোনো কোনোটির ২০ থেকে ২৫ বছর। আবার বিচারিক আদালতে রায় এলেও উচ্চ আদালতে একটিরও মীমাংসা হয়নি এখনো। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডিতে হত্যা চেষ্টার রায় আসে ২০১৭ সালে। সময় লাগে ২৮ বছর। ১৯৯৪ সালে পাবনা ঈশ্বরদীতে হত্যা চেষ্টার মামলায় রায় এলো চলতি বছর; সময় লেগেছে ২৫ বছর।
২০০০ সালে গোপালগঞ্জে হত্যা চেষ্টার মামলায় রায় আসে ২০১৭ সালে। সময় গেছে ১৬ বছর। তবে চূড়ান্ত রায় আসে ২০২১ সালের ২৩ মার্চ। এদিন ওই মামলায় ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে ২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই মাঠেই পরদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলাটি দায়ের করেন। এরপর ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এ ঘটনায় হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-২ এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় হত্যা চেষ্টার রায় আসে ২০১৮ সালে। সময় লেগেছে ১৪ বছর। জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা থেকে বেঁচে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করতে না পারলেও বুলেট তাঁর পিছু ছাড়েনি। দেশে ফেরার পর পিতার মতো তাঁকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দুটি (১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট), ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারটি (১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, ৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ’৯৫ সালের ৭ মার্চ, ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ), ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারটি (২০০০ সালের ২২ জুলাই, ২০০১ সালের ৩০ মে, ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর), ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে চারটি (২০০২ সালের ৪ মার্চ, ২০০২ সালের ২৬ আগস্ট, ২০০৪ সালে ২ এপ্রিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট), সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি (২০০৭ সালে ১/১১ পরবর্তী সময় কারাবন্দি থাকা অবস্থায় খাবারে বিষ প্রয়োগ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়) এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে চারটি হত্যা চেষ্টার কথা জানা যায় (২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী দলের প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়)। বঙ্গবন্ধুর খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শরিফুল হক ডালিম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করে। ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গিদের মাধ্যমে মানববোমায় তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে কারওয়ানবাজার এলাকায় তাঁর গাড়িবহরে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা। তবে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে। গোপালগঞ্জে ২০ জুলাই ২০০০, খুলনায় ৩০ মে ২০০১, সিলেটে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০১ এবং ঢাকায় ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের চেষ্টা ছিল অন্যতম। আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয় মুফতি হান্নান। একপর্যায়ে সে এদেশে ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থার সূচনাকারী হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতায় পরিণত হয়। তার নেতৃত্বে এ দেশে হুজি-বি প্রথম বোমা হামলা চালায় ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। এরপর সাত বছরে অন্তত ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায় তারা। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০১, আহত হয়েছেন ৬০৯ জন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার পর সেসময় খালেদা-নিজামী জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কমিটি করে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হয়েছিল; নষ্ট করা হয়েছিল গ্রেনেড হামলার সকল আলামত। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে জজ মিয়াদের কোন দোষ খুঁজে পায়নি। বরং ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৫২ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হলে প্রকৃত অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মনে রাখতে হবে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়েছিল আইএসআইয়ের সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। দল, প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা পালন করে।
উগ্রপন্থীরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনা তথা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতৃত্বকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ শেখ হাসিনা ফিনিক্স পাখির মতোই ভস্ম থেকে পুনরায় নির্মাণ করেছেন নিজেকে। যে নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য আশির্বাদ হয়ে উঠেছে। তাঁর শতায়ু কামনা করছি।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com