বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্ৰামী, গান্ধীবাদী নেতা ও সমাজসেবকের সশ্রদ্ধ চিত্তে জন্মদিন পালন করল শান্তিমোহন রায় স্মৃতিরক্ষা কমিটি। খানাকুলের কায়বা গ্ৰামে গত ২৭ ডিসেম্বর সারাদিন দিন ধরে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিশিষ্ট জনেরা। এদিন রাজা রামমোহন রায়ের উত্তরসূরি ও খানাকুলের রূপকার শান্তিমোহন রায়ের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান হয়। কেবল জন্মস্থান কায়বা গ্ৰাম নয়, হুগলির আরামবাগ কংগ্রেস ভবন, শেওড়াফুলি কংগ্রেস অফিস, রাজা রামমোহন রায় মহাবিদ্যালয় ও পাতুল গ্ৰামে এই মহান সংগ্ৰামীর প্রতি স্মৃতিচারণ করা হয়।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান আজও মানুষ ভোলেনি। মানুষ মনে রেখেছে খানাকুলে তাঁর হাত ধরেই রামমোহন কলেজ, বেসিক ট্রেনিং কলেজ, বালিকা বিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, এদিন শান্তিমোহন রায় স্মৃতি-রক্ষা কমিটির পরিচালনায় জননেতা শান্তিমোহন রায়ের আবক্ষ মূর্তির সমুখস্থ প্রাঙ্গণে তাঁর ১০৯তম পুণ্য জন্মদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়।
প্রভাতফেরী, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, রাষ্ট্রীয় শোক পালনের মধ্য দিনটি উদযাপন করা হয়। স্মৃতি রোমন্থন করেন মৃণালকান্তি দাস, দিলীপ কুন্ডু প্রমুখ।
এরপর প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও মাল্যদান ও পুষ্পার্ঘ্য প্রদান করে উদ্বোধনী সঙ্গীত অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন আরামবাগের সংসদ সদস্যা মিতালী বাগ, আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক দেবাশিস শেঠ, স্মৃতিরক্ষা কমিটির সভাপতি ড. রণজিৎ গোস্বামী, সেখ হাসান ইমাম, কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা, দিলীপ চ্যাটার্জি, সমীর ভান্ডারী, পলাশ রায়, সেখ মেহেবুব রহমান, স্বপন নন্দী প্রমুখ।
সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনায় স্মৃতিরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শান্তিমোহন রায়ের একমাত্র পুত্র চন্দন কুমার রায়।
উল্লেখ্য, এদিন বিশিষ্টজনরা শান্তিমোহন রায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, অগ্নিযুগের স্বাধীনতা আন্দোলনে খানাকুল থানায় যাঁদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁদের মধ্যে এক বিরল ব্যক্তিত্ব হলেন এই শান্তিমোহন রায়। খানাকুলের মাটিতে জন্মানো এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। রাজা রামমোহন রায়ের বংশেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রামমোহন রায়ের পিতা রামকান্ত রায় ব্রজবিনোদ রায়ের পঞ্চম পুত্র। এই ব্রজবিনোদ রায়ের তৃতীয় পুত্র হলেন রাধামোহন। রাধামোহনের পুত্র কুমুদনাথ তাঁর পুত্র ঈশান চন্দ্র। তাঁর পুত্র হরিপদ এবং তাঁর পুত্র মুনীন্দ্র মোহন। এই মুনীন্দ্রমোহন রায়ের প্রথম পুত্র হলেন শান্তিমোহন রায়। এঁদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষারও যথেষ্ট প্রসার ছিল। এই দিক থেকে বলা যায় শান্তিমোহন রায় বেশ স্বচ্ছল এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারেই জন্মেছিলেন। এঁরা বসবাস করতেন কায়বা গ্রামে। শান্তিমোহন রায়ের মাতা শ্রীমতি জহরবালা রায় ছিলেন পাতুল গ্রামের অধিবাসী শ্রী যতীন চৌধুরীর প্রথমা কন্যা। শিক্ষায়-দীক্ষায় তিনিও যথেষ্ট পারদর্শিনী ছিলেন। তিনি মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করা মহিলা। ভাল নাচতে জানতেন, গান গাইতে জানতেন এই রকম আরো অনেক গুণ ছিল তাঁর। যতীন চৌধুরী পেশায় ছিলেন হাইকোর্টের পেশকার। এই রকমই বিরল প্রতিভাধর পিতা-মাতা মুনীন্দ্রমোহন রায় ও শ্রীমতি জহরবালা রায়-এর পরিবারে জন্ম নিলেন শ্রী শান্তিমোহন রায়। সুতরাং তাঁর মধ্যে যে বিরলতম প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যাবে এতে আর আশ্চর্য কী।
বক্তারা বলেন, ১৩২২ সালের ১১ই পৌষ সোমবার মাতুলালয় পাতুল গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। শান্তিমোহন-রা ছিলেন মোট চার ভাই এঁদের মধ্যে তৃতীয় ভাই শ্রী বিলাসমোহন রায় অল্প বয়সেই পরলোক গমন করেন। তাঁদের অপর দুই ভাই হলেন শ্রী জয়ন্তমোহন রায় এবং কনিষ্ঠ মনোজমোহন রায়। শান্তিমোহনের জীবনের প্রথম দিকটা কাটে তাঁর মাতুলালয়ে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু পাতুল গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তী সময়ে কয়েক মাসের জন্য উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি সেকেন্দারপুর রায় কে. পি. পাল বাহাদুর উচ্চ বিদালয়ে ভত্তি হন। কিন্তু কিছুদিন পর আবার পাতুলেই ফিরে যান। শান্তিমোহনের বয়স যখন মাত্র ৯ বছর। সেই ১৩৩১ সালেই তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়।
এরপর যখন গান্ধীজি ঘোষণা করেন — ‘পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতে আমরা রাজী নই। হয় করব না হয় মরব।’ ৯ আগষ্ট গান্ধীজি, বল্লভভাই প্যাটেল, নেহেরু সহ বহু প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়, কংগ্রেস সংগঠনকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়। ইংরাজদের এই দমন ও শোষণ নীতির বিরুদ্ধে এবারে গর্জে উঠল সারা দেশ। কৃষক, মজুর, আপামর জনসাধারণ এমনকী গৃহবধূরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল আন্দোলনে। সরকারী স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র-ছাত্রী প্রত্যাহার করে নেওয়া হল, সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দিলেন অনেকে। খানাকুল অঞ্চলে এই সময় ব্যাপকভাবে আন্দোলন সংগঠিত হয় শান্তিমোহন রায়ের নেতৃত্বে। সরকারী পোষ্টাফিস, ইউনিয়ন বোর্ড প্রভৃতি পুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চলতে থাকে ডাকলুট, সেটেলমেন্ট বর্জন, ট্যাক্স আদায় না দেওয়া প্রভৃতি কাজও। দিকে দিকে গড়ে ওঠে এক একটি কেন্দ্র সেখান থেকে এইসব কাজ পরিচালিত হতে থাকে। এছাড়াও প্রয়োজন হয়ে পড়ে ত্রাণ কাজের। ইংরেজদের শোষণ এবং দমন নীতির সঙ্গে যুক্ত হল প্রকৃতির রুদ্ররোষ। মানুষ সহায় সম্বলহীন দিশাহারা হয়ে পড়ল । দিকে দিকে দুর্ভিক্ষ শুরু হল। মানুষের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়, ঘরে ঘরে অন্নের অভাব বস্ত্রের অভাব, জীবনদায়ী ওষুধের অভাব কিন্তু দেশপ্রেমের অভাব নেই, আন্দোলনে উৎসাহের অভাব বিন্দুমাত্র নেই।
সেই সময় শান্তিমোহন রায় পাতুল এবং আশ-পাশের উৎসাহী একদল যুবককে নিয়ে ‘নয়াদল’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই দল বিভিন্ন রকম স্বদেশী প্রচার, ডাকলুট, অবরোধ, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচীর সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভিক্ষ ত্রাণের কাজেও হাত লাগায়। তারা লঙ্গরখানা, দাতব্য চিকিৎসালয়, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ক্যাম্প, চরখা কাটা প্রভৃতি কাজকর্ম শুরু করে দেয় প্রবল উৎসাহে। তখন খানাকুল অঞ্চলের রাস্তাঘাট খুব দুর্গম ছিল। বিশেষত, বর্ষায় বন্যার সময় তো যাতায়াত করাই মুস্কিল হয়ে দাঁড়াত। এই রকমই একদিন শান্তিমোহন তাঁর কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে খানাকুল ও কৃষ্ণনগর বাজারের দিকে বেরিয়েছেন হরতালের প্রচার করতে। রাস্তায় ফাঁকা জায়গা দেখে পোষ্টার লাগানো হচ্ছে বা দেওয়াল লেখা হচ্ছে এবং তাতে লেখা থাকছে-‘এ যুদ্ধ ইংরেজদের, এ যুদ্ধে কেহ সাহায্য করবেন না,’ ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন বক্তারা।
বক্তাদের মুখে এও শোনা যায় ১৯৪২ সালের ৩০ আগষ্ট রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল এবং বেশ কিছু সঙ্গী সাথীর সঙ্গে তাঁর দু’ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে খুব কষ্টের সঙ্গে কাটাতে হত তাঁদের। শোবার জন্য সিমেন্টের জায়গা একটি বালিশ একটি কম্বল আর জেলখানার তাঁতে বোনা একটি চাদর, পরার জন্য একটি ডোরাকাটা হাফপ্যান্ট একটি আঁটসাঁট পায়জামা, গা মোছার জন্য হাতে বোনা এক টুকরো গামছা, খাবার বাসন বলতে একটি অ্যালুমিনিয়ামের থালা ও একটি বাটি এর মধ্যেই সবকিছু করতে হত। এই পরিবেশেই শান্তিমোহনের সঙ্গে রতনমণি চট্টোপাধ্যায়, ভবভূতি সোম, শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নেতৃস্থানীয় মানুষ থাকতেন। শান্তিমোহনকে বেশিরভাগ সময় তাঁতখানায় কাজ করতে হত। এইভাবে দু’বছর কাটল।
১৯৪৪ সালের ১১ জুন সঙ্গীদের অনেকেই ছাড়া পেলেন কিন্তু তাঁকে আরো ছ’দিন রেখে দেওয়া হল। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ থাকায় এই ছ’দিনের রেমিশন কেটে নেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী পনের-ষোল বছরের একটি কিশোরের জন্য তিনি ১০নং ওয়ার্ডের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের বরাদ্দ তেল ও সাবান কিছু কিছু ভিক্ষা করছিলেন। হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। আসলে ঐ তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের গায়ে মাখবার জন্য সাবান বা তেল বরাদ্দ ছিল না। শীতকালে তারা খুব চর্মরোগে কষ্ট পেত। এই বিষয়টি শান্তিমোহনকে ব্যথিত করে। যাইহোক একে একে প্রথম সারির নেতারা জেল থেকে ছাড়া পেলেন। আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হল। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট এল সেই কাক্ষিত দিন। ইংরাজদের পরাধীনতার শিকল ছিন্ন করে স্বাধীন সূর্যের মুখ দেখল ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে আরামবাগ মহকুমায় কংগ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলেন শান্তিমোহন রায় ।পরে অবশ্য দুর্গাচরণ চক্রবর্তী ও কালীপদ সিংহরায় এই পদে যোগ দেন এবং এই ত্রয়ী সম্পাদকের দায়িত্বে মহকুমা কংগ্রেস চলতে থাকে। স্বাধীনতার পূর্বে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী দেশ গড়ার দীর্ঘ সময় ধরে দেশের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা এবং অক্লান্ত সেবার জন্য চিরকাল দেশবাসী শান্তিমোহন রায়কে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই নাম।