‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি পাখির ডাকে জেগে। এমন দেশটি…’ আমার বাংলা। যে সব পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে তাদের অন্যতম হলো শালিক।
শুধু সামাজিক পাখি হিসেবে নয়, দলবেঁধে ডাকা আর ঝগড়াঝাঁটি করার ক্ষেত্রেও এদের বেশ নামডাক আছে। ঝগড়া করে অনেক পাখি কিন্তু যুগ যুগ ধরে এদেরই বদনাম বেশি। এই ভ্রান্ত ধারণার পিছনে রয়েছে এক মনস্তাত্ত্বিক কারণ।
‘তিনটে শালিখ ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে’
শৈশবে ‘সহজপাঠ ‘এ পড়ে আসা খেলা-ভোলা কবিতার কথা মনে গেঁথে গেছে প্রায় সকলের। উচ্চকণ্ঠে ‘চিড়িক… চিড়িক সুরে শিস দেওয়া শুনলে মনে হয় এ যেন বচসার সুর। প্রায় সব প্রজাতির শালিক বিভিন্ন স্বরে ডাকতে পারে। তবে ভয় পেলে একে অপরকে সতর্ক করে দেয় তৎক্ষণাৎ। পোষ মানেও সহজে। এরা নাকি মানুষের গলার স্বর শুনে চিনতে সক্ষম মানুষটিকে।
‘দু-শালিক নমস্কার,/পা দুটো পরিস্কার,/মাথা দুটো কালো/আজকের দিনটা ভালো।’
ছোটবেলায় এই কবিতা হামেশাই বলতাম। জোড়া শালিক দেখার ব্যাপারে কত কী ভালো-মন্দ হয় সঠিক জানা নেই কারোর কিন্তু বলে অনেকেই। এ বিষয় নিয়ে বিখ্যাত এক সাহিত্যিকের এক গল্প বলি….
মেঘলাল চক্রবর্তীর স্ত্রীর নাম হেমছায়া। তার একমাত্র শ্যালিকা মহামায়া। আজকাল সংসারে শ্যালক-শ্যালিকার বড়ই অভাব। অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য প্রভাতে মহামায়ার দৃষ্টিতে পড়লো একটি শালিক পাখি।
বাঙালি মাত্রই জানে এক শালিক হঠাৎ দেখে ফেলা চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। খুঁজে পেতে দ্বিতীয় শালিক না দেখলে পরিত্রাণের উপায় নেই। বহু খুঁজে দ্বিতীয়টির দেখা না পেয়ে যখন ব্যাকুল চোখে বললে,—
‘কী হবে জামাইবাবু?’
এহেন ডাকে জামাইবাবুটি কী কিছু না করে থাকতে পারে! যতই হোক ‘সহস্র বর্ষের সখী সাধনার ধন’-এর সমস্যায়। ধমনীতে বাহিত জমিদারের রক্ত বাধ্য করিল শোয়ার ঘরের কাঠের আলমারি খুলে বহুকালের পুরোন একটি গাদা বন্দুক বার করে আনতে জামাইবাবুকে। বন্দুকের নলটা শূন্যে মুখ করে একটি ফাঁকা আওয়াজ করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পাখির দল নানারকম চেঁচামেচি করতে করতে বিভিন্ন দিকে উড়ে গেলো। এই দলে ছিল অন্তত দশটা শালিক।
মহামায়ার অমঙ্গল ভঙ্গ হলো।
শুধু তাই নয়, শ্যালিকার যাতে নিয়ত সৌভাগ্য সূচিত হয় সেই জন্য শিয়ালদহ রথের মেলা থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দপ্তরের দৃষ্টি বাঁচিয়ে একটি খাঁচা সুদ্ধ একজোড়া শালিক পাখি কিনে মহামায়াকে উপহারও দিয়েছিলেন।
জোড়া শালিক পেয়ে শ্যালিকা বেশ সুখেই ছিলো কিন্তু পাখি স্নান করাতে গিয়ে বাধ সাধলো। স্নানের পর রঙ উঠে গায়ের রঙ দাঁড়ালো ধূসর। মহামায়ার শাশুড়ি বলেছেন, ‘এ দুটি ছাতারে পাখি’।
খবর পেতেই মেঘলাল বাবু অভিধান খুলে দেখলে ছাতারেও শালিকজাতীয় পাখি। কোথাও এ পাখিকে বলে ভাঁটশালিক। তবে, শালিকের জায়গায় জোড়া ভাঁটশালিক কতখানি মঙ্গলজনক হবে সে বিষয়ে জামাইবাবু কোনও ভরসা দিতে পারলেন না।
আমাদের দেশ প্রায় ছয় প্রজাতির শালিক দেখা যায়। গো বা গোবরে শালিক, কাঠশালিক, ভাতশালিক, ঝুঁটিশালিক, গাঙশালিক, বামনশালিক। এদের মধ্যে বামন ও কাঠশালিক দুর্লভ। এদের গানের গলাও মিষ্টি। তবে কাঠ শালিক সবচেয়ে ভালো গাইতে পারে। কাঠ শালিকের পিঠ উজ্জ্বল বাদামী ধূসর। বুক গাঢ় লালচে বাদামি।
‘সন্ধ্যা হয়—চারদিকে মৃদু নীরবতা;/কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে’—জীবনানন্দ দাশ
উল্লেখযোগ্য ভাবে এদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। এদের কলতান যাতে ‘চুপ’ করে না যায় তার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে সকলকেই। কোলাহল পছন্দ বলেই প্ল্যাটফর্মে এদের দেখা মেলে। এরাই হয়তো পক্ষীসমাজের রাজনীতিবিদ যারা ক্যামেরায় বন্দী হতে বা লোকসম্মুখে ঝগড়া করতে পিছপা হয়না।