বিজ্ঞান বলে মহাকাশে অনেক জ্যোতিষ্কই সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। সত্যি কি তাই? ‘বিলীন’ শব্দটি বেশ আপেক্ষিক। কারণ আজ যার আলো গভীর রাতের আকাশকে মায়াবি করে তুলছে, অন্তত কলকাতার বাড়ির ছাদ থেকে যেই নক্ষত্র আমি দেখতে পাচ্ছি, কাল তা নাও দেখতে পারি— কিন্তু তার মানে কি ‘নক্ষত্রের’ অস্তিত্ব বিলূপ হওয়া? ওই যে কবি বলেছেন—
‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছো নয়নে নয়নে …
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছো গোপনে।’
মনের মাঝে গোপন অবস্থানে আছেন যাঁরা— এই দুঃসময়ে সেই বরেন্যদের পূণ্যালোকে আগামীর পথে টর্চের আলো ফেলে দিকনির্দেশের চেষ্টা করছে ‘নতুনপথ এই সময়’ পত্রিকা। শুধু গ্রন্থ প্রকাশই নয়— এই পত্রিকার সম্পাদিকা অনুরাধা দেব-এর নিরলস প্রচেষ্ঠায় তাঁর টিম বিভিন্ন আলোচনা সভা আয়োজন করে ভুলতে বসা কবি-সাহিত্যিকদের নতুন প্রজন্মের কাছে আবার পুনরুর্জ্জিবিত করছেন। আজকের সমাজের কাছে, এ এক মহৎ কাজ।
২৮ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার ছিল সাবিত্রী রায়-এর ১০৮ তম জন্মদিন। কে সাবিত্রী রায়? ‘তিনি এক অসাধারণ লেখিকা। তাঁর বলিষ্ট এবং অসম সাহসী কলম অনেকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তাঁর লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস ‘স্বরলিপি’-র ৭০০ কপি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য উপন্যাস প্রকাশেও নানা বাঁধা— এই অমূল্য সাহিত্য সম্ভার মানুষের কাছে সাবলীলভাবে পৌঁছতে পারেনি। ফলে উচ্চ শিক্ষিত, শিক্ষিত, সাহিত্যিক বুদ্ধিবৃত্তি জগতের বহু মানুষ তাঁর নাম পর্যন্ত শোনেননি। তাঁর লেখার সাথে পরিচয় তো দূরের কথা।’ — জানালেন রাজনীতিবিদ তথা ‘নতুনপথ এই সময়’ পত্রিকার সম্পাদিকা অনুরাধা দেব। সাবিত্রী রায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর সাহিত্য সম্ভার ও সংগ্রামী জীবন নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপিকা গার্গী চক্রবর্তী, অধ্যাপিকা সুদক্ষিণা ঘোষ, অধ্যাপিকা তপস্যা ঘোষ, দিলীপ চক্রবর্তী, শুভময় মণ্ডল, শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রকাশক শুভঙ্কর দে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাহিত্যিক অমর মিত্র।
সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি আজীবন শ্রদ্ধা রেখেই একের পর এক উপন্যাসে মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন সাবিত্রী রায়। কিন্তু কে চেনে আজ তাঁকে? যে দলের মতাদর্শের প্রতি তাঁর আজীবন প্রতীতি, সেই কমিউনিস্ট পার্টিই তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাঁর লেখা থেকে! ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরকার দ্বন্দ্ব থেকে একটু উপরের তলার নেতাদের দ্বিচারিতা— সোজাসাপটা লিখেছিলেন তিনি। সেই বই নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল, নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তার পাঠ। নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার ‘আদেশ’, স্বামী শান্তিময় রায়কে পার্টি থেকে বহিষ্কার, কোনও কিছুই সাবিত্রীকে দমাতে পারেনি। থামাতে পারেনি তাঁর কলমও।লেখক তো দ্রষ্টা, ব্যক্তিগত দেখাটাও তাঁকে করে তুলতে হয় নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু দল তা মানবে কেন? সে তো বোঝে কেবল ‘পার্টি লাইন’, দাবি করে মনোযোগ আর আনুগত্যের সবটুকু। সমালোচনা দূরস্থান, মতামতে যে মতের পাশাপাশি অমতও থাকতে পারে, ‘পার্টি’ তা বুঝেও বোঝে না। ফলস্বরূপ নেমে আসে ‘সংস্কারবাদী’ তকমা, ও বহিষ্কারের ফতোয়া।
১৯১৮-র ২৮ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম সাবিত্রীর। শৈশব কেটেছে ফরিদপুরের গ্রামে। পিতার পদবি সেন। বাবা-মা ছাড়াও দশের কাজে এগিয়ে-আসা পিসির প্রভাব পড়েছিল তাঁর জীবনে। বেথুন কলেজ থেকে বিএ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিটি পাশ করা মেয়েটি নিজের বিপ্লবী দাদার বন্ধু শান্তিময় রায়কে বেছে নিয়েছিল জীবনসঙ্গী হিসেবে। ১৯৪০-এ বিয়ে, বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই স্বামীর কারাবাস। স্কুলে পড়ানোর কাজ নিয়েছিলেন সাবিত্রী, চাকরি করতে গিয়ে শিশুকন্যার দেখাশোনায় সমস্যা হচ্ছে দেখে ছেড়ে দেন সে কাজ। শিক্ষিতা মেয়ে অথচ নিজে উপার্জনক্ষম নন, এই আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে। লেখালিখিকে আঁকড়ে ধরায় সেই খেদ দূর হয়েছিল। সংসারের নানা কাজের মধ্যেই সময় বার করে লিখেছেন ন’টা উপন্যাস, কিছু ছোটগল্প, এমনকি শিশু-কিশোরপাঠ্য বইও। শেষ উপন্যাস ‘বদ্বীপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে, শেষ বই ‘নীল চিঠির ঝাঁপি’ ১৯৮০-তে। জীবনের শেষ ষোলো বছর কিছুই আর লিখলেন না। কারণ একটা বই করতে দু’হাজার টাকা লাগবে জানিয়েছিলেন প্রকাশক। আর নিজ সময়ে প্রশংসিত লেখক সাবিত্রী রায়ের টাকা ছিল না। নিজের জন্য প্রার্থনা না করাই তিনি স্থির করেছিলেন।
গণ্ডিবদ্ধ সাংসারিকতা থেকে বাঙালি মেয়েকে উত্তরণের হদিশ দেওয়া আশাপূর্ণা দেবী, বা জল-জঙ্গল-মাটির সংগ্রামের হয়ে কলম ধরা মহাশ্বেতা দেবী যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, সাবিত্রী রায় তা পাননি। সাবিত্রী রায়ের প্রথম উপন্যাস সৃজন (১৯৪৭) প্রকাশিত হয় তাঁর আটাশ বছর বয়সে। বালিকা বয়স থেকে পিসিমার কাছে আশ্রমে প্রতিপালিত হয়েছিলেন সাবিত্রী, যা তাঁর মনে আদর্শবোধ আর আত্মসংযমের একটা ধরন হয়তো তৈরি করেছিল। এটা পরে বামপন্থী আদর্শের প্রতি তাঁর বিশ্বাসে জায়গা পায়। ব্যক্তিগত জীবনেও পার্টিকর্মীকে বিবাহের মধ্যে দিয়ে আদর্শমূলক আন্দোলনকে অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। দেখেছিলেন আরও অনেক কিছুই। সাবিত্রীর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য বোধ হয় তাঁর চোখে-দেখা ব্যক্তিচরিত্রগুলোর সমকালীন সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনাবলির অংশ হয়ে যাওয়া। সৃজন, ত্রিস্রোতা, স্বরলিপি, পাকা ধানের গান— কমবেশি ষোলো বছরের লেখকজীবনে রচিত আটটি বড় উপন্যাসেরই মূল চরিত্র ছিল তাঁর সমসময়। বিরাট ক্যানভাস, অসংখ্য চরিত্র। দেশভাগের আগে-পরে লক্ষ লক্ষ পরিবারের পা রাখার জমি খোঁজার সামাজিক বিবরণ, তারই সঙ্গে মিশে গেছে বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর কালের বৃহত্তর বাংলার বিপুল পরিবর্তন। তেভাগার মতো রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিদের মুখ, শহরের কালোবাজারি, গুন্ডামির পাশাপাশি বাস্তুনির্মাণে মরিয়া মানুষদের নিত্যদিনের লড়াই। মেথর আন্দোলন থেকে ট্রাম পোড়ানোর বিক্ষোভ, জীবিকার খোঁজ। গায়ে গায়ে থাকা বিচিত্র শ্রেণিবিন্যাস। সেই আন্দোলন, অথবা টিকে থাকা, ধরা থেকেছে নানা মুখের পটে। সাবিত্রীর উপন্যাসে এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সর্বদাই বিবৃত হয়েছে ক্ষমতার বয়ানের বিপরীত বিন্দু থেকে। ‘নীচে থাকা’ লোকেদের বিন্দু থেকে।
কার্লাইল তাঁর কোনও এক লেখায় বলেছিলেন— ‘ইতিহাসের মাধ্যমে আমাদের অন্তর জুড়ে রয়েছে বড় বড় ঘটনা, বড় বড় মানুষের জীবন-কাহিনি। এই ইতিহাসের ধারাপথে পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটের মতো আমাদের চোখের সমূখ দিয়ে চলেছে কত বিরাট ব্যক্তিত্ব, কত যুদ্ধ ও দিগ্বিজয়, কত সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, কত ভাঙা, কত গড়া। কিন্তু যে মানুষ প্রথম কোদালখানা তৈরি করেছিল— আমরা জানি না সে কে ছিল, কবে ছিল, কোথায় ছিল। ইতিহাসের পটে তার নাম নেই, আমাদের মনের পটে তার ছবি নেই। কিন্তু সভ্যতা-বিকাশের ক্ষেত্রে সেই মানুষের দান কোনও সাম্রাজ্যের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। … নদীর উপরের ঊর্মিমালাই আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু এই লীলাচঞ্চল ঊর্মিমালার নীচে যে বেগবান প্রবাহ তা অলক্ষ্য ব’লেই সচরাচর আমাদের অজ্ঞাত। সমাজের জীবনপ্রবাহে এই অলক্ষ্য বেগ সঞ্চার ক’রে চলেছেন যাঁরা, তাঁদের ছবি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরবার কোনও পথ এনই। তাঁরা অখ্যাত, অজ্ঞাত, অনামী।
এ কথা সমগ্রভাবে মানব-সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসের পক্ষে যেমন সত্য, তার অংশবিশেষ সম্বন্ধেও তেমনই সত্য। আমাদের সাহিত্যে নারীর দানের কথা ভাবতে গিয়ে এই কথাটা বার বার মনে হচ্ছে যে, জনপ্রিয়তার মোড়কে আমরা দেখেছি শুধু তাঁদের, যাঁরা ছিলেন আমাদের কাছাকাছি, পাশাপাশি বা অনন্ত দৃষ্টির সীমার মধ্যে। আমাদের দৃষ্টির নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরা ওই অনামী। আজ সময় এসেছে সাবিত্রী রায়ের ক্ষেত্রে ‘অনামী’ তকমার ‘অ’ প্রত্যাক্ষান করার। তারই সূচনা করল ‘নতুন পথ এই সময়’ পত্রিকা।