সত্তরের দশকের সূচনায় যখন আমি লেখার জগতে আসি তখন বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় লেখকের আসনটি ছিলো শাহরিয়ার কবিরের। শাহরিয়ার কবিরের প্রতিটি গল্প উপন্যাস জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলো বরাবরই। কয়েকটি প্রজন্ম বিকশিত হয়েছে শাহরিয়ার কবিরের গল্প উপন্যাস পড়ে।
আমাদের শিশুসাহিত্য একজন শাহরিয়ার কবিরের অপরূপ রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ।
স্মৃতি থেকে কয়েকটি বইয়ের নাম এখানে পেশ করতে পারি। আমি জানি আমার বন্ধুদের অধিকাংশই এই বইগুলোর মুগ্ধ পাঠক ছিলেন একদা।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পদ হিশেবে বহুকাল ধরে দীপ্তি ছড়াবে শাহরিয়ার কবিরের এই বইগুলো—
নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা, একাত্তরের যীশু, নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা,আবুদের অ্যাডভেঞ্চার, পুবের সূর্য, পাথারিয়ার খনি রহস্য, আলোর পাখিরা, সীমান্তে সংঘাত, মিছিলের একজন, সাধু গ্রেগরীর দিনগুলি, হানাবাড়ির রহস্য, ব্যভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, একাত্তরের পথের ধারে, বার্চবনে ঝড়, নিশির ডাক, কিংবা কার্পথিয়ানের কালো গোলাপ।
বাংলাদেশের শিশুকিশোরদের দুর্ভাগ্য ছোটদের প্রিয় লেখক শাহরিয়ার কবির একটা পর্যায়ে এসে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছেন গল্প উপন্যাস থেকে। ক্রমে ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন বড়দের লেখক। বয়স্কজনপাঠ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ইতিহাসসম্পৃক্ত রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। যুক্ত হলেন রাজনীতির সঙ্গে। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মে জড়িয়ে থাকলেন বছরের পর বছর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখলেন শহিদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে।
এই সময়টায় রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন অনেকগুলো বড়দের উপযোগী বই। ১৯৮৭ সালে তাঁর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিলো ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ নামের ঐতিহাসিক বইটি।
সকলেই জানেন, দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থ লেখক শাহরিয়ার কবির। একুশের বইমেলায় একটি স্যাটেলাইট টিভির পক্ষ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘বইমেলা সরাসরি’তে শাহরিয়ার কবিরের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি ২০০৯ সালে। তখনও তিনি বইমেলার মাঠে এসেছিলেন লাঠিতে ভর করেই। সেই শাহরিয়ার কবির এখন হুইল চেয়ারে চলাচল করেন। উঠে দাঁড়াতে কিংবা হাঁটতেও পারেন না অন্যের সহায়তা ছাড়া। তাঁকে একটি খুনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলখানায় আটকে রেখেছে ইউনুস সরকার। ইতোমধ্যে একাধিকবার তাঁকে নেয়া হয়েছে রিমান্ডে। খুনের মামলাটি সঠিক না বেঠিক সেই তর্কে না যাই। জেলখানায় একজন সিনিয়র সিটিজেন হিশেবে প্রাপ্য ডিভিশন-সম্মান-মর্যাদা এবং চিকিৎসাসেবা থেকেও তিনি বঞ্চিত।
শাহরিয়ার কবিরকে জামিন দিলে তিনি পালিয়ে যাবেন বা পালাতে পারবেন এমনটা অসম্ভব জেনেও জেলখানার ঠান্ডা ফ্লোরে তাঁকে দিন কাটাতে হচ্ছে একটি কম্বল সম্বল করে, একজন সাধারণ কয়েদীর মতো।
শাহরিয়ার কবির কোনো সাধারণ কয়েদী নন।
ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য।
চলাচলে অক্ষম একজন সিনিয়র সিটিজেন শাহরিয়ার কবিরের ওপর আরোপিত হত্যা মামলাটি অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর।
শাহরিয়ার কবিরকে মুক্তি দিন।
অটোয়া ০৮ এপ্রিল ২০২৫
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলায় সরাসরি সম্প্রচারিত ‘বইমেলা সরাসরি’ অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত লেখক শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন লুৎফর রহমান রিটন। ছবিতে অন্যান্যের সঙ্গে লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং ফরহাদ খানকে দেখা যাচ্ছে। সময়কাল ২০০৯ ।