ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের এক প্রাচীন জাতির মধ্যে দোল বা হোলি উৎসবের জন্ম। সেখান থেকেই অবশিষ্ট ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। হোলি উৎযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদাই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে।
ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই আন্দাজ করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রীকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করত।
বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্রে’ দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি।
সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে।
মূলত পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ। ব্রজভূমি তথা মথুরা বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণলীলার কাছে নয়, বাংলার দোল উড়িষ্যা তথা বর্তমান ওড়িশার কাছে বেশি ঋণী।
ওড়িশার দাবি আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানকার অশোকাষ্টমী উৎসবের জন্যে। এই অশোকগাছের আর এক নাম দোহলী।
সংস্কৃত শ্লোকে আছে, নারীর হস্তাভরণ হল, ‘পণ্ডবী দোহলী গোন্দনী গড়ুকাদয়ঃ’। অর্থাৎ হাতে অশোকফুলের বা অশোকগাছের পাতার বেড়ি বা ডোর পরার নিয়ম ছিল। এই দোহলী থেকেই দোল ও হোলি কথাটির উদ্ভব হয়েছে। আসামের বরপেটা জেলায় এখনও পালিত হয় দেউল বা দৌল উৎসব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দোহলী > দেউলী > দেউল > দৌল > দোল। এই পথেই দোল এসেছে।
অশোকষষ্ঠী ব্রত বঙ্গের ঘরে ঘরে বিবাহিতা মহিলারা পালন করেন চৈত্রমাসে। তুলনামূলকভাবে অশোকাষ্টমী পালনের রেওয়াজ কম বাংলায়। তবে আসাম-ত্রিপুরা-ওড়িশায় অশোকাষ্টমী রীতিমত উৎসব। ত্রিপুরার রাজপরিবারে এই অশোকাষ্টমী উৎসব কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে।
তেমনভাবে ওড়িশাতেও এর খুব রমরমা।
অশোকাষ্টমী উৎসব ভারতের ওড়িশা রাজ্যে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে পালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয়। এই উৎসবের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য অপরিসীম, কারণ এটি মহিষাসুরের উপর দেবী শক্তির আধিপত্য ও বিজয়কে স্মরণ করে।
অশোকাষ্টমীর নামকরণ করা হয়েছে অশোক গাছ থেকে, যা এই উৎসবে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। হিন্দু পুরাণে অশোক গাছকে পবিত্র বলে মনে করা হয় এবং এটি সমৃদ্ধি, উর্বরতা এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। এই শুভ দিনে, ভক্তরা অশোক গাছের কাছে প্রার্থনা করেন এবং সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
অশোকাষ্টমী উৎসব মূলত দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের পূজার সাথে জড়িত। ভক্তরা তাজা ফুল এবং প্রাণবন্ত সাজসজ্জায় সজ্জিত দেবীর উদ্দেশে নিবেদিত মন্দিরগুলিতে যান, তাদের প্রার্থনা এবং ঐশ্বরিক আশীর্বাদ কামনা করার জন্য। পরিবেশ ভক্তি, মন্ত্র এবং ধূপের সুবাসে ভরে ওঠে।
অশোকাষ্টমীর একটি বিশেষ আকর্ষণ হল দেবী দুর্গা এবং ভগবান শিবের মূর্তির আনুষ্ঠানিক স্নান। “স্নানযাত্রা” নামে পরিচিত এই আনুষ্ঠানিক স্নানটি বিশাল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং এরপর বিস্তৃত আচার-অনুষ্ঠান এবং নৈবেদ্য প্রদান করা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করলে বা প্রত্যক্ষ করলে তাদের পাপক্ষয় ও পুণ্যার্জন হবে এবং ঐশ্বরিক আশীর্বাদ লাভ করা হবে।
অশোকাষ্টমী উপলক্ষে সুন্দরভাবে সজ্জিত রথের শোভাযাত্রা বের করা হয়। তাতে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে দেবী দুর্গার প্রতিমা বহন করা হয়। ভক্তরা বিপুল সংখ্যক ভিড় করেন, ভক্তিমূলক গান গেয়ে এবং স্তবগান করে, দেবীর কাছে তাদের আন্তরিক প্রার্থনা নিবেদন করেন। এই শোভাযাত্রা আধ্যাত্মিক উৎসাহ এবং সম্প্রদায়ের বন্ধনের পরিবেশ তৈরি করে।
উৎসবের আরেকটি অনন্য দিক হল “দণ্ড নাট” বা “স্টাফ ড্যান্স” নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। পাহান্ডি বিজে নামেও একটি পর্ব আছে। দণ্ড নাট শিল্পীরা, প্রাণবন্ত পোশাক পরিহিত, লম্বা লাঠি বহন করে এবং ছন্দময় তাল এবং সুরেলা সঙ্গীতের সাথে জটিল নৃত্য পরিবেশন করে। এই নৃত্য অশুভ শক্তির উপর দেবী শক্তির বিজয়ের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং ওড়িশার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
অশোকাষ্টমী এমন একটি সময়, যা মানুষের দানধ্যান ও করুণা প্রদর্শনের সন্ধিক্ষণ। দরিদ্রদের অনেককিছু দান করা হয় এবং বঞ্চিতদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। এই রীতি সেবার মনোভাব এবং সমাজকে ফিরিয়ে দেওয়ার গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।
উৎসবটি আরও নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সজ্জিত, যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত পরিবেশনা, লোকনৃত্য এবং থিয়েটার শো। শিল্পীরা শিল্পের প্রাণবন্ত অভিব্যক্তির মাধ্যমে তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করেন, দেবী দুর্গার সাথে সম্পর্কিত পৌরাণিক গল্প এবং কিংবদন্তি চিত্রিত করেন।
অশোকাষ্টমী উদযাপনে খাবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভক্তরা বিশেষ খাবার তৈরি করে দেবীকে প্রসাদ (পবিত্র খাবার) হিসেবে নিবেদন করেন। জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবারের মধ্যে রয়েছে ছেনা পোড়া (কুটির পনির দিয়ে তৈরি একটি মিষ্টি), মন্ডা পিঠা (ভাতের পিঠা) এবং বিভিন্ন মরশুমি ফল।
অশোকাষ্টমী ভক্তি, ধার্মিক চেতনা এবং অশুভের উপর ভালোর বিজয়ের স্মারক হিসেবে কাজ করে। এটি আধ্যাত্মিক জাগরণ, ঐক্য এবং সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করে। মানুষ দেবী দুর্গার ঐশ্বরিক উপস্থিতি উদযাপনের জন্য একত্রিত হয়।
আসল কথা, ওড়িশা রাজ্যের জাতীয় ফুল অশোক। তাই দোল তথা দোহলী (অশোকবৃক্ষ) ও অশোকাষ্টমীর গুরুত্ব সেখানকার অধিবাসীদের কাছে অপরিসীম। ত্রিপুরা ও আসামেও অশোকাষ্টমী উৎসবের চেহারা নেয়। বঙ্গে যেমন অশোকষষ্ঠী পালিত হয় ঘরে ঘরে। অশোকাষ্টমীও পালন করেন কেউ কেউ।