শনিবার | ১৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:২৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (ষষ্ঠ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস ভারতের সংবিধান রচনার নেপথ্য কারিগর ও শিল্পীরা : দিলীপ মজুমদার চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (দ্বিতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত রবীন্দ্রনাথের ইরান যাত্রা : অভিজিৎ ব্যানার্জি ঠাকুরকে ঠাকুর না বানিয়ে আসুন একটু চেনার চেষ্টা করি : দিলীপ মজুমদার যুদ্ধ দারিদ্র কিংবা বেকারত্বের বিরুদ্ধে নয় তাই অশ্লীল উন্মত্ত উল্লাস : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ, পঁচিশে বৈশাখ ও জয়ঢাক : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ মোহিনী একাদশীর ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত নিজের আংশিক বর্ণান্ধতা নিয়ে কবিগুরুর স্বীকারোক্তি : অসিত দাস ঝকঝকে ও মজবুত দাঁতের জন্য ভিটামিন : ডাঃ পিয়ালী চ্যাটার্জী (ব্যানার্জী) সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা : লুৎফর রহমান রিটন
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রাঙিয়ে দিয়ে যাও, রঙ ছাড়া জীবনের বর্ণনা অসম্ভব লিখছেন আবুল বাশার

আবুল বাশার / ৪৯৮ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০২২

জীবন হল রঙের ঝটাপটি৷‌ জীবন হল রঙেরই আশ্চর্য তারানা৷‌ এবং এই যে জীবন, তা হল রঙের বাসম্তী কৃষ্ণাঞ্জলি৷‌ রঙ ছাড়া জীবনের বর্ণনা অসম্ভব৷‌

আর বসম্ত? সে কে? কবির চোখে ঋতুদের রাজা৷‌ তার এই শ্রেষ্ঠত্ব কেন? ধরা আর ঝরার ঋতু এই বসম্ত৷‌ মুকুল আর বোলের, কুঁড়ি আর বীজের জীবনোচ্ছ্বাসের নাম বসম্ত৷‌ বর্ণে বর্ণে ভরে ওঠা এবং অজস্র প্রাচুর্য সহকারে ঝরে যাওয়া জীবনোৎকর্ষের বিস্ময়ের নাম বসম্ত৷‌ বসম্ত একাধারে শূন্যতা ও পূর্ণতার উপলব্ধি আলো ও রঙের ভেতর দিয়ে ব্যক্ত করে৷‌ বসম্ত দখিনা বাতাসে জীবনবিন্দুর সঞ্চয় বার্তাও বহে আনে৷‌ যেখানে তার শুষ্কতা সেখানে সে বলে, ‘রং দাও, আরও রং দাও, কিশলয়-সবুজে এ জীবন ভরে তোলো’৷‌

আমাদের এই বাংলায় একজন মহৎ বিজ্ঞানী ছিলেন, যাঁর বিজ্ঞানের ভাষা ছিল খাঁটি কবিত্বে পূর্ণ আর ছিল তাঁর জগৎ-প্রকৃতিকে দেখবার আশ্চর্য শক্তি৷‌ তিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে মিলিয়ে, সুর-লয়-তাল মিলিয়ে দেখেছিলেন বৈজ্ঞানিক আদরা-স্মিত পৃথিবী৷‌ নাম তাঁর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু৷‌

এই বিজ্ঞানী বসম্তের বর্ণনায় লেখেন, ‘বসম্তের স্পর্শে নিদ্রিত পৃথিবী জাগরিত করিয়া, প্রাম্তর বন আচ্ছন্ন করিয়া, উদ্ভিদ-শিশু অন্ধকার হইতে মস্তক তুলিল৷‌ দেখিতে দেখিতে হরিৎ প্রাম্তর প্রসূনিত৷‌’

প্রসূনিত শব্দটি কী মায়াময়৷‌ প্রসূনিত না লিখে যদি বিজ্ঞানী মুকুলিত লিখতেন, তা হলে তাঁর বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে কবিত্বের রসসঞ্চার হত কি! আমি তো হতবাক, এমনতর মহৎ বিজ্ঞানী লেখেন, ‘হরিৎ প্রাম্তর প্রসূনিত৷‌’

ফল ও ফুলে ভরা বসম্ত ঘুম থেকে জেগে উঠছে অন্ধকার থেকে আলোয়৷‌ রঙে ভরা বসম্ত৷‌

মহাবিজ্ঞানী লিখেছেন, ‘গাছে ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে দেখিলে আমাদের মনে কত আনন্দ হয়৷‌ বোধ হয় গাছেরও কত আনন্দ৷‌ আনন্দের দিনে আমরা দশজনকে নিমন্ত্রণ করি৷‌ ফুল ফুটিলেও গাছ তাহার বন্ধুবান্ধবদিগকে ডাকিয়া আনে৷‌ গাছ যেন ডাকিয়া বলে ‘কোথায় আমার বন্ধুবান্ধব, আজ আমার বাড়িতে এসো৷‌ যদি পথ ভুলিয়া যাও, বাড়ি যদি চিনিতে না পার, সেজন্য নানা রঙের ফুলের নিশান তুলিয়া দিয়াছি৷‌ এই রঙিন পাপড়িগুলি দূর হইতে দেখিতে পাইবে৷‌’ মৌমাছি ও প্রজাপতির সহিত গাছের চিরকাল বন্ধুতা৷‌ তাহারা দলে দলে ফুল দেখিতে আসে৷‌’

সুভাষদা (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়) যতই বলুন ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসম্ত’– তবু আমি তো ফুল ছাড়া বসম্তকে কল্পনাও করতে পারি নে৷‌ পলাশ নেই, কৃষ্ণচূড়া নেই, অথচ বসম্ত এসে গেছে, এ কেমন কথা! গন্ধবর্ণ, মধূপ গুঞ্জন ছাড়া বসম্ত কি হয়? এক চমৎকার কেতায় পর্যবেক্ষণ করেছেন মহাবিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র৷‌ লিখেছেন, ‘কোনো কোনো পতঙ্গ দিনের বেলায় পাখির ভয়ে বাহির হইতে পারে না৷‌ পাখি তাহাদিগকে দেখিলেই খাইয়া ফেলে৷‌ কাজেই রাত্রি না হইলে তাহারা বাহির হইতে পারে না৷‌ সন্ধ্যা হইলেই তাহাদিগকে আনিবার জন্য ফুল চারি দিকে সুগন্ধ বিস্তার করে৷‌’

ফলত বর্ণগন্ধ সমবায়ে বসম্তের যাপন৷‌ পাখিও চাই৷‌ কোকিলের কুহু চাই৷‌ নানারঙা নানাকন্ঠী বিহঙ্গ চাই৷‌ প্রজাপতির নানান বর্ণ ডানার কাঁপুনি চাই৷‌ সমাজ-অঙ্গনে প্রকৃত যৌবন চাই্ব দোল পূর্ণিমা চাই৷‌ চাই রঙের ঝটাপটি৷‌ আমের মঞ্জরী ছাড়া বসম্ত হয় না৷‌

আমি মুর্শিদাবাদের মানুষ, তাই আমের বউল-মঞ্জরীর আড়ালে বসে ডেকে ওঠা কোকিল ছাড়া বসম্তকে মনের মধ্যে টেনে আনতে পারি না৷‌ আমার বাসম্তী কল্পনা দল মেলে না৷‌ গায়ের উপর, বিশেষ করে কাঁধে আমমঞ্জরীর মধু ঝরে পড়ার একটা আমগন্ধ ব্যতিরেকে কী হবে বসম্ত-বিলাপ, টের পাব কী করে যে, রঙের আগুন-জ্বলা বসম্ত এসেছে? বসম্তের বিলাপ এই যে, এ বছর ভাল করে আমের মুকুল আসেনি গাছে গাছে৷‌ কথাটা বাস্তব৷‌ এ বছরের আবহাওয়াজনিত কারণে আমের প্রসূন ফুটে উঠতে পারছে না৷‌ অথচ মনে পড়ছে কী এক না-থামা মধূপ গুঞ্জনে বাগানগুলো গুঞ্জিত৷‌ এবং সেটা ছেলেবেলার কথা৷‌ সাইকেল করে চলেছি আমবাগানের ভেতর দিয়ে, ঝরে পড়া পাতার আড়ালে মুখ বার করে আছে আমের গুটি৷‌ সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে খুঁজে নিচ্ছি ওই গুটি৷‌ কাঁধে ঝরছে মধু৷‌ তখনও মুকুল আছে গাছে৷‌ মুকুল আর গুটি একসঙ্গে নুয়ে আছে ডালে৷‌ আধেক-আধেক৷‌ একই সঙ্গে ফুল-ফলের ঘনিষ্ঠতম সমাবেশ আর কোথায় এত স্পষ্ট করে দেখেছি? দেখিনি৷‌ এটি যেন এক চিরম্তন চিত্রকল্প৷‌ যা বাস্তবত সত্যও বটে৷‌

মুর্শিদাবাদে একটি চমৎকার লোকছড়া আছে৷‌

‘আমে ধান/তেঁতুলে বান৷‌’

যে-বছর আম ভাল ফলে, সে-বছর ধানও হয় বেশি ফলবান৷‌ আর যে-বছর তেঁতুল বেশি হয় সে-বছর নদীতে বন্যা হয়৷‌ এ বছর তা হলে কী হবে? এই আশঙ্কা সত্ত্বেও বসম্ত এসেছে৷‌ দখিনা বাতাস কোথায়? বাতাসে কী, চাপা বাসম্তী আলো ঝলমল করছে? বাসম্তী রঙ বাতাসে মিশে ঝলমল করতে দেখেছি ছেলেবেলায়৷‌ আর আজ? রক্তে কেমন চনমনে উত্তেজনা বয়ে কি আনছে বাসম্তী আলো? আমার কি দেখবার মতো চোখ দুটিই হারিয়ে গেছে? আমি কি রঙ-কানা হয়ে গেছি? নাকি কালো একটা রঙ গ্রাস করছে সাতরঙা বাংলার বসম্তকে? প্রত্যেক দিন নারী-ধর্ষণে কলুষিত হচ্ছে এই রাজ্যটা৷‌ এতই হিংস্র হয়েছে বাংলা! সমাজটার কী যেন হয়েছে! লোচ্চার দল সমাজের মাথায় চড়েছে৷‌

একটি ক্লাস সিক্সের ছাত্রী ধর্ষিতা হওয়ার পর নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরল, ওই আগুনের আঁচেই কি এ বছর আমগাছে মুকুল এলই না ভাল করে! শুধু কি আবহাওয়াই দায়ী, দুষ্কৃতীর পাপ দায়ী নয়? পোড়া দেহই কি বসম্তের ভাষা? ওই রঙটাই কি বাসম্তী আলোকে ফুটে উঠতে দিচ্ছে না?

ঝরে গেল কিশোরী৷‌ মুকুলেই শেষ হল৷‌ মুকুলের ঝরে যাওয়া সহ্য হয়, কিন্তু ক্লাস সিক্সের ছাত্রীর পুড়ে যাওয়া আসলে একটি নবীনা গুটির আমের শুকিয়ে রোদে ঝলসে যাওয়ার চেয়ে শতেক গুণ করুণ্ব এ জিনিস সহ্য হয় না৷‌ তা হলে, কী রঙ দেব জীবনকে?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন বসম্ত ব্যাপারে, যা আমার পক্ষে সাম্ত্বনা মাত্র৷‌ যদিও নির্ভয়াদের ঝরে যাওয়া এমন এক পাপ, যার জন্য প্রকৃতির দিকে চেয়ে থেকেও বুকটা গুমরে গুমরে ওঠে৷‌ এই রচনা কি নির্ভয়াদের উৎসর্গ করা যায়? কোনও সংবেদনকেই এভাবে মৃত্যুর ওপারে নির্ভয়ার আত্মায় পৌঁছে দেওয়া যায় না৷‌

তাই হঠাৎ মনে হল, আমরা নারীর এভাবে অকালে ঝরে যাওয়ার সঙ্গে ফুলের ঝরে যাওয়ার তুলনা না করলেই ঠিক করব! বরং বলব, যাকে ধর্ষণে-হত্যায় শেষ করে দেওয়া হচ্ছে, তা ফুলের সৌন্দর্য-করুণ ঝরে পড়া হলেও মানুষ আর ফুল এক নয়৷‌ ফুল বা ঘাস ফিরে ফিরে আসে অমৃত-বসম্তে, মানুষ আসে না৷‌ একবার যে যায়, সে চিরতরেই যায়৷‌ হঠাৎ মনে হল, ফুলের ঝরে পড়া আর ধর্ষিতার হত্যাকাণ্ড এক কথা নয়৷‌ মোটেও এক কথা নয়৷‌

আমি কবুল করছি, আমের মুকুল ঝরতে দেখে আমি কখনও ক্ষীণতম বেদনাও অনুভব করিনি৷‌ তার কারণ আজকাল বুঝতে পার্বি নির্ভয়ার ঝরে যাওয়া বুকে চেপে পাঠ করছি এই কথাগুলো, ‘বসম্তে ফুলের মুকুল রাশি রাশি ঝরে যায়্ব ভয় নেই, কেননা ক্ষয় নেই৷‌’ কেন ক্ষয় নেই? কারণ, বসম্তের ডালিতে ‘অমৃতমন্ত্র আছে’৷‌ ‘রূপের নৈবেদ্য ভরে ভরে ওঠে৷‌’

কেবলই ঝরছে, কেবলই পূর্ণ হচ্ছে৷‌ তা নির্ভয়ার বীভৎস-করুণ মৃত্যুর মতো বুক খালি করে দেয় না৷‌ ঝরতে ঝরতেই গুটি ধরে আমে৷‌ ক্লাস সিক্সের ছাত্রীর ঝরে যাওয়া তো এরকম নয়৷‌ তা সবটাই ক্ষয় ও ক্ষতি৷‌ তাতে অমৃত কোথায়? অথচ কিশোরীর হাসি ছিল ফুলেরই মতো সুন্দর৷‌ ধর্ষণ-হত্যার ঘটনাই কি বাংলার পুঁজি! এই বসম্তে?

আর পারছি না৷‌ এসো রঙের দিকেই চোখ ফেরাই৷‌

রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমার ঘরের দরজার কাছে কয়েকটি কাঁটা গাছে বসম্তের সোহাগে ফুল ফুটে ওঠে৷‌ সে হল কন্টিকারীর ফুল৷‌ তার বেগুনি রঙের কোমল বুকের মাঝখানে একটুখানি হলদে সোনা৷‌ আকাশে তাকিয়ে যে-সূর্যের কিরণকে সে ধ্যান করে সেই ধ্যানটুকু তার বুকের মাঝখানটিতে যেন মধুর হয়ে রইল৷‌ এই ফুলের কি খ্যাতি আছে আর, এ কি ঝরে ঝরে পড়ে না৷‌ কিন্তু, তাতে ক্ষতি হল কী৷‌’

সুতরাং বসম্তের গানে ক্ষতির কথা তুলব না৷‌ শুধু চাপা কষ্ট অপরাজিতা ও নির্ভয়ার ব্যাপারে বুকের মধ্যে থেকে যাবে৷‌ আমরা এই ধর্ষকভূমিতে দাঁড়িয়ে আর্ত-আকুল-তীব্র-যাতনায় ছটফট করব, আসলে নিজেরই হাত-পা কামড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারব না৷‌

যা হোক৷‌ তবু বসম্ত এল৷‌ রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধেছিলেন অকালে ঝরে যাওয়া সম্তান শমীন্দ্রের মুখ মনে করে৷‌ গানটার পুরোটা নিচে তুলে দেওয়া যাক৷‌ এটি কি সত্যিই কোনও বসম্তের গান্ব হ্যাঁ বসম্তেরই স্পষ্ট উল্লেখ পাই তাতে৷‌

গানটা সবার জানা৷‌ জানা জিনিসই অনেক সময় ধর্ষকভূমির মানুষকে জানাতে হয়৷‌

‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসম্তের এই মাতাল সমীরণে—’

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কী করলেন? ঘরেই গেলেন রয়ে৷‌

‘যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে–

এই নিরালায় রব আপন কোণে৷‌

যাব না এই মাতাল সমীরণে—’

কেন যাবেন না কবি? কারণ তাঁর কাজ আছে৷‌

‘আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে৷‌

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসম্তের এই মাতাল সমীরণে—’

রবীন্দ্রনাথের পিতৃ-হৃদয়ে ছিল এক আশ্চর্য মাতৃ-হৃদয়৷‌ যেন তিনি মায়ের মতো করে ঘর ধুয়েমুছে একাকী সাফ করে রাখছেন৷‌ মৃত্যুর ওপার থেকে শমীন্দ্রর কি একবারও মনে পড়বে না বাবাকে? তাঁর এই বসম্তে সম্তান ফিরবে বলে এক আকুল অপেক্ষা কবির এবং জেগে থাকা– যেন মায়েরই মতন৷‌ জ্যোৎস্নারাতে৷‌ বসম্তে৷‌ মাতাল হাওয়ায়৷‌

সুতরাং অপরাজিতা-নির্ভয়ার বাবা-মাও কি এই বসম্তে মৃত কন্যার ফিরে আসার অপেক্ষায় নেই? ফুল ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু ধর্ষণে-বিনষ্ট, ধর্ষণে-নিধন বালিকা কি ঘরে ফেরে আর? নিরাকুল এই প্রতীক্ষার নামই কি বসম্ত? বসম্ত এক উতল হাহাকার৷‌ বসম্তের এক নিজস্ব বেদনাবোধ ও হাহাকার আছে, যা নিরাকুল৷‌ একই সঙ্গে আনন্দ ও হাহাকারের কাব্যই হল বসম্ত৷‌

বসম্তকে কতভাবেই না মনে পড়ে আজ৷‌ এক বসম্ত অনেক বসম্তকে টেনে আনে মনের দু’কূল ছাপিয়ে মনের ডাঙায় আর মনে পড়ে ভৈরব নদীর চরভূমির বালুকাময় শূন্যতা৷‌ সূর্যাস্ত হচ্ছে৷‌ নদীর ত্রিমোহনীর জলে ডুবে যাচ্ছে সূর্য৷‌ পশ্চিম আকাশে ছেঁড়াছেঁড়া মেঘের আস্তরে লাল আইসক্রিমের রঙ, দোলের লালিমা ধরিয়ে দিয়ে থ হয়ে আছে৷‌ ধীরে ধীরে তা ফিকে হয়ে এল মেটে সিঁদুরের গুঁড়োয় আর ছিটেয়৷‌ রঘুনাথপুরের বিলের দিকে উড়ে গেল মালা দোলাতে দোলাতে আকাশি হাঁসের সারি আর ক্রমশ নীল রঙ এই চৈত্রেও হয়ে উঠল মটরশুটির ফুলের লাহান নীল৷‌ বিকেলে একঢল আচমকা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷‌

হাঁটুজল নদীতে জলের তিরতিরে ঢেউ চরম ঔদাস্যে বয়ে যাচ্ছে৷‌ একটা আশ্চর্য শ্যাওলার গন্ধ বাঁশপাতা মাছের গন্ধের সঙ্গে বয়ে আসছে, দক্ষিণের শীতল বাতাসে৷‌ ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার বুকের উপর, থুতনি ও নাকে লেগে যাচ্ছে নদীর জলে ঢলানো শ্যাওলার গন্ধ৷‌ বাতাস বিশেষ শীতল৷‌ আকাশে দপদপে সাঁঝতারা পশ্চিমের ফিকে লালের মধ্যে হীরের একটা বড় গোল কুচির মতো উজ্জ্বল৷‌ সেই এক আশ্চর্য আলো৷‌ পূর্বজন্মের স্মৃতি-মাখা তারাটা৷‌ আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি বিস্তীর্ণ চরের ওপর একা৷‌ শুধু কালো কালো ছোট ছোট পাখিরা নদীর জল ছুঁয়ে জীবনের পরিমাপ নিতে সূর্যের আধডোবা থালার দিকে দ্রুত ধেয়ে চলেছে৷‌ ডান হাতের মুঠোয় ধরা একখানা ছুরি, তত ধারালো নয়৷‌ আমার পায়ের কাছে কন্টিকারীর একটি যুবতী গাছ৷‌ তাতে একটি মাত্র ফুল৷‌ সোনা-হলুদ৷‌

একই তো কন্টিকারী, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখেন, সেই মুগ্ধতা কি আমারও ছিল না? রঙের কী যে প্রভাব মানুষের আবেগের ভেতর, ওই সোনা-হলুদ বা হলদে সোনা এক তীব্র আঘাতে মনকে যেন অমরাবতীর তীরে উড়িয়ে নিয়ে চলে৷‌ রক্তের ভেতরে প্রখর এক ঢেউ কেমন ছলাৎ করে বয়ে গেল, আমি কেমন চমকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ফুলের ক্ষুদ্র ও সুগভীর সৌন্দর্যের কুসুমিতায়৷‌

 

থুতনি তুলে পশ্চিম আকাশে চোখ তুলেছি, জ্বলজ্বল করছে হীরের টুকরো৷‌ একবার তারায় আর একবার ফুলে চোখ তুলি আর চোখ নামাই৷‌ যেন মোহ-মদিরা পান করে চলেছে আমার দু’চোখ৷‌

আমার হাতে ধরা ছুরি৷‌ এই চরে কেন এসেছি তা কি আমি ভুলে গেছি! বাতাস বইছে ঝিরঝিরে সুখ-ঝরা গোধূলির কনে দেখা আলোয়৷‌ কেমন পাগল-পাগল লাগছে৷‌ হঠাৎ চোখ ফেটে জল এল৷‌ বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল কিছু একটা!

বাবা আমাকে এই চকজমার চরে পাঠিয়েছেন৷‌ কুন্টিকারী সর্বত্র পাওয়া যায় না৷‌ এটি বিরল জাতির উদ্ভিদ৷‌ গাছে কাঁটা আছে, এটি বালুর উষরতায় জন্মাতে পারে৷‌ এটি এক ধরনের রোগহর গাছড়া৷‌

বাবার হয়েছে এক দুরারোগ্য ব্যাধি৷‌ অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসায় সারবে না৷‌ অ্যালোপ্যাথিতে তখন পর্যম্ত ওই রোগের ওষুধ বের হয়নি৷‌ বা যথাযথ ওষুধ নেই৷‌ বাবার চিকিৎসা চলছে কবিরাজি৷‌ আজিমগঞ্জের আদিনাথ কবিরাজ মশাই বাবার চিকিৎসা করছেন৷‌ বাবাকে দিয়েছেন খেতে নানান গাছড়ার বাটা-বড়ি৷‌ তার সঙ্গে বাবাকে খেতে হয় বাসক ছাল আর কন্টিকারীর গরম জলে ফোটানো ক্বাথ৷‌ ওই বাসক ও কন্টিকারী আমাকেই জোগাড় করতে হয়৷‌ বাসক পাওয়া যায় বিষ্টু খাজা-অলার বাগানে বোরাকুলির এলাকায়৷‌ বাসক জোগাড় তত কঠিন নয়৷‌ কিন্তু কন্টিকারী? এখানে-ওখানে ঘুরতে হয় ছুরি হাতে৷‌

একটাই ফুল৷‌ হরিদ্রাভ সোনায় পড়েছে তারার আলো– রঙের বিপুল মোহ বিস্তার করেছে দখিনা বাতাসে৷‌ সূর্য ডুবে গেল৷‌ এখনও অস্তরাগের পোঁচ লেগে রয়েছে মেঘের ছেঁড়া আস্তরে, মেঘের ওপরের ফাঁকা নীল জায়গায় সন্ধ্যাতারা৷‌

বাবাকে বাঁচাতে হবে, নইলে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন, বাঁচব না৷‌ কন্টিকারীর গোড়ায় এগিয়ে গেল ছুরি৷‌ কেটে নিলাম পুরো গাছটা৷‌ বাড়ি ফিরলাম কেমন একটা বিষন্নতায়, ভারাক্রাম্ত মনে৷‌ সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল৷‌ বাবা কন্টিকারীর ফুলটার দিকে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলেন, কোথায় পেলে?

বললাম, চকজমার চরে৷‌

বাবা বললেন, ফুলটা কী সুন্দর! কিন্তু উপায় কী৷‌ ক্বাথ তো খেতেই হবে বড় খোকা!

আমি সরে এলাম অন্যদিকে৷‌ দু’চোখ বন্ধ করে থুতনি তুললাম ওপরের দিকে৷‌ মনের ভেতরে ফুটে রইল সোনা৷‌ এইই তো জীবন কন্টিকারী৷‌ আজ দোল৷‌

সূত্র : আজকাল, ১৬ মার্চ ২০১৪


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন