বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে লিখেছেন ‘রামনবমী দোল’-এর কথা।
“গাঙ্গুলি-বাড়ি রামনবমী দোলের খুব উৎসব হয়, সেই উপলক্ষে সেও মামার বাড়ি বেড়াইতে আসিয়াছে। সুরেশ অধিকাংশ সময় সেখানেই কাটায়, গাঁয়ের অন্য কোনো ছেলে মিশিবার যোগ্য বলিয়া সেও বোধহয় বিবেচনা করে না।
যে পোড়ো ভিটাটা জঙ্গলাবৃত হইয়া বাড়ির পাশে পড়িয়া থাকিত সে জ্ঞান হইয়া অবধি দেখিতেছে, সেই ভিটার লোক ইহারা। সে হিসেবে ইহাদিগের উপর অপুর একটা বিচিত্র কৌতূহল ছিল…”
রামনবমী শুধু অস্ত্র হাতে মিছিলের দিন নয়, অন্তত এই বঙ্গে। নদীয়ার শান্তিপুর ও বেশ কয়েকটি জায়গায় রামনবমীতে দোল খেলেন রামায়ণের রামচন্দ্র। বাংলায় রামচন্দ্র হলেন রঘুনাথ। কপালে তাঁর রসকলি। এখানে তিনি শুধুই রাবণবধকারী মহাবীর নন, বরং পদ্মাসনে আসীন প্রজাবৎসল রাজা, শান্তির দেবতা, রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলার বেশির ভাগ জায়গায় পূজিত রামচন্দ্রের মূর্তির হাতে থাকে না তির-ধনুক। তাই হয়তো রামনবমীতে বাঙালি হিন্দু কোনও দিন অস্ত্র ধরেনি।
বৈষ্ণব সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান শান্তিপুরের বেশ কিছু পরিবারে রামচন্দ্রের দারুমূর্তি নিত্য পুজো পায়। তার মধ্যে অন্যতম বড়গোস্বামী বাড়ি। অদ্বৈতাচার্যের উত্তরপুরুষ মথুরেশ গোস্বামীর উত্তরপুরুষদের আমলে শুরু হয় রামনবমী উদ্যাপন। তাঁদের বাড়ির রঘুনাথ আসলে ছিলেন শান্তিপুরের অতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা। কোনও এক সময়ে রঘুনাথ বড়গোস্বামীর বাড়িতে স্থানান্তরিত হন।
রামনবমীতে বড়গোস্বামী বাড়িতে হয় বিশেষ পুজো, বসে মেলাও। এই দিন ভক্তেরা রঘুবীরের পায়ে আবির দেয়। হয়তো সেই জন্য এখানে লোকজনের মুখে ‘রামনবমী’ বলে কোনও উৎসবের নাম শোনা যায় না। তাঁরা বলেন, ‘রামচন্দ্রের দোল’। এ দিন অভিষেক ও পুজোর পরে বড়গোস্বামী বাড়িতে রঘুবীরের ভোগে থাকে ভাত, শাকভাজা, মোচার ঘণ্ট, পুষ্পান্ন, ছানার ডালনা, পায়েস, মিষ্টি — একাধিক নিরামিষ পদ।
বড় গোস্বামীবাড়ি ছাড়াও শান্তিপুরের মধ্যমগোস্বামী বাড়ি, সূত্রাগড়ে মোদক সম্প্রদায়ের রামমন্দিরে, গোপালপুর সাহাবাড়িতে হরিপুরে, সব জায়গাতেই বৈষ্ণব রীতি মেনে হয় রামচন্দ্রের পুজো। হরিপুরে পুজোর চেয়েও বেশি নজর কাড়ে বিসর্জন। কেন তার কোনও ব্যাখ্যা পাইনি। সীতায়নের কোনও মহিমা কি এর পেছনে?
শান্তিপুরের বাইরে নদীয়ার শিবনিবাস, বর্ধমানের অম্বিকা-কালনা, হুগলির শ্রীরামপুর, চব্বিশ পরগনার ভাটপাড়া, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর এবং কলকাতার কাছে চন্দননগর, চুঁচুড়া, গুপ্তিপাড়া, খড়দহে রামনবমীর ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। হাওড়ার রামরাজাতলায় রামসীতার সুবিশাল মাটির মূর্তি দেখতে আজও বহু মানুষ ভিড় করেন রামনবমীর দিন। বাংলায় রামচন্দ্রের আরাধনা তাই শক্তি প্রদর্শন নয়, বাঙালির আন্তরিকতার আয়নাতেই রামচন্দ্রকে দর্শন।
সম্প্রতি অযোধ্যায় যাই কার্যসূত্রে। রুটিন রামমন্দির দর্শনে গিয়ে পঞ্চমবর্ষীয় রামলালার বিগ্রহ দেখেছি। অত্যন্ত প্রশান্ত, ঘরের ছেলের চেহারা। অযোধ্যায় ঢোকার সময় বাসের জানালা দিয়ে দেখেছি সেখানকার পুরনো বাড়িগুলি। কোনও পাকাবাড়ির বাইরের দিকে প্লাস্টার নেই। বাড়ির সামনের দিকের দেওয়ালে শুধু প্লাস্টার, পাশের দিক, পিছনের দিকে নয়। বাড়ির পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে আরও বাড়ি থাকলে এরকম দেখা যায়। কিন্তু তাও নয়, পাশে প্রচুর ফাঁকা জায়গা। যেখানে বাড়িতে প্লাস্টারই করা হয় না, সেখানে খুব বেশি মারামারি হত বলেও মনে হয় না। আখক্ষেত, গমক্ষেতের রাজ্যে জন্মে রামচন্দ্র কি হঠাৎই অস্ত্র নিয়ে মেতে উঠবেন? সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব অন্তত তা বলে না।