শ্রীরাম জয় রাম জয় রাম বোল
মনরূপী চোখটিকে তুই খোল।
সত্যনিষ্ঠ ছিলেন প্রভু রামচন্দ্র
সত্যের ওপরেই সৃষ্টি প্রতিষ্ঠিত।
সত্য বচন সদা মুখে তুই বোল
মনরূপী চোখটিকে তুই খোল।।
‘অনন্তর যজ্ঞ সমাপ্তির পর ছয়টি ঋতু চলে গেল। অতঃপর দ্বাদশ মাসে চৈত্রের নবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রদয়ে, (রবি মঙ্গল শনি বৃহস্পতি ও শুক্র) পঞ্চগ্রহ স্ব-স্ব উচ্চস্থানে অবস্থিত হলে কর্কট লগ্নে দেবী কৌশল্যা দিব্যলক্ষনযুক্ত সর্বলোকবন্দিত জগৎপতি শ্রী রামচন্দ্রের জন্ম দিলেন।’ (বাল্মিকী রামায়ণ, আদিকাণ্ড, স্বর্গ ১৮, শ্লোক ৮-১০)
ত্রেতাযুগে জীবজগৎ যখন ত্রিতাপ জ্বালায় জ্বলছে তখন তাদের সুখ ও শান্তিদানের জন্য প্রেম-পবিত্রতা ও প্রসন্নতার প্রতিমূর্তি রাম, অযোধ্যায় চৈত্র মাসের শুক্লনবমী তিথির তপ্ত পৃথিবীতে দুপুর ১২ টার পর আবির্ভূত হলেন। কিছু ভক্ত বিশ্বাস করেন যে ভগবান রাম ছিলেন বিষ্ণুর পুনর্জন্ম, যিনি এই দিনে স্বর্গ থেকে নবজাতক হিসেবে অযোধ্যায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
তার জন্ম এবং জীবন হতে সমগ্র বিশ্ব এক অনুকরণীয় পথের সন্ধান পেয়েছে। পারিবারিক সামাজিক নৈতিক ও রাজকীয় বন্ধনে থেকেও মানবের উন্নত বিকাশ সম্ভব তা, পুরুষোত্তম রামের জীবনযাত্রায় বুঝিয়ে দেয়। রামের দেবত্ব রাম স্বয়ং নির্মাণ করেছেন।
যেকোনো মানব রামের মতো দেবত্বের অধিকারী হতে পারেন তা মহর্ষি বাল্মিকীর রামায়ণ দেখিয়েছে। বিকার বিচার ব্যবহারিক কর্মে ও আদর্শে রাম কখনো মানব মর্যাদার সীমা অলংঘন করেনি, তাইতো তিনি মর্যাদাপুরুষোত্তম।
ভারতের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, ভগবান বিষ্ণু ভক্তদের উদ্ধার করতে এবং দুষ্টদের পরাজিত করতে বিভিন্ন অবতারে অবতীর্ণ হন। তাঁর কার্যকলাপ, যা লীলা নামে পরিচিত, তাঁর প্রিয় ভক্তদের দ্বারা শ্রদ্ধা সহকারে উদযাপিত এবং চিন্তা করা হয়। ভগবান বিষ্ণুর রাম অবতার সারা দেশে তাঁর শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পালন করা হয়।
রাম নবমী ভগবান রামের মানবিক ও ঐশ্বরিক উভয় রূপেই আবির্ভাবকে চিহ্নিত করে, যা ভারত জুড়ে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের পবিত্র শহর অযোধ্যায় (ভগবান রামের জন্মস্থান), গভীর শ্রদ্ধা ও উৎসবের সাথে পালিত হয়। রাম নবমীর পূর্বে, হিন্দুরা চৈত্র নবরাত্রিতে নয় দিনের উপবাস পালন করে। উপাসকগণ মদ্যপান, ধূমপান পরিহার করে, সাত্ত্বিক নিরামিষ খাবার গ্রহণ করে এবং দেহের বিষমুক্তির জন্য প্রার্থনা ও ধ্যানে লিপ্ত হন। নবম এবং শেষ দিনে, অযোধ্যা এবং ভারতের অন্যান্য শহরগুলি প্রার্থনা এবং উৎসবে মেতে ওঠেন।
রামনবমীর দিন ভক্তদের বাড়িতে অথবা ভগবান রামের প্রতি উৎসর্গীকৃত ধর্মীয় স্থানে ভজন এবং কীর্তনের আয়োজন করা হয়। অযোধ্যা ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়, রামের মূর্তিগুলিকে দোলনার উপর রেখে শোভাযাত্রা বের করা হয়।
বেশিরভাগ মন্দির “হবন” বা যজ্ঞের আয়োজন করে — আগুনের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা মন, শরীর এবং আত্মাকে পবিত্র করার লক্ষ্যে কাজ করে। পুরোহিতরা “প্রসাদ” আকারে ভক্তদের মিষ্টি এবং ফল বিতরণ করেন। সাধারণত, ভক্তরা মধ্যরাত পর্যন্ত পুরো দিন ধরে উপবাস পালন করেন। এরপর মিষ্টি এবং ফল খেয়ে উপবাস ভাঙা হয়।
রামলীলা—ভগবান রামের রাবণকে পরাজিত করার একটি নাট্য চিত্রায়ন, যা দেশের অনেক জায়গায় মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকটি সাধারণত খোলা আকাশের নিচে মঞ্চস্থ করা হয়।
যদিও এই উৎসবটি সারা দেশে পালিত হয়, তবে প্রধান উৎসবগুলি অযোধ্যা, ভদ্রচলম, রামেশ্বরম এবং সীতামারহীতে অনুষ্ঠিত হয়। ভগবান রাম ছাড়াও, সীতা, লক্ষ্মণ এবং হনুমানের দেবতাদেরও এই দিনে পূজা করা হয়।
২০২৫ সালে রাম নবমী কখন: রাম নবমী ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল, রবিবার। রাম নবমী পুজোর মুহূর্ত শুরু হবে ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল সকাল ১১টা ০৮ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট পর্যন্ত। নবমী তিথি শুরু হবে ২০২৫ সালের ৫ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ২৬ মিনিটে। নবমী তিথি শেষ ২০২৫ সালের ০৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে।
আজ পুজোয় ভগবান রামকে হলুদ বস্ত্র, হলুদ ফুল এবং হলুদ চন্দন অর্পণ করুন।
তুলসী ছাড়া ভগবান বিষ্ণুর পুজো অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। সেজন্য আপনাকে ভোগের সঙ্গে ভগবান রামকে তুলসী দল দিতে হবে।
এই দিন সূর্যদেবের আরাধনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়,পদ্মফুল ও তুলসীপাতা সহযোগে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আরাধনা করলে বিশেষ ফল লাভ হয়।
শ্রী রামচরিতমানসের চৌপাই গুলিকে মন্ত্রের মতোই কার্যকর বলে মনে করা হয়। পুজোর সময় ইচ্ছানুযায়ী এই চৌপাইগুলিকে পাঠ করুন।
ভগবান রামের নাম জপ করলে সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। দিনে যখনই অবসর পাবেন, মনে মনে রামের নাম জপ করতে থাকুন।
এই দিনে স্নান এবং দান করাও গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভব হলে নদীতে স্নান করে সামর্থ্য অনুযায়ী দান করুন।
জীবনে কোনও সমস্যা, গুরুতর রোগ বা বাধা থাকলে বিশেষ করে রাম নবমীর দিনে রামরক্ষাস্তোত্র পাঠ করুন। এটি ঢালের মতো সমস্ত বাধা থেকে রক্ষা করে।
রাম নবমীর দিনটিকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। এই দিনে আপনি যে কোনও নতুন কাজ শুরু করতে পারেন, ঘরোয়া কাজ করতে পারেন বা কোনও শুভ কাজ শুরু করতে পারেন।
ভগবান রাম এবং শ্রীকৃষ্ণ ভারতবাসীর মনোজগতে ভারতীয় সংস্কৃতির আধার স্তম্ভরূপ ও নিষ্ঠাকেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠিত। শ্রীকৃষ্ণ ও রামচন্দ্রের লীলায় আপামর ভারতবাসী এতটাই লীলায়িত হয়েছেন, অন্য কারোর লীলায় হয়তো এতটা হয়নি। প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়ে তাঁদের প্রেমের রাজত্ব আজও চলে আসছে। “শ্রীরাম”, “জয়রাম”, ‘গোপালকৃষ্ণ’, ‘রাধে কৃষ্ণ’ ধ্বনি আজও এই কথার সাক্ষী হয়ে আছে।
রামনবমী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করার এবং সমাজে ভালোবাসা, শান্তি ও সম্প্রীতি প্রচারের সুযোগ করে দেয়। তাই এই দিনে বিভিন্ন জায়গায় ট্যাবলো এবং শোভাযাত্রা বের করা হয়।
আমার মেয়েবেলায় রামনবমীর দিন একটু বেলা হলেই মায়ের সঙ্গে যেতাম চুঁচুড়ার আখন বাজারে শ্রীরাম মন্দির বা রঘুনাথ জিউর মন্দিরে। ভগবানের রামচন্দ্র সীতা এবং হনুমান মন্দির বলতে আমাদের সময়ে চুঁচুড়ায় তখন ছিল এটাই একমাত্র মন্দির।
পূর্বমুখী দালান রীতিতে তৈরি, ১৯২৯ ট্রাস্ট গঠিত হয় এবং ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির তৈরি হয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে গোকুলচাঁদ আগারওয়াল আখন বাজারের গরুর হাটটি ক্রয় করেন ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে। এখানে তিনি অলংকার ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় সফলতার দরুন গৃহে রাম লক্ষণ সীতা এবং হনুমান পূজা শুরু করেন।১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মথুরা থেকে ব্রাহ্মণ আসেন নিত্য পূজা করতে। পুরোহিত পরিবার মন্দির সংলগ্ন স্থানেই থাকতেন। সেই সময় থেকেই মন্দির প্রাঙ্গণে রামনবমীর মেলা চলে আসছে।
একদ্বার বিশিষ্ট দালান রীতিতে তৈরি চার থাম মোজাইক করা মন্দির। মূল গর্ভগৃহে রাম লক্ষণ সীতা হনুমান সহ জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, গোপাল, নারায়ণ শিলা আছে। সবাই কাঠের পালঙ্কের উপর উপবিষ্ট। গোপাল পৃথকভাবে ঝুলন্ত অবস্থায়, উঠানে হনুমান পূজা ও বিষ্ণু মূর্তি পূজা হয়। বাঁদিকে শিব।
রামনবমী উপলক্ষ্যে এখানে একটা বিশাল মেলা বসত।
আগে নাগরদোলা চলত মাটির হাড়ি কলসি জালা প্রচুর বিক্রি হতো। মিষ্টির দোকান চৌবের জিলিপি ছাড়াও আরো দুটো দোকানে জিলিপি, পাঁপড়, চপ ভাজা হতো। সত্যি বলতে, ছোটবেলায় সেই জিলিপির লোভেই মায়ের সঙ্গে ছুটতাম রামনবমী মেলায়। তবে বর্তমানে আর সে রকম মেলা হয় না। মাটির জিনিসের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের আধুনিক জিনিস।মেলার জৌলুস কমের দিকে। ১৯৮০ থেকে ৮৫ পর্যন্ত শতাধিক দোকান বসত এখন মাত্র কয়েকটি দোকান বসে।
এই মন্দিরের বিষ্ণু মূর্তি দেখার মত, উচ্চতা ২১ ইঞ্চি, প্রস্থে ১১ ইঞ্চি। সোনার অলংকার পরানো আছে মূর্তিতে। মূর্তিটি অষ্টাদশ শতকের বলেই মনে করা হয়। হুগলি চুঁচুড়ার ঐতিহাসিক কিংবদন্তি সম্বন্ধে জানার জন্য অনেক মানুষের মনে কৌতুহলী মন আজও উঁকি মারে। সুযোগ পেলে অতি অবশ্যই ঘুরে আসুন প্রাচীণ এই শহরে, মন্দিরে।।