পুরানে কথিত আছে, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জলমগ্ন থাকায় প্রাণ সৃষ্টি করা নিয়ে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ইন্দ্র পঞ্চানন মিলে সমুদ্র গর্ভের রত্ন সিংহাসন থেকে মা’কে কাঁধে তুলে নিয়ে জলের উপর রাখলেন এবং মহাসমারোহে তাঁর আরাধনা করলেন। মায়ের কৃপায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপী জীবজগৎ প্রাণ লাভ করেলো। পিতামহ ব্রহ্মার প্রাণ সৃষ্টিতে ইচ্ছা সার্থক হল। দেবী মহেশ্বরের নাভি থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর উপবিষ্ট হলেন। এটি হল বুড়ো শিবতলার গড়বাটি রাজরাজেশ্বরী মাতার মূর্তির রহস্য।
দেবী দশমহাবিদ্যা, ষোড়শীমূর্তি, ত্রিপুরা সুন্দরী। প্রায় শতাধিক বছর আগে গড়বাটি বাজারে শুরু করা হয়েছিল ঘট পূজা। বিশ্বযুদ্ধের কারণে বেশ কিছু বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে এ পুজা শুরু হয়েছে। বাজারের সকল মানুষের প্রচেষ্টায় নবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রসঙ্গত গড়বাটি এলাকা আগে ফরাসীদের হাতে ছিল। ইংরেজরা চুঁচুড়া দখল করায় এটি হুগলী-চুঁচুড়া পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় বর্গী আক্রমণের কারণে ভাচরা গড় বা পরিখা কাটা হয়। এই গড়ের ধারে বাটিস্থ পাড়াকে গড়বাটি বলা হতো।
গড়বাটি বাজারের মধ্যে একটি টোল ছিল। আশেপাশের পাড়া থেকে শিশুরা সংস্কৃত, জ্যোতিষ শাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র ,ব্যাকরন ইত্যাদি পড়তে এবং শিখতে আসতো। রোজ দেবীকে প্রণাম করে শুরু হতো শাস্ত্রপাঠ।তখন গাছের তলায় দেবী সাধারণ ঘটে পূজিতা হতেন। তালডাঙ্গার হাট থেকেও ব্যাপারীরা আসতেন। দিনে জমজমাট হলেও সন্ধ্যার পর ফাঁকাই থাকতো বাজার। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের পর ধীরে ধীরে বসতি বাড়তে থাকে। তখনই ঘট থেকে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিতে পূজার প্রবর্তন হয়।
১৯৪৮ সালের সার্বজনীনভাবে শ্রী শ্রী রাজেশ্বরী মায়ের নতুন করে পুজো শুরু হলে বিপত্তি দেখা দেয় পুঁথি না থাকায় মন্ত্র নিয়ে। দেবী মন্ত্রের পুঁথি আনা হয় কাশি থেকে। আগে যারা ঘটে পুজো করতেন তাদের পুজো পদ্ধতি জানা ছিল না। এ পুজোর উদ্ভব সম্পর্কে নানা প্রচলিত জনশ্রুতি আছে।
একটি জনশ্রুতি বলে, এখানে ফরাসি ও ইংরেজদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলতো গরবাটি বাজারে দ্রব্য কেনা নিয়ে। এতে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যাপারীরা সমস্যায় পড়তো নিত্য ঝগড়া অশান্তি এরাবার জন্য গাছ তলায় থান তৈরি করে তাতে ঘট স্থাপন করে নিত্য পুজো শুরু করে দেয়। জেলে, বাগদীরা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে বাড়ি ফেরার সময় সামান্য কিছু ফুল, বেলপাতা, বাতাসা দিয়ে পুজোর ব্যবস্থা করত। বাজারে দেবীর সামনে কেউ অশান্তি করতে চাইতো না।
আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, স্থানীয় এক বাউড়ি পরিবার জীবিকার সন্ধানে এখানে বসবাস করতেন। নিঃসন্তান দম্পতি বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে তাদের বাড়ির শিলাখণ্ডটি গাছ তলায় রেখে অন্যত্র চলে যান। অন্য জাতির গৃহদেবতাকে গাছ তলায় পড়ে থাকতে দেখে বাজারের বিক্রেতারাই পুজো করতে শুরু করেন। যদিও এ সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
দক্ষিণমুখী পাকা দালান রীতিতে তৈরি শ্রী শ্রী রাজেশ্বরী মায়ের মন্দির। সামনে বড় অশ্বত্থ গাছ। দেবী নিত্য পূজিতা হন। বাৎসরিক পুজো ফাল্গুন মাসের সপ্তমী তিথিতে। এ বছর (২০২৩) ২৫শে ফেব্রুয়ারি থেকে ষষ্ঠী শুরু হয়েছে। চার দিনের পুজো। আজ নবমী। প্রথম দিন ঘট স্নান করিয়ে মায়ের পুজো শুরু হয়। পুষ্পাঞ্জলি এবং দুপুরের মধ্যাহ্নভোগ, রাত্রে আরতি ভোগ নিবেদন। সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে পূজা হয়। বলিদান নেই। অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা এবং পরে ধুনা পোড়ানো হয়। নবমীর দিন সপ্তসতী যজ্ঞ এবং অন্নকূট মহোৎসব। রাতে আরতীয ও ভোগ নিবেদন দশমীর দিন সকালে দশমী পূজো ও ঘট নিরঞ্জন করে গঙ্গা পূজা হয়। সকল মায়ের ভক্তরা যাতে নির্বিঘ্নে পুষ্পাঞ্জলী দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয় সুচারুরূপে। ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু করে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত প্রত্যেকটা আচার বিধি নিষ্ঠার সহিত পালন করা হয়।
দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি অতীব সুন্দর। শায়িত মহাদেবের নাভি থেকে পদ্মফুল বৃন্ত সমেত বেরিয়েছে। তাতে চতুর্ভূজা রাজরাজেশ্বরী লাল বেনারসি পড়ে বাঁ পায়ের উপর ডান পা রেখে বসে আছেন। তাঁর চার হাতেই অস্ত্র। দুহাতে তীর অন্য হাতে অঙ্কুশ এবং বজ্র। বাহন নেই। সামনের মহেশ্বর ব্রহ্মা-বিষ্ণু পঞ্চানন্দের মৃন্ময়ী মূর্তি। দেবীর পাশে জয়া-বিজয়াও আছেন। নৈবেদ্যের সিদ্ধচাল, মাসকলাই, হলুদ, দই, ফলমূল, চিড়ে, মুড়কি বাতাসা ইত্যাদি।
অতীতে মেলা হত কিনা জানা নেই তবে পঞ্চাশের দশকে তিন দিন যাত্রাপালা হত। কলকাতার নামিদামি দল ও যাত্রা করে গেছে ওই সময়। এখন এখানে বিশাল করে মেলা বসে। নানা ধরনের আলোকে সুসজ্জিত মেলায় মনোহারি দ্রব্য তেলেভাজা, বাদাম, জিলাপি, আধুনিক ফাস্টফুড, খেলনা বাটিতে ভরে ওঠে প্রাঙ্গণ। গড়বাটি উৎসব উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন আসেন কুটুমবাড়িতে। মেয়েরাও আসেন বাপের বাড়িতে, এত সুন্দর প্রাণবন্ত মেলা খুব কমই দেখা যায়। রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরের কাছেই মেলার মধ্যেই মঞ্চ করে চলে নানান সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুজোকে কেন্দ্র করে এমন সুন্দর মিলন উৎসব অনুষ্ঠিত হোক যুগ যুগ ধরে।
প্রনামমন্ত্র —সর্বমঙ্গল্যে মঙ্গল্যে শিব চরণেন গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে।
তথ্যসূত্র : হুগলি চুঁচুড়ার ইতিহাস ও অন্যান্য।
সত্যিই অনবদ্য লেখনী 👏👏👏
ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
খুব ভালো
থ্যাংক ইউ।