ফোড়নের নাম রাঁধুনি, এ নাম বোধহয় বাংলা ভাষাতেই সম্ভব। নিরামিষ তরকারিতে এর জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে শুক্তো, চাটনি, চচ্চড়ি বা গরমকালের পাতলা আম ডালে আলাদা স্বাদগন্ধ যোগ করে রাঁধুনি। স্বাদ ও গন্ধে রান্নাকে অন্য মাত্র দেয় পাঁচফোড়নের এই ফোড়নটি। একে স্থানীয় ভাষায় অনেকেই বলে সম্বরা বা সম্বুরা। রাঁধুনির প্রকৃত নাম চন্দনী। জইন, জোয়াইন বা জোয়ান এর মতো দেখতে তবে চন্দনী বা রাধুনী সাইজে একটু ছোট্ট দানা। গন্ধটাও বেশ ঝাঁঝালো।
কোন এক সময় যখন অ্যালোপ্যাথি কিংবা হোমিওপ্যাথি ওষুধে কোন ধারনাই ছিল না, তখন বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে মোকাবিলা করবার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হতো চেনাজানা লতাপাতা, গাছগাছড়া, কাঁচা ফলমূল বা মসলাপাতির উপরে। এগুলি বিশেষ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে অসুখ বিসুখের মোক্ষম দাওয়াই, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন। আজ বলবো ‘রাঁধুনি’র নানান উপকারিতা।
মূলত পাঁচফোড়নের অংশ এই মশলা। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটির ব্যবহার করা হয় আলাদাভাবে।
বাঙালি হেঁসেলের অন্যতম অঙ্গ এই রাঁধুনি ফোড়নের হিন্দি নাম অজমোদ, উর্দু ভাষাতে আজমোদ, সংস্কৃত ভাষাতে আজমোদা বা আজমোদিকা (अजमोद বা अजमोदिका), বর্মী ভাষাতে “কান্ত-বালু” এবং থাই ভাষাতে “ফাক চি লোম” নামে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে এটি প্রচুর চাষ করা হয়।
অন্যান্য ভারতীয় মশলার মতো রাঁধুনিরও গুণ প্রচুর। এতে রয়েছে প্রোটিন ফ্যাট কার্বোহাইড্রেট ক্যালসিয়াম ফসফরাস ভিটামিন ও খনিজ বিভিন্ন পদার্থ। এছাড়া এটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় নানা প্রকার রোগ নিরাময় কার্যকর। এতে একপ্রকার উদ্বায়ী তেল আছে, যার সঙ্গে মিশে থাকে থাইমল।
হজম বা পরিপাক ক্রিয়া রাঁধুনি ফোড়ন খুবই উপকারী। বদহজম, গ্যাস, অম্বল, পেটের মাংসপেশির ক্র্যাম্প দূর করে এই মশলা। আয়ুর্বেদ মতে শরীর থেকে কফের প্রভাব দূর করে রাঁধুনি। শ্বাস-কাশি-হুপিং কাশি শ্বাসযন্ত্রের নানান সমস্যা দূর করে এই মশলা। ফুসফুসের কার্যকারিতা বজায় রাখে এই মশলা। এটি কফনাশক।
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজের মতো উপাদান থাকায় রাঁধুনি হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে দেয় না। হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস। এটি বেদনানাশক।
অ্যান্টিভাইরাল উপাদান থাকায় শরীরে ইনফ্লেম্যাশন রোধ করে রাঁধুনি মশলা। আর্থারাইটিস, আলসার-সহ অন্যান্য সমস্যায় উপশমকারী এই ফোড়ন।
শরীরে আয়রন গুরুত্বপূর্ণ। রাঁধুনি মশলা নিয়মিত ডায়েটে থাকলে আয়রনের যোগান বজায় থাকে। রক্তাল্পতায় ভুগলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাঁধুনি ফোড়ন খান।
উচ্চরক্তচাপ বা হাইপার টেনশন নিয়ন্ত্রণ করে রাঁধুনি। পেশির সুস্থতা বজায় রাখে বলে গাঁটের যন্ত্রণা কমাতেও এই মশলা কার্যকরী।
রাঁধুনি পাতা বা আজমোদা পাট্টা এপিয়াসি পরিবারের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই মশলার গাছের পাতা পরিচিত সেলেরি হিসেবে। রাঁধুনি পাতা কমবেশি সারা বছরই পাওয়া যায়। এই পাতা অনেকটা ধনে পাতার মতো দেখতে হয়। রাঁধুনি পাতা থেকে বেশি এর শুকানো সুগন্ধী দানা বা বীজ বাঙালি খাবারে বেশি ব্যবহার করা হয়, যা এই উপমহাদেশের বাকী অংশের ব্যবহার বিরল। স্যালাডে এই পাতার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।
রাঁধুনি পাতা একটি পুষ্টিকর এবং ঔষধি উদ্ভিদ। এর পাতায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। রাঁধুনি গাছের টাটকা পাতা থাইল্যান্ডে ভেষজ হিসেবে এবং মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাতে ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রাঁধুনি পাতা বিভিন্নভাবে খাওয়া যেতে পারে। যেমন রাঁধুনি পাতা তরকারি, ডাল, মাছ, ইত্যাদি বিভিন্ন রান্নায় অতিরিক্ত স্বাদ এর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাঙালি খাবারে এক বিশেষ স্বাদ ও গন্ধের বৈশিষ্ট এনে দেয়।
রাঁধুনির শুকানো বীজ-এর মতোই রাঁধুনি পাতাও আপনি ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। শুকানো পাতাগুলি একটি এয়ারটাইট কন্টেইনারে সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। খেয়াল রাখুন রাঁধুনি পাতা ছায়াযুক্ত জায়গায় শুকানো হলেই ভালো। রাঁধুনি পাতা সংগ্রহ করার সময়, খেয়াল রাখবেন যে পাতাগুলি যেন ভালোভাবে পরিপক্ব এবং তাজা হয়। পাতাগুলি যেন কোনো দাগ বা ক্ষত না থাকে। আশা করি এই তথ্যগুলি রাঁধুনি পাতা সংগ্রহে আপনার কাজে লাগবে।
রাধুনীর কিছু ঘরোয়া প্রয়োগ বলি —
পেটফাঁপা, অরুচি, বদহজম, বমি বমি ভাব, হিক্কা, পেট ব্যথা আমাশয় প্রদাহ (গ্যাসট্রাইটিস) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক চা চামচ রাঁধুনি রাত্রে এক গ্লাস গরম জলে ভিজিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখুন। পরের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই জলটিকে তিন চার বারে কিছু খাওয়ার পর খান, দেখবেন ঘরোয়া টোটকাটি আপনার বেশ কাজে লেগেছে।
অনুষ্ঠান বাড়িতে বেশি খেয়ে শরীর হাঁসফাঁস করছে, দু-তিন গ্রাম রাঁধুনি ও এক চিমটি নুন হাতে ডলে চিবিয়ে নিন। তারপর সামান্য হালকা গরম জল খান, দেখবেন বেশ আরাম পাচ্ছেন।
গাঁটের ব্যথায়, বাতের ব্যথায় দু-তিন গ্রাম রাঁধুনি চূর্ণ দিনে দুবার কিছু খাওয়ার পর হালকা গরম জল দিয়ে খান। তারপর রাঁধুনি বেটে হালকা গরম করে দিনের বেলায় আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিন। সন্ধ্যার সময় এটিই ফেলে দেবেন। এভাবে তিন চার দিন করলে উপকার পাবেন।
মহিলাদের বিশেষ সমস্যার ক্ষেত্রে রাধুনী পাঁচ গ্রাম দু-কাপ জলে সেদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে রাত্রে ঢাকা দিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে ছেঁকে ওই জলটি সকালে ও সন্ধ্যায় কিছু খাওয়ার পর খেতে হবে। মাস দুই খেলে উপকারটা বুঝতে পারবেন। এর সঙ্গে জিরে ও মেথি দু-গ্রাম করে চার গ্রাম মিশিয়ে নিলে আরো ভালো কাজ করবে।
কেবলমাত্র স্বাস্থ্যগত দিক থেকেই নয়, রাঁধুনি চাষে লাভ দেখেছেন চাষীরা। অনেক ক্ষেত্রেই চাষের মাঠে পড়শি রাজ্যগুলিকে পথ দেখিয়েছে এই বাংলা। কিন্তু এক্ষেত্রে চিত্রটা কার্যত বিপরীত। রাঁধুনি চাষে পার্শ্ববতী উড়িষ্যা বাংলার কৃষকদের পথ দেখিয়েছে বলা যায়। কারণ ওড়িশা রাজ্য থেকে চাষ শিখে এসে বাংলায় রাঁধুনি ফলিয়ে লাভের মুখ দেখেছেন ওড়িশা ঘেঁষা দাঁতন এলাকার চাষীরা। স্থানীয়রা জানছেন গত দু-বছর দু-একজন চাষী চাষ করেছিলেন। ফলন মেলার পর ওই দুই চাষির লাভের অংক দেখে এই চাষে মন দিয়েছেন স্থানীয় বহু কৃষকই। এবছর সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে।
ভাদ্র মাসে চাষ শুরু হয়, প্রায় ছয় মাস লাগে চাষে। বৈশাখে ফলন তোলা হয়। এই সময় ধান চাষ করতে পারেন না চাষিরা। তবে ধান চাষের থেকে অনেক বেশি লাভজনক চন্দনীর চাষ। ফলন বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এক বিঘা জমিতে ফলন পাওয়া যায় এক থেকে দেড় কুইন্টাল। চাষীরা লাভ পান প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। চাষীদের বক্তব্য, এলাকায় ধীরে ধীরে এই চাষ আরো বাড়বে।
ওড়িশা থেকে রাঁধুনি চাষের শিক্ষা শিখে লাভবান হচ্ছেন জেলার চাষিরা। স্বাদে গন্ধে স্বাস্থ্যে ভরপুর এই রাঁধুনি। বাঙালিয়ানা খাবার কে সমৃদ্ধ করুন রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে। ভালো খান সুস্থ থাকুন।….
Disclaimer : এই প্রতিবেদনটি কেবলমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য, তাই বিস্তারিত জানতে হলে সর্বদা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। ঘরোয়া টোটকা/ উপায় সন্ধান দিয়েছেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডক্টর সুবল কুমার মাইতি।