“প্রতীচীর তীর্থ হতে প্রাণরসধারা
হে বন্ধু এনেছ তুমি, করি নমস্কার।”
ইতিহাসের ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন যাদের প্রভাব সীমানা ছাড়িয়ে জাতির গতিপথকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে। এমনই একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ, যার ন্যায় বিচারের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি, জীবনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, স্বাধীনতাকামী ও দারিদ্র্যলাঞ্ছিত মানুষের প্রতি দরদ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথ চিরতরে বদলে দেয়। স্বার্থসম্পর্কহীন তাঁর নির্ভীক মহত্ত্ব জ্যোতির্ময় হয়ে ধরা দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। আবেগপ্রবণ এই বিদেশি বন্ধুকে রবীন্দ্রনাথ কখনওই ভুলে যাননি। কারণ এন্ড্রুজ সাহেবই ছিলেন গুরুদেবের পরম সখা, বন্ধু!
শৈশবে বাবার কাছে ভারতের গল্প শুনে বড় হয়ে সেই দেশে যাবার সম্ভাবনা দেখেন এন্ড্রুজ।
একদিন মাকে গিয়ে বালক এন্ড্রুজ বলেন, ‘মা এখন থেকে তুমি আমাকে রোজ কিছু ভাত খেতে দেবে। বাবা বলেছিলেন ভারতবর্ষের লোকেরা ভাত খায়। বড় হয়ে আমিও ভারতবর্ষে যাব তো তাই আমাকে ভাত খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে’। মা তো তখন ছেলের কথা শুনে হেসেই অস্থির। পরবর্তী কালে তাই বাস্তবায়িত হলো।
চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ C.F.A অর্থাৎ Christ’s Faithful Apaste (খ্রীষ্টের বিশ্বাসী প্রেরিত পুরুষ) কথাটি তার জীবনচর্চায় সার্থক হয়ে উঠেছিল। জন্ম ১৮৭১ এর ১২ই ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল অন টাইনে। তার পিতা ছিলেন বার্মিংহামের ক্যাথলিক অ্যাপোস্টোলিক চার্চের “এঞ্জেল” (বিশপ)। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেমব্রোক কলেজে পড়ার সময় ‘মূলধন ও শ্রম’ — এই দুয়ের সংঘাতের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের সম্বন্ধ” বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার “বানি” লাভ করেন এন্ড্রুজ। এন্ড্রুজের জীবনে ধার্মিক পিতামাতার প্রভাব ছিল প্রবল। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে পেমব্রোক কলেজ মিশনে যাজক হন ও পরে কেমব্রিজের তাত্বিক কলেজ ওয়েস্টকট হাউসের যাজক ও সহ অধ্যক্ষ হন। সাথে সাথে তিনি বিশপ ওয়েস্টকট পরিচালিত ক্রিশ্চান সোস্যাল ইউনিয়নে যোগ দেন।
১৯০৪ সালের ২০শে মার্চ বোম্বে বন্দর জাহাজ থেকে নামলে এন্ড্রুজ। তিনি বললেন, ‘ভারতে এসে আমার দ্বিতীয় জন্ম হলো’।ভারতে এসে দিল্লির সেন্ট স্টিভেনসন কলেজে দীর্ঘ সময় দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপনার সাথে ধর্মীয় সুসমাচার প্রচারে লিপ্ত থাকেন। এখানে এসে তিনি প্রত্যক্ষ করেন ইংরেজের অত্যাচার। তিনি বুঝতে পারেন ভারত হয়ে ইংরেজরা যে পথে চলছেন সে পথ খ্রিস্টদের প্রদর্শিত পথ নয়। সেই সময় থেকেই মানবপ্রেমী অ্যান্ড্রুজ ভারতের মানুষের উন্নতি স্বার্থে অগ্রসর হতে থাকেন।
১৯১২ সালে চার্লসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল এক সন্ধ্যায় লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড হীথে বিখ্যাত চিত্রকর উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের বাড়িতে।সেদিন সাহিত্যের আসরে রবীন্দ্রনাথ সহ ইয়েটস, মে সিনক্লেয়ার, এজরা পাউন্ডের মত ইংরেজ সাহিত্যিকদের ছিল নিমন্ত্রণ। কবি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ থেকে কয়েকটি কবিতা তাদের আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন। শ্রোতাদের মধ্যে এককোণে ছিলেন এন্ড্রুজ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসুধার মাধুর্য এন্ড্রুজকে আবেগী করে তোলে।জোৎস্না প্লাবিত সেই রাত্রে গুরুদেব যখন ফিরে আসছিলেন তার ঘরে, এন্ড্রুজ তাঁর সঙ্গ নিলেন। নিস্তব্ধ রাতে তার মন পূর্ণ ছিল গীতাঞ্জলির ভাবে। ভারতের অস্তাচলের রবির ছোঁয়া লেগেছে তখন লন্ডনের আকাশে।ঈশ্বর প্রেমের পথে তার মন এগিয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের দিকে। অনেকটা যেন ‘দেবতাকে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা’র মত।
এন্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎকারটি বর্ণিত হয়েছে ‘অ্যান ইভিনিং উইথ রবীন্দ্র’ নিবন্ধে, যার লেখক স্বয়ং এন্ড্রুজ।এর আগে ইউরোপের কোন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোন লেখা প্রকাশিত হয়নি। এটি ছিল প্রথম রচনা যেখানে রবীন্দ্রনাথের কথা বলা হয়েছিল। সেই অর্থে নিবন্ধটি ঐতিহাসিকও বটে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রচনা, দর্শন, ব্যক্তিত্বে এন্ড্রুজ এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথ উঠলেন এন্ড্রুজের গুরুদেব। কবির আমন্ত্রণে এন্ড্রুজ ১৯১৩ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতনে এলেন। সাহেবী পোশাক ছেড়ে পড়লেন খদ্দরে ধুতি পাঞ্জাবি ও চাদর। এখানে এসে তিনি ইংরেজি পড়াতেন আর বাংলা শিখতেন। অধিকাংশ সময়ে আশ্রমের পথে প্রান্তরে হেঁটে বেড়াতেন খালি পায়ে।
কবিগুরুর শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল তাঁর শান্তির বাসভূমি, তাঁর প্রেমের মৃত্তিকা, আত্মার আত্মীয়, হৃদয়ের আশ্রয়স্থল। মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের পাশে থেকে, আর্ত-আতুর মানুষের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের দীনশরণময় এক মহৎপ্রাণ- অসহায়ের, দীনের বন্ধু — “দীনবন্ধু”।
রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা আত্মভোলা বৃদ্ধ দার্শনিক প্রবর দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে এন্ড্রুজের গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্যতা,কারো কারো মতে ‘আত্মার যোগ’। প্রতিদিন কোন না কোন সময় দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে কিছু সময় তাঁরা ‘নিচু বাংলা’য় কাটিয়ে আসতেন। প্রিয় সাহেবের সঙ্গে খোশগল্পে বৃদ্ধের অট্টহাসিতে ‘নিচু বাংলা’ মুখরিত হয়ে উঠতো।
বাইরে ঘোরাঘুরির জন্য দ্বিজেন্দ্রনাথের একটি রিক্সা গাড়ি ছিল। মাঝে মাঝে দেখা যেত সাহেব রিক্স টানছেন আর তাতে সওয়ার হয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ আপন মনে গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। তবে দ্বিজেন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুডে থাকতেন। একবার কোন কারনে ইংরেজ শাসকদের আচরণে তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। নিজের দর্শনচর্চার দূরহ জগতে একাকী আত্মমগ্ন মানুষটি স্বাভাবিক ছন্দে নেই। এন্ড্রুজ নিচু বাংলায় গিয়ে দেখেন গোমরা মুখে বসে আছে দ্বিজেন্দ্রনাথ। পায়ের ধুলো নিয়ে সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন,’ কি বড়, সব খবর ভালো তো?’
দ্বিজেন্দ্রনাথ কৃত্রিম রেগে বললেন, ‘এই সাদা চামড়ার মানুষগুলি সব এদেশে ছেড়ে না গেলে আর ভালো থাকার উপায় আছে?’ সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এন্ড্রুজ দিনেন্দ্রনাথকে আস্তে আস্তে বললেন, ‘I say Dinoo, your grand father is terrible.’
গান্ধীজীর সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথের মধুর সম্পর্ক ছিল।
চমৎকার বোঝাপড়া, দেখা হলে দীর্ঘ আলাপচারিতা। মহাত্মা উচ্চকণ্ঠে তাকে ডাকতেন বড়দাদা বলে। এন্ড্রুজ গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। সমবয়সী ছিলেন ‘মোহন’ বলে ডাকতেন আবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করতেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর চিন্তাভাবনার মধ্যে বিস্তার পার্থক্য ছিল। অনেক সময় দেখা গেছে দ্বিজেন্দ্রনাথ তার প্রিয় গান্ধীর পক্ষ নিয়ে ছোট ভাই রবির সঙ্গে তর্কযুদ্ধে বসতেন বিশেষত ‘চরকা’র কার্যকরিতা নিয়ে। উদাস, আত্মভোলা দার্শনিক হলেও তিনি ঠিক জানতেন, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী যোগাযোগ রক্ষা সেতুবন্ধক ছিলেন এন্ড্রুজ। সেজন্য দ্বিজেন্দ্রনাথ খুশি হয়ে এন্ড্রুজকে নাম দিয়েছিলেন ‘হাইফেন’।
১৯১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গান্ধীজি শুরু করেন সত্যাগ্রহ আন্দোলন।এর স্বপক্ষে এন্ড্রুজ ভারত থেকে গিয়ে গান্ধীজীর আন্দোলনে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার সঙ্গী হলেন আরো এক বিখ্যাত রবীন্দ্র অনুরাগী পিয়ার্সন।
১৯১৩-এর ৩০শে নভেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে কবিকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন এন্ড্রুজ। ৫ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব ভোরে উপস্থিত হলেন খিদিরপুর বন্দরে এন্ড্রুজকে জাহাজে তুলে দিতে। সঙ্গে ছিলেন পিয়ার্সন। এর আগে কোন সতীর্থকে এইভাবে বিদায় জানাননি কবি।
শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় নেওয়ার আগে প্রয়াত মহর্ষির শূন্য কক্ষে নিয়ে গিয়ে উপনিষদের দুটি মন্ত্র লিখে তাদের মর্মার্থ বুঝিয়ে দেন। এই মন্ত্র দুটি এন্ড্রুজের মনে এত গভীর রেখা পাঠ করে যে জাহাজ ছাড়ার পড়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখেন,… And then you give me on that last evening (when you wear very tired and I hardly like to trouble you) the very message which I needed to much.’
দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে এন্ডুজ লক্ষ্য করেন সেখানকার ভারতীয়রা বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েও তাদের মধ্যেও রয়েছে তীব্র বর্ণবিদ্বেষ। ইংরেজি শাসক গোষ্ঠী যেমন আফ্রিকাবাসি ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখে, ভারতীয়রাও তার চেয়ে বেশি অবজ্ঞা করে স্থানীয় কাফ্রি, জুলু প্রভৃতি স্থানীয় কৃষ্ণবর্ণ আদিবাসীদের।
একদিন বক্তৃতা দিয়ে এন্ডুজ যখন বাড়িতে ফিরছিলেন, তখন একদল জুলু তাকে অনুসরণ করে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা জানি আপনি ভারতীয়দের জন্য প্রাণদিতে প্রস্তুত। কিন্তু আপনি কি আমাদের জন্য প্রাণ দিতে পারেন?’
শুরু করলেন আরও কঠিন সাধনা — ভারতীয়দের মন থেকেও বর্ণবিদ্বেষ দূর করতে। তিনি ভাবলেন ধর্মীয় প্রেরণায় ও প্রভাবে হয়তো মানুষের মনের বিদ্বেষ বিষ নিরাময় হতে পারে তাই বিভিন্ন গীর্জায় গিয়ে বক্তৃতা দিতে লাগলেন।
এন্ডুজের বক্তৃতা শুনতে পিয়ারসনকে নিয়ে গান্ধীজী একদিন গির্জায় গেলেন। কিন্তু গির্জায় তাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না কারণ মাহাত্মা কৃষ্ণকায় ভারতীয়। তাকে বাইরে থেকে ফিরিয়ে দেয়া হলো এই ঘটনায় এন্ডুজ বড় আঘাত পেলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় এন্ডুজ তাঁর মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেলেন। ডারবান থেকে রবীন্দ্রনাথকে কেবলগ্রামে মায়ের মৃত্যু খবর জানানোর পর লিখলেন এক দীর্ঘ চিঠি।
এন্ডুজ দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতন ত্যাগের আগের দিন রাত্রে কবি সেই সময়ের আবহে তাৎপর্যপূর্ণ একটি গান লিখেছিলেন।
‘লুকিয়ে আস আঁধার রাতে তুমি আমার বন্ধু,
লও যে টেনে কঠিন হাতে তুমি আমার আনন্দ।
দুঃখরথের তুমিই রথী তুমিই আমার বন্ধু,’
তার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ যে চিঠি লেখেন, সঙ্গে পাঠান সেই গানের ইংরেজি অনুবাদও, সান্ত্বনা জানিয়ে।
‘You have come to me hidden in the darkness of night my friend’
(চলবে)