ঝোপ জঙ্গল আছে। সন্ধ্যা হলেই শেয়ালের হাঁকডাক আছে। এরই মাঝে দুটি পুকুর আছে, তবে আগের মতো নেই। এই পরিবেশেই যুগপুরুধের স্মৃতি-বিজড়িত বসত বাড়িটি ভাঙাচোরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। গা থেকে লতাপাতা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষটুকু টিকিয়ে রাখতে টনক নড়েনি প্রশাসনের। জায়গাটিকে কেন্দ্রীয় পর্যটনের মানচিত্রে যাতে তুলে ধরা যায় তার জন্য এখনও কাজ শুরু হয়নি। ক্ষোভ স্থানীয় মানুষের।
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যে গত দু বছরে খরচ করা হয়েছে প্রায় ২৩ লক্ষ টাকা। সেই টাকা জলে গিয়েছে বলে অভিযোগ। এখানেই শেষ নয়, এর রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন এবং সংস্কারের কাজ সেই তিমিরেই। পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। বলা হয়েছিল ধাপে ধাপে গড়ে উঠবে অনেক কিছুই। যাতে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায় এই স্থানটিকে। জন্মের আড়াইশো বছর পার হয়ে গেলেও প্রথম আধুনিক ভারতীয় মানুষ রাজা রামমোহন রায়ের জন্মভিটা ও স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি টিকিয়ে রাখার জন্য কোনও বড়ো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, ভ্রমণ-পিপাসুরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন এখানে। হতাশ হয়েছেন। যাঁর হাত ধরে ধর্মসংস্কার, সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, বাংলা ভাষার উন্নয়ন-তিনিই আজ অবহেলিত। তাঁর কর্মাদর্শকে টিকিয়ে রাখতে এখানে কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। কেবল আমোদপিপাসুরা এখানে এসেছেন। আমবাগানে চড়ুইভাতি সেরেছেন। বাড়ি ফিরেছেন। এর বেশি কিছুই পাননি তাঁরা। ভ্রমণপিপাসুরা বঞ্চিত হয়েছেন সব কিছু থেকে। কেবল দেখেছেন লতাপাতা জড়ানো শেষ ধ্বংসাবশেষটুকু। তাও খসে খসে পড়ছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় বুঝি কারও নেই। অনেকদিন ধরেই আশাপূরণের চেষ্টা চলছে। জেলা পরিষদ উদ্যোগও নিয়েছে। রামমোহনকে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তাও আজ বিশবাঁও জলে।
প্রসঙ্গত, এটা দেখভাল করছে রামমোহন স্মৃতিস্বত্ব সংরক্ষণ সমিতি। সমিতি বিভিন্ন ধাপে ধাপে জায়গাটিকে মনোরম ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলবে, এটাই বৈঠকে স্থির হয়েছিল। এর কাজও শুরু হয়েছিল।ওই পর্যন্তই। আঞ্চলিক রামমোহন গবেষক দেবাশিস শেঠ জানান, রাধানগরে জন্মভিটার স্মৃতি সৌধ ও রঘুনাথপুরে তাঁর বসতবাড়ি আজও অবহেলিত। তাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ কারও নেই। এটা বড়ই দুঃখের। খানাকুলে ফি-বছর বন্যায় ক্ষতিগ্ৰস্ত এই জায়গাটি। পর্যটন মানচিত্রে মুখ ফেরাচ্ছে পর্যটকরা। রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে, কিন্তু সেভাবে উন্নয়ন হয়নি। রামমোহন-এর স্মৃতি বিজড়িত বাসভবনের শেষ অংশটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য অভিজ্ঞ লোকদ্বারা তা মেরামতি করা প্রয়োজন। প্রায় ৪০ বিঘা এলাকাকে চিহ্নিত করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া দরকার। ঝোপজঙ্গল কেটে আর বাঁকুড়ার লাল রাঙামাটি দিয়ে পথ তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে পুকুর দুটোকে সংস্কার করে খাল কাটার কাজ করতে হবে। তাতে শিশুদের জন্য বোটিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেবল তাই নয়, সতীদাহ শ্মশানে এক মনোরম উদ্যান তৈরি করে পর্যটকদের কাছে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। সেখানে শিশুরা খেলতে পারবে, খেলার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জামও রাখতে হবে।আর পুরো এলাকাটিকে সৌন্দর্যায়ন করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন রকমারি ফুল, বাহারি গাছ লাগানো দরকার।
তার মধ্য দিয়েই চলে যাবে লাল মোরামের রাস্তা। আর একদিকে আমবাগান।
এদিকে বহু বছরের পুরানো আমগাছগুলো বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। সারি সারি গাছের ফাঁকে নতুন আমের চারাগাছ লাগানো জরুরি। নির্দিষ্ট করে সেখানে পর্যটকদের জন্য পিকনিকের ব্যবস্থা করা দরকার। সেই সঙ্গে বাগান থেকে -আয়ের পুরোটাই এখানকার উন্নয়নের কাজে লাগানো।
উল্লেখ্য, এই বাগানটিই চড়ুইভাতির জন্য নির্দিষ্ট করে এখানে প্রবেশমূল্য করতে হবে প্রতি জন ৫০ টাকা। দেবাশিসবাবু আরও বলেন, পুরো এলাকাটি দেখভালের জন্য ক্যাজুয়াল কর্মীও নিয়োগ করা হয়েছে। সতীদাহ শ্মশানে প্রবেশ করতে গেলে ন্যূনতম পয়সার টিকিট চালু করা হবে বলে জানিয়েছে সমিতি। এখানে পর্যটকরা এলে সুষ্ঠুভাবে দেখতে পারেন ও ঘোরাঘুরি করতে পারেন এর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাও থাকছে। পর্যটকরা যেমন এখানে রামমোহনের বসবাসকারী বাড়িটি দেখতে পাবেন, তেমনি দেখতে পাবেন বৌদির সতী বেদীটিও। সাজানো ফুলের বাগান, গাছপালা ও পাখিদের কলকাকলি সবই থাকবে। এটা প্রশাসনের ভাবতে হবে। রামমোহনের স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিতে কিছু তথ্যমূলক বইও লাইব্রেরিতে রেখে দিতে হবে। এর কিছু অদূরেই রাধানগরে রামমোহনের জন্মভিটার দেখা মিলবে। এখনও বিশেষ নজর পড়েনি সরকারের। এখানে একটি রামমোহন মেমোরিয়াল হল নির্মিত হয়েছে। পর্যটকরা রামমোহনের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বই পড়তে পারবেন। তা ছাড়া পাশেই রামমোহনের স্মৃতি গ্রামীণ গ্রন্থাগার তৈরি হয়েছে। রামমোহনের ওপর গবেষণার জন্য’ বিভিন্ন বই ও তথ্য রাখা আছে। কর্মীর অভাবে তা ধুঁকছে। ইতোমধ্যে দেড়লক্ষ টাকার বই কেনা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। যা ভ্রমণ পিপাসুদের অনেকটাই খিদে মেটাতে পারত। বিভিন্ন গাছ গাছালির মাঝে গড়ে উঠেছে রামমোহন নামাঙ্কিত মহাবিদ্যালয়। গ্রাম্য সরল পরিবেশে পড়াশোনা করতে দূর দূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এখানে ছুটে আসে। যোগাযোগের ব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে গবেষক বলেন, অসুবিধের অনেকটাই তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। রামমোহনের গ্রামে আসতে গেলে আগে বাস ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। এখন অনেক রুট ও ট্রেকার চালু হয়েছে। যা রাধানগরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে যাতে দূরপাল্লার বাস চালানো যায় তার চেষ্টাও চলছে। এজন্য রামমোহন কলেজ লাগোয়া ২ বিঘা খাসজমি আছে। এখানে যাতে সি এস টি সি-র বাস টামিনাস গড়ে তোলা যায় তার আলোচনা চলছে। এটা হলে কলকাতা থেকে সরাসরি পর্যটকরা এখানে আসতে পারবেন। এছাড়া অন্যান্য জায়গায় দূরপাল্লার বাস যাতে চলাচল করতে পারে তারও চেষ্টা করা হচ্ছে।এর সঙ্গে রেল সংযোগের দাবিতে সরব এখানকার মানুষ। রামমোহনের জন্মস্থানে দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা যাতে থাকতে পারেন তার জন্য অতিথিশালা তৈরির দাবি যেমন সরকারের কাছে রাখা হয়েছে, তেমনি টেকনিক্যাল স্কুল, কলেজ যা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে তোলার ব্যাপারেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। একটাই উদ্দেশ্য। রামমোহনের কর্মাদর্শ ও চিন্তাভাবনাকে চিরজাগরুক রাখা। এ জন্য প্রতি বছর কলেজ মাঠে ‘রামমোহন মেলা’ করে থাকেন। তবে এও বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকার মানুষের কাছে এই মেলা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়া চরম ক্ষোভ জনমানসে।
এদিকে এলাকার মানুষের অভিযোগ, প্রতি বছর রামমোহনের আমবাগানে চড়ুইভাতি করতে এসে মদ খেয়ে মাতলামি, জোরে মাইক চালানো এবং অশালীন আচরণ এখানকার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে। পরম পরিতাপের বিষয়, এজন্য প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয় না। বিশেষ করে ২৫ ডিসেম্বর, ১ জানুয়ারি ও ২৬ জানুয়ারি। ওই কটা দিন পরিবেশ রীতিমতো বিষিয়ে যায়। এটা প্রশাসনের দেখা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেন, ভারত পথিক রামমোহনের জায়গায় যেটা আগে হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না। প্রয়াত শান্তিমোহন রায়ের চেষ্টায় এখানে রাজা রামমোহন রায় মহাবিদ্যালয়, রামমোহন বালিকা বিদ্যালয়, রামমোহন রায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। তারপর থেকে আর কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। তাই এখানে আমোদ-প্রমোদের জায়গা টেকনিক্যাল কলেজ বা স্কুল, কিংবা কৃষি বিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। যেটা অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীই চেয়েছিলেন। এখানে জায়গারও অভাব নেই। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শিশুদের উদ্যান, খাল কেটে প্যাডেল বোটিংয়ের ব্যবস্থা না করে যুব সম্প্রদায়কে আগামী দিনের আলোর পথ দেখানো উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। তা ছাড়া এটা বন্যাকবলিত এলাকা। সাঁইমানা থেকে বন্যার জল এসে খালের বাঁধে ধাক্কা মারলে সমস্তই ডুবে যাবে। সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। লক্ষ লক্ষ টাকা জলে যাবে। তাই নব জাগরণের স্রষ্টার জন্মভিটায় তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে গেলে একে আমোদ প্রমোদের জায়গা হিসেবে না গড়ে শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের পীঠস্থান রূপেই গড়ে তোলা উচিত।