“যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে, / জড় করে আনি সব—থাক সেই আশাতে”…সুকুমার রায়।
বাসনার সেরা বাসা যে রসনায় সে কথা মর্মে গাঁথা আছে বাঙালির। সেই রসনাকে রসে-বসে রাখতে বাঙালির অন্তহীন আগ্রহও সর্বজনবিদিত। যদিও গ্রীষ্মের ‘তাপস নিঃশ্বাস’-এ শরীর অস্থির প্রায় কিন্তু শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন সঠিক খাদ্যাভ্যাস।
বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল ও প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হয় সুস্থ থাকার জন্য। আসুন আজ জেনে নিই প্রথমে গ্রীষ্মের সব্জীর কথা।
সজনে : আমাদের বাংলায় প্রতিটি বাজারেই নির্দিষ্ট সময়ে সজনে ফুল, পাতা, ডাঁটা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদ, অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ রসায়ন, সুশ্রুত সংহিতা প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থে এই ভেষজের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের আগমন হয়ে থাকে। এগুলির অব্যর্থ ওষুধ সজনে। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, কপার, বিটা ক্যারোটিন, ফলিক অ্যাসিড ও বিভিন্ন ভিটামিন থাকে সজনে তে।
ঢেঁড়শ : খেতে যেমন সুস্বাদু, রান্না করা যায় সহজে আর কম ক্যালোরি-বেশি ফাইবার যুক্ত ঢেঁড়শ হৃদরোগ, হাই ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এতে উপস্থিত ফলিক অ্যাসিড মহিলাদের গর্ভধারণে সাহায্য করে ও অকাল গর্ভপাত আটকায়। হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারট্রাইগ্লিসারিনের ক্ষেত্রে ডায়েটারী থেরাপির কাজ করে ঢেঁড়শ। তবে অতিরিক্ত ব্যবহার পেটের গন্ডগোল তৈরি করতে পারে। বাজার থেকে নিয়ে এনে নুন জলে ধুইয়ে সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ফ্রিজে হাল্কা সুতির কাপড় জড়িয়ে রেখে দিলে টাটকা থাকে ঢেঁড়শ।
পটল: গ্রীষ্মে শরীর ঠান্ডা রাখতে, দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াতে, রক্তে শর্করা-কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে পটল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আয়ুর্বেদে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতে পটল ব্যবহার করা হয়। গরমে শরীরে জলের ঘাটতি মেটায় পটল। কচি পটলের দানা কোষ্টকাঠিন্য সারায়। পটল ত্রিদোষ (বায়ু, পিত্ত, কফ) নাশ করে।
টমেটো : বাঙালির আমিষ বা নিরামিষ, তরকারি বা চাটনি, স্যালাড হোক বা স্যুপ সব রান্নাতেই এর উপস্থিতি কাম্য। কাঁচা টমেটোতে প্রায় ৯৪ শতাংশ জল থাকে। এতে উপস্থিত লাইকোপিন ও ভিটামিন সি ডিএনএ ড্যামেজ প্রতিরোধ করে। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে টম্যাটো খেতে বলা হয়। এছাড়া ডায়াবেটিস, অ্যানিমিয়া, হাই ব্লাড প্রেসার, স্কার্ভির সমস্যা কমাতে সাহায্য করে টমেটো। সান বার্ন রোধ করতে কাঁচা টমেটো ত্বকে লাগলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
লাউ : গরমে শরীরে জলের অভাব মেটাতে (প্রায় ৯৬ শতাংশ জল থাকে) ও উত্তাপ থেকে বাঁচাতে গরমের স্বাস্থ্যকর সব্জী লাউ। লাউয়ে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, ফোলেট, ভিটামিন, খনিজ ও পুষ্টিকর ফাইবার।
স্ট্রেসজনিত কারণে রাতে ভালো ঘুম না হলে নিয়মিত কিছুদিন রাতের খাবারে লাউয়ের ডাল, তরকারি বা অন্যকোন রেসিপি রাখলে উপকার পাবেন। এছাড়া কাঁচা আম, শসা, লাউ, ঝিঙে, কুমড়ো, উচ্ছে-করলা,বেগুন,কলমিশাক, পাটশাক খেতে পারেন এই গরমে সুস্থ থাকতে।
গ্রীষ্মকালে প্রকৃতি যেমন পৃথিবীর সমস্ত রস শুষে নেয় তেমনি বিভিন্ন ফলমূলের মাধ্যমে তা আমাদের ফিরিয়েও দেয়। এই সময় যে ফলগুলো পাওয়া যায় সেগুলো শরীরকে পুষ্টি ও বল প্রদান করে। সামগ্রিকভাবে শরীর ঠান্ডা রাখে।
আম : দেশের জাতীয় ফল ও স্বাস্থ্যকর হিসেবে আমের কদর রয়েছে। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় আম ফলের রাজা। এটি বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, মিনারেলস ও বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। আম গরমের তীব্র দাবদাহ থেকে রক্ষা করে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। কাঁচা আম ভিটামিন “সি” ও পাকা আম ভিটামিন “এ” সমৃদ্ধ। এতে উপস্থিত ম্যাঙ্গিফেরিন (পলিফেনল) বিভিন্ন ধরনের ক্রনিক রোগ যেমন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ ইত্যাদি প্রতিরোধে সক্ষম। তবে অতিরিক্ত পাকাআম খাওয়া ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ক্ষতিকর।
তরমুজ : তরমুজের অনেক গুন। আয়ুর্বেদে বলা হয় তরমুজ ক্ষুধাবর্ধক, তৃষ্ণা নিবারক, কামোদ্দীপক, রক্তবর্ধক। দেহের ওজন কমানো, হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে, দাঁত পরিস্কার রাখতে, স্ট্রোক প্রতিরোধে এর জুড়ি মেলা ভার। সমীক্ষায় দেখা গেছে, তরমুজে ক্যালোরি কম, ফ্যাট নামমাত্র, ৯২ শতাংশ জল, সুগার ৬ শতাংশ ,খনিজও অন্যান্য মিলিয়ে ২শতাংশ। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর তরমুজ খেলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়।
প্রায় একই গুণসম্পন্ন তরমুজের বীজ বাজারে চালমগজ দানা হিসেবে পাওয়া যায়। পোস্তর বদলে রান্নায় মগজদানা ব্যবহার করা হয়। খালিপেটে তরমুজ না খাওয়াই ভালো। হজমশক্তি কম থাকলে কম করে খেতে হবে।
লিচু : গরমের রসাল ফল। লিচু মিষ্টি স্বাদের বলবর্ধক, যকৃতের ক্রিয়াবর্ধক,ভুলে যাওয়ার রোগ প্রতিরোধে, অপুষ্টিতে, কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায়, শরীর তরতাজা রাখতে বাজারে যতদিন লিচু পাওয়া যাবে খেয়ে নেবেন। গাজরের থেকে বিটা ক্যারোটিন অনেক বেশি থাকায় রাতকানা রোগের হাত থেকে লিচু ঔষধের কাজ করে। চুল আর দাঁতের সৌন্দর্য বাড়াতে রোজ ৪-৫টি লিচু খেতে পারেন।
তবে লিচু পাকানো বা সংরক্ষনের জন্য নানান বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তাই খাবার আগে একঘন্টা জলে ডুবিয়ে রেখে ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া উচিত। পড়শি দেশ চীন থেকে এখন সারাবিশ্ব জুড়ে এর চাহিদা তুঙ্গে।
আনারস : “অরুচির রুচি হয় মুখে দিলে পর”, আনারসের অম্ল-মধুর রসে রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, কপার, আয়রন, প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার, ওমেগা ৩-৬ ফ্যাটি আসিড, ভিটামিন এ, বি, সি, ই, কে প্রভৃতি। আনারস হার্টের সুরক্ষায়, পেশি ও হাড়কে মজবুত করতে, কৃমি, বদহজম, হাঁপানি, কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে রসের অধিকমাত্রা জরায়ু সংকোচ করে। তাই গর্ভবতী মায়েদের আনারস না খাওয়াই ভালো।
পাকা আনারসের টুকরো নুন আর গোলমরিচ দিয়ে খেলে মহিলাদের মেন্সট্রুয়েসনের স্বল্পতায় কাজ দেয়।
গরমে রসাল ফল হিসেবে কাঁঠাল, জাম, বেল, সপেদা, জলভরা তালশাঁস, পেয়ারা, আঙুর খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া খাদ্য-পানীয় হিসাবে বাতাবিলেবু তো আছেই।
সারাবছর সকালের দিকে অনেকেই পাকা কলা দুধ দিয়ে মেখে খায়। বর্তমানে গবেষণা বলে, দুধ-কলা একসঙ্গে খাওয়া ঠিক নয়। কথায় বলে ‘দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষা”-র কথা। কিন্তু সাপ দুধ বা কলা কোনোটাই খায় না।
বাজারে খোলা অবস্থায় রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া কাটা ফল না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। গরমে বাড়িতেও দীর্ঘক্ষণ কাটা ফল ফেলে রাখা উচিত নয়। ডায়াবেটিস, রেনাল ফেলিওর বা অন্যান্য রোগের সমস্যা থাকলে বিশেজ্ঞের পরামর্শ মেনে সব্জী বা ফল নিজের খাদ্যতালিকায় রাখবেন।
হাঁসফাঁস গরমে রিচ খাবারগুলি বাদ রেখে প্লেন ভাত, টক ডাল, সব্জির তরকারি, দুধ, টকদই, লেবুর শরবত, ডাবের জল, গ্রীন টি খাওয়ার অভ্যাস করুন। অনেকেই গরমে পান্তাভাত খাওয়া পছন্দ করেন। এতে শরীর যেমন ঠান্ডা থাকে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ঘরে বিভিন্ন ফলের তৈরি ঠান্ডা স্মুদি খেতে পারেন। দিনে কমপক্ষে ১২ গ্লাস জল খাবেন।
পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে গেলে কঠোর পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে হয়। শ্রমজীবি মানুষদের কি গরম, কী ঠান্ডা… শ্রম করতেই হবে। শ্রম করতে গেলে শরীরকে সুস্থ রাখা দরকার। তার জন্য দরকার সুষম আহার। তৃপ্তির সঙ্গে সপরিবারে শান্তির বাতাবরণে যা কিছু গ্রহণ করবেন, তাতে ক্লান্তি, অবসাদ কোনো এক যাদুমন্ত্রে হারিয়ে যাবে। গরমের দিনগুলোয় সপরিবারে সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।।
Source : From various science journals and articles.
বাহ! সঠিক সময়ে খুব প্রয়োজনীয় কথা। ভালো লাগল।
খুব ভালো। খরচের দিকটা একটু থাকলে আরও ভালো লাগতো।
আজ বাজার থেকে ফল আর লাউ বাদ দিয়ে লাল কুমড়ো ও প্রচুর ঢ্যাড়স পটল ঝিঙে তরমুজ 🍉 ও সব সবজি কিনেছি,লেবু শুদ্ধ।
ঢেড়স কুমড়ো উচ্ছে। এগুলো র আরো উপকারিতা কোষ্ঠ সরল রাখে।
লাল কুমড়ো ও লাল শাক এন্টিওক্সিডেন্ট হিসেবে ও চোখ ভাল রাখে।
খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটি,তথ্য সন্নিবেশিত।